গল্পের ম্যাজিক:: যমের অরুচি - দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী


যমের অরুচি
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

যমরাজ সবে মাখন মাখিয়ে পাউরুটিটা মুখের সামনে ধরলেন, অমনি মস্ত এক চোঁয়া ঢেকুর উঠল পেটটা গুড়গুড় করে উঠল, বুকটা ধড়ফড় করে উঠল অম্বল-বদহজমের বালাই তার কোনওদিনই নেই কোর্মা, কোপ্তা, কালিয়া, এতদিন যা ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে খেয়েছেন নিয়মিত যোগা করেন তবে এমন বিপত্তি কেন? আমাজনের জঙ্গলের মতো জোড়া ভুরুদুটি কুঁচকে তিনি তক্ষুনি চিত্রগুপ্তকে তলব করলেন চিত্রগুপ্ত করজোড়ে গদগদ কন্ঠে বলল, “আদেশ করুন, প্রভু
“তোমার কাজে কোনও গোলমাল হয়নি তো?
“আদেশ করেন যাহা প্রভু যমরাজ, আমি প্রাণমন ঢেলে করি সেই কাজ
আহ্‌ কাব্যি থামাও! বলছি, আমার বদহজম তো আর এমনি এমনি হয় না নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু করেছ যে পাপের ভাগী আমাকে হতে হচ্ছে
চিত্রগুপ্ত মাথা চুলকে বলল, “ভ্রান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু, গণনায় যদি ভুল করি কভু
বেশ, খাতা ঘেঁটে দেখ কোথাও কিছু ভুল করেছ কি না আমি একবার গুরুদেবকে দূরদর্পণে জিজ্ঞেস করি
রিমোট টিপে যমরাজ দূরদর্পণটা খুললেন ত্রিকালজ্ঞ ব্রহ্মাকে স্মরণ করা মাত্রই তিনি এসে উপস্থিত দুধসাদা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু হাসলেনযমরাজ হাতজোড় করে বললেন, “প্রভু, আপনার কিছুই অজানা নয় আমি হপ্তাখানেক ভালো করে খাবার খেতে পারছি না জল খেলেও অম্বল হচ্ছেএসব রোগবালাই তো মর্ত্যের মানুষের বলুন দিকি আমার এসব হচ্ছে কেন?
ব্রহ্মা একবার চক্ষু মুদে ধ্যান করলেন তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুম বাতাসি গ্রামে দুর্ভিক্ষে কত শত মানুষ, গরু-ছাগলের প্রাণ গিয়েছে কেউ কেউ আবার কঙ্কালসার অবস্থায় পড়ে ছিল তাদেরকেও মৃত ভেবে এখানে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে এদের অনেক আয়ু বাকি ছিল আরও চল্লিশ বছর তো বটেই বাচ্চাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম সেই পাপের ভাগী হয়েছ তুমি তাই তোমার এইসব উপসর্গ দেখা দিয়েছে
যমরাজ আমতা আমতা করে বললেন, “প্রভু, ওরা তো না খেতে পেয়ে এমনিতেও বাঁচত না তা কয়েকদিন আগেই না হয় তুলে নিয়ে আসা হয়েছে আর তাছাড়া দুর্ভিক্ষ তো আমার কারণে হয়নি বরুণদেব যদি বৃষ্টি না দেন, মা লক্ষ্মী যদি ফসল না দেন, আমি কী করব?
ব্রহ্মা বললেন, “তাহলে ভোগ কর পাপের শাস্তি আমারও কিছু করার নেই, বাছা
যমরাজ খানিক ভেবে বলল, “প্রভু, আমি ভাবছিলাম, এদের পরের জন্মে ফাউ হিসেবে এই জন্মের বাড়তি আয়ু জুড়ে দিই কেমন হয় বলুন?
ব্রহ্মা রেগে উঠে বললেন, “ঠাট্টা হচ্ছে? এ কি এয়ারটেলের সম্পর্কতা নাকি? জন্মের বাড়তি আয়ু পরের জন্মে!
“তাহলে কী করা যায় প্রভু? আপনি আমাকে বাঁচান যমরাজের কাঁদো কাঁদো অবস্থা
ভেউ ভেউ কান্নার সঙ্গে হেউ হেউ ঢেঁকুরের মারাত্মক কম্বিনেশন শুনে ব্রহ্মা আর বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলেন না দাড়ি চুলকে খানিক ভেবে বললেন, “একটা মিটিং ডাকি অন্যসব দেবতাদের নিয়ে আজ দ্বিপ্রহরে তুমিও থেকো সেখানে তারপর দেখি এর সমাধান করতে পারি কি না
মিটিং শুরু হওয়ার দু’মিনিট ছত্রিশ সেকেন্ড কুড়ি মিলি সেকেন্ড আগে একজন অতি ক্ষীণ, দীর্ঘদেহী লোক এসে উপস্থিতব্রহ্মা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন আসুন, সময়বাবু আজকাল তো আপনার দেখাই পাওয়া যায় না
সময়বাবু ঘড়ি ঠিক করতে করতে বললেন, আমি ভীষণ ব্যস্ত একদম সময় নেই মিটিং শুরু করুন
এখনও তো সবাই আসেনি
সময়বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “এই অসময়ে আমাকে তলব করার মানে কী? দেবতাদের কারোরই সময়জ্ঞান নেইএইজন্যে, এইজন্যেই পৃথিবীতে এমন বিশৃঙ্খলা
ব্রহ্মা হাত তুলে বললেন, “আহা, চটছেন কেন বলুন দেখি? এক্ষুনি সবাই এসে পড়বে তা সময়বাবু, আজকাল কি খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন? বড্ড রোগা হয়ে গেছেন দেখছি
সময়বাবু আবার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে বলছি না মশাই, আমার একদম সময় নেই! সকালে খাই একফালি শসা আর দুটো চিনাবাদাম তাতেই পাঁচ সেকেন্ড সময় নষ্ট হয় আমার দুই সাগরেদ ঘন্টা আর মিনিট সবসময় সতর্ক করে দেয়, সারাদিনে কতগুলো কথা বলব, কতক্ষণ ভাবব, কতক্ষণ মেজাজ গরম করব, দাঁত কিড়মিড় করব, আক্ষেপ করব, সবকিছুএই দেখুন, কতগুলো বাড়তি কথা বলে ফেললাম বলে জিভ কাটলেন সময়বাবু
একে একে অন্য দেবতারা আসতে শুরু করলেন যথারীতি মিটিং শুরু হল
যমরাজ তার করুণ কাহিনি শোনাবার পর দেবতামহলে জোর কোলাহল শুরু হল সরস্বতী বীণায় ঝঙ্কার তুলে সভা শান্ত করলেন ব্রহ্মা বরুণদেবের উদ্দেশে বললেন, “এসব কী হচ্ছে বরুণ? আবহাওয়া দপ্তরে এত গোলমাল! কোথাও অতিবৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টি
বরুণ খানিক আমতা আমতা করে বললেন, “কী করব প্রভু, এসব হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলএইসব ওই মানুষগুলোর দোষেই তো হয়েছে আমাদের সবার একটা করে বাহন আর মানুষগুলোকে দেখুন, পরিবার পিছু তিনটে চারটে করে বাহন কালো ধোঁয়া আর হর্নের শব্দে প্রাণ নাজেহাল আর এই ব্যাটাচ্ছেলে মেঘেরা আজকাল আমার একটাও কথা শোনে না যে যার মতো চরে বেড়াচ্ছে
লক্ষ্মী সুর টেনে বললেন, “আজকাল এমন সব কীটনাশক আর রাসায়নিক সার দিচ্ছে যে অন্নের মধ্যে আর থাকতেই পারছি না
ব্রহ্মা দাড়ি চুলকে বললেন, “হুম, সমস্যা খুব গভীরে কিন্তু ওই হতদরিদ্র, বুভুক্ষু মানুষগুলোকে নিয়ে কী করা যায় বল তো দেখি
যমরাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আমার পেটে ওই বাতাসি গ্রামের বাতাস ঢুকে গিয়ে যে কী তোলপাড় করছে, কী বলব!
ব্রহ্মা এবারে পালনকর্তা বিষ্ণুর দিকে ফিরে বললেন, “আপনিই কিছু বুদ্ধি বের করুন আমি তো খুবই কনফিউসড
বিষ্ণু একটু ভেবে বললেন, “ওদের সবাইকে পৃথিবীতেই পাঠিয়ে দেওয়া হোক
যমরাজ তিড়িং করে সোজা হয়ে বসে বললেন, “তা হয় নাকি? এত্তগুলো লোক ওদের পারলৌকিক ক্রিয়া এতক্ষণে সম্পন্ন হয়ে গেছে
বিষ্ণু হেসে বললেন, “গ্রাম তো একদম ফাঁকা হয়ে গেছে পারলৌকিক ক্রিয়া করবে কে? আর তাছাড়া সময়বাবুর যদি কৃপা হয় তবে সময়কে একটু পিছিয়ে দেওয়া যায়
সময়বাবু এমন কথায় বিরক্ত হয়ে বললেন, “ইয়ার্কি হচ্ছে! সময় নিয়ে খেলা? ক্ষমা করবেন প্রভু, কিন্তু এই সময় এগোতে পিছোতে গিয়ে যদি কিছু গন্ডগোল হয় তবে তার জন্য আমি দায়ী নই
বিষ্ণু অভয় দিয়ে বললেন, “আহা, কয়েকদিন পিছিয়ে দিন এদের স্মৃতিও যাতে কিছুদিন পিছিয়ে যায় সেই ব্যবস্থা আমি করে দেবআর ওই ক্ষুধার্ত মানুষদের জন্য স্বর্গে মহাভোজের ব্যবস্থা হোক
ইন্দ্র এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিলেন মহাভোজের কথা শুনে তড়িঘড়ি উঠে বসে বললেন, উত্তম প্রস্তাব! আমি সমর্থন করছি
ব্রহ্মা বললেন, “তা এত আয়োজন করবে কে শুনি?
মহাদেব অভয় দিয়ে বললেন, “দেবী অন্নপূর্ণাই তো আছেন তিনি থাকতে ভাবনা কী?
সবাই ধন্য ধন্য করে সানন্দে বলে উঠল, “হোক, হোক
তারপর স্বর্গে এক বিশাল মহাভোজের আয়োজন হল দেবী অন্নপূর্ণা নিজের শরীর থেকে একশত রাঁধুনির সৃষ্টি করলেন তারা কেউ সবজি কাটল, কেউ মশলা বাটল, কেউ খুন্তি নাড়ল, কেউ পাত পাড়ল অপূর্ব  পোলাও, লুচি, পায়েসের গন্ধে তিনলোক মাত হয়ে গেল বাতাসি গ্রামের মানুষদের আর ফুর্তি ধরে না তারা আনন্দে কব্জি ডুবিয়ে চেটেপুটে খেতে শুরু করল
দেবদেবীরাও কেউ বাদ গেল না মেনকা রাবড়িতে জিলিপি ডুবিয়ে কুড়মুড় করে খাচ্ছিলেন সময়বাবুকে পাশ দিয়ে হন হন করে হেঁটে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “ও সময়বাবু, একটু জিলিপি খাবেন?
সময়বাবু তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি খাচ্ছেন, খান না আমার একদম সময় নেইযত্তসব
বাতাসি গ্রামের ঘরে ঘরে দেবী অন্নপূর্ণা একটি করে চালের ঘড়া রেখে এলেন যাতে তাদের অন্নাভাব না থাকে পরের বছর খুব ভালো ফসল হল গ্রামের লোকেরা আনন্দে খেয়ে-পরে দুধেভাতে থাকতে লাগল আর যমরাজের আগের মতোই খাওয়ার ইচ্ছে ফিরে এল তিনি সতর্ক দৃষ্টি রাখলেন যাতে আর অনাহারে লোক না মরে

পুনশ্চঃ এই গল্পটা যদি সত্যি হত, কত ভালো হত তাই না? কিন্তু পৃথিবীর খেয়াল যে সবথেকে আগে তোমাকেই রাখতে হবে ক্ষুধার্তের মুখে অন্ন তুলে দিতে হবেতোমার উৎসবের দিনে যেন কেউ অভুক্ত না থাকে সে দায়িত্ব তোমারই
_____
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়

19 comments:

  1. যেমন গল্প তেমনি অলঙ্করণ। আর শেষের বার্তাটিও খুব দামী। সচেতন হোক বর্তমান প্রজন্ম। সুস্থ থাকুক আগামী।

    ReplyDelete
    Replies
    1. anek dhanyobad..khub bhalo laaglo matamat peye :)

      Delete
  2. ভালো লাগল। মজার এবং বার্তাবহ।

    ReplyDelete
  3. মনে হল যেন পাঁচালি পড়ছি, আর অসাধারণ আঁকা

    ReplyDelete
  4. আহা! এমন গল্প কেন সত্যি হয় না?
    দারুণ লাগল। সত্যি!

    ReplyDelete
  5. Bhari sundor Dwaita. Tomaar kolpona aar bhasha... Dui i asadharoN. OlonkoroNer magic tomar srishTi ke onyo matra diyechhe. Aaro anek anek lekho bon.

    ReplyDelete
    Replies
    1. anek dhanyobad didi..anek bhalobasa nio :)

      Delete
  6. অসাধারণ লেখা।

    ReplyDelete
  7. অসাধারণ লেখা।

    ReplyDelete