গল্পটা শুনতে নেই
সৌরভ চক্রবর্তী
আজ অফিস থেকে অনেকটা
আগে বেরিয়ে গেছিল তন্ময়। যাদবপুরের কাছাকাছি একটা ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করার ছিল। শহরে
নতুন হওয়ায় এবং উত্তর কলকাতার বাসিন্দা হবার সুবাদে দক্ষিণ কলকাতাটাকে হাতের চেটোর
মতো
চিনে উঠতে পারেনি সে। তাই রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেয়েচিন্তে সাঁপুইপাড়ায় উপস্থিত
হয়েছিল তন্ময়। তারপর সেখানে পৌঁছে মোটা বুদ্ধি ক্লায়েন্টের কথামতো ঠিকানা বের করতে আজ
সে গলদঘর্ম হয়ে পড়েছিল। এখন কাজকর্ম
সব শেষ করে বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বেজে গেছে। যেতে হবে মধ্যমগ্রাম। ভিআইপি বরাবর
কোন বাস যাবে জেনে নিয়ে সেদিকে পা বাড়ায় সে।
অল্প দূর যেতেই গোদের
উপর বিষফোঁড়ার মতো ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়। একটা গলি দিয়ে হাঁটছিল তন্ময়।
গলির মুখে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ গলির মুখটাকে এই অন্ধকার রাতে প্রায় বন্ধ করে
রেখেছে। সঙ্গে ছাতা নেই, গাছের নিচে বৃষ্টিও খুব একটা পড়ছে না।
তন্ময় সেই গাছের নিচেই দাঁড়িয়ে পড়ে। এদিকে রাত বাড়তে থাকে, সঙ্গে কমতে থাকে বাস
পাওয়ার সম্ভাবনা। ওলা বা উবের নিয়ে তন্ময় চলে আসতেই
পারে। এ ভাবনা মাথায় আসতেই প্রথমে তন্ময়ের মনে পড়ে, মাসের এখনও দশদিন বাকি।
ক্যাব নিলে মাসের শেষ ক’টাদিন না খেয়ে কাটাতে হবে। সুতরাং ক্যাবকে
হিসেবের বাইরেই রাখতে হয়। মনে মনে তন্ময় ভাবে, কেন যে বোম্বেতে
কনস্ট্রাকশন
কোম্পানিতে চান্স পেয়েও কলকাতায় সেলস বিজনেসে এসে ভিড়লাম!
সত্যি, তন্ময়ের জার্নিটা বেশ
ইন্টারেস্টিং। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ে প্রথম চাকরি ব্যাঙ্গালোরে। তারপর
সেখান থেকে বোম্বেতে ট্রান্সফার। কিছুদিন বোম্বেতে কাটিয়ে এবং গণপতিপূজার প্রসাদ
খাওয়ার পর তন্ময়ের জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। সব ছেড়েছুড়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসে।
কারণটাও বেশ মজাদার। ছোটো থেকেই তন্ময়ের লেখার হাতটা খাসা, একথা অনেকেই তাকে
বলেছে। বেশ কিছু নামী ম্যাগাজিন সে সব ছাইপাঁশ ছেপেওছে।
তন্ময়ের মায়ের মতে, এইসব ম্যাগাজিনওয়ালারাই তন্ময়ের জীবনটাকে বরবাদ করার
পেছনে দায়ী।
তন্ময় অবশ্য সেসব কথা
শোনেনি। সোজা কলকাতায় এসে লেখালিখি বাড়িয়ে দেয়। এমনকি খড়গপুরের বাড়ি
ছেড়ে মধ্যমগ্রামে অল্প টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকতে শুরু করে। একমাস পর বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়। মা-বাবা হয়তো ভেবেছিল, টাকা পাঠানো বন্ধ করলে ছেলের
মাথার লেখক
হবার ভূত নেমে যাবে। কিন্তু সে ভূত নামে না। গল্প লেখার ভূত এতটাই মাথায় চড়ে বসে
যে তন্ময় দেশের বেশ নামকরা একটি ফিনান্স কোম্পানিতে চাকরি জুটিয়ে ফেলে। প্রথম ছ’মাস বেতন খুবই কম, তবুও ভালো কোম্পানি এবং সেলসের বিজনেস
বলে যখন তখন অফিস কেটে বেরিয়ে পড়া যায়। তাই লেখালিখিটাও সমানতালে চালাতে পারছে সে। ওই মাঝেসাঝে আজকের মতো দেরি হয়ে যায়। সে যাক, তবুও ভালো - তন্ময়
মনে মনে এই ভাবে।
কিন্তু আজকে সে সত্যিই বিপাকে পড়েছে। এতক্ষণে বৃষ্টির
ছাঁট আরও বেড়েছে। বটগাছের ছাউনি ভেদ করে বৃষ্টির জল তন্ময়কে ভিজিয়ে দিতে পুরোপুরি সক্ষম। সঙ্গে সঙ্গত
করছে বজ্রবিদ্যুৎ। বিজ্ঞান বইয়ে লেখা আছে এরকম সময় গাছের নিচে দাঁড়ানো মোটেই উচিত নয়। এসময়ে আমি আপনি হলে কী ভাবতাম জানা নেই, তবে তন্ময়
কিন্তু তখন ভাবছিল, এরকম দিনে চা-তেলেভাজা সহযোগে
একটা গল্প লিখতে বসলে দারুণ হত। নিদেনপক্ষে একটা গল্প যদি কেউ শোনাত!
ঠিক তখনই একটা বাস এসে থামল রাস্তায়। তন্ময় লক্ষ করেনি যে গলির মুখটায় সে
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে সেটা এসে শেষ হয়েছে একটা বাসস্ট্যান্ডে। সে দেখতে পেল বাসটায় ‘মধ্যমগ্রাম’ লেখা আছে। সে আর দেরি না করে ব্যাগটা মাথায় ধরে দৌড়ে
গেল বাসটার দিকে। রাস্তায় এতক্ষণে জল জমে গেছিল। তন্ময়ের পায়ের চাপে জল ঝপাৎ ঝপাৎ
করে চারদিকে ছিটিয়ে পড়ল। কোনওমতে সে বাসে উঠে বসে পড়ল সামনের এক খালি সিটে। বাসটায়
এখনও যাত্রী বিশেষ কেউ নেই। তাই সিট পেতে অসুবিধে হল না। তন্ময় বুঝল, গাড়িটার স্ট্যান্ড কাছেপিঠেই। যাক একেবারে মধ্যমগ্রাম গিয়ে উঠবে। মাঝে আর
কোথাও নামতে হবে না - এই ভেবেই
স্বস্তি পেল সে।
বাসটা আবার চলতে শুরু করে দিয়েছে। ব্যাগ থেকে ইয়ার ফোনটা বার করতে গিয়ে থমকে
গেল তন্ময়। ড্রাইভারের সিটের সমান্তরাল সিটে বসে আছে একটা লোক, পরনে ফর্মাল পেন্টুলুন এবং হাফ হাতা
জামা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে আছে জামাকাপড়। লোকটাকে তন্ময় চেনে।
“ধীরাজদা?” বলে ডাকতেই লোকটা মাথা তুলে তন্ময়ের দিকে চাইল। তন্ময়কে
চিনতে পারল এক দেখাতেই।
“আরে তন্ময়! এদিকে?”
“ক্লায়েন্ট ছিল। চলে এস আমার সিটে।”
ধীরাজ চলমান বাসের হ্যান্ডেল ধরে কোনওমতে এসে হেলতে দুলতে এসে বসল তন্ময়ের
পাশে। ধীরাজ হচ্ছে তন্ময়ের বর্তমান অফিসের বহু পুরনো কর্মচারী। তন্ময় যখন ছ’মাস
আগে প্রথম জয়েন করে তখন এই ধীরাজদাই হাতে ধরে তাকে সব কাজ শিখিয়েছিল।
বাস বিভিন্ন স্টপেজে থামছিল আর নতুন যাত্রী উঠছিল। শহর জুড়ে এখন তীব্র
বৃষ্টিপাত চলছে - ক্ষণে
ক্ষণে বজ্রবিদ্যুৎ। সে কারণেই কি না জানা
নেই, তবে এখন কলকাতায় আলো নেই বিভিন্ন অঞ্চলে। বাসের হেডলাইট আর মাঝে মাঝে
বিক্ষিপ্ত কিছু এলাকার উঁচু ইমারতগুলির আলো ছাড়া চারদিক অন্ধকার। বাসের ভেতরেও
বাসের ব্যাটারিচালিত ক্ষীণ আলো। তন্ময় সঙ্গী যাত্রীদের একবার জরিপ করে নিল। কিন্তু এই আলোতে কাউকেই স্পষ্ট
দেখতে পেল না। সবাই অন্ধকারের অবয়ব হয়েই বসে আছে
যে যার জায়গায়।
“ক’দিন ধরে
অফিস আসছ না, কী ব্যাপার?” ধীরাজদাকে প্রশ্ন করল তন্ময়।
“আসছি না। কী করে আসি বল! একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে যে।”
“অ্যাক্সিডেন্ট? কার? কবে? কীভাবে?”
“সে এক গল্প। শুনতে নেই রে।”
“কী মাথামুণ্ডু বলছ, ধীরাজদা? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। কীসের গল্প? আর শুনতে নেই মানে?”
ধীরাজদা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। মাথা এখনও নিচু। তারপর বলল, “তুই কি গল্পটা শুনতে চাস?”
“হ্যাঁ, চাই।”
“গল্প শুনলে কিন্তু বিপদ ঘটবেই।”
“গল্প শুনলে বিপদ ঘটে এটা বাপের জম্মে শুনিনি। আর তাছাড়া আমি যে গল্প লিখি
আর শুনতেও যে খুব ভালোবাসি, সেটা তো
তুমি জান। চটপট শুরু কর তো। এমনিতেও এরকম ঝড়জলের রাতে তিলোত্তমায় বাসভ্রমণে
গল্প শোনার ভাগ্য কম লোকেরই জোটে।”
“বেশ, তবে
শোন।”
ধীরাজদা গল্প শুরু করল, “আজ থেকে
অনেক বছর আগে দক্ষিণের কাসমুদ্রম গ্রামে এক ব্রাহ্মণ দম্পতি বাস করতেন।
শ্মশানসংলগ্ন ভূমিতে ছোটো কুঁড়েঘরে তাঁদের বাস। সামান্য যজমানি করে চলত তাঁদের সংসার। কোনওভাবেই তাঁদের সংসারকে সচ্ছল বলা
চলে না। দিন আনি
দিন খাই করে চলে যায় তাঁদের। কিন্তু এ নিয়ে এঁদের মনে কোনও দুঃখ ছিল না। বরং খুশিই ছিলেন তাঁরা।
“যজমানি ছাড়াও আরও এক মাধ্যমে তাঁরা পয়সা রোজগার করতে পারতেন। ব্রাহ্মণ ও
ব্রাহ্মণের স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন তন্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। সঙ্গে জানতেন আয়ুর্বেদ।
শ্মশানের পেছনেই ছিল বিস্তৃত জঙ্গল। সেই জঙ্গলে যে সমস্ত ওষধিগাছ পাওয়া যেত তা দিয়েই
বিভিন্ন রোগের ঔষধ তৈরি করতেন ব্রাহ্মণের স্ত্রী। ব্রাহ্মণ গ্রামে গ্রামে লোকের বাড়িতে পূজা করে বেড়াত বলে সে আর
ঔষধ তৈরির ব্যাপারের মধ্যে নাক গলাত না। কারণ, দিনের শেষে সে খুবই ক্লান্ত হয়ে
পড়ত। বামুনির তৈরি ঔষধ বিভিন্ন গ্রামের লোক এসে নিয়ে যেত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঔষধগুলি অব্যর্থ
ছিল। কিন্তু বামুনি কোনওদিন সেই ঔষধের বদলে পয়সা নিত না। কেউ পয়সা দিতে চাইলে দক্ষিণী ভাষায় বলত, যদি রোগ সেরে যায় সামনের শ্মশানে
যে দেবীর গর্ভগৃহ আছে সেখানে কিছু ফল রেখে এস।
“ব্যস, এইটুকুতেই বামুনি খুশি ছিলেন।
“রাতের বেলায় ব্রাহ্মণ তন্ত্রসিদ্ধিতে বসত। সঙ্গে
বামুনি। তন্ত্রের ষটকর্মের উপর দু’জনেই এত বছরের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তন্ত্রকে মানুষের মঙ্গলের জন্য
ব্যবহার করাই এঁদের লক্ষ্য ছিল। রাতের বেলায় যখন লোকেরা মড়া নিয়ে আসত তখন দেখত শ্মশানের এককোণে দু’জন ঘোর সাধনায় মগ্ন। চারপাশে
জ্বলত মশাল। মাঝখানে হোম করতেন ব্রাহ্মণ। রাত বাড়লে পোড়া কাঠের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসত মানুষ-পোড়া গন্ধ। বিশাল বটগাছের নিচ থেকে হোমের ধোঁয়া সরু হয়ে উঠে
যেত গাছের মগডাল অবধি। এই সময় শ্মশানযাত্রীরা দূর থেকে সাধনা দেখত। কিন্তু কারও কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। আর অনুমতি থাকলেও কেই বা সাহস
করে যেত ওইদিকে।
“ভোর সাড়ে চারটা অবধি চলত সাধনা। তারপর দু’জনেই ফিরে আসতেন নিজের কুটিরে।
সকালে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যেতেন পূজার্চনার
জন্য, আর
বামুনি বেরোতেন জঙ্গলের পথে। এই ছিল তাঁদের জীবন। তাঁরা ভেবেছিল, এভাবেই হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু না। নিয়তির পরিহাসে
তাঁদের এই জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হল।
“সরকার থেকে ঠিক হল কাসমুদ্রমে তৈরি হবে রেলস্টেশন। তারপর ঠিক সময়ে সেই
স্টেশন তৈরির কাজ শুরু হল। একদিন সেই কাজের সমাধাও হল। জঙ্গল
যেখানে শেষ তারপর ক্রোশ দশেক গেলেই রেল লাইন। যে কাসমুদ্রম গ্রামের নাম
প্রায় সবারই অজানা ছিল সেই গ্রামে হঠাৎ করেই লোক সমাগম বাড়তে লাগল। কাসমুদ্রম
গ্রাম হায়দ্রাবাদের থেকে খুব একটা দূর নয়। তাই ধীরে ধীরে লোকবসতি আরও বাড়তে লাগল। অনেক নতুন লোক এসে আস্তানা নিল।
এবার একটা নতুন জিনিস ঘটল।
“এতদিন যেসব লোক গ্রামে থাকত তাঁদের সবাই অশিক্ষিত, গ্রামের চাষবাস করা খেটে
খাওয়া মানুষ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁরা এভাবেই চলে এসেছে। রেল না এলে এভাবেই
কেটে যেত আরও শতাধিক বছর। কিন্তু এবার বাইরে থেকে লোক যারা এল তাঁদের অনেকেই
পড়াশোনা জানা লোক। তাঁদের পরিবারের বাচ্চারাও বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে
লাগল। ধীরে ধীরে কাসমুদ্রম গ্রামেই গড়ে উঠল
তাঁদের প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়য়। শিক্ষার সচেতনতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবার মধ্যে।
“এসবের ফলে যেটা হল সেটা ছিল খুব নির্মম। কারণ, এতদিনে ব্রাহ্মণ দম্পতি দু’জনেরই বয়স বেড়েছে।
ব্রাহ্মণ আর আগের
মতো গ্রামে গ্রামে পূজা করতে যেতে
পারেন না। শুধু
রাতের বেলায় নিয়মমাফিক শ্মশানে বসে সাধনা করেন। কিন্তু বামুনির ভয়, এই শরীর
নিয়ে আর বেশিদিন
ব্রাহ্মণ সাধনাও
করতে পারবেন না। আগে
আয়ুর্বেদ চিকিৎসার জন্য বামুনি কোনও পয়সা নিতেন না, বদলে ফল চাইতেন দেবীপূজার জন্য। এখন বামুনি ফল
চান না। রোগ
সেরে গেলে সবাইকে দু’কৌটো আতপ চাল দিতে বলেন, সঙ্গে যে কোনও এক পদ কাঁচা সবজি। শ্মশানকালী পূজার জন্য সরকার
নতুন লোক রেখেছে বলেই এখন আর ফল লাগে না দেবীর জন্য। আর তাছাড়া তাঁদেরও তো খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
“এভাবে আরও কিছু সময় কাটে। ব্রাহ্মণ এখন প্রায় শয্যাশায়ী। বামুনি একা রোজ
রাতে সাধনা করেন। চিকিৎসার জন্যেও এখন কেউ আর
বিশেষ আসে-টাসে না।
সবাই রেলগাড়ি চেপে শহরে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসে। পুরনো কিছু
শিষ্য এখনও কিছু
দক্ষিণা পাঠায় বলে তাঁরা খেয়ে পরে বেঁচে আছেন। শ্মশানে যে
বটগাছটা ছিল সেটাও কেটে ফেলা হয়েছে। এমনকি শ্মশানে তৈরি
হতে চলেছে ইলেকট্রিক চুল্লি। এত লোক শ্মশানে কাজ করে যে সাধনার সময় মনঃসংযোগে
বামুনির এখন অসুবিধা হয়। আর
তাছাড়া এক নতুন উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হচ্ছে ইদানিং। আগে শ্মশানযাত্রীরা কেউ মশালের
আলো আর হোম দেখলে এদিকটায় আসত না। এখন বেশ কিছু অনুসন্ধিৎসু লোক এসে বসে থাকে সাধনার সময়। সব মিলিয়ে কাসমুদ্রম আর ব্রাহ্মণ
দম্পতির জন্যে আগের মতো নেই।
“এরকম একদিন ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এখানে আর
কিছুদিন থাকলে আমরা না খেয়ে মরব। অবশ্য আমার চিন্তা আমি করি না। যা
বুঝতে পারছি আর অল্পদিনই বাঁচব। কিন্তু তোমাকে তো বাঁচতে হবে। চল, আমরা অন্য কোনও গ্রামে চলে যাই। অন্তত আমি থাকতে থাকতে তোমার একটা গতি করে
দিয়ে গেলে মরেও শান্তি পাব।
“বামুনি সবকথা চুপ করে শুনলেন। তারপর অনেক
ভেবে বললেন, আমার জন্য এত চিন্তা করো না। ঠিক একটা হিল্লে হয়ে যাবে। সত্যি একটা হিল্লে হয়ে গেছিল অল্পদিনের মধ্যেই। ঘটনাটা এতটাই
আকস্মিক ছিল যে এর ঘোর কাটাতে অনেকটা সময় লেগে যায়।
“সেদিন রাত্তিরে হঠাৎ কুটিরের বাঁশের দরজায় করাঘাত হয়। বামুনি লন্ঠন জ্বেলে
বাইরে এসে দেখেন বাইরে
তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে একজনের কোলে একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা
বোধহয় অচেতন অবস্থাতে আছে। একজন পুরুষ এগিয়ে এসে বলল, আমার ছেলেটা রাত থেকে পেট-ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে। শহরে গিয়ে বড়ো ডাক্তার দেখাতে দেখাতে সেই সকাল
হয়ে যাবে। আর রেলগাড়ি যদি দেরি করে তবে দুপুর গড়াবে। আমার বাচ্চার পেট-ব্যথা আপনি ততক্ষণের জন্য কমিয়ে
দিন।
“পুরুষ নিজের কথা শেষ করতেই পেছনে এক মহিলাকণ্ঠে প্রায় আর্তনাদ শোনা গেল, আমার ছেলেটা মরে যাচ্ছে। দু’ঘণ্টা পেট-ব্যথায় ককিয়ে শেষ আধঘণ্টায় মুখে
একটা রা কাড়েনি। আপনি যে করে
হোক ওকে বাঁচান।
“সঙ্গে একজন গ্রামবাসী ছিল। বামুনি তাঁকে চিনতে পারলেন। তাঁদেরই এক শিষ্য-স্থানীয়।
সেই যে এদের এখানে নিয়ে এসেছে বুঝতে অসুবিধে হল না। বামুনি মাটির বারান্দায় চাটাই
পেতে তাতে বাচ্চাটাকে শোয়াতে বললেন। তারপর বাচ্চাটার নাড়ি টিপে, পেট টিপে নিজের বাক্স বের করে কিছু ঔষধ তাকে
খাইয়ে দিলেন। রোগটা ঠিক
কী বামুনি নিজেও ধরতে পারেননি। এই রোগের লক্ষণ তাঁর অজানা।
শুধু ব্যথা কমানোর ঔষধই তিনি দিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, আজ
রাতটুকু এই ঔষধগুলি একে এক ঘণ্টা পরপর খাওয়াতে থাক। কাল সকালে
অবশ্যই শহরে নিয়ে যেও। আমি শুধুমাত্র ব্যথা নির্মূল করার
বটিকা একে দিয়ে দিলাম।
“পুরুষটি বামুনিকে প্রণাম করে তাঁর হাতে দু’টাকার একটি নোট গুঁজে দিল।
বামুনি ফিরিয়ে দিতে চাইল, কিন্তু লোকটি তা নিল না। উপরন্তু যদি তার ছেলে ভালো হয়ে ফেরে তবে আরও অনেক উপঢৌকন পাঠাবার
প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে সে সবাইকে নিয়ে ফিরে গেল।
“মনে রাখতে হবে যখনকার গল্প বলছি তখন দু’টাকা নেহাত ফেলনা নয়। বামুনি সে রাতে ঘুমাতে পারলেন না। দু’টাকার জন্য নয়। ছেলেটার কী রোগ হয়েছে তা তিনি ধরতে পারেননি। এতদিনের আয়ুর্বেদের অভিজ্ঞতা
তাঁকে পুরোপুরি হার মানিয়েছে এই রোগের কাছে। এদিকে ভোর হয়ে এসেছে। রাতের সাধনার
ধকল এবং ভোররাতে চিকিৎসা, সবমিলিয়ে একসময় বামুনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
“পরদিন সকালে বামুনির ঘুম ভাঙল না। ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। বাইরে
কীসের চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। তাতেই তাঁর
ঘুম ভেঙে গেছে। তিনি বাইরে বেরিয়ে দেখলেন, তাঁর কুটিরের বাইরে অনেক লোক জমা
হয়ে গেছে। এমনকি চেঁচামেচিতে ব্রাহ্মণ কখন ভগ্ন শরীরে বাইরে এসে সবার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিয়েছেন, বামুনি ঘুমের ঘোরে বুঝে উঠতে পারেন না। অল্প সময়েই তিনি বুঝতে পারেন সমস্ত ঘটনা।
“আর তারপর এক নিষ্ঠুর ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে কাসমুদ্রম গ্রাম।”
এতটুকু বলে ধীরাজদা থামল। তন্ময় বলল, “কী হল? থামলে কেন?”
“তুই কি এখনও শুনতে চাস? এখনও সময় আছে, যদি আমি এখানে থেমে যাই তোর বিপদ হবে না।”
তন্ময় এখনও অবধি এই কাহিনিতে ভয়ের কিছু পায়নি। সত্যি বলতে
খুব যে একটা ভালো লাগছে সেরকমও নয়। কিন্তু কাহিনি শুরু যখন করেছে শেষ না করে তন্ময়
ক্ষান্ত হবার পাত্র নয়। সে ধীরাজদার প্রশ্নের উত্তরে এরকম এক চাহনি দিল যে ধীরাজ আবার গল্প শুরু করে
দিল।
“সেদিন রাতে সেই বাচ্চাটি মারা যায়। তাকে শহরে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তার জানায়
তার মৃত্যু কাল রাতেই হয়েছে। ডাক্তারের অনুমান, মৃত্যু হয়েছে ভোর রাত সাড়ে
চারটা-পাঁচটার দিকে। বাচ্চার মা-বাবার ধারণা, বামুনির দেওয়া ঔষধ খেয়েই
বাচ্চাটির মৃত্যু হয়েছে। আর তারা যখন গ্রামের সবাইকে এ ব্যাপারে জানায় তখন তাতে
বেশ কয়েকজন এই বলে ইন্ধন যোগায় যে বামুনিকে শ্মশানে শবসাধনা সহ তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক
ইত্যাদি করতে দেখা যায়। আর এসমস্ত সাধনায় যে বাচ্চার বলি আবশ্যক সে বিষয়ে প্রায়
সবাই নিশ্চিত। এ-কান থেকে
ও-কান হয়ে খবর আশেপাশের গ্রামেও
ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
আর বামুনি সেদিনই এক নতুন নামে অভিষিক্তা হন, পিশাচ সিদ্ধা।
“এরপরের কাহিনি খুব ছোটো। পিশাচ
সিদ্ধাকে সেইসময় পুড়িয়ে মারাই ছিল নিয়ম। কিন্তু গ্রামবাসীকে বামুনি সে
সুযোগ দেয়নি। এসব গণ্ডগোল একজন সাধিকার জীবনে এই প্রথম। তার উপর অশক্ত শরীর। হঠাৎ
করেই ব্রাহ্মণ
আবিষ্কার করলেন, এতক্ষণ
যে গ্রামবাসীরা তাঁর ও তাঁর গিন্নীর উৎখাতের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল সেই উত্তেজনার
স্রোত চুপ হয়ে আসছে। এক সময় সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল আর ব্রাহ্মণ দেখতে পেলেন সবার চোখ
তাঁর দিক থেকে সরে তাঁর পেছনের দিকে আবদ্ধ হয়েছে। ব্রাহ্মণ সেই দিক অনুসরণ করে যা
দেখলেন তাতে তাঁর পায়ের নিচের জমি দোদুল্যমান ঠেকল। বামুনি এলিয়ে পড়ে আছেন কুটিরের
দাওয়ায়। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে বামুনি শুধু নিজে মুক্তি পেলেন না, শিক্ষার আলোকে নব্য আলোকিত
হওয়া কাসমুদ্রম গ্রামকেও মুক্তি দিলেন এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির হাত থেকে।”
খুব জোরে একটা বাজ পড়ে। ধীরাজ গল্পটা থামায়। বাসও একটা স্টপেজে এসে থেমেছে।
মধ্যমগ্রাম এখনও অনেক দূর। বাসে আরও কিছু লোক উঠে পেছনে চলে গেল। শহরে আলো প্রায়
নেই। লোকগুলির অবয়ব আর কালো কালো মাথা ছাড়া কিছুই বোঝার উপায় নেই। বাস এখন প্রায়
ভরে গিয়েছে। অনেকেই ঝুলে ঝুলে ফিরছেন ঝড়জলের রাতে।
“তারপর!”
তন্ময়ের প্রশ্নে ধীরাজ আবার গল্প ধরে, “বামুনিকে সৎকার করতে সেদিন শ্মশানে কেউ যায়নি। একা ব্রাহ্মণ আর একজন শিষ্য
মিলে কোনওভাবে
তাঁর সৎকার সমাধা করেন। একসময়
বৃষ্টি নামে। ততক্ষণে চিতা নিভে এসেছে। শিষ্যটিও এতক্ষণে বাড়িতে চলে গেছে। শ্মশানে
ব্রাহ্মণ একা।
“ব্রাহ্মণ নিজের জায়গা থেকে উঠে আসেন। একটা পোড়া কাঠ তুলে বামুনির চিতায়
ঢুকিয়ে নাড়া দিতেই বাকি সমস্ত পোড়া কাঠ সরে যায়। চিতা এখন ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে।
বামুনির অস্থি খুঁজে পেতেই সেটা একটা বাঁশের ভেতরে ফেলে ফিরে যান নিজের কুটিরের দিকে। অপেক্ষা
করতে থাকেন সময়ের। ব্রাহ্মণ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন তিনি এখন কী করবেন। আজ গ্রামবাসী যে ভুল করেছে তাঁর শাস্তি তিনি
দেবেনই, যে শাস্তি কেউ ভাবতেও পারে না।
“এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই গ্রামে চাউর হয়, বাচ্চাটার মৃত্যু সম্পূর্ণ
স্বাভাবিক ছিল। তার পেটের ব্যথা অনেক কাল পুরনো। চিকিৎসা কোনওদিন করানো হয়নি।
সেদিন অতিরিক্ত ব্যথা হবার পরও মা-বাবা ভেবেছিল কমে যাবে। কিন্তু তা না কমে
উপরন্তু বেড়ে যাওয়াতেই
বিপত্তি ঘটে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে যাকে অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলি সেটাই ঘটেছিল
বাচ্চাটার ক্ষেত্রে। কিন্তু চিকিৎসার অভাবে সেইটা ভেতরেই ফেটে গিয়ে ডেকে আনে
বাচ্চাটির মৃত্যু। এত কিছু সেদিন গ্রামবাসী বোঝেনি। আর গ্রামের তন্ত্রসাধিকা এক
গরিব বামুনির মৃত্যুও তাই খুব একটা সাড়া ফেলেনি কারও হৃদয়ে। কিন্তু এই ঘটনা জানামাত্রই
ব্রাহ্মণের মাথার আগুন আবার ধিকিধিকি জ্বলে উঠে। ব্রাহ্মণ এতদিন যে তন্ত্রকে লোকের
কল্যাণ সাধনে ব্যবহার করেছেন, এবার সেই তন্ত্রের মারণ আর উচাটনের প্রভাব দেখাতে বদ্ধপরিকর হন তিনি।
“তার দু’দিন পর
ছিল অমাবস্যা। সেদিন তিনি বহুদিন পর তাঁর জীবনের শেষ তন্ত্রসাধনার জন্য প্রস্তুতি নেন। সমস্ত উপকরণ অশক্ত হাতে জোগাড় করে শ্মশানের উদ্দেশে রওনা দেন। সাপ, বেড়াল, শকুন, বাদুর - চারটে অস্থি আগেই জোগাড় করা ছিল তাঁর কাছে। এবার সেই আসনে তিনি জুড়ে দেন বামুনির অস্থি। তৈরি হয়
পঞ্চমুণ্ডির আসন। সামনে জ্বলে উঠে হোমের প্রোজ্বল শিখা। এক খুব বিশ্বস্ত শিষ্যকে দিয়ে ব্রাহ্মণ জোগাড় করিয়েছিলেন এক টাটকা লাশ। পাশের গ্রামের
কোনও মহিলাকে সাপে কেটেছিল। সেই লাশ জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেই লাশই জোগাড় করে সেই
শিষ্য। পঞ্চমুণ্ডির আসনটিকে ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠা করেন সেই লাশের পিঠে। তারপর কৌপীন পরিহিত অবস্থায় তার উপর বসে
সাধনা শুরু করেন। এ সাধনা
মৃত্যুর সাধনা। সমস্ত জীবনের তন্ত্র থেকে প্রাপ্ত সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সাধনা। এই
সাধনা কোনওদিন মানুষের মঙ্গলের জন্য হতে পারে না। এই সাধনার একমাত্র লক্ষ্য
মৃত্যু।”
এই পর্যন্ত বলার পর বাসটা প্রচণ্ড শব্দ করে ঝাঁকুনি খায়। ধীরাজদা ও তন্ময়সহ
বাসের সকল যাত্রী চমকে উঠে। রাস্তায় জল জমে গেছে। তাই এরকম হয়েছে। কিছুক্ষণ পর বাস
আবার চলতে শুরু করে। ধীরাজদাও আবার গল্প শুরু করে, “সেই রাতে ব্রাহ্মণ তাঁর কাহিনি
লিপিবদ্ধ করেন একটা শালপাতার
মধ্যে। তারপর সেই কাহিনি নিয়ে ভোরবেলায় তিনি রওনা দেন সেই বাচ্চা
ছেলেটির বাড়ির উদ্দেশে। ভোরবেলায় ব্রাহ্মণকে এই বেশে দেখে রীতিমত চমকে উঠে বাচ্চাটির মা ও বাবা। কিন্তু তারা ততদিনে
নিজেদের ভুল বুঝে ফেলেছে। তাই ব্রাহ্মণকে তাড়িয়ে না দিয়ে দাওয়ায় বসতে দেয়। বাচ্চাটির
মা ব্রাহ্মণের জন্য জলখাবারের ব্যবস্থা করতে ভেতরে চলে যায়। আর বাবা ব্রাহ্মণের
হাত ধরে বলেন, আমি সেদিন পুত্রশোকে বিধ্বস্ত ছিলাম। আমি জেনে গেছি, কী ভুল আমি করেছি। আপনি চাইলে আমার শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন।
“ব্রাহ্মণ মাথা নেড়ে তাঁকে পাশে বসতে বলেন। শাস্তির পরিবর্তে তাঁকে একটি
গল্প শোনাতে চান। লোকটি অবাক হলেও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের মন রক্ষার্থে রাজি হয়ে যায়। তারপর ব্রাহ্মণ গল্প শুরু করলেন।
“অল্প সময় পর গল্প শেষ হল। আর তারপর...”
ধীরাজদা চুপ করল। তন্ময় এবার পাগলের মতো জিগ্যেস করল, “কী হল তারপর? কী হল? চুপ করলে কেন?”
ধীরাজদা মুচকি হেসে বলল, “তারপর কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটির মা ফিরে এসে দেখল ব্রাহ্মণ নেই। শুধু মাটিতে
লুটিয়ে পড়ে আছে বাচ্চার বাবার লাশ। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় হৃদরোগে
মৃত্যু ঘটেছে লোকটার। গ্রামবাসী
ঘটনা জানামাত্র ব্রাহ্মণের বাড়ি হানা দেয়। কিন্তু তাঁকে আর পাওয়া
যায় না। শুধু
তার লাশ পাওয়া যায় শ্মশানে, সেই পঞ্চমুন্ডির আসনে।
“সেদিন একই সঙ্গে শ্মশানে ব্রাহ্মণ আর ওই লোকটার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। শুধু একটা জিনিস দেখে সবাই অবাক হয়। দু’জনের একজনের ছায়াও আর
মাটিতে পড়ছে না। সেদিন ছিল কড়া রোদ। আর তাই নিচে মাটিতে সবার তীক্ষ্ণ কালো ছায়া
পড়ছিল। কিন্তু মৃতদেহদুটির কোনও
ছায়া সেদিন পড়েনি।
“এই ঘটনার পর পর আশেপাশের গ্রামে সেই ব্রাহ্মণ এবং বাচ্চাটির বাবার
আবির্ভাবের কাহিনি ছড়িয়ে
পড়ে। আর তাঁদের আবির্ভাবের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে একটি করে মৃত্যু। আর মৃতদেহের সৎকারের সময় মৃতদেহগুলির ছায়া
মাটিতে পড়তে দেখা
যেত না। এভাবে ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তে থাকে। আজকে যার
মৃত্যু হয়েছে সেই কালকে অন্য কোথাও গিয়ে উপস্থিত হচ্ছে, তার সঙ্গে থাকছে একটি শালপাতার
পুঁথি। একটা গল্প সে বলছে আর একটা করে মৃত্যু হচ্ছে। ব্যস, চলতেই থাকল। কাসমুদ্রম এবং আশেপাশের গ্রাম অল্পদিনেই জীবিত
মানুষের শ্মশানে পরিণত হল। সবাই বেঁচে আছে। কিন্তু শুধুমাত্র ছায়াটিকে অবলম্বন
করে। দেহের মৃত্যু সম্ভব, সৎকার সম্ভব – কিন্তু ছায়ার!
“ব্রাহ্মণ এভাবেই সেদিন বামুনির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছিল সব্বাইকে
জীবন্ত ছায়া বানিয়ে। লোকগুলিকে দেখলে মনে হত দুপুরের কড়া রোদে কেউ এদের দাঁড় করিয়ে কোনও তীক্ষ্ণ করাত দিয়ে
ছায়াটিকে কেটে নিয়েছে। এ জীবন কী দুর্বিষহ হতে পারে একমাত্র আমরাই জানি।”
তন্ময় এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। গল্পে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু এবার তার মুখ
থেকে ছিটকে বেরুল, “আমরাই
জানি মানে? তুমি কী করে জান? তুমি তো ছায়া নও, রক্তমাংসের মানুষ তুমি। এসব বলে
ভয় দেখাতে চাইছ নাকি?”
“না তন্ময়, ভয় কেন
দেখাব। তুইই তো শুনতে চাইলি গল্প। নইলে কি
তোকে বলতাম আমি? এই
দ্যাখ না, আমি নিজেই গল্পটা শুনে এভাবে
ছায়া হয়ে ঘুরছি। ওই যে শুরুতে বলেছিলাম একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে। এই দ্যাখ, তোর জন্যে শালপাতার পুঁথিটাও
এনেছি।”
তন্ময় তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু বাসে
এখন এত লোকের ভিড় যে সে ধাক্কা খেয়ে আবার জায়গায় বসে পড়ে।
“দেখ ধীরাজদা, খুব বাজে ইয়ার্কি হচ্ছে। আর তুমি তো কাসমুদ্রম গ্রামের বাসিন্দা নও যে
তোমার এই হাল সেই ব্রাহ্মণ করে দিয়েছে। তাই না?”
ধীরাজদা এবার হেসে উঠে, “ডাইনি অপবাদে যখন যেখানে কোনও নির্দোষকে খুন করা হয়েছে সেখানেই ব্রাহ্মণ তাঁর দলবল নিয়ে পৌঁছে সেই শহরকে
বানিয়েছেন
ছায়াগ্রহ। কিম্বা এরকম কোনও ঘটনার ফলে যদি
কেউ অপদস্থ হয়েছে এ খবরও তাঁর কানে কোনওভাবে এসেছে তবুও ঘটেছে একই পরিণাম। আমাদের গ্রামের
মফস্বলেও ঘটেছে এরকম অনেক ঘটনা। এবার কলকাতার পালা। কারণ কলকাতার মধ্যেও সেই আদিকাল
থেকে ঘটে আসছে এরকম বহু মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বোধহয় আমাদের পৌঁছাতেই একটু দেরি হল। কী বলিস, তন্ময়?”
তন্ময় চিৎকার করে উঠে, “জানি না। আমি জানি না। তুমি
এভাবে তাকাচ্ছ কেন? কেন এগিয়ে আসছ আমার দিকে?”
সে বেরিয়ে পালাতে
চায়। আর তক্ষুনি শহরে আলো ফিরে আসে। তন্ময় দেখতে পায় সে যে বাসে আছে তাতে লোক
গিজগিজ করছে। কিন্তু তাদের কারও শরীর বলে কিছু নেই। যা আছে শুধুমাত্র ছায়া। আর সব ছায়াই এখন এগিয়ে আসছে
তার দিকে। সবার হাতেই একরকম দেখতে শালপাতার পুঁথি। তন্ময় ভয়ে বসে পড়ে বাসের মেঝেতে।
পেছন থেকে একটা মুখ তার কানের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসে। ধীরাজদার মুখ।
“ভয় পাস না, তন্ময়। তুই সেই কোন সময়েই ছায়া
হয়ে গেছিস। বাসটা তখন খুব জোরে কেঁপে উঠেছিল, মনে আছে? বাস অনেক দূরে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে পড়ে আছে। এখন তুই
আমাদেরই একজন।”
তন্ময় এবার চোখ বন্ধ করে। স্পষ্ট দেখতে পায়, তার লাশটা এখনও পড়ে আছে সেই
বাসটার ভেতরে। আর চোখ খুলতেই আবিষ্কার করে, তার হাতে সদ্য চলে এসেছে একটা শুকনো খরখরে শালপাতার পুঁথি। আজ থেকে তার
শিকার ধরার পালা শুরু।
এখন আর সে গল্প লিখবে না, গল্প শেষ করবে।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
Besh interesting plot, BHALO laglo pore.
ReplyDeleteঅন্যরকম গল্প। ভালো লাগল।
ReplyDelete