সময়ের চোখ
বাবিন
“কী আনন্দ যে হচ্ছে
আমার ঠিক বলে বোঝাতে পারব না,” খুশিতে চোখদুটো চকচক করে উঠল ডক্টর
স্যান্যালের, “এই আনন্দ আমি তোমার সঙ্গে ছাড়া আর কার সাথেই বা শেয়ার করব, বল?”
“সত্যিই স্যার, আপনি অসাধ্যসাধন
করেছেন। আপনি ছাড়া এটা
সম্ভব ছিল না,” আমি জিজ্ঞেস করি, “কিন্তু স্যার, এটা করলেন কীভাবে? মানে, কোন টেকনোলজিতে এটা
করলেন? আজকালকার কোনও বিজ্ঞানীই নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করবেন না! আদৌ
সম্ভব নয় বলেই সবাই হাত ধুয়ে ফেলবেন!”
“হ্যাঁ, জানি। ফোর্থ
ডাইমেনশনকে পেরিয়ে যাওয়া যে সম্ভব এটা কেউ ভাবতেই পারবে না।”
“আচ্ছা স্যার, আপনার
মনে আছে কি না জানি না, সোমশুক্লও অনেকটা এইরকমই কিছু করতে চাইছিল। কিন্তু বেচারা...”
আমার মনটা খারাপ হয়ে
গেল ওর কথা মনে পড়তে।
স্যান্যাল-স্যার জিভ
দিয়ে চুকচুক করে একটা শব্দ করে খেদ প্রকাশ করে বললেন, “ওর মুখেই শুনেছিলাম, বেচারা
অনেকদূর এগিয়েও ছিল, কিন্তু শেষমেশ হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। বলতে পার, ওর সেই ব্যর্থতার থেকেই আমার এই
গবেষণার সূত্রপাত। আমিও ওর মতো
করে ভাবতে শুরু করি, সত্যিই কি সম্ভব সময়কে পারাপার করা? ওর গাইড হিসেবে আমি তখনই
শুরু করি এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে। তবে যতটুকু শুনেছিলাম তাতে আমার মনে হয়েছিল, ওর পদ্ধতিতে অনেক ভুল ছিল। সেগুলো আমি শুধরে নিয়েছি। চল তোমাকে দেখাই।”
স্যার সোফা থেকে উঠে
এগিয়ে গেলেন ওঁর গবেষণাগারের দিকে। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম। স্যান্যাল-স্যারের বাড়ির এই ব্যক্তিগত গবেষণাগারেই
সোমশুক্ল কাজ করছিল। কারণ, ওঁর নিজের সংগ্রহে এমন কিছু অত্যাধুনিক যন্ত্র ছিল যেগুলো নাকি বিশ্ববিদ্যালয়েও
ছিল না। তাছাড়া স্যার
অবিবাহিত হবার ফলে যতক্ষণ খুশি ও এখানে কাজ করতে পারে, বাধা দেবার কেউ নেই।
ডক্টর স্যান্যাল
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। আমি আর সোমশুক্ল দু’জনেই ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করছিলাম। আমি সাউন্ডের
ওপর কাজ করছি আর সোমশুক্ল করছিল লাইট নিয়ে। স্যার ছিলেন সোমের গাইড। আমরা দু’জনে হোস্টেলের একই রুমে থাকতাম। আমাদের কাজ
এমনই যে সেখানে সময়ের হিসেব রাখলে চলে না। তাই নাওয়া-খাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও সময়ও ছিল না। কখনও কখনও রাতে
ফিরতামও বেশ দেরি করে। দু’জনের কাছেই হোস্টেল-রুমের একটা করে চাবি
থাকত। যে আগে ফিরত
সে তালা খুলে ঢুকে যেত। অন্যজন পরে এসে দরজা খটখট করলে আমরা খুলে দিতাম।
গতবছর একদিন রাতে আমি
তাড়াতাড়ি ফিরলেও সোম ফিরল না। আমি রাত দশটা নাগাদ খাওয়াদাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি সোম ফেরেনি। একটু পরেই জানা
গেল স্যারের বাড়ির ল্যাবের মধ্যেই সোম সুইসাইড করেছে। বিষ খেয়েছিল। কোনও নোটও রেখে
যায়নি। সকলেই আন্দাজ
করেছিল হতাশা থেকে এই ঘটনা। কারণ, ওর গবেষণার বিষয়টা ছিল এমনই অসম্ভব যে
অনেকেই ওর কান্ডকারখানায় হাসাহাসি করত। টাইম মেশিন! সময়কে নিয়ে খেলা করা! কখনও এগিয়ে
যাওয়া আবার কখনও শতাব্দী পিছনে চলে যাওয়া! পাগলের প্রলাপ আর কী!
আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। দীর্ঘ দু’বছর ধরে এক ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের
মধ্যে একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। ওর এভাবে চলে যাওয়াটাকে মন থেকে মেনে নিতে
পারলাম না। খুব চাপা
স্বভাবের ছেলে ছিল। বলেনি কিছুই
আগে থেকে। আমিও আঁচ করতে
পারিনি যে ও আত্মহত্যা করবে। তাহলে ওকে বোঝাবার সুযোগ পেতাম। আসলে ও যে ভয়ঙ্কর বিষয়ে গবেষণা করছিল সেটা সফল হবার আশা প্রায় ছিল না বললেই
চলে। তা সত্ত্বেও
মনপ্রাণ এক করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল।
ওর
মৃত্যুর পর গবেষণাটা অসমাপ্তই রয়ে গেছিল। আজ প্রায় মাস ছয়েক পর প্রফেসরের ডাকে আজ আবার এখানে এসেছি। উনি কিছু একটা দেখাবেন বললেন। এখানে এসে শুনলাম
উনি নাকি সোমের অসমাপ্ত কাজটি শেষ করে ফেলেছেন।
স্যার
ল্যাবের এককোণে রাখা বেশ মজবুত একটা ট্রাইপডের ওপর দাঁড় করানো বেশ বড়সড় জবরজং
বাক্সর দিকে এগিয়ে গেলেন। জিনিসটা দেখতে অনেকটা আদ্যিকালের ক্যামেরার মতো। তবে তার নিচে একটা চাকার মতো অংশ যার সঙ্গে
খুব সম্ভবত একটা শক্তিশালী মোটর লাগানো। বেশ কিছু তার বেরিয়ে রয়েছে। সেগুলো কাছের একটা টেবিলে রাখা কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত।
“এটা
হল টাইমোস্কোপ। এখনও পর্যন্ত এটার কথা আর কেউ জানে না। তোমাকেই প্রথম দেখাতে চলেছি এটার কার্যকারীতা।”
স্যারের মুখটা ঝকঝক
করছে। শুনেছি
সাফল্যের হাসি এইরকমই হয়।
“ফিজিক্সের
স্টুডেন্ট তুমি, আশা করি ব্যাপারটা বোঝাতে বেশি বেগ পেতে হবে না,” স্যার বলতে
থাকলেন, “সাধারণত আমরা বস্তুর তিনটে ডাইমেনশন বা মাত্রার কথাই বলি — দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতা। কিন্তু এছাড়াও আরও একটা মাত্রা আছে নিশ্চয়ই জান, ফোর্থ ডাইমেনশন বা চতুর্থ
মাত্রা। যাকে
বলে টাইম, সময়।”
“আমি জানি স্যার, আমাদের পড়তে হয়েছে এসব,”
আমি বলি।
“সোম চাইত ফোর্থ ডাইমেনশনকে বদলে দিতে। কোনো বস্তুর আর তিনটি মাত্রাকে — দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা যখন পালটানো সম্ভব তখন চতুর্থটাকেই বা নয় কেন?” স্যার চকচকে চোখে নিজের দাড়িতে
হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন, “ও যখন এই বিষয়ে গবেষণা করতে চায়, আমার ঠিক সায় ছিল না। কিন্তু ওর জিদের কাছে হার মেনে অনুমতি দিই। আমার ল্যাবরেটরিও
ব্যবহার করতে দিই। কিন্তু
ও কতদূর কী করতে পেরেছিল সেটা আমার অজানা। এমনকি
ওর গবেষণার পেপারগুলো পর্যন্ত খুঁজে পাইনি।
আত্মহত্যা করার আগে সব পুড়িয়ে দিয়েছিল। তবে আমার ধারণা
চিন্তাভাবনার স্তরেই রয়ে গেছিল ওর গবেষণা।
বাস্তবে কীভাবে সম্ভব সেটা ও বুঝতে পারেনি।”
বিষণ্ণ মনে বললাম, “ওর কম্পিউটার দেখেছিলেন?
সেখানে কি কিছু পাওয়া যায়নি?”
“উঁহু, হার্ড ডিস্কের পার্টিশন উড়িয়ে লো-লেভেল
ফরম্যাট করে দিয়েছিল যাতে কেউ কখনও কোনও কিছু উদ্ধার না করতে পারে,” ক্যামেরাটার
ওপর পরম মমতায় হাত বুলিয়ে উনি বলতে লাগলেন, “তবে আমার তখনই মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে
আমাকে কাজ করতেই হবে। আমাকে সফল হতেই হবে। সেটাই হবে ওর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য। কিন্তু আমি নিজের কাছেই পরিষ্কার ছিলাম না যে আদৌ এটা সম্ভব কি না। শুধু অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াবার মতো করে ইন্টারনেটে নানান তথ্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে
মাথায় ক্লিক করে গেল আইডিয়াটা।”
“ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলুন স্যার,” আমি
কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ক্যামেরাটার বিশেষত্ব কী?”
“হ্যাঁ, তোমাকে খুলে বলি,” স্যার বলতে
লাগলেন, “আমরা যখন কোনও বস্তুকে দেখি তখন কিন্তু আসলে সেই বস্তুটিকে দেখি না, আমরা
দেখি তার দেহ থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মিকে। এই যে
আমরা মহাকাশে এত কোটি কোটি গ্রহ-নক্ষত্র-উপগ্রহ দেখতে পাই তাদের অনেকেই হয়তো এই
মুহুর্তে আদৌ নেই। ধ্বংস হয়ে গেছে বেশ কিছু বছর, কিংবা যুগ অথবা শতাব্দী
কয়েক আগে। ওরা এতটাই দূরে আছে যে তাদের শরীর থেকে নিঃসৃত-প্রতিফলিত
আলো আমাদের কাছে পৌঁছতে এই সময়টা লাগছে। ধর,
আজ এই মুহুর্তে যদি সূর্য ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলেও আরও আট মিনিট আমাদের চোখের সামনে জ্বলজ্বল
করতে থাকবে। অর্থাৎ, সূর্য থেকে আমাদের কাছে তার আলো পৌঁছতে সময়
লাগে আট মিনিট।”
আমি বলি, “এটা জানি স্যার। কিন্তু এর সঙ্গে ক্যামেরাটার সম্পর্ক কী?”
“বলছি, পুরো ব্যাপারটা শুরু থেকে বুঝিয়ে না
বললে গোটা ব্যাপারটা ধরতে পারবে না,” স্যার খুশি খুশি মুখে বলতে লাগলেন, “তুমি তো
জান, সাধারণ আলো, লেসার রশ্মি, অতিবেগুনি অর্থাৎ আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি এরা সবই আর
কিছুই নয়, ভিন্ন ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ। তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হলে তাদের বর্ণও পাল্টে যায়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি
হবে সেই আলো তত বেশি আশেপাশে ছড়িয়ে না গিয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখে দ্রুত পৌঁছে
যাবে। তুলনায় কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পৌঁছতে সময় বেশি নেবে।”
এগুলো আমার পড়া ছিল স্কুলেই। তাই বুঝতে
অসুবিধা হল না। আমি বললাম, “যেমন দৃশ্যমান রশ্মির মধ্যে লাল আলোর
তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, ৬২০ - ৭৫০ ন্যানোমিটার। আর সবচেয়ে কম হল বেগুনির, ৩৮০ - ৪৫০ ন্যানোমিটার। সেজন্য অনেক দূর থেকে লাল আলো দেখা যায়, আর ঠিক সেই কারণেই বিপদসংকেত হিসেবে লাল
রঙকে ব্যবহার করা যায়।”
“একদম ঠিক!” স্যার পরম উত্সাহের সঙ্গে বলতে থাকলেন, “এখানে মনে রাখতে হবে যে আমাদের
চোখ শুধুমাত্র দৃশ্যমান আলো অর্থাৎ ঐসব বস্তু থেকে নির্গত তড়িচ্চুম্বকীয়
তরঙ্গ যা কিনা ৩৮০
থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের, সেইগুলোকেই দেখতে পায়। কিন্তু ওই বস্তু থেকে আরও কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো যা কিনা আরও দেরিতে এসে পৌঁছায়,
তাকে আমরা মোটেই দেখতে পাই না। তার মানে সূর্য
থেকে আট মিনিটের পরে যে সমস্ত কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে
তাকে যদি কোনওভাবে ধরে ফেলা যায় তাহলে কিন্তু সূর্য ধ্বংস হয়ে যাবার দশ মিনিট, দশ
দিন, দশ বছর এভাবে আরও অনেক অনেক দিন পরেও তাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব!”
“কী বলছেন!” আমি চমকে উঠি, “এটা কি সত্যিই
সম্ভব?”
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট!” স্যার গর্বের হাসি
হেসে বলেন, “সত্যিই এটা সম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই জান যে মৌমাছির মতো অনেক কীটপতঙ্গ
অতিবেগুনি আলো যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৩০০ - ৪০০ ন্যানোমিটার, দেখতে পায়, অথচ মানুষ সেটা
পারে না। ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে ছবি তোলার মতো ক্যামেরা
আছে কিন্তু সেইসব অদৃশ্য অতিক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি যা কিনা অতি সামান্য
দূরত্বকেও, ধর এক সেন্টিমিটার পার করতেও বছরের পর বছর লাগিয়ে দেয়, তাকে ধরে ফেলার মতো
ক্যামেরা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। আর আমার ক্যামেরা সেই অসাধ্যই সাধন করেছে। আজ থেকে দশ বছর
আগের অদৃশ্যমান আলোকরশ্মিকেও ও দেখতে সক্ষম! আর কতটা সময় পিছনে আমি যেতে চাই সেটাও
আমার কম্পিউটারে তৈরি সফটওয়্যার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।”
“ভাবাই যায় না, স্যার!” আমি মন্ত্রমুগ্ধের
মতো বলি, “এটা তো যুগান্তকারী আবিষ্কার! এইভাবে আজ পর্যন্ত কেউ ভাবেনি। আচ্ছা এই
ক্যামেরার সাহায্যে আমরা কি ভবিষ্যতের ঘটনাও দেখতে পারি?”
স্যার উত্তর না দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে
লাগলেন।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বলুন না
স্যার, আপনি কি ভবিষ্যতের ছবিও তুলতে পেরেছেন?”
স্যার উঠে ফের বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি স্যারের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে হতবাক সুরে বলি, “যদি সত্যিই এটা সম্ভব
হয় স্যার, আপনি তো নোবেল পাবেন!”
স্যান্যাল-স্যার বসার ঘরের লাগোয়া কিচেনেটে
রাখা ফ্রিজ থেকে জুসের ক্যান বার করে আমার দিকে পিছন করে দুটো গ্লাসে ঢালতে লাগলেন। আমি মুখটা দেখতে পাচ্ছি না বলে ওঁর অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তাই উত্তেজনায় প্রায় চিত্কার করেই জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, এই টাইমোস্কোপে কি
ভবিষ্যতের ছবিও তুলতে পারা যায়?”
দুটো গ্লাস দু’হাতে নিয়ে উনি উদ্ভাসিত মুখে
আমার দিকে ফিরে নিচের ঠোঁটটা উপরের ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে বললেন, “ইয়েস, মাই বয়! আই
হ্যাভ ডান ইট! ইয়াহ!”
কিছুক্ষণ আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। হাঁ করে চেয়ে রইলাম। স্যার গ্লাসদুটো সেন্টার টেবিলে রেখে সোফায় বসে
আমাকেও বসতে ইঙ্গিত করে বলতে লাগলেন, “হ্যাঁ, এটাও সম্ভব হয়েছে। তবে তার টেকনিকটা একটু আলাদা। তুমি বোধহয় জান,
কোনও বস্তু যদি আলোর গতিতে ছুটতে পারে তবে সে আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। আমিও বিশেষভাবে প্রস্তুত একটা মোটরের সাহায্যে ক্যামেরাটাকে আলোর চেয়েও বেশি
গতিতে ঘুরিয়ে দিই। এতটাই জোরে ঘুরতে থাকে যে তখন সেটা সময়কেও পার করে এগিয়ে যেতে পারে। আগে থেকে প্রোগ্রামিং করে রাখলে আমার টাইমোস্কোপ সেই অবস্থায় ভবিষ্যতের ছবি
আর ভিডিও পর্যন্ত তুলে আনতে পারে।”
“স্যার, আপনি কী বলছেন জানেন? তার মানে তো
আইনস্টাইনের ‘ই
ইজ ইকুয়াল টু এমসি স্কোয়ার’ ফর্মুলাটাই মিথ্যা
প্রমাণিত হয়ে যাবে!” আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠি!
“আজ যেটা অসম্ভব কাল যে সেটা সম্ভব হবে না
সেটা কে বলতে পারে? সক্রেটিসের ঘটনা জানা আছে তো? সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবার অপরাধে
বেচারাকে হেমলক বিষ খেয়ে বেঘোরে মরতে হয়েছিল।” স্যার একটা গ্লাস আমার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “জুসটা খাও। সব দেখাব, কোনও চিন্তা নেই। আর মুখটা বন্ধ
কর, নইলে মাছি ঢুকে যাবে যে!”
কথা বলার মতো অবস্থায় আমি ছিলাম না। সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে গিয়ে মাথাটা ঘুরপাক খেতে লাগল। মনে পড়তে লাগল সোমশুক্লের লিখে যাওয়া প্রতিটি কথা।
স্যার বললেন, “তবে হ্যাঁ, এখানে বসে তুমি
অন্য কোনও জায়গার ছবি তুলতে পারবে না। যে জায়গায়
ক্যামেরাটা থাকবে, শুধুমাত্র সেই জায়গারই ভবিষ্যতের ছবি তুলে আনা সম্ভব।”
কিছুক্ষণ স্যারের মুখের দিকে চেয়ে ওঁর উলটোদিকের
সোফায় আমি হতবুদ্ধির মতো বসে রইলাম। কয়েকমুহূর্ত পর যেন হুঁশ ফিরে পেয়ে আমি সোফা থেকে উঠে
স্যারের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে ডানহাত নামিয়ে ওঁর পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করলাম। স্যার আমাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “সফল হও জীবনে।”
ঠিক এই মুহুর্তে খুব সাবধানে আমার বাঁ হাতটা
পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে সেই পূর্বপরিকল্পিত কাজটা করে ফেললাম।
আমার বেশ তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। নিজের আসনে ফিরে
গিয়ে স্যারের মুখোমুখি বসে জুসের গ্লাসে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বললাম, “আমার একটা
প্রশ্ন ছিল। কাউকে বলিনি এতদিন। আমার ধারণা, সোমও একটা যন্ত্র তৈরি করেছিল। আর তারও নাম ছিল টাইমোস্কোপ। অবিশ্যি তার কথা
ও আর আমি ছাড়া আর কেউ জানত না। গবেষণাটা ও খুব গোপন রেখেছিল। তবে আপনি তো ওর গাইড ছিলেন। আপনি কি সত্যিই
জানতেন না এটার কথা?”
“ওহ্, তুমি জানতে দেখছি,” স্যান্যাল-স্যার
ভ্রূ কুঁচকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে একটা অদ্ভুত হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন,
“অবিশ্যি রুমমেট ছিলে, জানাটাই তো স্বাভাবিক। আমিও তাই কোনও রিস্ক নিইনি। হ্যাঁ, এই সমস্ত চিন্তাভাবনার রসদ আমাকে সোমই দিয়েছে। আমি জানি তুমি যতটা অবাক এই আবিষ্কারের জন্য হয়েছ তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক
হয়েছ এইজন্য যে এগুলো তো সোমশুক্লর করার কথা ছিল। যাক, এখন আর তোমাকে খুলে বলতে কোনও দ্বিধা নেই... ইয়ে তাড়াহুড়ো কোরো না,
আস্তে আস্তে খাও জুসটা। পুরো ব্যাপারটা বলতে একটু সময় তো লাগবেই।”
সান্যাল-স্যার নিজের গ্লাসে চুমুক দিতে
দিতে বলতে লাগলেন, “আসলে সোম গবেষণাটা প্রায় শেষই করে এনেছিল। কিন্তু ভুলটা করল
আমার সাহায্য না নিয়ে একাই সমস্ত ক্রেডিটটা নিতে গিয়ে। আরে, গুরুকে ছাড়া কি এসব সম্ভব ছিল? তুমিই বল।”
আমি জুসে চুমুক দিয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আপনি
আন্দাজ করেছিলেন যে ও এমন একটা আবিষ্কার করতে চলেছে যেটা কিনা নোবেলের দোরগোড়ায়
পৌঁছে দেবে ওকে। আর আপনি সারাজীবন মাথা খুঁড়ে মরলেও তার কাছাকাছি
পৌঁছতে পারবেন না।”
স্যার চোখদুটো ছোটো ছোটো করে আমার দিকে
কুতকুতে দৃষ্টিতে চেয়ে অদ্ভুত একটা হাসি হেসে এক ঢোঁকে নিজের জুসটা পুরো শেষ করে
ফেলে বললেন, “ওহ্! তাহলে তুমি আন্দাজ করে ফেলেছ?”
আমি ধীরেসুস্থে জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে
বললাম, “হ্যাঁ, না পারার কী আছে? টাইমোস্কোপ যার কাছে আছে তার পক্ষে কিছুই অজানা
থাকার নয়।”
“তার মানে?” স্যার একটা হিক্কা তুলে বললেন,
“তুমি কি জান, তোমার গ্লাসে আমি...?”
“অবশ্যই!” আমি স্যারের মুখের কথা ছিনিয়ে
নিয়ে বললাম, “সোম জানত যে আপনি ওকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তারপর আত্মহত্যার কথা
রটিয়ে ওর সমস্ত গবেষণার কাজ চুরি করে নেবেন। পরে
আপনি আমার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে আমাকেও মেরে ফেলার চেষ্টা করবেন। আমি সেটা আন্দাজ করে আপনাকে প্রণাম করতে গিয়ে গ্লাসটা পালটে দেব আর নিজের দেওয়া
বিষ মেশানো জুস খেয়ে আপনি যে মারা যাবেন এসবই গোপন চিঠিতে সোম আমাকে জানিয়ে গিয়েছিল। আমি শুধু অপেক্ষায় ছিলাম আজকের দিনটির।”
হা হা হা করে প্রফেসর অট্টহাস্য করে উঠলেন,
“কিন্তু আমিও যে টাইমোস্কোপ চালিয়ে সেসব দেখে নেব সেটা নিশ্চয়ই সোমশুক্ল জানত না?
আর এবার আমি মোটেই তোমার গ্লাসে বিষ মেশাইনি, বরং নিজের কাছেই সেই বিষাক্ত গ্লাসটা
রেখেছিলাম। কারণ, জানতাম তুমি গ্লাস পালটে নেবে। তাই আমাকে প্রণাম করতে গিয়ে তুমি যখন বাঁহাত দিয়ে গ্লাসদুটো পালটে দিলে সেটা
দেখেও না দেখার ভান করে গেলাম। গ্লাসের পঁচাত্তর শতাংশ তোমার পেটে চলে গেছে। মোটামুটি পঁচাত্তর
থেকে একশ মিলিগ্রাম স্ট্রিকনিন এখন তোমার পেটে। কারও বাপের ক্ষমতা নেই তোমাকে বাঁচাবে।
পোস্টমর্টেম না হলে হার্ট অ্যাটাক, আর হলে
সুইসাইড!”
এই পর্যন্ত বলে প্রফেসর আবার হিক্কা তুলতে
লাগলেন। হাত-পা’গুলো কেমন যেন টানটান করে ছড়িয়ে বসলেন। মুখের একপাশ একটু খিঁচিয়ে আমার হাসি হাসি নির্বিকার মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে
চেঁচিয়ে উঠলেন, “কী ব্যাপার, তোমার ভয় করছে না? আর আমার এরকম অস্বস্তি হচ্ছে কেন?
কী করেছিস তুই?”
আমি গ্লাসের বাকি জুসটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করে
খালি গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে তাকালাম প্রফেসরের দিকে, “স্যার, আপনি এই
ভুলটা কী করে করলেন? আপনি কি জানেন না, সময়ের থেকে আগে এগিয়ে যেতে পারলেও সময়কে পালটানো
সম্ভব নয়? আপনি যেমন ভবিষ্যতকে দেখে নিয়েছেন, সোমও তেমনি নিজের তৈরি টাইমোস্কোপের
সাহায্যে ভবিষ্যতটা দেখে নিয়েছিল। তাই নিজের
মৃত্যুর ঘটনাটা জানা থাকলেও, ও জানত যে সেটা আটকানো সম্ভব নয়। পুলিশও যে আপনাকে ধরতে পারবে না ওর মৃত্যুর জন্য সেটাও আমরা জানতাম। আর আপনার মৃত্যু কীভাবে হবে সেটাও জানা ছিল আমাদের। কোন গ্লাসে আসলে বিষ থাকবে সেটা ও জানত, আর আমাকে সমস্ত লিখে জানিয়ে গিয়েছিল। আপনাকে প্রণাম করার অছিলায় আমার গ্লাসটা পালটাবার কথা ছিল। কিন্তু যেহেতু আপনার গ্লাসেই বিষটা ছিল তাই আমি পিছনে হাত নিয়ে গিয়ে
গ্লাসদুটো একবার নয় দু’বার পালটাপালটি করি। আপনার গ্লাস আপনারই থেকে যায়।”
স্যান্যাল-স্যার বিস্ফারিত চোখে একবার
গ্লাস আর একবার আমার দিকে চেয়ে ক্রমাগত হিক্কা তুলতে লাগলেন। সোফার ওপর ওঁর সমস্ত
শরীরটা ধনুষ্টঙ্কারগ্রস্ত রুগির মতো বেঁকেচুরে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরিয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি
উনি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছেন। তবুও আমার দিকে
আঙুল তুলে উনি বললেন, “তুই, তুই বাঁচবি না। গ্লাসে তোর আর আমার দু’জনেরই হাতের ছাপ আছে... আমাকে
বিষ দেবার জন্য... আমার আবিষ্কার চুরি করার জন্য...”
প্রচন্ড রাগে গা রি রি করে উঠল। দাঁতে দাঁত চেপে
বললাম, “কোন আবিষ্কারের কথা বলছেন, স্যার? সোমশুক্লের সমস্ত গবেষণার
পেপার, ওর তৈরি টাইমোস্কোপ চুরি করে সেটাকে নিজের বলে চালাতে চাইছেন?”
স্যার এখন আর উত্তর দেবার মতো অবস্থায় নেই। মুখের রাগত কঠিন ভাবটা পালটে করুণার হাসি হেসে বুক পকেটের থেকে উঁকি মারা
পেনটায় হাত রেখে বললাম, “স্যার, এটা ক্যামেরা পেন। এখন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যা যা কথাবার্তা হল সমস্ত এতে ভিডিওসুদ্ধু রেকর্ড
করা আছে। সময়কে পুরোপুরি পালটাতে না পারলেও কিছু কিছু তো করাই
যায়, তাই না? আশা করি মরণোত্তর নোবেলটা সোমশুক্ল ভট্টাচার্য্যকেই দেওয়া হবে।”
ল্যাচ-কি দেওয়া দরজাটা টেনে দিয়ে আমি পোর্টিকোর দিকে এগিয়ে গেলাম।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
বেশ ভালো লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ ঝজুদা। প্রাণিত হলাম।
Deleteখুব ভালো লাগল
ReplyDeleteধন্যবাদ। ভাল থাকবেন 💐
Deleteএকটি নিটোল বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প পড়লাম যা লেখক বিষয়বস্তু এবং ভাষার যোগ্য মেলবন্ধনে একটি সুন্দর গল্প লিখেছেন । আমার মতে এই গল্প টি অনেক বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক/ লেখিকার কাছে শিক্ষণীয় এবং ঈর্ষনীয় উদাহরন হয়ে থাক । আমি নিজেও বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখার পাঠ নিচ্ছি। এতি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ। প্রাণিত হলাম
DeleteSundor..
ReplyDeleteথ্যাঙ্কিউ
Deleteবাংলায় বাঙ্গালীদের গল্পে বিঞ্জান খুব ভালো হয়েছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ। ভাল থাকবেন
Delete