টিকটিকি
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
“আপনি এলিয়েনে বিশ্বাস করেন?”
ট্রেনের কামরায় শুয়ে শুয়ে বেশ আরাম করে একটা ইন্টারেস্টিং বই পড়ছিলাম। এইরকম একটা প্রশ্নে চমকে উঠলাম। দেখি আমার উলটোদিকের সিটে বসা লোকটি আমার হাতে ধরা বইটির দিকে ইঙ্গিত করে মুচকি মুচকি হাসছেন। আমিও ভদ্রতা দেখিয়ে হেসে বললাম, “বইটা কিন্তু বেশ মজার।”
“How to spot alien species, বাহ্, বইটার বিষয় সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
“এই বইতে ভিনগ্রহী সম্পর্কে বিভিন্ন দেশবিদেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। তারপর নিজের কিছু মৌলিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।”
“বাহ্, ইন্টারেস্টিং!”
ইতিমধ্যেই গরম গরম স্যুপ চলে এসেছে। ভদ্রলোক স্যুপের কাপে চুমুক দিলেন খুব অদ্ভুতভাবে। আগে বারদুয়েক জিভ ঠেকিয়ে দেখলেন। তারপর চুমুক দিয়ে বার তিনেক আবার জিভ ঠেকালেন। তারপর আমায় বললেন, “ভালো করেছে কিন্তু। খেয়ে দেখতে পারেন।”
আমি মাথা নাড়লাম, “এখানকার খাবার আমার পছন্দ হয় না।”
এরপর আবার ওই বইটার প্রসঙ্গে ফিরে গেলাম।
“বুঝলেন, এই বইতে লিখেছে যে এলিয়েনরা আমাদের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়। তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু আমরা তাদের চিনতেই পারি না। অর্থাৎ তারা নানারকম ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু একটু খেয়াল করলে ঠিকই বোঝা যাবে। যেমন ধরুন, একধরনের এলিয়েন হচ্ছে খুব লম্বা আর দেখতে একদম ফ্যাকাশে সাদা, রক্তশূন্য। এরা খুব জ্ঞানপিপাসু। এদের মেমরি নাকি সাংঘাতিক। ভীষণ বুদ্ধিমান এলিয়েন এরা। এদের বেশিরভাগ সেমিনার, আর কনফারেন্সে দেখতে পাওয়া যায়। এরা বিরক্ত হলে বা ভয় পেলে এদের গায়ের রং আরও ফ্যাকাশে হতে হতে এক্কেবারে কাচের মতো হয়ে যায়। এরা দশ ফুট অবধি লম্বা হতে পারে।
“আবার একরকমের এলিয়েন আছে যারা খুশি হলে তাদের হাইট বেড়ে যায়। চুল বেড়ে যায় দুই ইঞ্চি। এই ছোটোখাটো এলিয়েনরা কারোও কোনও ক্ষতি করে না। এরা আসলে বিভিন্ন গ্রহের দূত হিসেবে কাজ করে, যাতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় থাকে।
“আবার কেউ কেউ দেখবেন সমস্ত কাজে অদ্ভুতরকম পারফেক্ট। চেহারাতেও নাক-চোখ-মুখ-কান সবের মধ্যে কোনও খুঁত নেই মনে হয়, এমন অদ্ভুত সামঞ্জস্য। ঠিক যেন কোনও শিল্পীর হাতে আঁকা। এরা আসলে ক্লোন এবং এইরকম একজনের আদলে তৈরি হাজারজন পাবেন। এদের দেখে যেকোনও সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হবে। এরাও নাকি মানুষের মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
“এছাড়াও আছে শেপ শিফটাররা যারা পরিবেশ অনুযায়ী মানুষ, পশুপাখি এবং জড় পদার্থের রূপও ধারণ করতে পারে। এদেরকে বহুরূপী বলা যায়। এন্ড্রোমেডানদের তো আবার খালি চোখে দেখা যায় না। তারা নাকি খুব সূক্ষ্ম দেহে চলাফেরা করতে পারে এবং তাদের বিশাল স্পেসশিপ স্ট্রাটোস্ফিয়ারে রেখে তারা পৃথিবীর লোকদের ওপরে নজর রাখে। এরা পৃথিবীর পাহারাদার। যে কোনও বাইরের আক্রমণ থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করে।”
“হুম, ভারি বিস্ময়কর ব্যাপার। ভূত, ভগবান আর এলিয়েন। আপনি কি জানেন যে মেসোপটেমিয়ায় যাদের দেবতা বলে মনে করা হত তারা আসলে ভিনগ্রহী। সে ব্যাপারে এই বইতে কিছু লেখেনি?”
“লিখেছে বৈকি। এই তো চ্যাপ্টার
সাঁইত্রিশ। মেসোপটেমিয়ার দেবতারা আসলে নিবিরু গ্রহ থেকে থেকে এসেছিল। ওদের কাজ ছিল সোনা খোঁজা। সোনার খনিতে কাজ করত। তারপর কাজ করতে করতে পৃথিবীর আবহাওয়া ওদের সহ্য হল না। কিছু শ্রমিক মারা গেল। আর কেউ কেউ পৃথিবীতেই পরিবার তৈরি করে থেকে গেল। এইভাবে মানুষের এবং এলিয়েনদের মিশ্রণে এক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হল। এই দেবতাদের নাম ছিল ‘অনুনাকি’।”
“তাহলে এই যে মানুষেরা ঈশ্বর বলে বা দেবতা বলে যাদের মানে তারাও তো এলিয়েন হতে পারে।”
“হতেই পারে। কিন্তু সে বড়ো জটিল বিষয়। সবকিছুই তো আমাদের বিশ্বাস দিয়ে তৈরি। আসল সত্যিটা হয়তো আমরা কখনওই জানব না।”
ভদ্রলোক বললেন, “ঠিক বলেছেন। কে যে উপর থেকে কলকাঠি নেড়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নিৰ্দিষ্ট করছে তা বলা মুশকিল।”
“আপনার নামটা তো জানা হল না?”
“আমার নাম অঞ্জন মিশ্র। আপনার?”
“আমার নাম ঋত্বিকা। ঋত্বিকা সেন,” বলে আমি নিজের পরিচয় সম্পর্কে আর বেশিদূর গেলাম না। কী দরকার গায়ে পড়ে বেশি কিছু বলার।
হঠাৎ গায়ে উড়ে এসে বসল একটা আরশোলা। আমার জন্ম থেকে জানি দুশমন। চিৎকার করে উঠলাম। ভদ্রলোক একটা হাত বাড়িয়ে উড়ন্ত আরশোলাটাকে খপ করে কী করে ধরে ফেললেন জানি না। তারপর একটা কাগজে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। আমি তখন থরহরি কম্পমান অবস্থায়। অঞ্জনবাবু খুব মজার দৃষ্টিতে চোখ নাচিয়ে বললেন, “আরশোলা খেয়েছেন কখনও?”
“ইয়াক, ছিঃ!” আমি ঘেন্নাভরা দৃষ্টিতে তাকালাম।
“সে কী মশাই! কীটপতঙ্গ পৃথিবীর কতগুলো দেশের মানুষদের যে প্রিয় খাবার, তা আপনি জানেন? মেক্সিকো, চিন, ঘানা, থাইল্যান্ড…”
আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম, “আমার রাতের খাবারটা আপনি খেতে পারেন। আমি আর কিছু খাব না আজ।”
অঞ্জনবাবু একটু অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন, “কেন, কীটপতঙ্গ খাওয়ার কথা বললাম, তাই?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না না, তা নয়।” তারপর মজা করে বললাম, “এই যে কীটপতঙ্গ, এরাও কিন্তু এলিয়েন হতে পারে। জানেন কী? মানে, আমি ইনসেক্টয়েডসদের কথা বলছি, সুপার ইন্টেলিজেন্ট বাগস। এই আরশোলার কথাই ধরুন না। তিনশো কুড়ি কোটি বছর, সেই কার্বোনিফেরাস পিরিয়ড থেকে টিকে আছে। এর মাঝে কত প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু আরশোলা থেকে গেছে। মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কোটি বছর পরেও এরা টিকে থাকবে আমার ধারণা। প্রাচীন ইজিপ্টে দেবতা খনুম নাকি আরশোলাদের হাত থেকে মানুষদের রক্ষা করতেন।”
অঞ্জনবাবু বললেন, “ঠিক বলেছেন। আমিও প্রাচীন মিশরের বিষয়ে পড়াশুনো করেছি একটু আধটু। এই খনুম নাকি কুমীরমুখো ছিলেন।”
আমি বললাম, “দেখছেন, কুমীরমুখো! অর্থাৎ এলিয়েন হতেও তো পারেন। পিরামিড যে এলিয়েনদের তৈরি নয়, তাই বা কে বলতে পারে?”
অঞ্জনবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে রাত গড়িয়ে গেল। ট্রেন চলছে ধিকি ধিকি করে ঢিমে গতিতে। কাল সকালেই দিল্লী। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আমি খুব সতর্ক হয়ে বার বার চাদর থেকে মুখ তুলে উঁকি দিচ্ছি। অঞ্জনবাবু খুব মোটা দুটো কম্বল চাপিয়ে দিব্যি ঘুম দিচ্ছেন। ওনার খুব শীত করছিল, তাই একটা এক্সট্রা কম্বল চেয়ে নিলেন। সব হিসেব মিলে যাচ্ছে। যে উদ্দেশ্যে আমার এখানে আসা তা কাল সকালেই সিদ্ধ হবে। কিন্তু এই রাতটা আমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
সকালের আলো ফুটেছে। আমি আমার জায়গা থেকে ধীরে ধীরে অঞ্জনবাবুর বার্থের দিকে গেলাম। আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন অঞ্জনবাবু। আমি আস্তে করে কম্বলটা সরিয়ে ফেললাম। যা ভেবেছিলাম তাই। অঞ্জনবাবু বিছানায় নেই। দিনের আলোয় সরীসৃপরা তাদের আসল রূপে ফিরে আসে। তাড়াতাড়ি আমার ব্যাগ থেকে স্বচ্ছ কৌটোটি বের করে অঞ্জন টিকটিকি মিশ্রকে ভরে ফেললাম তার মধ্যে। এন্ড্রোমেডা স্পেসশিপে বার্তা পাঠালাম - ‘মিশন একমপ্লিশড’।
রেপ্টিলিয়ান ধরা পড়েছে। ওদের গ্রহটা বিপর্যস্ত হয়েছে অনেক আগেই। এরা এখন দলে দলে মানুষের ক্ষতি করে পৃথিবী দখল করার দিকে পা বাড়িয়েছে। আমরা এন্ড্রোমেডানরা এই গ্রহ শুরু থেকে সাজিয়েছি। পৃথিবীর মানুষদের ক্ষতি আমরা কিছুতেই হতে দিতে পারি না। আজ চিফ খুব খুশি হবে আমার ওপরে। ভাগ্যিস টেলিপ্যাথি ব্লক করার পদ্ধতি আয়ত্ত করে ফেলেছি। নইলে ওই সরীসৃপ কাল রাতেই আমার মনোভাব টের পেয়ে যেত। ট্রেন এখন রাজধানী পৌঁছল। চারিদিকে মানুষের ভিড়। আমার শরীরটা ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল।
_____
অলঙ্করণঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteচমৎকার 😂
ReplyDeleteভালো লাগল। নতুন স্বাদের।
ReplyDeleteDarun...
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগলো মতামত জেনে :)
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDeleteকিশোরদের জন্য আদর্শ কল্পবিজ্ঞানের গল্প।
ReplyDeleteদারুণ দারুণ। একদম জমজমাট।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ খুব উৎসাহ পেলাম আপনাদের কথায়। :)
ReplyDeleteব্যাপক লাগল!
ReplyDeletedhanyobad :D
ReplyDeleteDaruN!! Dwaita aro ekbar tor talent er porichoy pelam! Awesome!
ReplyDeleteদুরন্ত !! খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteবেশ ভালো।
ReplyDeleteবেশ ভালো লাগল। শেষের ঝাঁকুনিটাও বেশ! এলিয়েনদের নিয়ে গল্পচ্ছলে বেশ জানয়াও যায়, আকর্ষণ জাগে আর একটু জানার। আর হ্যাঁ, সঙ্গের আঁকাটিও খুবই নজরকাড়া।
ReplyDeleteশাশ্বত কর
দারুন!
ReplyDeleteদুর্দান্ত!!!
ReplyDeleteআমার প্রিয় সাহিত্যিকদের কাছ থেকে এইরকম মতামত পেয়ে আমি যারপরনাই খুশি।
ReplyDeleteগল্পটি গতানুগতিক কল্পবিজ্ঞানের গল্প থেকে অন্য জাতের যা সব বয়সি মানুষের যোগ্য,পড়ে মনে হতেই পারে কোনো এন্ড্রোমেন্ডনই লিখেছেন গল্পটি । খটকা টা শেষ প্যারার আগের প্যারাতে । "আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছেন অঞ্জনবাবু। আমি আস্তে করে কম্বলটা সরিয়ে ফেললাম। যা ভেবেছিলাম তাই। অঞ্জনবাবু বিছানায় নেই।" যদি অঞ্জনবাবু টিকটিকি হয়ে ঘুমোচ্ছেন তবে উনি বিছানায় কেন নেই? আর ওনার সাইজ তাহলে আগের মতই আছে আর সেইটাই এই প্যারার প্রথম লাইনটা বলছে? অত বড় সাইজের বোতল কই? না থাকলে বুঝে নিতে হবে যে এন্ড্রোমেন্ডন হয় টিকটিকটা কে ছোটো করে দিয়েছে আর নয়ত বোতল টা ছোটো ছিল কিন্তু টিকটিকিটাকে রাখার জন্য বড় হয়ে গেল। কিন্তু এত স্বাধীনতা কি পাঠকের আছে? লেখিকা কি বলেন?
ReplyDeleteঠিক বলেছেন। তবে এই গল্পে উল্লেখ করেছি যে সরীসৃপ- দিনের
Deleteআলো গায়ে পড়তেই তাদের আসল রূপে ফিরে আসে। আর কম্বল সরাতেই সেই তাৎক্ষণিক পরিবর্তন হয়েছে। আর টিকটিকি সাধারণ টিকটিকির সাইজের আমি কল্পনা করেছি। তাই তাকে স্বচ্ছ পাত্রে বন্দী করা গেলো। তবে পাঠকদের কল্পনার একটু জায়গা আমি রাখতে চেয়েছি অবশ্যই।
ভারী সুন্দর হয়েছে গল্পটি। প্রায় আপাদমস্তক প্রেডিকটেবল হওয়া সত্ত্বেও যে সমস্ত তথ্য দিয়ে ঠাসা হয়েছে এই ছোট্ট গল্পটি তা এক পরম পাওয়া। এতটুকু গল্প লিখতেও যে-লেখক পড়াশোনা করেন, তাঁকে কুর্ণিশ।
ReplyDeleteবেশ জমেছে গল্পটা। ভাল লাগল পড়ে।
ReplyDeleteThanks :) matamat peye khub bhalo laaglo
Deleteজমাটি, শেষের চমকটা ভাল, কিন্তু বড্ড কল্পনানির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক কি একটাও লেখা নেই?
ReplyDeleteanek dhanyobad :) sampurno bigyanbhittik lekha hayto ei sankhyay paabenna kalpona aar bigyan mishiye lekha anek galpoi paaben...anyo galpo gulou pore dekhben
Delete