মান
ঋজু
গাঙ্গুলী
রঞ্জনদের
বসার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রোদের রং কমলা হয়ে যাওয়া দেখছিলাম আমি। ঘরে এই
মুহূর্তে মনোজদা, রিনি, অপু, আর রঞ্জনের মধ্যে তুমুল তর্ক চলছিল এটার ফয়সলা করার
জন্য যে মানুষকে অমানুষ বা না-মানুষের থেকে আলাদা করা যায় কী দিয়ে। আমাদের আসরের
হোস্ট, মানে রঞ্জনের দাদু আলোচনাটা উপভোগ করছিলেন। কিন্তু আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।
একটু
পরেই সন্ধে হবে। পড়তে বসতে হবে। তার আগে তর্ক নয়, মন একটা গল্প চাইছিল। ঠিক তখনই
কথাটা শুনতে পেলাম আমরা সবাই।
“মন
নয়, বোধ বা হুঁশও নয়,” দরজায় দাঁড়িয়ে নিচু অথচ স্পষ্ট গলায় বললেন সরকারজেঠু, “আমার
মতে মানুষ আর অমানুষের তফাৎ করে দেয় মান।”
সরকারজেঠু
হলেন রঞ্জনের বাবা রণজেঠুর বন্ধু। সেনাবাহিনী
থেকে অবসরপ্রাপ্ত মানুষটি রঞ্জনদের বসার ঘরে আমাদের আসরে কালেভদ্রে হাজির হন। এলেও
কফি খাওয়া, সহাস্যে জগৎসংসারের যাবতীয় বিষয় নিয়ে আমাদের কথা আর আলোচনা শোনা এবং
শেষে দাদুর দিকে মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে বেরিয়ে যাওয়াই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তবে কখনও কখনও
তিনি মুখ খোলেন। আর সেই দিনগুলোয় আমরা এমন কিছু ঘটনা সম্বন্ধে জানতে পারি, যেগুলো
অবিশ্বাস্য হলেও কেন জানি না, কিছুতেই অবিশ্বাস করতে পারি না।
রঞ্জন
অন্দরমহলে জেঠুর আগমনী শুনিয়ে দিয়েছিল। জেঠুর জন্য কফি, আর আমাদের জন্য চা নিয়ে
কাকিমা একটু পরেই হাজির হলেন। ততক্ষণে জেঠুর চারপাশে আমরা মোটামুটি গোল হয়ে পজিশন নিয়েছিলাম।
কাকিমাও গল্পের গন্ধ পেয়ে আর দেরি না করে বসে পড়লেন দাদুর পাশেই।
কফির
কাপে চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন জেঠু।
“২০০৪-এর
ভারত মহাসাগরীয় ভূমিকম্প, যাকে আমরা সহজ ভাষায় তার সবচেয়ে বড়ো ফল ‘সুনামি’ বলেই
মনে রেখেছি, তাতে আন্দামান ও নিকোবর যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার ঠিকঠাক হিসেব
কখনওই মানুষের সামনে আসেনি। কিন্তু আমরা যারা সেই সময় ওই এলাকায় ছিলাম, তারা জানি,
কত দ্বীপ থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে গেছিল ওই রাক্ষুসে ঢেউয়ের সামনে, কত মিষ্টি জলের
হ্রদ হয়ে গেছিল সমুদ্রের খাঁড়ি।
“আমি
যে ঘটনার কথা বলছি, তার সূত্রপাত হয় এর কিছুদিন পর যখন রুটিন সর্টিতে বেরোনো
আমাদের একটা হেলিকপ্টার নর্থ সেন্টিনেলিজ
আইল্যান্ডের কাছাকাছি এসে ডিসট্রেস সিগনাল তুলে এবং ভাঙাচোরা কিছু বার্তা পাঠিয়ে
স্ক্রিন থেকে হারিয়ে যায়।
“কয়েকদিন
আগে হওয়া একটা বিরাট সোলার ফ্লেয়ারের ধাক্কায় আমাদের স্যাটেলাইট-নির্ভর চোখ আর কানগুলো
তখন অনেকটাই কমজোরি। তাই বহু চেষ্টাতেও চপারটার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
“আমাদের
বেশি চিন্তিত করেছিল অন্য একটা জিনিস।
“প্লেনটা
যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল সেটা সেন্টিনেলিজদের এলাকা। আজও আধুনিক পৃথিবীর ধরাছোঁয়ার
বাইরেই থেকে গেছে এরা। সুনামির পরে ওদের দ্বীপে জিনিসপত্র
আর ওষুধ নিয়ে আমাদের চপার পৌঁছনোর চেষ্টা করেও তির আর পাথরের মুখে পিছিয়ে আসে।
ভয়ে নয়, মানুষগুলোর স্বাধীনতাবোধকে সম্মান জানিয়ে। কিন্তু আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে
পারছিলাম না, হেলিকপ্টারটার কী হয়ে থাকতে পারে।
“ওই
এলাকার আকাশে এমন কিছুই ছিল না যা একটা চপারকে আঘাত করতে পারে বা ডুবিয়ে দিতে
পারে। তাছাড়া, সেন্টিনেলিজদের কাছে অস্ত্র বলতে থাকে স্রেফ তির আর পাথর। একটা ‘মিল’,
মানে যে মাল্টিপারপাস চপারটা সেদিন উড়ছিল, ওসবের পরোয়াই করে না।
“তাহলে
চপারটার কী হয়েছে?
“ইউনিফায়েড
আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর কম্যান্ডকে ব্যাপারটা জানানোর পর ঝটপট অর্ডার আসে, একটা
ছোটো দল রেকি করার জন্য ওই দ্বীপের কাছে যাবে।
“যদি
চপারটা জলে পড়ে গিয়ে থাকে বা নামতে বাধ্য হয়ে থাকে, তাহলে পাইলটকে উদ্ধার করাই হবে
প্রথম কাজ। বাকিটা পরে দেখা যাবে। যদি এমন বোঝা যায় যে চপারটা দ্বীপে ক্র্যাশ
ল্যান্ড করেছে, তাহলে এটা ধরে নিতে হবে যে পাইলট বেঁচে আছে, আর দ্বীপে নামার
চেষ্টা করতে হবে তাকে উদ্ধার করার জন্য।
“সেন্টিনেলিজদের
সঙ্গে সংঘাতের সম্ভাবনা কমানোর জন্য দলে ছিলাম মাত্র চারজন - আমি, ক্যাপ্টেন বিস্ত,
মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে মেজর পান্ধে, আর চিফ পেটি অফিসার নৌশাদ। রাতের অন্ধকারে
দ্বীপটার কাছে গেলে আমাদের শত্রু ছাড়া আর কিছু ভাববে না সেন্টিনেলিজরা।
তাই আমরা প্রথমে ঠিক করেছিলাম, দিনের বেলায় যাব। কিন্তু হেলিকপ্টারের চালক হয়তো
আহত হয়েছে, আর এই অবস্থায় তার কাছে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। আমাদের কাছে এক জওয়ানের
প্রাণের মূল্য সবচেয়ে বেশি। তাই শেষ
অবধি আমরা সেই রাতেই একটা স্পিড-বোট নিয়ে রওনা হলাম ওই দ্বীপের দিকে।”
“যে
দ্বীপটার কথা বলছেন, সেটা কতটা দূরে ছিল জেঠু?” জানতে চায় রঞ্জন।
“পোর্ট
ব্লেয়ার থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রায় চৌকো আকারের ষাট বর্গ
কিলোমিটার আয়তনের নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ড কাগজে কলমে সাউথ আন্দামান
ডিস্ট্রিক্টের অংশ হলেও প্রায় স্বাধীন দেশ।” একটা বড়ো
শ্বাস ফেলে বলেন জেঠু।
“১৯৯৭-এর
পর, এমনকি অ্যানথ্রপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া থেকেও কেউ ওই দ্বীপে পা রাখেনি। ভারত
সরকার ওই দ্বীপের আশেপাশে তিন নটিক্যাল মাইল, মানে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটারের কিছুটা
বেশি এলাকা ওই জন্যই এক্সক্লুশন জোন হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে যাতে সেখানে কেউ
ঢুকতে না পারে।”
সবাই
চুপ করে থাকায় আবার কথা শুরু করেন জেঠু।
“ভাঙা
চাঁদের আলোয় নৌশাদের স্টেডি হাত আমাদের স্পিড-বোটটাকে ঝড়ের বেগে ছুটিয়ে নিচ্ছিল
দ্বীপের দিকে। আমি অবশ্য ভাবছিলাম সেন্টিনেলিজদের কথা।”
“ওরাও
কি জারাওয়াদের মতো একটা হিংস্র ট্রাইব?” মাত্র কিছুদিন আগেই পড়া ‘সবুজ দ্বীপের
রাজা’ থেকে জানা তথ্যের জোরে প্রশ্নটা করি আমি।
মৃদু
হেসে বলেন জেঠু, “একসময় লোকে ওদের নিয়ে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর কথা ভাবত ঠিকই, তবে এখন জারাওয়াদের
সেই স্বাতন্ত্র্য আর নেই। কিন্তু সেন্টিনেলিজরা রয়ে গেছে এক্কেবারে আলাদা, নিজের
মতো, স্বাধীন হয়ে। সেন্টিনেলিজদের সংস্কৃতি এখনও আদিম হান্টার-গ্যাদারার স্তরের,
এমনটাই মনে করা হয়। ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব তো দূরের কথা, আলাপ-পরিচয় করার যাবতীয়
চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীন ভারতে ডাইরেক্টর অফ ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার, মেজর
টি.এন.পণ্ডিত সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে খুব একটা ফল পাননি।
“১৯৭৪
সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একদল অ্যানথ্রপলজিস্টদের নেতৃত্বে ওই দ্বীপে গিয়ে
‘ম্যান ইন সার্চ অফ ম্যান’ নামক একটা ডকুমেন্টারি বানানোর চেষ্টাও সম্পূর্ণ ব্যর্থ
হয়।”
“আচ্ছা,
জেঠু,” প্রশ্নটা করে রঞ্জন, “আমার যদি খেতে ইচ্ছে না করে তাহলে অনেক সময় মা আমাকে
জোর করে খাওয়ায়। সেরকমভাবেই ভালো করতে চেয়ে জোর করে সেন্টিনেলিজদের সঙ্গে কখনও
যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়নি?”
“বিস্তর
হয়েছে,” তেতো মুখে বলেন জেঠু, “এই ভালো করতে চেয়েই তো একসময়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য
আর স্বাধীনতার গর্বে প্রবল প্রতাপশালী ব্রিটিশ বা জাপানিদের দূরে ঠেকিয়ে রাখা জারাওয়াদের
অসুখে এবং খারাপ অভ্যাস ধরিয়ে প্রায় শেষ করে দিয়েছি আমরা, মানে স্বাধীন ভারতের
প্রশাসক আর ট্যুরিস্টরা। তবে সেন্টিনেলিজদের স্বাধীনতাপ্রীতি বোধহয় যুগে যুগে এই
অঞ্চলের সবার সম্ভ্রম তৈরি করেছে। তাই শ্রীবিজয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান
চালানো রাজেন্দ্র চোল হোক, বা নৌবহর দিয়ে এলাকায় মারাঠা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা
কাহ্নোজি আংরে, এই বিশেষ দ্বীপটায় এঁদের কেউই ঘাঁটি বানাতে চায়নি।”
“এখনও
পৃথিবী থেকে এরা এতটাই আলাদা হয়ে আছে?” সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে রিনি, “কিন্তু
কীভাবে?”
“অন্য
উপজাতির লোকেরা কখনও ওই দ্বীপে বসতি করতে চায়নি?” প্রশ্নটা তোলে মনোজদা।
“সেন্টিনেলিজদের
আপোষহীন স্বাধীনতাপ্রীতি আর টেরিটোরিয়াল স্বভাব অন্য কোনও উপজাতিকে ওই এলাকায়
ঢুকতে দেয়নি। একই কারণে ওরাও থেকে গেছিল বাকি
পৃথিবীর থেকে একেবারে আলাদা, সম্পূর্ণ স্বাধীন,” গম্ভীর মুখে বলেন জেঠু, “তাই
দ্বীপের যত কাছে আমরা এগিয়ে আসছিলাম সেই রাতে, ততই নিজের দেশের একদল শিশুর মতো সরল,
স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলতে হতে পারে ভেবে মনটা ভারী হয়ে উঠছিল।”
কিছুক্ষণ
চুপ করে ছিলেন জেঠু। বোধহয় একটু অধৈর্য হয়েই এবার মন্তব্য করলেন কাকিমা, “আপনারা
তারপর কী করলেন, সরকারদা?”
আবার
কথা শুরু করলেন জেঠু, “ঘন জঙ্গলে ঢাকা নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডের চারপাশে রয়েছে
প্রবালের একটা প্রাচীর বা কোরাল রিফ,” বলে চলেন জেঠু, “আগে সেগুলো জলের তলায় থাকত
বলে জাহাজডুবির ঘটনাও ঘটেছে ওখানে।”
“২০০৪-এর
সামুদ্রিক ভূমিকম্প, মানে সুনামির পর ওই দ্বীপের ঠিক নিচের টেকটনিক প্লেট প্রায় এক
থেকে দুই মিটার উঠে এসেছিল। এর ফলে শুধু যে এই কোরাল রিফ জলের ওপর পাকাপোক্তভাবে
উঠে এসেছিল তাই নয়, সেটাকে দ্বীপের থেকে আলাদা করার মতো জল সরে জায়গাটা শুকনো হয়ে
গিয়ে বা অগভীর জলাশয় তৈরি হয়ে গিয়ে পশ্চিম আর দক্ষিণে দ্বীপের সীমানা বেড়ে গেছিল
প্রায় এক কিলোমিটার করে।
“সব
থেকে বড়ো কথা, নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডের দক্ষিণপূর্ব কোণ থেকে প্রায় ছ’শো
মিটার দূরে রিফের একেবারে প্রান্তে থাকা একটা আলাদা দ্বীপ, কন্সট্যান্স আইলেট, ওই
ঘটনার পর মূল দ্বীপের সঙ্গে জুড়ে গেছিল। আমাদের টার্গেট ছিল কন্সট্যান্স আইলেটের
কাছে পৌঁছনো।
“প্রবাল
প্রাচীরের থেকে বেশ কিছুটা দূরে থাকার সময়েই ইঞ্জিন বন্ধ করে স্রেফ দুলিয়ে আর
ভাসিয়ে দ্বীপটাকে এক চক্কর দিয়েছিলাম আমরা। কোনওরকম মেটাল বা তেলের চিহ্ন, মানে
একটা এয়ারক্র্যাফট জলে পড়লে যা যা দেখা যায়, তার কিছুই আমাদের নজরে পড়েনি। সেটা
রেডিওর মাধ্যমে জানাতে গিয়েই বুঝতে পারলাম, রেডিও কাজ করছে না।
“শুধু
রেডিও নয়, আমরা দেখলাম যে আমাদের সঙ্গে থাকা ইলেকট্রনিক্স-নির্ভর প্রায় সবকিছু
অকেজো হয়ে গেছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলে আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন যদি বৈঠার
সাহায্যে বোটটাকে দূরে নিয়ে গিয়ে বেসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, তাহলে আরও
সময় নষ্ট হবে। সেই তুলনায় যেহেতু আমাদের কাছে এ-বিষয়ে স্পষ্ট আদেশ আছেই, দেরি না
করে দ্বীপে নামার চেষ্টা করাই হবে একমাত্র কর্তব্য। যথাসম্ভব কম আওয়াজ করে তীরের
কাছে এলাম আমরা।
“নৌশাদকে
বোটে রেখে এবং বেসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমরা
তিনজন যথাসম্ভব নিঃশব্দে তীরে এসে পৌঁছলাম। রেকির
অভিজ্ঞতা অল্পবিস্তর আমাদের সবার ছিল, এমনকি মেজর পান্ধেরও। শত্রুর এলাকায়
ঢোকামাত্র আমাদের সবার সেন্স যেটা খুঁজছিল সেটা হল, আমাদের দিকে কেউ লক্ষ করছে কি
না। আশ্চর্য করে দেওয়ার মতো ব্যাপার হল, সেই জায়গাটাতেই আমরা কিচ্ছু টের পাচ্ছিলাম
না।
“বিস্ত
আমার দিকে ইশারা করে বোঝাল, ও নিশ্চিত যে আমাদের কেউ দেখেনি, যেটা নর্থ
সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডের ইতিহাস অনুযায়ী স্রেফ অসম্ভব!
“কনস্ট্যান্স
আইলেট খুব ছোট্ট জায়গা। তাই কিছুক্ষণ পরেই আমরা এসে পৌঁছলাম
গাছের ভিড়ের মধ্যে একটুকরো ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই দেখতে পেলাম চপারটাকে।”
জল
খাওয়ার জন্য থামলেন জেঠু। আমরা কেউ নিজের জায়গা ছেড়ে নড়লাম না। ঘরে ঘনিয়ে ওঠা
অন্ধকারটাকে ‘দূর হটো’ বলার জন্য লাইটগুলো কখন জ্বলে উঠেছে, খেয়ালও করিনি। কিন্তু
এখন একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়া এই ঘরে ভেসে এল পাশের বাড়ির টিভি থেকে মেগাসিরিয়ালের
ঘ্যানঘেনে মিউজিক। আড়চোখে ঘড়িটা দেখে নিলাম আমি। সাতটার মধ্যে বাড়িতে ঢুকে পড়তে না
বসলে মা একদম করালবদনা হয়ে যাবে। কিন্তু
জেঠুকে তাড়া দেওয়ার মতো মহাপাপ আমি কিছুতেই করতে পারব না!
আবার
কথা শুরু করলেন জেঠু।
“হেলিকপ্টারের
পাশেই একটা গাছের ছায়ায় সযত্নে শোয়ানো ছিল চালকের শরীরটা। আমি আর বিস্ত কিছু বলার
আগেই পান্ধে ছুটে গেলেন তার কাছে। আমরা গাছের আড়ালে থেকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে আশেপাশে
লক্ষ রাখার চেষ্টা করছিলাম। তবে রাতের
জঙ্গল, আর সমুদ্রের কাছে থাকা একটা জায়গার স্বাভাবিক দৃশ্য আর শব্দ ছাড়া কেউ বা
কিছুই চোখে বা কানে ধরা পড়ছিল না। কিছুক্ষণ পরে পান্ধে একটা বড়ো শ্বাস ফেলে উঠে
দাঁড়ালেন। দুঃসংবাদের আশঙ্কাই করছিলাম আমরা। কিন্তু
ছেঁড়া ছেঁড়া ছায়ার মধ্যে ভাঙা চাঁদের আলোতেও পান্ধের হাসিমুখ বেশ স্পষ্টভাবেই
দেখতে পেলাম। ওই হাসির মধ্যে কিছুটা ভরসা লুকিয়ে ছিল বলে এবার আমরা দু’জনেই এগিয়ে
গেলাম সেদিকে।
“পান্ধে
বললেন, ‘ও সুস্থ। ঘুমোচ্ছে। কোথাও চোট লেগেছে কি না সেটা আরও খুঁটিয়ে না দেখলে
নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না। তবে যা
বুঝছি তাতে ও একদম ঠিক আছে।’
“বিস্ত
আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। ওর শরীরের ভাষা স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল, আমাদের ম্যানডেট
অনুযায়ী এখানেই আমাদের এক্সপ্লোরেশন সমাপ্ত করে ফিরে যাওয়া উচিত। আমিও
সেটাই চাইছিলাম, কিন্তু একটাই প্রশ্ন মাথায় খোঁচাচ্ছিল। চপারটা, অন্তত বাইরে থেকে
দেখলে অক্ষত ছিল। চালকও। আবার আশেপাশের গাছপালা বা মাটিতে এমন কোনও চিহ্নও ছিল না
যা থেকে মনে হয় যে একটা বিপন্ন হেলিকপ্টার এখানে ক্র্যাশ-ল্যান্ডিং করতে বাধ্য
হয়েছে। অর্থাৎ, চপারের চালক এখানে হয় নিজে থেকেই নেমেছে, যা তার করার কথাই নয়,
নয়তো তাকে যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে গাইড করে এখানে নামানো হয়েছে। সেটা কীভাবে হল?
চালককে ঘুমই বা পাড়াল কে?
“আমার
বক্তব্য বিস্ত আর পান্ধেকে বুঝিয়ে বললাম। ওরা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝল। আমাদের
অজ্ঞাতসারে কোনও বিদেশি শক্তি বা সন্ত্রাসবাদীরা এখানে ক্যাম্প বানিয়েছে কি না
সেটা এখনই নিশ্চিত করা দরকার।
“ঠিক
হল, চালককে নিয়ে মেজর পান্ধে ফিরে যাবেন বোটে। তারপর নৌশাদ আর তিনি চেষ্টা করবেন
এই অব্যাখ্যাত রেডিও সাইলেন্স জোনের বাইরে বেরোলেই বেসকে খবর দিতে। ইতিমধ্যে আমি
আর বিস্ত চেষ্টা করব মূল দ্বীপের ভেতরদিকে যাওয়ার। যদি বেসের সঙ্গে যোগাযোগ করা
যায়, তাহলে সাহায্য চেয়ে পাঠাতে হবে যাতে কপ্টারের চালককে সবচেয়ে কাছের হসপিটালে
নিয়ে যাওয়া যায়। দু’ঘন্টার মধ্যে যদি আমরা তীরে এসে না পৌঁছই, তাহলে বেসকে সেটা
জানাতে হবে। তার আগে নয়, কারণ নিজেদের দেশের ভেতরে আমরা কোনও ইনসিডেন্ট তৈরি করতে
চাইছিলাম না।”
“কিন্তু
সরকার,” এবার দাদু প্রশ্নটা তোলেন, “ষাট বর্গ কিলোমিটার তো নেহাত কম জায়গা নয়। তোমরা
দু’জন সেটা খুঁজে দেখার জন্য, তাও আবার ঠিক কী খুঁজছ সেটা না জেনেই এই দু’ঘন্টার
ব্যাপারটা কীভাবে ঠিক করলে?”
“ব্রিলিয়ান্ট
কোশ্চেন!” জেঠুর মুখে একটা সত্যিকারের উষ্ণ হাসি ফুটে ওঠে এবার।
“স্যাটেলাইট
থেকে দেখা ছবি অনুযায়ী মূল দ্বীপের বালিয়াড়ি ছাড়ালেই যে গভীর জঙ্গল, মানে গাছে
ঢাকা জমিটা শুরু হবে সেটা একদম ফ্ল্যাট নয়। একটু একটু করে উঁচু হয়ে গেছে মাটিটা,
যাতে দ্বীপের মাঝামাঝি জায়গাটা হয়ে উঠেছে প্রায় একশো বাইশ মিটার উঁচু। অবিশ্রান্ত
তির আর পাথরের মধ্যেও একটা খুব লো-অলটিট্যুড রান সেরে আমাদের একটা সিকরস্কি
দ্বীপটার যে ফটোগুলো তুলে এনেছিল, তাদের থেকে জানা গেছিল, ঘন গাছে ঢাকা হলেও ওই
জায়গাটায় রয়েছে একটা লেক। আমরা ঠিক করেছিলাম, ওই লেকের দিকে এগোব, কারণ দ্বীপে যে
ক’জন মানুষই থাকুক না কেন জল এবং মাছের জন্য তাদের বা এই দ্বীপে বাইরে থেকে এসে
আস্তানা গাড়া হানাদারদের ওই লেকের কাছে আসতেই হবে।
“দ্বীপের
এই অংশটা, যে কোনও কারণেই হোক না কেন সম্পূর্ণ জনহীন হয়ে গেছে, এমনটাই মনে হচ্ছিল।
তবুও কোনও ঝুঁকি না নিয়ে আমরা যতটা সম্ভব কম আওয়াজ করে কিছুটা ঘুরপথে এগোতে শুরু
করলাম কন্সট্যান্স আইলেট ছাড়িয়ে মূল দ্বীপের দিকে।
“কোরাল
রিফের জায়গাটা পার হওয়ার সময় খোলা আকাশের নিচ দিয়েই আমাদের দৌড়তে হচ্ছিল।
কিন্তু তখনও আমাদের নজর ছিল মূলত পায়ের কাছে ধ্বংসস্তূপের মতো করে ছড়িয়ে থাকা
ধারালো প্রবালের দিকে, যেখানে অসতর্কভাবে পড়ে গেলেই একটা বড়োরকমের চোট লাগা
নিশ্চিত।
“ভাবছিলাম, যে জায়গাটা ছিল এই দ্বীপের বাসিন্দাদের খাবারের
সবচেয়ে বড়ো উৎস, সেটার এমন বিপর্যয়ের পরেও লোকগুলো কীভাবে সবার থেকে আলাদা হয়ে
বাঁচতে পারছে?
“তবে এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমরা চলার বেগ কমাইনি। মাথার মধ্যে
থাকা ঘড়িটা টিকটক করে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, যা দেখার তা দেখে তীরে ফিরে আসার জন্য
আমাদের হাতে সময় কমে আসছে। চাঁদের আলোয় ধবধবে সাদা বালিয়াড়ি পেরিয়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে
ঢোকামাত্র ঘটনাটা ঘটল।
“আমি আর বিস্ত দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলাম। কারণ, আমাদের কেন যেন
খুব ঘুম পেতে শুরু করেছিল। আমার যে পেয়েছে সেটা তো নিজেই বুঝেছিলাম। বিস্তকে সজোরে মাথা
ঝাঁকাতে দেখে বুঝলাম ওরও একই অবস্থা। তারপরেই মাথায় ভেসে এল একটা আশ্চর্য ছবি। দেখতে পেলাম, আমি
আর বিস্ত হেঁটে যাচ্ছি পেছন ফিরে, যেখান থেকে এসেছিলাম সেদিকেই।
“এবারও যে এটা আমাদের দু’জনের সঙ্গেই হয়েছে সেটা বুঝতে সময়
লাগল না। আমি বুঝতে পারলাম, ভাষায় না হলেও ছবির মাধ্যমে আমাদের একটা খুব স্পষ্ট
বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
“এবার বিস্ত বলে উঠল, ‘আমাদের ফিরে যেতে বলছে কেউ, কিন্তু
এখন ফেরার প্রশ্নই ওঠে না।’
“আমিও একমত হলাম। নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডের বুকে
টেলিপ্যাথির মাধ্যমে আমাদের কাছে এমন বার্তা যে পৌঁছে দিতে পারে, তার সঙ্গে একবার
সামনাসামনি আলাপ না করে ফিরে যাওয়া যায় নাকি? ঠিক করলাম, যার আঙুল আমাদের মনের মধ্যে পৌঁছে গেছে, তার
কাছেও কিছু বার্তা ছবির মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া দরকার। আমি খুব সচেতনভাবে আমাদের
চালকের ঘুমন্ত অবস্থার ফটোটা মনে ফুটিয়ে তুললাম। তারপর, অবাক হলে যা যা আমার মনে
হয় সেই সবক’টা অনুভূতি মনে আসতে দিলাম।
“কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আশপাশ থেকে আসা খস খস শব্দে
বুঝলাম, আমাদের ঘিরে ফেলছে সেন্টিনেলিজরা। এত আওয়াজ শোনার সুযোগ আমাদের পাওয়ার
কথাই নয়, বরং তার আগেই একঝাঁক তির বা পাথর ছুটে আসার কথা আমাদের দিকে। কিন্তু
সেগুলো কিছুই হল না। এও বুঝলাম,
আমাদের ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে গেছে।
“সেই প্রথম সামনে থেকে দেখলাম সেন্টিনেলিজদের। লম্বায় ওরা পাঁচ ফুটের একটু বেশিই হবে। অন্ধকারে
বোঝা না গেলেও জানতাম, নেগ্রিটো বলতে যাদের বলা হয় তাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যই ওদের
মধ্যে দেখতে পাব। যেমন গায়ের কালচে রং, মাথার কোঁকড়ানো চুল ইত্যাদি। তবে
ওসবের থেকে আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল একটাই জিনিস, ওদের হাতে ধরা ধনুক, যাতে তখনও বন্দি হয়ে আছে একেকটা তির,
যারা সুযোগ পেলেই আমাদের দিকে ছুটে আসবে আমাদের হাতের অস্ত্র ওপরদিকে ওঠার আগেই।
“একটু পরেই ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি একটু সহজ হয়ে এল। মনে হল,
হয়তো ওদের কাছেও কোনও বার্তা এসে পৌঁছল এটা বুঝিয়ে, যে আমরা এই দ্বীপে ওদের শত্রু
হয়ে আসিনি।
“ইশারা করল একজন। ওই সংকেত বোঝার জন্য অস্ত্র লাগে না। হাতের অস্ত্র কোমরে গুঁজে আমরা হাঁটা লাগালাম নির্দেশিত
পথে।
“পায়ের নিচের মাটিটা ওপরদিকে উঠতে শুরু করল একটু পরেই।
বুঝতে পারলাম, আমরা যাচ্ছি সেই লেকের দিকেই যেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করে আমরা
কনস্ট্যান্স ছেড়ে এদিকে এসেছিলাম।
“বেশ কিছুক্ষণ পরেই আমরা এসে পৌঁছলাম লেকের কাছে। লেকটার
ধারে প্রায় জনা তিরিশেক নারী-পুরুষ খুব মন দিয়ে একটা লম্বাটে জিনিসের কাছে কিছু
করছিল।
“এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমার দম আটকে গেল যা দেখে তা ছিল
লেকের ধারেই কিছুটা মাটিতে আর কিছুটা জলে। প্রথম দর্শনে প্রাণীটিকে দেখে অক্টোপাস বলেই মনে হয়। কিন্তু
তারপর ভয়ে বুকের খাঁচার মধ্যেই প্রায় লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ একটু একটু
করে ফিরে এলে চোখ আর মাথার মধ্যে সংযোগগুলো আবার কাজ করতে শুরু করে। তখন বোঝা যায়,
অক্টোপাসের মতোই একঝাঁক শুঁড় বা টেন্ট্যাকল থাকলেও এই প্রাণীটি অন্যকিছু। সম্পূর্ণ সাদা রঙের এই প্রাণীটির শরীরের ওপরের যে অংশটুকু
দেখতে পাচ্ছিলাম, তা দেখলে অনেকটা হেলমেটের মতো মনে হয়। অর্থাৎ, একটা অস্বচ্ছ সাদা
গোলাকার আবরণ, যার নিচে সম্ভবত সিলিন্ডারের মতো একটা আকার নেমে গেছে জলের মধ্যে। গোলাকার জায়গাটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার ঠিক নিচেই
সিলিন্ডারের মতো জায়গাটা থেকে বেরিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটা টেন্ট্যাকল।
“আমাদের থেমে যেতে দেখে সেন্টিনেলিজদের মধ্যে কয়েকজন বল্লম
দিয়ে আমার আর বিস্তের পেছনে খোঁচা দিল। জলের প্রাণীদের প্রতি আমাদের মধ্যে একটা
সহজাত বিকর্ষণ আছে। হয়তো সেজন্যই মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। একটা বিশ্রী দিকে ব্যাপারটা টার্ন নিতে পারত এরপর। আমাদের
দু’জনের আঙুল নিজেদের অজান্তেই কোমরের দিকে এগোতে শুরু করেছিল ইতিমধ্যেই।
“ঠিক তখনই আমাদের মনের মধ্যে একটা ছবি ফুটে উঠল। রোদ ঝলমলে
সমুদ্রের তীরের ছবি, যেখানে বসে সামনের নীল আকাশে ভেসে যাওয়া এক-আধটা মেঘ, আর ডাক
তুলে পেছনের সবুজ বন থেকে বেরিয়ে ওড়াউড়ি করা রঙিন পাখিদের দেখছি আমি।
“মনটা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে গেল এরপর। বুঝতে পারলাম, সামনের
ওই প্রাণীটি আমাদের শান্ত হতে বলছে। তারপর দেখলাম, দুটো টেন্ট্যাকল বা শুঁড় দুর্বল
ভঙ্গিতে আমাদের সামনে বাড়িয়ে ধরল সে। নিজেদের মধ্যে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে খুব খুব সাবধানে
হাত বাড়ালাম আমরা। একটা হাতির শুঁড়ের শেষ
প্রান্তের মতোই নরম টেন্ট্যাকলের প্রান্তটা আলগোছে স্পর্শ করে সরিয়ে নিয়েছিলাম
আমরা। আর তারপরেই মাথায় ভেসে এসেছিল দৃশ্যের পর দৃশ্য।
“দেখলাম, যেন দিনের বেলাতেও অন্ধকার ঘনিয়ে এল। সমুদ্রের জল হঠাৎ করে
উঁচু হতে শুরু করল এক দুই করে দশ মানুষের সমান হয়ে! বুঝতে পারলাম, যেকোনওভাবেই হোক না কেন সুনামির দিন এই
দ্বীপের আশেপাশে যা ঘটেছিল, আমরা সেটাই দেখতে পাচ্ছি।
“আমরা দেখলাম, জলের মারাত্মক দাপট আর সমুদ্রের নিচে হওয়া
প্রবল ভূমিকম্পের ধাক্কায় কীভাবে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল দ্বীপের একটা দিক, কীভাবে
রিফ আর দ্বীপের মাঝখানের জায়গাটা উঁচু হয়ে উঠে মাছ ধরার সহজতম জায়গাটা চিরকালের
জন্য এই দ্বীপের বাসিন্দাদের নাগালের বাইরে নিয়ে গেল। আর তারপরেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল জলের তলার একটা
দৃশ্য।
“জলটা আন্দামান সি-র স্বাভাবিক টার্কয়েজ ব্লু নয়, বরং সবুজ
রঙের বলে বুঝলাম আমরা এবার লেকের নিচের দৃশ্য দেখছি। লেকের নিচে, অনেক অনেক গভীরে আমরা দেখতে পেলাম পাথর ভেঙে
পড়ছে একটা দিক দিয়ে। সেখান দিয়ে যেন অন্য একটা কিছুর স্রোত ঢুকে আসছে লেকের ভেতরে। এমন একটা কিছু, যার ছোঁয়ায় জল গরম হয়ে উঠছে আর জায়গাটা
ঘুলিয়ে যাচ্ছে। ‘ভলক্যানিক ভেন্ট!’ আমার এখনও মনে আছে, এই কথাটা আমরা দু’জনেই
একসঙ্গে বলে উঠেছিলাম।”
চুপচাপ ঘরটার ভেতরে তখন মাথার ওপর ঘোরা ফ্যানের, আর আমাদের
সবার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাইরে জগৎসংসার রসাতলে যাক! আমরা জেঠু,
আর ক্যাপ্টেন বিস্তের সঙ্গে সেইমুহূর্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম এক রহস্যময় দ্বীপের মাঝে। কিন্তু এক লহমার জন্য আমি ফিরে আসতে বাধ্য হলাম রঞ্জনদের এই
বসার ঘরে। কারণ, অপু জেঠুকে জিজ্ঞেস করল, “ওটা আসলে কী ছিল?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জেঠু বললেন, “আমাদের অফিসিয়াল
রিপোর্টে ওটার কোনও উল্লেখ ছিল না। তার কারণটা একটু পরেই বুঝতে পারবে। তবে আমার
ধারণা, ওটা ছিল অন্য কোনও গ্রহ বা অন্য মাত্রা থেকে আসা কোনও প্রাণী।”
“অন্য মাত্রা?” আমাদের সবার হয়ে প্রশ্নটা করল রিনি।
“মেজর পান্ধের কাছেই শুধু মুখ খুলেছিলাম আমরা দু’জন। ওঁর
কাছে জেনেছিলাম, বিজ্ঞানীরা নাকি অনেকেই মনে করেন যে ভাগ্যের সামান্য হেরফের হলে
মানুষের বদলে অক্টোপাস বা তাদের মতো কোনো সেফালোপড এই পৃথিবীর অধীশ্বর হতে পারত।
“অক্টোপাসদের বুদ্ধিমত্তা এবং অ্যাপেক্স
প্রিডেটর হয়ে উঠতে গেলে যা যা লাগে তার প্রতিটি গুণ নাকি মানুষের সঙ্গেই তুলনীয়। হয়তো দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার প্রাচীন লোকগাথা আর কল্পবিজ্ঞান-হরর সাহিত্যের উপজীব্য থুলু মিথোসের উৎস
এমনই কোনও মহাশক্তিধর ও বুদ্ধিমান অক্টোপাস। হতেই পারে যে এদের বাস অন্য গ্রহে নয়,
বরং এই গ্রহেই স্থান-কালের পাশাপাশি অন্য কোনও মাত্রা বা ডাইমেনশনে। তাই ওটা ঠিক কী ছিল তা আমি বলতে পারব না।”
আমরা সবাই চুপ করে আছি দেখে জেঠু আবার শুরু করেন তাঁর কথা।
“আমরা বুঝতে পারছিলাম সামনের প্রাণীটি কী বলতে চাইছে। ভারত
মহাসাগরে ভূমিকম্পের ফলে সেন্টিনেলিজদের খাদ্যের প্রধান উৎসটি ইতিমধ্যেই ধ্বংস
হয়েছে। এবার যদি তাদের পানীয় জলের একমাত্র উৎসটিও ভলক্যানিক ভেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা
গলন্ত সালফারের উপস্থিতির ফলে দূষিত হয়ে যায়, তাহলে তাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া
অবধারিত।
“আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় একের পর এক ছবি
কল্পনা করার চেষ্টা করলাম এরপর। প্রথমেই দেখলাম ও দেখালাম একের পর এক নৌকো এবং
হেলিকপ্টারে চাপিয়ে সেন্টিনেলিজদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই দ্বীপ থেকে।
“তার প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক। একটা
তীব্র যন্ত্রণা তৈরি হল আমার মাথায়। তারপর সিনেমার মতো করে টুকরো টুকরো একঝাঁক ছবি
এসে ধাক্কা মারল মনে, যার প্রত্যেকটাই হানাদার এবং দাস ব্যবসায়ীদের তরফে এই দ্বীপে
নেমে দ্বীপবাসীদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা নিয়ে। বুঝতে পারলাম, আমি ভুল
বার্তা দিচ্ছি।
“নিজেকে শান্ত রেখে এবার আমি অন্য
একঝাঁক ছবি ভাবলাম। এতে আমি দেখালাম, মূল দ্বীপ থেকে দূরে একটা ছোটো ভেলায় মাটির
কলসিতে আর জালায় জল, ফল, কাঁচা মাংস এসব রেখে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে দ্বীপের দিকে।
“এর উত্তরে আরেকটা ছবি ভেসে এল। দেখলাম,
মোটামুটি আধুনিক বলেই মনে হয় এমন একটা জাহাজ আটকে আছে কোরাল রিফে। তীর থেকে তাদের
দেখে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছে কয়েকজন সেন্টিনেলিজ। কিন্তু উত্তরে, মনে হল
যেন দূরের জাহাজের কাছে ধোঁয়া উঠতে দেখলাম। ব্রিফিংয়ের সময় বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করতেই স্পষ্ট
হল, এই দ্বীপের অতি প্রাচীন রেকর্ড-কিপার আমাকে কী বলতে চাইছে।
“১৯৭৭-এ এম.ভি. রুসলে নামের একটা কার্গো শিপ আর ১৯৮১-তে এম.ভি.
প্রিমরোজ নামের আরেকটা জাহাজ দ্বীপের ধারের কোরাল রিফে ধাক্কা খেয়ে আটকে যায়।
প্রিমরোজের ব্যাপারটা মারাত্মক চেহারা নিয়েছিল।
কারণ, রিফে আটকে যাওয়ার ক’দিন পরে ওই জাহাজের লোকেরা দেখে মূল দ্বীপের কিছু
বাসিন্দা যাদের হাতে ছিল বল্লম আর তির, ওই জাহাজের কাছে আসার জন্য তীরে নৌকো তৈরি
করছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন রেডিও মেসেজ পাঠিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র
ড্রপ করার অনুরোধও করেছিলেন! ঘটনাচক্রে তখন সমুদ্র এতটাই অশান্ত হয়ে উঠেছিল, যে দ্বীপের
বাসিন্দারা জাহাজের কাছে বা অন্য কোনও জাহাজ প্রিমরোজের কাছে এসে পৌঁছতে পারেনি। কিছুদিন
পর ও.এন.জি.সি.-র একটা হেলিকপ্টার প্রিমরোজের লোকেদের উদ্ধার করেছিল।
“আমার চিন্তাভাবনার প্রক্রিয়া যে
প্রাণীটির কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা বুঝলাম যখন এর পরেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল একটা
অদ্ভুত ছবি। দ্বীপের তীরে মাথা উঁচু
করে তির আর ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল সেন্টিনেলিজ। আমি বুঝতে পারলাম, সেন্টিনেলিজদের কাছে শেষ কথা স্বাধীনতা।
এরা আর কারও সাহায্য নেবে না, যা করার করবে নিজেরাই।
“আমাদের এই মানসিক কথোপকথন বিস্তের কাছেও স্পষ্ট হয়েছিল।
তাই একটু অধৈর্য হয়ে প্রথমে দাঁত খিঁচিয়ে পরে শান্তভাবে ও একটা ছবি ফুটিয়ে তোলে। ছবিটা আমাদের রেডিও নিয়ে নাড়াচাড়া করার আর হতাশায় মাথা
নাড়ানোর।
“উত্তরে পেলাম না। তবে লম্বাটে জিনিসটার কাছে কাজ করতে থাকা মানুষগুলোকে কিছু
একটা বার্তা দেওয়া হল বোধহয়। কারণ, তারা সবাই জিনিসটা থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। জিনিসটা ছিল একটা প্রকাণ্ড বুলেটের আকারের স্পেসশিপ!
“আমাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না বলে
সন্তর্পণে জিনিসটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখেছিলাম। জিনিসটার গায়ে অনেক
জায়গায় ফাটল বা চিড় থাকলেও সেগুলোকে যথাসাধ্য যত্নে মেরামত করা হয়েছে লোহা,
অ্যালুমিনিয়াম, এমনকি সোনার টুকরো দিয়ে। ঝট করে মনে পড়ে গেল ব্রিফিংয়ের সময় বলা আরেকটা কথা।
“আগুনের ব্যবহার না করলেও
সেন্টিনেলিজরা সমুদ্রে ভেসে আসা ফ্লোটসাম থেকে বা রিফে আটকে যাওয়া জাহাজ থেকে যখনই
পেরেছে ধাতুর টুকরো তুলে নিয়েছে। কোল্ড ফর্জিং, অর্থাৎ আগুন ব্যবহার না করে
শুধুমাত্র গায়ের জোরে ধাতুর পাতকে বেঁকিয়ে তাকে ব্যবহার করার মতো আকার দেওয়া ওরা
জানে, এমন ধারণার উৎস এই তথ্যটাই। কিন্তু শুধু তির বা বল্লম বানানোর জন্য নয়। সেন্টিনেলিজরা যে ধাতুর
ব্যবহার করছে একটা স্পেসশিপ মেরামত করতে, এটা আমাদের ধারণার মধ্যে ছিল না
স্বাভাবিকভাবেই।
“এর সঙ্গে আমাদের রেডিও সাইলেন্সের
কী সম্পর্ক সেটাই যখন ভাবার চেষ্টা করছিলাম, তখন আগের মতোই মনের চোখ দিয়ে দেখলাম
এক আশ্চর্য দৃশ্য। দেখলাম, দ্বীপ থেকে দেখা যাচ্ছে রাতের আকাশের একটা অংশ। একটা
ধূমকেতু লম্বা হয়ে গেছে আকাশের সুদূর এককোণে। বাতাসে ধুলোবালি কিচ্ছু নেই বলেই
দেখা যাচ্ছে তাকে। সঙ্গে দেখা যাছে কনিক্যাল শেপের একটা অদ্ভুত আলোকেও, খুব ধীরে
যে আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যাচ্ছে। দেখতে পেলাম, আমাদের এই
চির-অন্ধকার দ্বীপের ভেতরেও যেন জ্বলে উঠেছে একটা জোরালো আলো। কারণ, স্পেসশিপটা থেকে
বেরিয়ে আসছে আলোর স্রোত।
“বুঝতে পারছিলাম না আমরা ঠিক কোন
সময়ের দৃশ্য দেখছি - অতীতের,
বর্তমানের, নাকি ভবিষ্যতের। কিন্তু ঠিক সেই সময় কালো আকাশের পটভূমিতেও একটু দূর
দিয়ে যাওয়া একটা জাহাজ চোখে পড়ল আমাদের। জাহাজটা স্টিমশিপ, যা দেখে আমি নিঃসন্দেহ
হলাম যে আমরা পুরনো কিন্তু মোটামুটি কাছাকাছি সময়ের একটা দৃশ্য দেখছি। দ্বীপের উজ্জ্বল আলো দেখেই হয়তো এগিয়ে আসছিল জাহাজটা।
“বুঝতে পারলাম, দ্বীপের বাসিন্দা সেন্টিনেলিজদের
মধ্যে দারুণ উত্তেজনা আর আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তারা ছুটে আসছে একবার লেকের কাছে, আর একবার স্পেসশিপটার
কাছে, যার সর্বাঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে আসছে সাদা আলোর স্রোত। কী হল বুঝতে পারলাম না। তবে ঝপ করে নিভে গেল
আলোটা।
“জাহাজটা কোরাল রিফের কাছে এসে বেশ
কিছুক্ষণ দাঁড়াল। কিন্তু আর কোনও আলো দেখতে না পেয়েই হয়তো ঘুরে চলে গেল
নিজের পথে। দৃশ্যান্তর হল না,
কিন্তু আমাদের দু’জনের মনেই রয়ে গেল একটা অদ্ভুত শূন্যতা আর হতাশা।
“বিস্ত বলল, ‘মনে হয়, এই স্পেসশিপটা
যখন কোনও মেসেজ পাঠানোর চেষ্টা করে বা চালু হয়, তখনই সেটা একটা জ্যামারের মতো কাজ
করে, যার ফলে ইলেকট্রনিক্স বা রেডিও-নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়ে।’ যুক্তিটা আমার বেশ মনঃপূত হল, কিন্তু একটা তীব্র সঙ্কটে
পড়েছিলাম।
“ভারতের মধ্যে একটা স্পেসশিপ, সে
সচল হোক বা অচল পাওয়া গেলে সেটা আমাদের রিপোর্ট করতেই হবে। আর তার পরের দৃশ্যটা
সহজেই অনুমেয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার
তুলনায় তিরিশ বা চল্লিশটি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের প্রাণের মূল্য কমই হবে।
সেনাবাহিনীর এক্সট্র্যাকশন টিমের সঙ্গে সংঘর্ষে পৃথিবীর বুক থেকে অবশেষে মুছে যাবে
সত্যিকারের স্বাধীন একটি জনগোষ্ঠী।
“সেন্টিনেলিজদের মধ্যে এবার একটা
চাঞ্চল্য দেখতে পেলাম। ওরা স্পেসশিপটাকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল লেকের একদম ধারে একটা
ঢালু জায়গা বরাবর। বুঝতে পারছিলাম, ওই ঢাল
বরাবর গড়িয়ে দিলে স্পেসশিপটা ভেসে না উঠে নিচে নামতে থাকবে, বিশেষত যদি তার সামনের
অংশটা ভারী হয়।
“প্রাণীটির টেন্ট্যাকলদুটো আবার
আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমরা হাত বাড়ালাম, নির্ভয়ে, নিঃসংশয়ে। বুঝতে পারছিলাম, এই দ্বীপের বাসিন্দাদের স্বাধীনভাবে বাঁচার
ইচ্ছেটাকে সম্মান দিয়ে এত এত বছর ধরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে যে প্রাণী, সে
আমাদের ক্ষতি করবে না।
“এবার ওগুলো ধরা মাত্র মাথায় ভেসে
এল কয়েকটা টুকরো টুকরো ছবি, যাদের মধ্যে একটা ছিল আমাদের হেলিকপ্টারের। মনে হল এবং
পরে হসপিটাল থেকে কনফার্ম করেছিলাম, চালকের একটা মাইনর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল
দ্বীপটার কাছাকাছি আসার সময়। চপারটা কন্সট্যান্স আইলেটের বুকে ক্র্যাশই করত। কিন্তু তখনও জ্ঞান থাকা
চালকের মগজে কোনওভাবে কিছু কথা, কিছু ছবি পাঠাতে সক্ষম হয় এই প্রাণীটি। তার ফলে
চালক প্রায় যান্ত্রিক দক্ষতায় চপারটা নামাতে সফল হয় এবং ঘুমিয়ে পড়ে।
সেন্টিনেলিজদের একটা দল চালককে সযত্নে বাইরে শুইয়ে দিয়েছিল।
“মনে হল, সেনাবাহিনী চপারটা রিট্রিভ
করতে চাইলে যাতে বাধা দেওয়া না হয় এই দ্বীপের বাসিন্দাদের বুঝিয়ে সে ব্যবস্থাও
করেছে প্রাণীটি।
“আমাদের মাথায় তখনও অগুন্তি প্রশ্ন
আসছিল। কিন্তু সেগুলোর উত্তর আর পেলাম না। আমাদের হাত থেকে নিজের
নরম শুঁড়গুলো বের করে নিয়ে গড়িয়ে আর ঘষটিয়ে স্পেসশিপের কাছে পৌঁছে গেল প্রাণীটি
এবং সেখানে উঠে পড়ল।
“আরে! ও কী করছে?’ বিস্ত প্রশ্নটা
করার আগেই আমি বুঝেছিলাম, কী ঘটতে চলেছে। শেষ জ্বালানিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এই স্পেসশিপ আর কোনওদিন
উড়বে না। তাই একে অস্ত্রের মতো করে ব্যবহার করতে চলেছে প্রাণীটি। যাতে লেকের নিচের ওই ফাটলটা একেবারে সিল হয়ে যায়, আর এই
দ্বীপে শত-সহস্র বছর ধরে তাকে আশ্রয় দেওয়া একদল স্বাধীন মানুষের সসম্মান স্বাধীনতা
সে নিশ্চিত করতে পারে।
“স্পেশশিপের মধ্যে কয়েকটা আলোই শুধু
জ্বলছিল এতক্ষণ। কিন্তু এবার, মানে প্রাণীটি তাতে অদ্ভুত কায়দায় নিজেকে তুলে
নেওয়ার পরেই তার বাকি আলোগুলো জ্বলে উঠল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমাদের। তারপরেই ঝপাং
করে জলে নেমে পড়ল প্রকাণ্ড বুলেটের মতো জিনিসটা।
“বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম লেকের
ধারে। তারপর, বহুদূর থেকে ভেসে আসা অনেকগুলো কামান একসঙ্গে গর্জে ওঠার মতো একটা
আওয়াজ পেলাম। দেখলাম, লেকের কালচে-সবুজ জলের তলাটা লালচে-কমলা হয়ে উঠল কয়েক মুহূর্তের
জন্য।
“হুঁশ ফিরল, যখন আমাদের চারপাশে
প্রতিটি নারীপুরুষ এক অদ্ভুত ভাষাহীন গোঙানি তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নিজেদের সেই
প্রথম ট্রেসপাসার মনে হল। নীরবে ফিরে চললাম আমরা কন্সট্যান্স আইলেটের দিকে। তারপর বোটে চড়ে আমাদের
বেসে।
“একটা সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট দাখিল করেছিলাম
আমরা, যাতে এও বলা ছিল যে হেলিকপ্টারের রিট্রিভ্যাল সম্ভব যাতে হয় সেটা নিশ্চিত
করার জন্যই আমাদের ওখানে কিছুক্ষণ থাকতে হয়েছিল। চপারটা উদ্ধার হয়েছিল কনস্ট্যান্স আইলেটের সেই প্রান্ত
থেকেই। চালক সুস্থ হয়ে ডিউটিতে
জয়েন করেছিল বাধ্যতামূলক পরীক্ষানিরীক্ষার পর। সেও বলেছিল, বুকে একটা অসহ্য
যন্ত্রণা হওয়ার পর সে হেলিকপ্টারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। তারপর তার কী হয়েছিল,
সে কিছুই মনে করতে পারেনি।
“সেন্টিনেলিজরা থেকে গেছিল নিজেদের
মতো। তবে তাদের আচরণে হিংস্রতা বোধহয় কিছুটা বেড়ে গেছিল তাদের
বন্ধুটি আর তাদের মধ্যে না থাকাতেই। ২০০৬-এ দুই কাঁকড়া শিকারি ওই দ্বীপের এলাকায়
চোরাপথে ঢুকতে গিয়ে ওদের হাতে মারাই যায়, যেটা খুব দুঃখজনক। আমি আর ওই এলাকায় কখনও যাইনি।”
“কিন্তু জেঠু,” রিনি বলে, “ওই ধূমকেতুর ব্যাপারটা কী ছিল?”
“১৭৭১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে ভেসেল
‘ডিলিজেন্ট’ নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে প্রচুর আলো
দেখেছিল। ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জন রিচি এমনটাই লিখে গেছেন।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলেন জেঠু।
“খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ওই সময়েই চাইনিজ অ্যাস্ট্রোনমাররা একটি
‘ব্রুম স্টার’, অর্থাৎ ধূমকেতু দেখেন আকাশে। ক্যান্টারবারির জ্যোতির্বিদ জেমস
সিক্সও এটিকে পরে পর্যবেক্ষণ করেন। তবে সবচেয়ে ডিটেইল্ড স্টাডি করেছিলেন ফ্রান্সের
চার্লস মেসিয়ার, যিনি শুধু এই ধূমকেতুটিকেই দেখেননি, সঙ্গে নিরক্ষীয় অঞ্চল দিয়ে
খুব ধীরে চলে যাওয়া একটি শঙ্কু-আকৃতির আলোও লক্ষ করেছিলেন।
“নর্থ সেন্টিনেলিজ আইল্যান্ডে
মেরুনড এক নভোযাত্রীর উদ্ধার পাওয়ার শেষ রাস্তা ছিল সেটাই, আলোর মাধ্যমে দৃষ্টি
আকর্ষণ করা। কিন্তু দ্বীপের অন্য বাসিন্দারা যাতে সেজন্য বিপন্ন না হয়, সেজন্য সেই
সুযোগটাও সে নেয়নি। ডিলিজেন্টের নজর যাতে এই দ্বীপের ওপর না পড়ে সেটা নিশ্চিত করার
জন্য আলো নিভিয়ে দিয়েছিল সে।
“এতগুলো বছর পরে, নিজেকে ভবিতব্যের
হাতে ছেড়ে দেওয়া এই প্রাণী হঠাৎ বুঝল আবার বিপন্ন হয়েছে এই দ্বীপের বাসিন্দারা।
হয়তো নিজে এই দ্বীপে, এই বিন্দুতে বন্দি বলেই সে আরও বেশি করে বুঝতে পেরেছিল
স্বাধীন অস্তিত্ব ঘুচে গেলে অচিরেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এরা। যেমন হয়েছিল জাংগিলরা
বা অনেকাংশে ওঙ্গি ও জারাওয়ারা। তাই বন্ধুত্বের সম্মান রাখতে, আতিথ্যের সম্মান রাখতে সে
সেটাই করল যাকে আমরা মনুষ্যত্বের শেষ কথা বলি। নিজের জীবন দিয়ে সে বাঁচিয়ে গেল সেন্টিনেলিজদের
স্বাধীনতাকে। মানের এমন অধিকারীকে আমি
তাই অমানুষ ভাবতে পারি না। তার ফাইলাম বা জেনাস যাই হোক না কেন।”
_____
অলঙ্করণঃ
সুমিত রায়
খুব ভালো লাগল!
ReplyDeleteথ্যাংকু থ্যাংকু।
Deleteদারুণ!
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deletebesh sundor...tan tan..durdhosho!
ReplyDeleteথ্যাংকু থ্যাংকু
Deleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ।
Deletedarun
ReplyDeletedarun
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ।
Deleteঅদ্ভুত রকমের ভালো হয়েছে ঋজুদা । দুর্দান্ত।
ReplyDeleteকল্পবিজ্ঞানের ভালো লেখার জন্য বিভিন্ন বিষয়ে অকারণ পড়াশোনা ও সাধারণ জ্ঞান থাকা খুব আবশ্যিক। এ লেখায় তারই পরিচয় পেলাম। খুব ভালো হয়েছে। কিছু জায়গায় একটু কম ডিটেলিং থাকলেও চলত। সুযোগ থাকলে একটু সরল নাম ব্যবহার করা ভালো।
ReplyDeleteকিশোরদের পক্ষে একটু জটিল মনে হলো।না হলে গল্পটা ভালো।
ReplyDeleteভালো গল্প।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteOshomvob valo r akorshonio....
ReplyDelete