ভূত-চতুর্দশী
পাপিয়া গাঙ্গুলি
পাপিয়া গাঙ্গুলি
ছোটো ব্যাগটাতে জামাকাপড়, দাঁত মাজার ব্রাশ, টুকিটাকি
বাকি জিনিস গুছিয়ে ভাইয়ের ঘরে গেল টুপা। দেখল খাটে
টানটান হয়ে টিনটিন পড়ছে পাপু। ব্যাগ-ট্যাগ কিছুই গোছানো নেই। একটু বাদে
বাবা ফিরলেই ওই
গাড়িতেই ওদের পৌঁছে দেবে মামাবাড়ি। এমনই ঠিক আছে। বাবা অফিস বেরনোর আগে বলে
গেছিল গুছিয়ে রাখতে ওদের ব্যাগ। বিকেল হল, দ্যাখো ছেলের কোনও হুঁশ
নেই। মা খুব কড়া স্বভাবের। বাবা সবসময় ওদের একটু
প্রশ্রয় দেয়। মা বোঝে আর বাবার ওপর রাগারাগি করে। তখন বাবাও তাদের সাথে বকা খায় আর
মিটিমিটি হাসে। বাড়িতে এটা একটা মজার ব্যাপার।
ভাইয়ের ঘরে ঢুকেই একটা পচা
গন্ধ পেল টুপা।
“উঃ কী গন্ধ! কী রে, মোজা কাচতে দিসনি? কোথায় ফেলে রেখেছিস?”
“উঃ কী গন্ধ! কী রে, মোজা কাচতে দিসনি? কোথায় ফেলে রেখেছিস?”
“আছে হয়তো কোথাও!”
নির্লিপ্তভাবে বলে দিল। নবাবপুত্তুর
বই নিয়ে মশগুল। পুরো ঘরটা অগোছাল, লন্ডভন্ড। গুছিয়ে দিলে আবার কিছুদিন পর একরকম। কাল ওর
সাথে একটু রাগারাগি হয়েছে। টুপার ফাইলে লাগানো পছন্দের সবক’টা স্টিকার
খুলে নিজের খাতায় লাগিয়ে নিয়েছে। কিছু ছিঁড়েও গেছে। অথচ দু’দিন আগেই বলেছিল, স্টিকারস
ওনলি ফর গার্লস। খুব রেগে গেছিল। ঝগড়া করে টুপাই কথা
বন্ধ করেছে। কিন্তু এখন কথা না বললে তৈরি হতে দেরি করবে। বাকি ভাইবোনেরা পৌঁছে
যাবে মামাবাড়িতে। আধা মজা মিস হয়ে যাবে। টুপা একটু গলা-খাঁকারি দিয়ে
শুরু করল, “টিনটিন পড়লেই হবে? ব্যাগ গোছাবে কে? যাওয়ার
সময় হয়ে গেল তো!”
“তুই গোছাবি।” শান্ত গলায় বলে পাশ ফিরে শুল
পাপু।
চড়াং করে মাথাটা গরম হয়ে গেল
টুপার। সামলে নিল নিজেকে। গজগজ করতে করতে পাপুর ব্যাগ গোছাতে লাগল। ইচ্ছা
করছিল দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এখন আবার ঝগড়া শুরু
করলে মা যাওয়াটাই
ভেস্তে দিতে পারে। সকাল থেকে মুখ গোমড়া করে আছে, মামার বাড়ি যাওয়া নিয়ে। তাই
বাবা চুপিচুপি বলে গেছে রেডি হয়ে থাকতে। আসলে মামাবাড়ি থেকে পুজো কাটিয়ে
দশমীর পরদিন সবে ওরা ফিরেছে বাড়ি। আবার কালীপুজো
উপলক্ষে মামার বাড়ি রওনা আজ, মানে কালীপুজোর একদিন আগেই। সেই নিয়ে
রাগ মায়ের।
“পড়াশোনা শিকেয়
তুলে, শুধু মামাবাড়ি গিয়ে নৃত্য করো। উঁচু ক্লাস হচ্ছে
সেদিকে খেয়াল নেই,” এই বলে রাগী মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মা।
টুপাদের, মানে টুপা
আর ওর সব মাসতুতো, মামাতো ভাইবোনদের এক চরম আকর্ষণ ওদের
মামাবাড়ি। সব সুন্দর গল্প, আনন্দ, মজা, আবদার, দুষ্টুমি সব ওই চেতলায়, মামার
বাড়ি ঘিরে।
চেতলায় কালীপুজো দুর্গাপুজোর থেকেও
বেশি জমজমাট। একসাথে বাজি পোড়ানো, ঠাকুর দেখে বেড়ানোর মজাই আলাদা। পুজো থেকেই
মামাবাড়িতে তাঁবু ফেলে টুপা আর তার সব মাসতুতো ভাইবোনেরা। মস্ত তিনতলা বাড়িতে
মামারা সবাই একসাথে থাকে। ব্যবসায়ী একান্নবর্তী পরিবার। তাই মামাতো দাদা দিদি, ভাইবোনরা সব একবাড়িতে থাকার
মজা পায়। টুপাদের কাছে প্রকৃত অর্থেই মামাবাড়ি ভারি মজা।
সুযোগ পেলেই সেখানে।
দিদিমা সংসারের কর্ত্রী। মোটাসোটা, সাদা চুল, সোনালি গায়ের রং
আলো করে তিনি নিজের ঘরে উঁচু পালঙ্কের নীচে আসন পেতে বসে
থাকেন। পালঙ্কে সুন্দর করে সাজানো দাদুর বড়ো ছবি।
দাদু চলে যাবার পর নাকি দিদা ওই পালঙ্কে ওঠেননি। বেশ একটা দেবী দেবী ভাব।
দাদু মারা যাওয়ার পর সেই এত বড়ো ব্যবসা ছেলেদের দিয়ে চালাচ্ছে। চার ছেলে ও তাদের
পরিবার নিয়ে বিরাট সংসার। পাঁচ মেয়েরও যাতায়াত লেগে থাকে সারাবছর। নাতি-নাতনি
তাঁর কাছে খুব কাছের। তাই যত অন্যায় বাঁদরামো করতে তাদের জুড়ি নেই, মানাও
নেই। দিদার কাছে সাতখুন মাফ। সব ভাইবোনেরা এক হলেই, ওরা দলবেঁধে বাড়ির
লোক, পাড়ার লোক সবাইকে অতিষ্ঠ করে মারে যে ক’দিন থাকে।
তাদের নানারকম দুষ্টুমি দিয়ে। মামাতো, মাসতুতো ভাইবোন মিলিয়ে ওদের যাকে
বলে সলিড একটা গ্যাং আছে।
দশজনের গ্যাং। বাকি দাদা দিদিরা বয়সে অনেক বড়ো। তারা আদর দিয়ে আরও বাঁদর
করে ওদের। দশ বছরের বোন থেকে আঠেরো বছরের দাদা সবাই মিলে একটা গ্রুপে। এই
গ্রুপের একটা নামও দিয়েছে। সবার নামের আদ্যক্ষর নিয়ে ‘টুবামারাপা’। ( টুপা, টুসকি, বনি, বাবু, বাচ্চু, মাম্পি, রানা, রিঙ্কু, পাপু ও পাপান)
পাপান অবশ্য ওদের বড়দার আট
বছরের ছেলে। ওদের সাথে ঘুরে বেড়ায়।
একসাথে বেড়াতে যাওয়া, পিকনিকে
যাওয়া, চিড়িয়াখানা ঘোরা, একসাথে বসে ভিডিআর-এ সিনেমা
দেখা, তারস্বরে বেসুরো গান গেয়ে সবার কান ঝালাপালা করা, পাশের
বাড়ির বেলগাছ থেকে স্রেফ মজার জন্য বেল চুরি করা - এসব এদের দলের কার্যক্রমের
তালিকাভুক্ত। এরপরের কাজ কারবার লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে।
তা যা হোক বাবাকে ঢাল করে, মায়ের
বিরক্ত মুখ হজম করে, টুপা ও পাপু ড্রাইভারের সাথে পৌঁছে গেল মামাবাড়ি। গিয়ে দেখল
বাকি দল সবাই পৌঁছে গেছে। সবাই মিলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের বাড়ির
চারতলায় দাঁড়ানো সরযূর সাথে চিৎকার করে গল্প করছে। সরযূ আর ওর বোন শনু মাড়োয়ারি। কিন্তু বহুবছর
কলকাতায় থেকে পাক্কা বাঙালি এখন। ওদের বন্ধু। নীচের তলার গুজরাটি মহিলা কড়া চোখে তাদের দিকে
তাকিয়ে। টুপাদের গাড়ি থেকে নামতে দেখেই তুমুল চিৎকার করে উঠল সবাই ‘এসে গেছে, এসে গেছে’ বলে।
গুজরাটি মহিলা বিকৃত মুখে
ভেতরে চলে গেল। আসলে গত কালীপুজোয় বনির ওড়ানো একটা রকেট বেমক্কা সাঁই করে ওদের
বারান্দায় চলে গিয়ে বারান্দায় টানানো শাড়িতে আগুন ধরে গেছিল। তাতে বড়দা ওদের বলেছিল যে, বাজি
পোড়াবার দিনে অমনি খোলা জায়গায় কাপড় রাখা উচিত কাজ হয়নি।
সেই থেকে রাগ ওদের।
নীচে গাড়ি এসে থামল। মামারা কাজ
থেকে ফিরল সবাই। আজ কুলফিওয়ালা এলেই তার হাঁড়ি খালি করে কুলফি খাওয়া হবে, ঠিক করা
আছে। ছোটোমামা বলেছে সে খাওয়াবে কুলফি।
সন্ধে নামতেই ‘কুলফিইই’ বলে লাল
শালু মোড়া হাঁড়ি নিয়ে কুলফিওয়ালা পাড়া দিয়ে হেঁটে যায়। ইতিমধ্যে
মামারা দোতলায় পৌঁছে গেছে। পেছন থেকে ন মামা এসে বলল, “আজ সন্ধে হলেই সব জায়গায় মোমবাতি
জ্বালাবি। না হলে ভূত ঢুকে পড়বে বাড়িতে।”
মোমবাতি তো প্রতিবছরই
জ্বালানো হয়, কিন্তু এই ভূত ঢোকার কথা তো আগে শোনেনি
ওরা।
“ভূত ঢুকবে কেন? আসবেই বা
কেন?” রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল। দশ বছরের রিঙ্কুর খুব ভূতের ভয়।
“সে কি, তোরা জানিস না! আজ তো ভূত-চতুর্দশী। আজ সব ভূতেরা আকাশ
থেকে নামে।”
এমন একটা ইন্টারেস্টিং খবর
ওরা জানত না যে, কালীপুজোর
আগেরদিনটাকে ভূত-চতুর্দশী
বলে। সেদিন নাকি গোটা গোটা ভূতেরা আকাশ থেকে নেমে আসে। রিঙ্কু, বাচ্চু, টুসকি, পাপান
কাছাকাছি ঘেঁষে দাঁড়াল। যেন এখুনি ভূত আসছে।
রানা বলল, “ভূত যদি
নামে আকাশ থেকে তাহলে তো দেখা যাবে, আর দেখা গেলে আরও মজা। কেমন করে নামে তা দেখা
যাবে। প্যারাশুটে ঝুলতে ঝুলতে, নাকি মেঘের সিঁড়ি বেয়ে, নাকি
ইউএফও-র মতো কোনও যানে করে। একবার যদি দেখে ফেলা যায় তাহলে আর
চিন্তা নেই। সবাইকে
গল্প করে চমকে দেওয়া যাবে। উঃ, কী মজা!”
পাপু বলল, “শুধু কি
তাই! বলা যায় না টিভি চ্যানেলও এসে যাবে।”
মাম্পি বলল, “তোমরা
ফেমাস হওয়ার স্বপ্ন দেখ, ওদিকে ভূত তোমাদের ঘাড় মটকাবে। দেখে নিও।”
ভয় দেখানো কথায় পাত্তা না
দিয়ে যেই ভাবা সেই কাজ শুরু করল। শুরু হল ভূত নামা দেখা অভিযান। কিন্তু
শেষপর্যন্ত গ্যাং-এর কয়েকজন ‘ওরে বাবা রে, কী হবে রে’ বলে পগার
পার।
বাকি ক’জন, মানে টুপা, দুইভাই বাবু, পাপু আর মাসতুতো দাদা
রানা নিজেদের লক্ষ্যে স্থির থাকল।
টুপা বলল বাকিদের, “কী ভীতু
বাবা তোরা! ভুত কি তোদের চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবে!”
তারা ঠিক করল
গোধুলি থেকে ডেরা বানাবে ছাদে। রাতে ডিনার করতেও নামা যাবে না, যদি ভূত
ফস্কে যায়। তাই বলা হয়ে গেল রান্নাঘরে যে তাদের রাতের খাবার বানানোর দরকার নেই।
তারা সাথে এগরোল, জলের বোতল, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে
নিল। কোনওভাবে যেন ভূত নামা দেখায় ব্যাঘাত না
ঘটে।
তিনতলার ছাদের ওপর জলের
ট্যাঙ্ক-এর ছাদ। লোহার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে বিরাট
সিমেন্টের ট্যাঙ্ক। সেটার গায়ে আবার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠলে
ট্যাঙ্কের মাথা – ‘টুবামারাপা’-র ডেরা। বলা যায় প্রায়
পাঁচতলা উঁচু জায়গা। বাঁধানো ট্যাঙ্কের ওপর উঠে পড়লে পুরো
এলাকা দেখা যায়। ওদের গোপন আলোচনার জায়গা এটা। বড়োদের থেকে বকা খেয়ে
মুখ লুকোবার জায়গা এটা। লুকিয়ে বারণ করা জিনিস খাবার জায়গা এটা।
সেদিন ভূত সাক্ষাতের জায়গাও এটা।
ভূত-চতুর্দশীর দিন অন্ধকার একটু নামতে
কুলফিবরফ খেয়ে উঠে পড়ল চারজন সেই ট্যাঙ্কের মাথায়। রানা, পাপু, বাবু আর
টুপা। অপেক্ষা, ভূতেদের জন্য।
টুপা ভাবছিল সত্যজিৎ রায়ের ভূতেদের মতো নেচে-নেচে, সারিবেঁধে
ভূতেরা
অবতরণ করবে। অদৃশ্য মিউজিক বাজবে। আর ওরা সিনেমার মত ভূত দেখবে।
সন্ধে গড়িয়ে রাত এল। কোথায় কী। দু’টো চিপসের
প্যাকেট শেষ। বসে বসে ক্লান্ত, চারজন
শুয়ে আছে চিৎ হয়ে, আকাশের দিকে চেয়ে। কখন নামে কখন নামে। বুকে অল্প
ধুকপুক। এই নামল বুঝি। কিন্তু আকাশে শুধু বাজির রকমারি খেলা। কোথায় আর
ভূত! চারদিকে
মাইকে হিন্দী, বাংলা সব গান জগাখিচুড়ি হয়ে যাচ্ছে। ওরা খাচ্ছে আর
গল্প করছে। টুপা বলল, “এত হট্টগোলে কি ভূত আসে?”
অনেক রাত তখন। প্রায় মাঝরাত।
ঘুম এসে যাচ্ছে। গা ঝাড়া দিয়ে সব উঠে বসল। একবার শোয়া আবার বসা, এই চলছে। হঠাৎ ‘এল না সে এল না’ বলে কে
যেন তীক্ষ্নস্বরে বেসুরো গান গেয়ে উঠল কানের কাছে। চমকে উঠল টুপা। এ
আবার কার গলা! ভূতেরা শুনেছে নাকিসুরেই কথা বলে। গানও নাকিসুরে... এক
ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে দেখল, রানাদা কানের সামনে মুখ এনে নাকিসুরে গান গেয়ে মজা করছে।
“ধ্যাৎ, কী যে কর না!” বিরক্ত
টুপা সরে বসল।
“কি রে, ভয় পেলি তো!” রানা
জোরে হেসে উঠল।
“অনেক হয়েছে। আর খ্যাঁক-খ্যাঁক
করে হাসতে হবে না। সত্যি ভূত নামলে দেখব কার কত সাহস। হুঃ!” টুপার ভাই
পাপু একটু রেগে বলে উঠল। রানার সাথে তার অম্লমধুর সম্পর্ক। তারও পর আবার
দিদিকে ভয় দেখিয়েছে।
এদিকে চারজনেরই মন একটু
খারাপ। এত প্ল্যান করে গুছিয়ে বসা হল অথচ ভূতের পাত্তা পাওয়ার
আশা প্রায় জিরো। পরেরদিন সকাল হলেই বাকিরা সব জিগ্যেস করবে, শুধু প্রশ্ন
নয় কৌতুক মিশ্রিত গলায় প্রশ্ন করবে, ‘কি রে, কী ভূত দেখলি? ক’টা ভূত দেখলি?’
কারণ, ওদের ভূত দেখার
উৎসাহ ও প্রস্তুতি দেখে পলুদিদি, ছোটমাসি আগে থেকেই হাসি ঠাট্টা শুরু করেছিল। এসব ভেবে
বেশ চিন্তিত চার মক্কেল। পাশের বেলগাছে পাখিদের খুব ঝটপটানির আওয়াজ পাওয়া গেল। ওরা
একটু টানটান হল। এত রাতে পাখিরা জাগল কেন?
মামাতো ভাই বাবু বলল, “ভূত দেখা
যায় না কিন্তু অনুভব করা যায়। আমি শুনেছি। আর জন্তু
জানোয়াররা আগে টের পায়।”
অতি কল্পনাপ্রবণ টুপা
ঘোষণা করল, “হুম, আকাশটা হঠাৎ ঘোলাটে লাগছে রে। আর বেশ
গা শিরশিরও করছে। এই শিরশিরানিটাই হল ভূত।”
ব্যস, যেই না বলা, সবার মনে
হল ভূতুড়ে অদৃশ্যজনেরা তাদের ঘিরে রেখেছে। নিমেষে দুদ্দাড় করে পড়তে মরতে নেমে গেল রানা আর
দুইভাই। টুপা একটু
হতভম্ব ভাব কাটিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ নেই। একদম একা সে।
খুব ভয় হল। সেও একটু দ্রুতপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেল। দেখল
রানাদা ফিরে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “নামলি না কেন তুই?”
“আজীব তো তোমরা, আমার কথা
না ভেবেই চলে গেলে! কিছু বোঝার আগেই তো সব ফাঁকা। কী সব বীরপুরুষ এক এক জন!”
“আচ্ছা বাবা ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা
দাঁড়া, আমি আসছি ওপরে। চল আমরা দু’জনই ওয়েট করি ভূতদের
জন্য।” এই বলে রানা উঠে এল ট্যাঙ্কের ওপর। টুপার পাশে
এসে বসল।
“বাবু, পাপুর কী হল?”
“ওদের ঘুম পেয়ে গেছে বলল। আসবে
না। আসল কথা ভয় পেয়েছে,” বলে রানা হাসল।
দু’জনে বসে নানারকম গল্প শুরু
করল। আকাশে তখনও বাজির রকমারি কমে এলেও আছে।
রানাদা বলল যে, ও কোথায় পড়েছে যে যাকে আমরা আত্মা বলি তা আসলে এক
এনার্জি।
“রানাদা, শীত করছে
না তোমার?” টুপা জিগেস করল।
“না, তোর করছে?”
“হুম।”
“ওড়নাটা জড়িয়ে নে।”
“আচ্ছা রানাদা, বল তো ভূত
কেমন দেখতে হয়?”
“কেমন আবার? ভূতের মতই।”
“আরে ভূত কেমন দেখতে তাই তো জানি না।”
“তাহলে তোর মতো!”
“দূর, তুমি না...। তুমি তো
কত বই পড়। পড়নি কোথাও?”
“ভূতের সাথে দেখা হলে বলিস
ওরাই যেন ওদের নিয়ে একটা বই লেখে। কেমন দেখতে, কী খায়, কোথায় থাকে... তারপর
তোকে প্রেজেন্ট করতে।”
“সবেতে তোমার মজা করা।”
“দেখ ভোরের আলো ফুটবে এখুনি। তোরও
ঠান্ডা লাগছে। আবার জ্বর বাঁধাবি। আমার আর ভালো লাগছে না। ভূত না ছাই। চল, নীচে চল।
কাল সবাই জিগেস করলে একটা গল্প বানিয়ে বলে দিস,” হাসতে হাসতে বলল রানাদা।
“আমাদের বোকা বানিয়েছে বড়োরা। বেকার
সময় নষ্ট হল। চলো তো শুতে যাই। ঘন্টাখানেক ঘুমনো যাবে। কাল অনেক রাত
পর্যন্ত জাগতে হবে। পুজো আছে।”
“ঠিক তাই। চল।”
ওরা দু’জন নীচে দোতলায় নেমে এল।
ওদের সবার শোওয়ার জন্য বরাদ্দ ঘর হল লম্বা একটা বারান্দা ঘেঁষা একটা বড়ো ঘর।
ঢালাও বিছানা করে সবার ঘুমের ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রানা বলল, “তুই যা, আমি কলঘর
হয়ে আসছি। দরজায় খিল তুলিস না আবার।”
সিঁড়ির ডানদিকে ওদের শোবার
ঘর আর বাঁদিকে বাথরুম। রানাদাদের বাড়িতে বাথরুমকে কলঘর বলে ওরা। রানাদা বাথরুমের দিকে চলে
গেল। টুপা সাবধানে ঘরের দরজা খুলল যাতে
কারোর ঘুম না ভাঙে। ঘরে নীল রাত-আলো জ্বলছে। তাই দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। দরজায়
দাঁড়িয়েই সে লম্বা বিছানায় নিজের শোওয়ার একটা জায়গা খুঁজছে। সব ভাইবোনেরা হাত পা
ছড়িয়ে ঘুমে কাদা। নাক ডাকার আওয়াজও আছে হাল্কা।
একি, এ কী দেখছে টুপা! টুপার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার
জোগাড়। কী অদ্ভুত! টুপা বিস্ফারিত চোখে
দেখল পাপুর পাশে রানাদা চাদর মুড়ে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে বিছানায়। তাহলে এতক্ষণ যে ছাদে
ওর সাথে ছিল, ওর সাথে নীচে নামল, টয়লেটে গেল... সে কে? কিছু
বোঝার আগেই টুপার মাথাটা বাইরের দিকে বাথরুমের দিকে ঘুরে গেল। যা দেখল তাতে অজ্ঞান
হবার জোগাড়। বাথরুমের বাঁকে অন্ধকারে একজোড়া সাদা দাঁত ঝুলছে আর হাসছে। আর কিছু দেখা
যাচ্ছে না। ওর কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে খোনা গলায় বলল, “ভূত দেখতে
মানুষের মতও হয়।”
টুপা কেমন অবশ হয়ে ধপ করে
বসে পড়ল। তারপর সামনে ঘুমনো বোনকে জড়িয়ে কাঁপতে থাকল। চিৎকার
করার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। বাইরে একটা দু’টো কাকের
ডাক। আর কিছু মনে নেই। কখন যেন ঘুমিয়েও পড়েছে।
পরেরদিন সকালে ডাইনিং রুমে
এসে দেখল সব ভাইবোনেরা চা খাচ্ছে। তার আসতে একটু দেরি হয়েছে। ঘুমিয়েছে নাকি
অজ্ঞান হয়েছে জানে না। চেয়ার টেনে বসতে বসতে শুনল বাবু রসিয়ে রসিয়ে
আকাশ ঘোলাটে হওয়া ইত্যাদি গল্প করছে। বাকি সবাই মিটিমিটি হাসি
নিয়ে শুনছে। টুপা বসার সাথে সাথে বাবু, পাপু চিৎকার করে উঠল, “এই তো একা
টুপাদিদি ছাদে ছিল। ও নিশ্চয় দেখল, জিজ্ঞেস কর।”
বড়োরা হাসতে হাসতে টেবিল ছাড়ল।
মেজোমামা বলল, “সবাই মিলে
আলোচনা করে একটা ভূতের গল্প লিখে ফেল। আমি ছেপে দেব।”
টুপার ঠিক সামনের চেয়ারে
রানাদা বসে পাঁউরুটি খাচ্ছে আর বলছে, “তোর সাহস আছে টুপা। আমাদের তো
ভয় লেগেছিল খুব। তুই একা রয়ে গেলি। তা, কিছু দেখলি? কখন নামলি
ছাদ থেকে? আরে ভূত বলে কিছু নেই।”
টুপা চায়ের কাপ ঠোঁটে ছুঁইয়ে
একদৃষ্টে রানার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, এটা রানাদা নাকি অন্য কেউ!
________
ছবি - পুষ্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতি - মাস্কাটবাসী বারোবছর। বাংলাভাষায় লেখালেখির চেষ্টা করা, নাটক করা, বই পড়া, গান শোনা পছন্দের তালিকায়। দেশের মাটিতে পোঁতা আছে সম্পূর্ণ মন।
খুব ভালো একটা গল্প...আমাকে আমার ছোট বেলায় ফিরিয়ে নিয়ে গ্যাল
ReplyDeleteআমার দারুণ লাগলো... আরও লেখ এমন
ReplyDelete