|
ভ্যালি ফোর্জের লগ হাট |
শিহরিত অতীতের মায়াজালে
রাখী নাথ
হলদে বিকেল আর গোলাপী
সন্ধ্যের সন্ধিক্ষণে - দিগন্তবিস্তৃত জনহীন প্রান্তরে, শতাব্দীপ্রাচীন, কাটা গাছের
গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছোট্ট একচালা কুঁড়েঘরগুলির সামনে দাঁড়িয়ে অজান্তেই কেমন জানি গা
ছমছম করে উঠছিল আমার। আর তা করবে নাই বা কেন! জায়গাটা নিয়ে
ভুতুড়ে গপ্পো তো আর কম নেই! মৃত্যুর গন্ধ লেগে আছে পরিত্যক্ত একচালাগুলির প্রায়
প্রতিটি কাঠের বাংকে। হ্যাঁ, এই সেই ইতিহাসপ্রসিদ্ধ
প্রান্তর! আমেরিকান রেভোলিউশনারি ওয়্যারের ক্ষতবিক্ষত স্মৃতি বুকে নিয়ে, ১৭৭৫ সালের
১৯শে এপ্রিল শুরু হওয়া সেই যুদ্ধের একটুকরো প্রামাণ্য দলিল বুকে নিয়ে জেগে আছে এই
ভ্যালি ফোর্জ ন্যাশনাল পার্ক। তাহলে একটু
খুলেই বলি শোন - ১৭৭৭ সালের ১৯শে ডিসেম্বর জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে কন্টিনেন্টাল আর্মি
শীতকালীন ঘাঁটি গেড়েছিল এই ভ্যালি ফোর্জে। প্রবল শীতে সৈনিকরা তখন সকলেই প্রায়
কাবু, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ঠান্ডায় মৃতপ্রায়। ছয়মাসের
এই অস্থায়ী ছাউনিতেও সৈনিকদের যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল ড্যাম্প, বরফশীতল আবহাওয়ার
সঙ্গে, অদম্য খিদের সঙ্গে। তাদের কাছে তখন না ছিল পর্যাপ্ত খাদ্য, না ছিল উপযুক্ত
পোশাক, না ছিল ভাল জুতো। যুদ্ধের তাড়নায় অনেকের পায়ের জুতোই নষ্ট হয়ে গেছিল। ভাবতে
পারো - সেই অবস্থাতেই, সেই কনকনে বরফের দুনিয়ায়, চূড়ান্ত ঠাণ্ডার মাঝে এক একটি
চালাতে প্রায় এক ডজন করে সৈন্য গাদাগাদি করে ওই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে রাত কাটাতে
বাধ্য হয়েছিলেন! ১১০০০ সৈন্যের মাঝে ২০০রও ওপর সৈন্য নাকি মারা গিয়েছিলেন – টাইফয়েড,
নিউমোনিয়া, স্মলপক্সে। ফিলাডেলফিয়ার
২৫ মাইল উত্তরপশ্চিমে এই ভ্যালি ফোর্জ ন্যাশনাল পার্ক আসলে এক উঁচু পাহাড়ি অঞ্চল
– মাউন্ট জয় আর মাউন্ট মিজারির কোলের নিরাপদ আশ্রয়ে চারপাশের বন্ধুর প্রাচীর ভেদ
করে ব্রিটিশদের পক্ষে এখানে আক্রমণ করাটা যথেষ্ট কঠিন ছিল, আর সেই কারণেই শীতকালীন
ক্যাম্পের জন্যে ওয়াশিংটন এই স্থানটিই নির্বাচন করেছিলেন। তারপর? তারপরের গল্প তো
ইতিহাস - ছয়মাস এইখানে ক্যাম্প করে থাকার পর এই কন্টিনেটাল আর্মি নিউ জার্সির
ব্যাটল অফ মনমাউথে ব্রিটিশ সৈন্যকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে দিয়েছিল!
|
লগ হাটের মধ্যে সৈন্যদের শোয়ার বাংক, আর ঐ যে ফায়ারপ্লেস |
|
ঐ জঙ্গলেই আছে সেই কুখ্যাত ওকগাছ |
|
ভ্যালির গা ছমছমে দৃশ্য |
মোহময় বিকেল গড়িয়ে ঝিমধরা সন্ধ্যে
নেমে আসছিল। প্রায় ৩৫০০ একর জুড়ে বিস্তৃত পেনসিলভ্যানিয়ার প্রথম স্টেট পার্কের
সুবিশাল চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যের ছিপছিপে আঁধারে মিশে যেতে যেতে হঠাৎ কেন জানি না
আমার মনে হল যেন ঘাড়ের কাছে কেউ নিঃশ্বাস ফেলল! চমকে পিছন ফিরে তাকালাম, কই, কেউ
নেই তো! তবে কি আমার মনের ভুল! হতেও পারে! ভুত আছে না নেই এই নিয়ে তর্কের চেয়েও বড়
বোধহয় হল - এই ভয়াল অনুভূতির স্পর্শটুকু, এই থমথমে ভয়ের হাড়কাঁপানি ধারণাটুকু! এই
নির্জন, শুনশান, একাকী নিঝুম প্রান্তরে, হুহু শীতল বাতাসের শিরশিরানিতে জমাট বেঁধে
থাকা অদ্ভুত শিহরণটুকু! বাবারে! ঐ শত শত মৃত সৈন্যকে এখানেই কোথাও না কোথাও কবর
দেওয়া হয়েছিল - কোথায় তা নিয়ে অবশ্য জল্পনাকল্পনার অন্ত নেই। অনেকেই নাকি সন্ধ্যের
ঘনালো আঁধারে কাঠের একচালা থেকে রক্তাক্ত সৈন্যদের উঁকি মারতে দেখেছেন, এমনকি
অস্বাভাবিক রকমের তীব্র গোঙানিও নাকি শুনতে পেয়েছেন অনেকেই! কাছেই ঐ জঙ্গলের মাঝেই
কোথাও আছে সেই সুবিশাল ওকগাছটা – শুনেছিলাম এক হিমেল শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে আশেপাশের
এলাকার দুতিনজন ঐ ওকগাছের মগডালে নাকি একটা ডেডবডি ঝুলতে দেখেছিল। তাড়াতাড়ি গাছে
ওঠার সমস্ত সরঞ্জাম জোগাড় করে তারা আবার সেখানে উপস্থিত হতে অবাক হয়ে দেখে ডেডবডি
ভ্যানিশ! শোনা যায়, এখানেই নাকি এক ব্রিটিশ স্পাইকে খুন করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর
থেকে গভীর রাতে অনেকেই নাকি গাছের উঁচুডাল থেকে একটা ডেডবডি ঝুলতে দেখেছেন! কিন্তু
কেউ আর কাছে যাওয়ার সাহস করেননি।
|
ওয়াশিংটনের হেডকোয়ার্টার, ভ্যালি ফোর্জ |
আমারও এই মুহূর্তে আর সাহস হল
না ঘন জঙ্গলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে! ভেতরের সাহসী মনের দপদপানিটুকু কখন যেন উধাও
হয়ে গেছে সন্ধ্যের কালো চোখের চোখ কড়কানিতে! ফাঁকা পাহাড়ি এলাকায় উত্তাল বাতাসের
শোঁশোঁ আওয়াজে হঠাৎ হঠাৎই কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে শুরু করেছে, গাছেদের
জড়াজড়ি ভিড়ের মাঝে ঝরাপাতায় খচমচ শব্দ করে হঠাৎ পিলে চমকে দিয়ে দৌড়ে গেল কোন
বেয়াক্কেলে কাঠবেড়ালি!
|
ওয়াশিংটনের প্রতিমূর্তি |
|
ন্যাশনাল মেমোরিয়াল আর্চ, ভ্যালি ফোর্জ |
মানে মানে বাড়ি ফেরার পথ
ধরলাম আমি। সুখে থাকতে ভুতের কিল থেকে আমার এই মুহুর্তে আর এতটুকুও ইচ্ছে নেই! তোমাদের
যদি ইচ্ছে থাকে তো আমাকে একটু জানিও, আমি পার্কে যাওয়ার সমস্ত হাল-হদিশ দিয়ে দেব
তোমাদের, কেমন!
|
একাকী |
|
দিগন্ত বিস্তৃত ভ্যালি |
|
আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কাঠের গুঁড়ি, ঠিক ঠিক সেভাবেই |
|
ইতিহাস বুকে নিয়ে জেগে রয়েছে এই ভ্যালি |
______
ছবিঃ লেখিকা
আমার next destination ঠিক করে ফেল্লাম, এত করে invite করলে কি আর ফেলতে পারি
ReplyDeleteantorik dhonyobad, ghure asun, ondhokar ghoniye asa obdhi thakar cheshta korben
Delete:)
এই লেখা পড়তে পড়তে সময় সরণি পেরিয়ে ধূসর ইতিহাসের অলিগলিতে পথ হারিয়ে ফেলে হঠাৎ ঘাড়ের কাছে হিম শীতল নিঃশ্বাস শুনতে পেলাম।
ReplyDeleteখুব ভালো।
onek onek dhonyobad, sotyi onuproanito holam
Delete