গোলটেবিল:: অশরীরী প্রহরী: জয়দীপ চক্রবর্তী :: আলোচনা: সুলগ্না ব্যানার্জ্জী


অশরীরী প্রহরী - জয়দীপ চক্রবর্তী
আলোচনা - সুলগ্না ব্যানার্জী

বইয়ের নাম: অশরীরী প্রহরী; লেখক: জয়দীপ চক্রবর্তী
প্রকাশক: পত্রভারতী; প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: রঞ্জন দত্ত এবং প্রদীপ্ত মুখার্জী
দাম: ৩২৫ টাকা (ভারতীয় মুদ্রা)

বইয়ের ভূমিকায় স্বয়ং লেখক জয়দীপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন ভূত মানেই অত্যাচারী - রাগি - ডানপিটে নয়, কখনও কখনও শান্ত - নিরীহ - গোবেচারা ভূতের দেখাও পাওয়া যায় ‘অশরীরী প্রহরী’ বইয়ের ২০টি গল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভূতের চরিত্রের ওপর আলোকপাত করেছেন তিনি এবার তাহলে সরাসরি চলে আসা যাক বইয়ের আলোচনায়

চরণদাস: সুবিমলের গ্রামের স্কুলের পুরোনো দারোয়ান চরণদাস গল্পের কথক দীপকে অচেনা ‘লক্ষণপুর’ গ্রামে পথ চিনিয়ে সুবিমলের বাড়িতে পৌঁছে দেয় যা শুনে সুবিমল নিজের বাকরুদ্ধ হয়ে যায় কেন? সেটা গল্পেই জানা সম্ভব

অঙ্কের ভূত: অঙ্কের স্যার বরুণবাবুর মতে ‘ভুতোটা কে ভূতে পেয়েছে’ কারণ যত সহজ অঙ্কই হোক না কেন ভুতোর মাথায় কিছুতেই ঢোকে না কেন? চায়ের দোকানি ভুতোর বাবা হরিপদ তাই ঠিক করেছিলেন তারা তান্ত্রিকের কথামতোই একটা যজ্ঞ করবেন তারপর...? সত্যিই কি ভুতোকে ভূতে পেয়েছিল সেটা জানার জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের এই মজার গল্পটি পড়তেই হবে

শেষ রাতের ট্রেন: বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা এই গল্পের ভৌতিক আবহাওয়া শিহরণ জাগায় শিরায় শিরায় গল্পের কথক ড: জেমস শিকারে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলে নির্জন রাস্তায় তার দেখা হয় জ্যাকবের সঙ্গে তুষারপাতের সেই রাতে কথক আশ্রয় চায় জ্যাকবের মনিবের বাড়িতে তারপরের ঘটনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বরং গল্পটা যে কোনো বয়সের পাঠককে অবশ্যই আকর্ষণ করবে

বংশীবটতলার ওদিকে: ভুবনপুরের রঞ্জন দত্ত ছোটোবেলা থেকেই দস্যিবৃত্তিতে সেরা ছিল এবং মাতৃবিয়োগের পর দস্যি থেকে দস্যু হয়ে খুনের মামলায় জড়িয়ে হাজতবাস করতে তার বেশি দিন সময় লাগেনি এহেন রঞ্জনই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বদলে গেল অনেকটাই রঞ্জন দস্যু থেকে পরিণত হল রঞ্জন তান্ত্রিকে মানুষের সাহায্যই তখন তার পথ এই সময় একদিন তার কাছে একটি বাচ্চা ছেলে এসে রঞ্জনকে জানায় তার মায়ের ওপর অশরীরী ভর করেছে
বাকিটা...! সত্যিই কি রঞ্জন সাত্ত্বিক হতে চেয়েছিল নাকি এর আড়ালেও ছিল তার ভণ্ডামি? শেষের চমকটা জানতে গেলে এ গল্প অবশ্যপাঠ্য

হরেন সমাদ্দারের ম্যাজিক: বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান হরেন সমাদ্দারের কথা বহুবার শুনলেও তাঁর খেলা দেখার সুযোগ ঋক আর সুতনু কখনও পায়নি সেবার সৌভাগ্যবলে ছোটকা একটা পাস পেয়েছিল কালিদাস কংসারি হলে হরেন সমাদ্দারের ম্যাজিক দেখার সে পাসে দু’জন অ্যালাও বলেই ছোটকা নির্দ্বিধায় সেটি তুলে দেয় সুতনুর হাতে কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে সুতনুর বাড়ি পৌঁছে ঋক জানতে পারে কংসারি হল যাবার রাস্তাঘাট বন্ধ, গাড়ি চলছে না অতএব উপায় কালিঝোরার ঘন জঙ্গলের পায়ে হাঁটা পথ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি সঠিক সময়ের মধ্যে কংসারি হলে পৌঁছোতে পারবে তারা? হরেন সমাদ্দারের ম্যাজিক দেখা কি তাদের পক্ষে সম্ভব হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে অবশ্যই পড়তে হবে মনোমুগ্ধকর গল্পটি

ব্যবসায়ী বিপুলবাবু: বাড়ির বড়োদের মুখে বিপুলবাবু বরাবর শুনে এসেছেন বাড়ির পাশেই খালপাড়ে তাঁদের যে খালি জমিটা বহুকাল ধরে পড়ে আছে তা বাস্তু ভূতদের ও জমি নিয়ে ব্যাবসা করলে তাঁদের কুনজরে পড়তে হবে কিন্তু বিপুলবাবু তো ব্যবসায়ী, এসব সেন্টিমেন্ট বোঝেন না ওদিকে তাঁর ছেলেরও টাকার প্রয়োজন শেষমেশ যখন সিদ্ধান্তের প্রায় দোরগোড়ায় তিনি পৌঁছেছেন হঠাৎ এক রাতে তাঁর সাথে দেখা হয়ে গেল মহিম মাষ্টারের কে এই মহিম মাষ্টার? তিনি কি পারবেন বিপুলবাবুর সিদ্ধান্ত বদলাতে? সে সব প্রশ্নের উত্তর দেবে এই গল্পটি, তবে এই গল্পের শেষে রয়েছে এক বিশেষ বার্তা

পানু তান্ত্রিকের প্রায়শ্চিত্ত: ‘আত্মা অবিনশ্বর’ এই মন্ত্রকেই জীবনের রোজগারের একমাত্র উপায় করে নির্দ্বিধায় পান্নালাল ওরফে ‘পানু তান্ত্রিক’ আর তার চেলা ‘ফড়িং’ দিব্যি মানুষ ঠকিয়ে যাচ্ছিল রোজগারপাতিও মন্দ হত না তাদের মানুষের বিশ্বাস - স্নেহ - ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে বেশ ভালোই ছেলেখেলা চালাচ্ছিল কিন্তু একদিন হঠাৎ... না থাক! চালাকির দ্বারা যে কোনো মহৎ কাজ হয় না লেখকের কলম এ গল্পের মাধ্যমে আবার বুঝিয়েছে সেই চিরাচরিত সত্য

জিতেন হেমব্রমের কলম: প্রীতম শত চেষ্টা করেও অংক আর ইংরেজিতে দক্ষতা আনতে না পারায় বন্ধু অরিন্দম তথা ক্লাশের ফার্স্ট বয়কে হারাতে পারে না এ নিয়ে তার ওপর চাপ দিতে পিছু পা হন না তার বাবা-মা একদিন ভরদুপুরে মা ঘুমিয়ে পড়লে ঘুড়ির পেছনে ছুটে প্রীতম পৌঁছে যায় পুরোনো গোরস্থানে আর সেখানেই প্রীতমের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় জিতেন হেমব্রমের কে এই জিতেন হেমব্রম? ফার্স্ট হলেই চার-চারখানা পছন্দমতো গল্পের বই, প্রীতম কি পারবে এ বছর ফার্স্ট হতে? ভৌতিক রস হলেও অপূর্ব মায়াময় এই গল্প মুগ্ধ করবে যে কোনো বয়সের পাঠককে

লাস্ট মিনিট সাজেশন: ফাইনাল পরীক্ষার লাস্ট মিনিট সাজেশনের জন্য উপযুক্ত মানুষ ‘বিমল’-দার সাহায্য নিতে চেয়েছিল মৃদুল প্ল্যানচেটের মাধ্যমে তার আহ্বান তার বন্ধুরা নাকচ করেনি, কিন্তু প্ল্যানচেটের আড়ালে আরেকটাও অভিসন্ধি ছিল মৃদুলের সেটা কী? বিমলদার আত্মা ঠিক কী সাজেশন দিয়েছিল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য? এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো গল্প যেখানে রয়েছে খুব সুন্দর বার্তাও

টমটম বাবার পাঠশালা: দীপ্ত-র মধ্যে ‘আমি’ বিষয়টা একটু বেশি, শুধু সে কেন আমাদের সকলের মধ্যেই হয়তো সেটা আছে কিন্তু শিলং-এ মাসির বাড়ি বেড়াতে এসে একা বেরিয়ে হঠাৎই পথ ভুল করে সে মনে তার খুব রাগ, বোন রুচিরার প্রতি তবে ভাগ্যে সে পথ ভুল করেছিল, তাই তো ‘রবিন’-এর সঙ্গে দেখা হল তার, আর রবিন তাকে নিয়ে এল টমটম বাবার কাছে তারপর...? ছোটোদের প্রতি এক সুন্দর বার্তা দিয়েছেন লেখক যা বড়োদেরও ভাবায়

মাধো সর্দারের শেষ ডাকাতি: রঘুনাথগঞ্জ তো বটেই, এমনকি তার আশেপাশের গ্রামগুলোও একসময়ে কাঁপত ডাকাত মাধবলাল ওরফে মাধো সর্দারের দলের নামে কালে কালে বয়স বাড়ার ফলে দল ভেঙে গেলেও বুধন, বাঁটু আর বৃন্দাবন তার সঙ্গেই থেকে গেছে তবে বয়স বাড়ছে, তাই এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাতদল ঠিক করল পরিত্যক্ত এক কুঠীবাড়ি, যেখানে লুকোনো ধনসম্পদের গুজব আছে সেখানে ডাকাতি করে আনুষ্ঠানিকভাবে ডাকাতির জীবন থেকে অবসর নেবে সফল হবে কি তাদের শেষ ডাকাতির পরিকল্পনা? বাকি রহস্য রয়েছে গল্পে

অশরীরী প্রহরী: স্বল্প পরিসরের এই গল্পে লেখকের ক্ষুরধার কলম যে দক্ষতা ফুটিয়ে তুলেছে তা জানতে এই গল্পটি অবশ্যপাঠ্য

ভূতবাবার মেলায়: বন্ধু অভিজিতের সঙ্গে তার গ্রামের বাড়িতে ঘুরে বাড়ি ফিরছেন লেখক সঙ্গে তাঁর বন্ধু দু’জনের মধ্যে আলোচনা চলছে ‘ভূত’ নিয়ে এমতাবস্থায় যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য কৃষ্ণমোহন হল্টে ট্রেন থেমে যায় ট্রেনেই তাঁদের আলাপ হয় হঠাৎ আবির্ভূত নিবারণ চন্দ্র দাসের সঙ্গে তারপর কী হয় তা জানতে গেলে পড়তেই হবে এই ভিন্ন স্বাদের গল্পটি

নারায়ণগঞ্জে দু-রাত: নিরিবিলি শান্ত গ্রাম নারায়ণগঞ্জে অফিস কলিগ সুপ্রিয়র সাজেশনে তাদের পুরোনো বাড়িতে বদনাম আছে জেনেও কৌশিক বেড়াতে আসে তার দুই বন্ধুকে নিয়ে সত্যিই কি অশরীরী আত্মাদের বাস ছিল সে বাড়িতে? গল্পের শেষের টুইস্টটা রীতিমতো গা ছমছমে

হারায় না কিচ্ছুটি: এ গল্প নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গেলে গল্পে থাকা দার্শনিকতার প্রতি অবিচার হবে শুধু বলতে পারি জীবনের না ফেরার পথে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে ফিরে পেতে গেলে মিশে যেতে হবে মানুষের মধ্যেই

একটু অন্তত ভয় পাওয়ান: ভূতের গল্প লিখে সবেমাত্র পরিচিতি লাভ শুরু করেছেন প্রাণকৃষ্ণবাবু, ডাক এল এক পত্রিকার চিফ গেষ্ট হিসেবে ছোটো পত্রিকা, তাই নিজের দায়িত্বেই যেতে রাজি ছিলেন তিনি তবে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছোনোর দিন সেখানে পৌঁছোনোর পথেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রিষভের, ভারী অদ্ভুত আর্জি তার কে এই রিষভ অথবা কী তার আর্জি তা জানতে হলে গল্পটি অবশ্যপাঠ্য

নগেন গোঁসাইয়ের নিদান: পৈতৃক সম্পত্তির জোরে অলস হরেন হালদার হঠাৎ জ্যোতিষ জীবন গোস্বামীর সাহচর্যে জানতে পারে তার আয়ু মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর অলস হরেন এতে খুশিই হয় এবং আলস্য তার বেড়ে যায় এমতাবস্থায় হঠাৎ একদিন রাতের অন্ধকারে তার ঘরেই সে দেখা পায় নগেন গোঁসাইয়ের কী হয় তারপর?

ডায়মন্ডহারবার লোকালের সেই লোকটা: ডায়মন্ডহারবার থেকে ট্রেনে কথক তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে উঠেছিলেন আর তখনই তাঁরা জানতে পারেন বাসুলডাঙার ঘটনাটি ওদিকে ট্রেন চলতে শুরু করলে তাঁদের সকলের মনে হয় তাঁরা ছাড়াও ট্রেনে আরেকজনের উপস্থিতি কী ঘটে শেষ পর্যন্ত? গা ছমছমে গল্পটি জয় করবে সবার মন

নতুন আনা রেডিও: না রেডিওটা মোটেই নতুন নয়, বরং সেকেন্ড হ্যান্ড আজকাল রেডিওর মতো জিনিস খুব কম লোকের বাড়িতেই আছে বাঙালির কাছে যেমন রেডিওর গুরুত্ব মহালয়ার ভোরেই তেমনই ব্যতিক্রমী নন তিনিও পুরোনো রেডিওটা এবছর ঝেড়েঝুড়ে ঠিক না করতে পেরে যখন তিনি শম্ভু মুখুজ্জের দোকানে গেলেন, শম্ভুবাবু তাঁকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড কিন্তু ভালো রেডিওই দিলেন তবে গোলমাল শুরু হল সেই রাত থেকেই কী গোলমাল তা জানতে অবশ্যই পড়তে হবে এই গল্পটি

অন্য ভূতের গল্প: মানুষই যে কেবল ভূত ভয় পায় তাই-ই নয়, ভূতও ভয় পায় মানুষকে কিন্তু ‘আত্মারাম’ আর ‘প্রবাল স্যার’ দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা হয়েও কী সুন্দর বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন একে অপরের, তা এই গল্পের মূল বিষয় সুমধুর কাহিনি বলতে যা বোঝায় এটি তাই-

সবশেষে বলব, সুলেখক জয়দীপ চক্রবর্তী ‘অশরীরী প্রহরী’ গ্রন্থে কুড়িটি ভিন্ন স্বাদের গল্পের এমন সুন্দর মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন যা কেবল কিশোর সাহিত্যের অন্তর্গত হলেও আকর্ষিত করবে যে কোনো বয়সের পাঠককে
----------
ম্যাজিক ল্যাম্প 

1 comment:

  1. ভীষন সাবলীল সুন্দর স্বতঃস্ফূর্ত রিভিউ

    ReplyDelete