সপ্তসুরপু্রের কাণ্ডকারখানা
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
।। ১ ।।
“আজ্ঞে, সপ্তসুরপু্রটা কোথায় বলতে পারবেন?”
“তুমি কে বাপু! সপ্তসুরপুরের খোঁজ চাইছ!”
আড়ে চাইলেন কুঞ্জসুন্দরবাবু, যাকে বলে নিরীক্ষণের উদ্দেশ্যে - বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের ছোকরা ছেলেটির মুখটা ভারী মায়ামাখানো। মাথায় উশকোখুশকো চুল, পরনে একটা সাত পুরোনো শার্ট-প্যান্ট। পায়ে দু-তিনবার সেলাই হওয়া চটি। কাঁধে একটা ঝোলা, বেশ ভারী বলে বোধ হচ্ছে। তার থেকে কিছু কাগজপত্তরও উঁকি মারছে! কুঞ্জসুন্দরবাবু হলেন এই রঘুগঞ্জের এক হর্তাকর্তা ব্যক্তি। নাদুসনুদুস গত্তিওয়ালা কুঞ্জবাবুর গঞ্জে তিনখানা অয়েল মিল রয়েছে, এছাড়াও সোজা-বাঁকা নানা পথে নানা ব্যাবসা রয়েছে কুঞ্জসুন্দরের। গঞ্জের লোক তাঁকে মান্যিগণ্যি করে। তাঁর নাম নিয়ে দু’ঢোক জলের সঙ্গে ভয়ও খায়।
আজ নেহাত তালেবর সামন্তর ছেলের মুখেভাত, তাই না এই বোশেখের কিটকিটে ভরদুপুরে গঞ্জের রাস্তায় নেমন্তন্ন খেতে বেরোনো। না হলে এতক্ষণে মিল ঘুরে কাজ সেরে ফেলতেন। এর দোষ, তার খুঁত ধরে-টরে দু’জনকে গালাগালি আর তিনজনকে ঝামটা মেরে কথা শুনিয়ে সুখে ভুড়ভুড় দিবানিদ্রা দেবার কথা তাঁর এখন। কুঞ্জসুন্দরের জীবনে দুটি ব্রত, এক, টাকা করা, দুই সারাদিনে অন্ততঃ জনাপাঁচেক লোককে ভুল ধরানো। ভুল ধরিয়ে, তাদের মুখ শুকিয়ে খাবি খাইয়ে না দিতে পারলে তাঁর সেদিনের ভাতই হজম হবে না। অবশ্য সেরকম অশৈলী ঘটনা খুব একটা ঘটে না। কুঞ্জসুন্দরের মাইনে করা লোক রয়েছে। ঝানু পাল তার নাম। তা সে নামে যেমন, কাজেও তেমন। যেদিন যেদিন মিলের ছোটোবাবু বা আর কোনো কর্মচারীর কোনো দোষ পাওয়া যায় না, সেদিন সেদিন সে রাস্তা থেকে উমনো-ঝুমনো লোক ধরে আনে। তাদেরকে ভালোভাবে গাল দিয়ে, তাদের খাতা-পেনসিল দিয়ে ভুলগুলো পাঁচ পাঁচে পঁচিশবার করে লিখিয়ে, তবে ভাত হজম করেন কুঞ্জসুন্দরবাবু। তা আজ তাঁর ভাগ্য বেশ ভালোই বলতে হবে। বেমক্কা হাতের কাছে এরকম মাতব্বরি করার লোক দুপুর দুপুর পেয়ে গেলেন! তালেবর খাইয়েছেও ভালো। পমফ্রেটের কালিয়া, কইমাছের কারি, পাঁঠার মাংস, পোলাও, কোর্মা, রাজভোগ… সব মিলিয়ে সে এক হাপুসহুপুস টইটুম্বুর ব্যাপার। তা সেগুলো হজমের এমন বাজখাঁই সুযোগ এককথায় পেয়ে গিয়ে কুঞ্জসুন্দর যাকে বলে যারপরনাই খুশখুশা হয়ে উঠলেন। কিন্তু, একটা শুকনো-পাকনা ছেলে এভাবে দাঁড়িয়ে চারিদিকে সপ্তসুরপুরের সুলুকসন্ধান করছে কেন? সেই ঘটনার পর থেকে ত, ওখানে আর কেউ…!
কথা বলে দেখা যাক! ভাবলেন তিনি!
“তা, দূর দেশ থেকে এখানে কী মনে করে!”
“আজ্ঞে, আমি লিখি, তা শুনেছি সপ্তসুরপুরের কবি নিতাই সোম শিক্ষানবিশি নিচ্ছেন, তাই জন্যেই…”
অবাক চোখে তাকালেন কুঞ্জসুন্দর। কিন্তু তিনি, যাকে বলে ঘোড়েল ব্যক্তি! তো, গলায় উদাসী সুর খেলিয়ে বললেন, “অ… এই কথা, তা সে আগে বলতে হয়! ওই অকালকুষ্মাণ্ড নেতাইয়ের বাড়ি যাবে!”
“আজ্ঞে, অকাল…”
“কুষ্মাণ্ড! শোনোনি নাকি কথাটা? সেদিনের ছেলে, সেও নাকি কোবতে লেখে, তার আবার শিক্ষানবিশ! ছো! বলি কাজ জোটাতে পারনি? দুই কুড়ি বয়েস পার হতে চলল, এসেছ কোবতে শিখতে! তুমি মানুষ না ওরাংওটাং?”
“আজ্ঞে আমি কবি!” বেশ জ্বলজ্বলে বড়ো চোখে বুক ফুলিয়ে বলল রাগকুমার।
কুঞ্জসুন্দর বিদেশি কাকাতুয়ার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে চোখ কুঁচকে তিরিশ সেকেন্ড, যাকে বলে অবলোকন করলেন রাগকুমারের মুখটা! তারপর কেমন যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললেন, “তা যাও, ওই পুব দিক বরাবর, কিছু দূর গেলে দেখবে একটা বুড়ো বট, ওর পাশ দিয়ে গেলে মুসুর ডালে কড়াইবুড়ি সাড়ে তিন পাক দেবার আগেই পৌঁছে যাবে! তারপর? দিনের বেলা পটর পটর, রাতের বেলা হরিমটর!”
।। ২ ।।
ভারী অদ্ভুত জায়গা তো এই সপ্তসুরপুর! হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল রাগকুমার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। রাস্তায় একখানাও আর লোক নেইকো। রাগকুমারের পেটে সাড়ে সতেরোখানা ছুঁচো একসঙ্গে, যাকে বলে ডন আর বৈঠক মারছে, এদিকে বটগাছও পেরিয়ে এল, কিন্তু নিতাই সোমের বাড়ি কই? ফাঁকা রাস্তার দু’পাশ জুড়ে গাছের ভিড় বাড়ছে, এমন সময় দূরে একটা পোড়ো বাড়ির আভাস পেল রাগকুমার। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে সেদিকে কিছুটা এগোতেই সাঁ করে কী একটা কানের পাশ দিয়ে গাছের গুঁড়িতে গিয়ে লাগল! রাগকুমার কাঠ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল! তারপর খুব আস্তে বাঁ দিকে ঘাড় ঘোরাতেই চক্ষু ছানাবড়া, একটা আস্ত তির! ভয়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই চমকানোর পালা,
“রে দুর্মদ শোণিতপিপাসু রক্ষ
কী চাস বিদীর্ণ করি আমার বক্ষ!”
বজ্রগম্ভীর স্বরটা সামনে এগিয়ে আসছে ক্রমশ! টানা চোখ মেলে ভ্যালভেলিয়ে তাকাল রাগকুমার!
লম্বা সাদা দাড়ি বুক অবধি নেমেছে। কোটরগত দু’খানা চোখ যেন আগুনের ভাঁটা, গায়ে পিরান, হাতে ধনুক!
“কে তুই, ধিক! অবিমৃশ্যকারী বল্মীক! দাঁড়াস আমার ফুলের ’পরে, থাকবে না আর মুণ্ড ধড়ে!”
রাগকুমার চমকে উঠে পায়ের দিকে তাকাল। সত্যিই তো। সে একটা বাহারি লতানে গাছের ফুলের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! তাড়াতাড়ি পা সরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে একটা পেন্নাম ঠুকল সে, “পেন্নাম হই খুড়োমশাই। আমি রাগকুমার!”
“রাগ না বিরাগ?”
“আজ্ঞে?”
“কী কারণে আসা? মোর জিজ্ঞাসা!”
“আজ্ঞে, আমি এসেছি নিতাই সোমের কাছে! উনি শিক্ষানবিশি নেবেন বলেছিলেন!”
কোমল হয়ে এল মারকুটে চোখ!
“এই কথা! বললেই হয়! এসো, পাটি পেতে দিই, বোসো।”
“আজ্ঞে, আমি ভয়ে ফুটোবালতি হয়ে গেছলুম!”
“বটে, সব সাহস গিয়ে/ পালিয়েছে ফুটো দিয়ে! তাই ফোটেনি কথা, নইলে অন্যথা?”
কিছুই না বুঝে বৃদ্ধের পিছন পিছন চলল রাগকুমার। বাড়িটার চারপাশে জঙ্গল হয়ে রয়েছে, বহু গাছ, বিবিধ পাখি। লোহার সড়ালে গেট ঠেলে ঢুকল দু’জনে। লম্বা নুড়িবিছানো পথের শেষে বাড়ির দরজা, তার সামনের চাতালে এসে থামলেন খুড়োমশাই।
“রোসো, আমি যাই, জল-টল আনি, তুমি বোসো।”
সুড়ুৎ করে দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। চাতালে বসে চারদিকটা পড়ন্ত বিকেলের আলোয় দেখে বিশেষ ভরসা হল না রাগকুমারের। বাড়িটার, যাকে বলে ভগ্নদশা, এক কালে হয়তো জাঁকজমক ছিল খুবই, কিন্তু এখন তার হাড়গোড়টুকু আছে কেবল। উপরের ঝুলবারান্দাটা ভেঙে পড়বে যে কোনোদিন। ঘরগুলোও কেমন অন্ধকার মতন। বাড়ির চারিদিকে নানা ফুল-ফলের গাছ। একটু সাজানো থাকলে হয়তো বাগানই বলা যেত, কিন্তু এখন যা অবস্থা, তাতে এও জঙ্গলই হয়েছে। সূর্য নিভে আসছে, ইনি যদি আজ থাকতে না দেন তাহলে এই ভুলভুলুয়া দেশে সে কোথায়…
“জানলে কোথায় আমার খবর? এই ন্যাও চা, জবর…”
যেমন হঠাৎ চলে গিয়েছিলেন তেমনই হঠাৎ ফেরত এসেছেন খুড়োমশাই, হাতের সানকিতে চা, খানিক পাউরুটি আর জল। কপাকপ সেগুলো উদরস্থ করার পর প্রশ্নটা খেয়াল হল রাগকুমারের। লজ্জা পেয়ে সে বললে, “আজ্ঞে…”
“কথায় কথায় এত আজ্ঞে কর কেন বল তো? নিজের রাস্তা নিজেই চল তো?”
“আজ্ঞে…”
“আবার…!”
চোখ পাকালেন খুড়ো, “মানে আপনিই কি শ্রীল শ্রীযুক্ত…”
“জানি না যুক্ত না বিযুক্ত, না বেশি না কম, আমি নিতাই সোম!”
“আজ্ঞে, ধন্যি হই, যদি পাই আপনার শ্রীচরণ…”
“মরণ…, খুলে বল ছোঁড়া, আমার আছে তাড়া…”
“আগ… ইয়ে মানে আমি হলেম রাগকুমার। নিবাস, ঐ গঙ্গাপারের শহরে। আমি ছেলেপুলেদের পড়াতাম। শুধু পড়াতাম না, তাদের নতুন কাব্যির কথা, গানের কথাও শোনাতাম। ছেলেরাও আমায় ভালোবাসত খুব। তা সেই নিয়ে ভারী ঝামেলা হল। অন্য মাস্টাররা হিংসেয় জ্বলল! তারা সবাই মিলে বড়ো অপমান করলে, বললে আমি নাকি পড়া না করিয়ে গুচ্ছের বাজে জিনিস শেখাই। হেডস্যারের কানে যেতেই চাকরিটি গেল। থাকতুম যে ভাড়াবাড়িতে তার ভাড়া পড়ল বাকি। একদিন বাড়িওয়ালাও দিল খেদিয়ে! বাপ-মা নেই, স্বজন-বন্ধু কাউকে চিনি না, লেখালিখি মাথায় উঠেছিল। কোথায় যাব, কী করব কিচুই বুঝতে পারছিলুম না, তখনই আমাদের মেসের পুরোনো লোক গৌরের সঙ্গে দেখা। সেই বললে আপনার কথা। আপনি নাকি গুরুকুল খুলেছেন, শিক্ষানবিশ নেবেন। আপনার লেখা কত পড়েছি… তাই তো দৌড়ে চলে এলাম…”
“হুম, তা তুই কিছুদিন থাক, বাকি তারপরে দেখা যাক…”
“আজ্ঞে, আপনি আমাকে…”
নিতাই সোমের পাকানো চোখ দেখে আর বেশি কিছু বলার সাহস হল না রাগকুমারের। সে সোমের পিছু পিছু ঢুকে গেল পোড়ো বাড়িটার ভিতর। যার নাম “রত্নকুঞ্জ”। বাইরের বাগানে তখন সন্ধ্যারাতের চাঁদ উঠেছে। বাতাসে শরীর জুড়ানো মৃদু হাওয়া…
।। ৩ ।।
“কোনো সন্ধান পেলি?”
“না হুজুর, শঙ্খমণির কোনো সন্ধান ওই বুরবক জানেই না।”
“সে জানার কথাও না”, গোঁফ চুমরে বললেন কুঞ্জসুন্দর, “তবু তুই নজর রাখবি ঝানু!”
……………………………………………………………………………………
আজ মাসখানেক হল নিতাই সোমের বাড়ি আছে রাগকুমার। দিন তার খারাপ কাটছে না। তবে ব্যাপার ভারী অশৈলী! শিক্ষানবিশি বলতে সে একাই। আর তাকে দিয়ে উস্তুম-খুস্তুম কাজ করান নিতাইবাবু। বাগান পরিষ্কার, জল তোলা, দুধ আনা, ঘর-ঝাঁট, এমনকি সময় সময় কড়াইবুড়ির হাত-নুড়কুৎ হয়ে রান্নার এটা-ওটা সাহায্য। তবে কাব্যিকথা বিশেষ হয় না, এই যা দুঃখু। ভয়ে ভয়ে দু’বার বলতে গিয়েছিল, দু’বারই বিরাশি সিক্কার ধমক খেয়ে ফিরেছে। নিতাই সোম পরিস্কার জানিয়েছেন, তাড়াহুড়ো করলে এখানকার থাকা-খাওয়া সব উঠবে। তা এসব তার অভ্যেস আছে। গরিব মায়ের ছেলে। বাপ তো কবেই চলে গেছেন। সেই থেকেই লড়াই। তবু ভালো কড়াইবুড়ি ছিল। নাহলে তো হাত পুড়িয়ে খেতেও হত তাকে।
বেশ মানুষ এই কড়াইবুড়ি। বয়স নাকি একশো-আট। এই বয়সে একলা কাঠ কুড়োয়, রাঁধে-বাড়ে, খায়-দায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, অমন বাঘের মতো নিতাই সোমকে বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। তার নাকি দুর-সম্পর্কের মাসি সে। ‘রত্নকুঞ্জ’-র থেকে দশ-পা দূরে বুড়ির ঘর। যত দিন রাগকুমার এসেছে, এই কড়াইবুড়ির কাছেই তার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন নিতাই সোম। উনি নিজে কখনও খেতে আসেন না বুড়ির কাছে। সত্যি বলতে কি উনি কখন খান, কখন শুতে যান, সারাদিন কী করেন, এ সবকিছুই রহস্য রাগকুমারের কাছে। কেবল দিনের আলো পড়লেই বাগানে ওঁর কাছে ডাক পড়ে। সেখানে কাজ হল রোজ নতুন একখানা করে গাছ চেনা। বাগানটাকে যে কী ভালোবাসেন নিতাইবাবু, অথচ বাগানের একটা কাজও নিজে করেন না। সারা
সকাল রাগকুমার বাগানে কাজ খাটে, আর সারা সন্ধ্যা তার সারাদিনের খতিয়ান নেন নিতাই সোম।
“তা ছেলে, আজ কী খেলে?”
“আজ্ঞে বকা, কেস, মারধোরটাও হত, কিন্তু…” সরল মনে বলল রাগকুমার।
“তুমি ত বেকুব শিরোমণি, ক্যামনে পাবে শঙ্খমণি?”
“শঙ্খমণি?” অবাক প্রশ্নটাতেই বাঘ হয়ে উঠলেন নিতাই!
“কে বলছিল ঝানুর সঙ্গে কথা? পিঠে পড়লে, বুঝবে ব্যথা!”
হ্যাঁ, আজ ঝানু পাল এসে কড়াইবুড়ির বাড়ির দরজায় তার সঙ্গে বকছিল বটে! ঝানু পালকে চিনতে বেশি সময় লাগেনি রাগকুমারের। গঞ্জের বিচ্ছিরি বড়োলোক কুঞ্জসুন্দরের, যাকে বলে ডান হাত। তাকে যে চটানো যাবে না, সে কথা কেমন করে বোঝানো যাবে নিতাইবাবুকে! তাছাড়া সে এসে মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয় রাগকুমারের, সে কেমন আছে, কার কাছে খাচ্ছে, কী করছে, এই সব। কড়াইবুড়ি অবশ্য তাকে দেখলেই গাল পাড়ে! আর হ্যাঁ, নিতাই সোমের কথা ঝানুর কাছে বলতে কড়াইবুড়ি কড়া করে নিষেধ করেছে! তাই তো রাগকুমার চুপচাপই থাকে, তাতেও এত হ্যাটা! বলি, দাবিটা কী!
আর আজকের গাছটাও তেমনি। কৃষ্ণচূড়া গাছ আবার চেনার কী আছে বলো দেখি! এসে ইস্তক কেবল গাছ আর বাগান! উফ, এই নাকি কাব্যের শিক্ষানবিশি, এর চেয়ে হিমালয়ে গিয়ে সাধু হওয়া ঢের ভালো ছিল! হাতের হ্যারিকেনটা তুলে ধরল বিরক্ত রাগকুমার। আর ঠিক তখনই, “ওরে ওরে, ফেল তো দেখি আলো, করছে ঝলোমলো...” “কোথায়! কোথায়!” হইচই করতেই আবার ধমক! “চুপ কর, চারদিকে আছে চর!” নিতাই সোমকে অনুসরণ করে আস্তে আস্তে বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে গিয়ে দাঁড়াল রাগকুমার। একটা গাছ, নতুন নাকি! একমাস ধরে এই বাগান পরিষ্কার করছে, এ গাছ ত দেখেনি! পানপাতার মতো বড়ো বড়ো লাল পাতা, ঝাউ গাছের মতো একহারা উপরে উঠে গেছে, হাত-দুই লম্বা, আর উপরে ওটা কী? আরে কুঁড়ি তো! চাঁদের আলো পড়ে সাদা কুঁড়িটা ঝকঝক করছে!
“দুধের মতো সাদা!” বিগলিত হয়ে বলে ফেলে রাগকুমার, আর এই প্রথম মিঠে সুরে কথা বললেন নিতাই সোম, “ঠিক, দুধে কী থাকে বল তো…”
“আজ্ঞে, আমি জানি না, তবে ঝাঁটু গোয়ালা জানবে, কাল সকালে…!”
“ওরে কুটকুটে কপোতাক্ষ! দুধে রস থাকে! কাল মাঝরাতে এইখানে আসবি। কাল পূর্ণিমা, তোর শিক্ষা পূর্ণ হবে!”
কী শিক্ষা, কীভাবে পূর্ণ হবে, কিছুই বুঝল না রাগকুমার, নামে রাগ থাকলেও আসল রাগপ্রধান তো এই নিতাইবুড়ো! গজগজ করতে করতে নিজের মনে রত্নকুঞ্জের দোতলায় নিজের ঘরে ঘুমোতে গেল রাগকুমার। রাগের চোটে খেয়ালই করল না, নিতাই সোম পদ্য ছেড়ে গদ্যে কথা কইছেন।
।। ৪ ।।
জ্যৈষ্ঠসন্ধ্যার চাঁদ উঠেছে বাগানে। সত্যি এক মাসে বাগানটাকে একদম অন্যরকম করে ফেলেছে রাগকুমার। এক্কেরে, যাকে বলে ফাস্টো কেলাস! “রাগকুমার!” নাম ধরে ডাকছেন নিতাই কবি! গুটিপায়ে এগিয়ে গেল রাগকুমার। “আয় এখানে!” উত্তর-পূর্ব কোণের গাছটার দিকে গিয়ে অবাক হয়ে গেল রাগকুমার! এক দিনে কুঁড়িটা এত বড়ো হয়ে উঠেছে!
“শোন বলি, আজ থেকে ঠিক চব্বিশ বছর পূর্বে এই সপ্তসুরপুর ছিল ভারী চমৎকার জায়গা। গাছে গাছে বানর, মাঠে মাঠে দস্যি ছেলেপিলে, ঘরে ঘরে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের দল। সকালে উঠে সবাই রাগসাধনা করত। গান-বাজনা, পাঠ, কবিতার পালা বসত প্রতি সপ্তাহে। আমার বাপ-মাও ছিল তার মধ্যে। কিন্তু, সে বেশিদিন রইল না। সবাই দলে দলে শহরের দিকে গেল। সেখানে অনেক টাকা…”
“তার সঙ্গে টাক, পুরো ফ্রি, যাকে বলে…” স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কথাখানা বলেই জিভ কাটল রাগকুমার, “এই রে!”
কিন্তু না, মাত্র একবার ভস্মকারী চাউনি দিয়ে, আবার শুরু করলেন নিতাই সোম...
“এই সপ্তসুরপুর তার দিশে হারাল। বাবা-জেঠা-কাকারা চলে গেলেন। পড়ে রইলাম মা আর আমি। তাও লেখায় কিছু নামডাক হওয়ায় আমার দিন চলে যেত। তেমন অভাব হয়নি। তখনও জ্ঞানের দিন ছিল! লোকে আলগা-মেধার থেকে মননকে গুরুত্ব দিত বেশি! এমন সময় মা পড়ল অসুখে। যখন বুঝলাম কিছু করার নেই, তখন মনখারাপ করে এই বাগানে এসে মায়ের পাশে বসে থাকতাম। তখনই মা আমার হাতে শঙ্খমণি গাছের বীজ দিয়েছিল। মায়েরই নির্দেশমতো এই বীজ বাগানের উত্তর–পূর্ব কোণে পুঁতে দিয়েছিলাম। মা বলেছিল, এই গাছে এক যুগ, মানে বারো বছরে একবার ফুল হবে। শঙ্খমণি ফুল, আর তখনই গাছটা দেখা যাবে। যে ফুল পাবে, সে হবে অমিত ঐশ্বর্য্যের অধিকারী।”
“গুপ্তধন?” শুধোল রাগকুমার!
মাথা নাড়লেন নিতাইবাবু।
“বারো বছর অপেক্ষা করেছি। যখন ফুল তোলার সময় এল, ঠিক তখনই… ওই কুঞ্জসুন্দর আমায় আক্রমণ করল গুপ্তধনের লোভে। আর…”
“তারপর…” অধৈর্য্য গলায় জিজ্ঞেস করল
রাগকুমার।
“ওই কাদাখোঁচার বাচ্চা ঝানু ছিল আমার চাকর। ও-ই গিয়ে লাগাল কুমির কুঞ্জসুন্দরটাকে, সে তখন সদ্য গঞ্জে এসেছে। ব্যস। আমার আর পাওয়া হল না শঙ্খমণি! কিন্তু মাতৃদায়, কারও না কারও হাতে তুলে দিতেই হবে এই ফুল, নাহলে আমার এই ল্যাজেগোবরে অবস্থা থেকে মুক্তি নেইকো। মা-ই বলেছিল উত্তরাধিকারী আসবেই! তোল ঐ কুঁড়ি।”
ভেবলু বালকের মতো রাগকুমার ফুলটা তুলতেই সেটা তার সাত-পাপড়ি মেলল। আর সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন ধাক্কা দিল রাগকুমারকে। সে বুঝতে পারছে সব কিছু, অনুভব করতে পারছে, প্রত্যেকটি গাছ, প্রাণ। সুর-কাব্যের ঢেউ খেলছে মনের ভেতর। সে এক উথাল-পাথাল অবস্থা।
“ওরে, গোবরমুখো পুতেরা জানত না, শঙ্খমণি হল জ্ঞানপুষ্প, তার মূল্য হল চৈতন্য, কোনো সাধারণ রত্ন বা অর্থ নয়। জেনে রাখ রাগকুমার, প্রত্যেক গঞ্জে, শহরে, দেশে এইরকম জ্ঞানপুষ্প থাকে, কিন্তু আসল মানুষের অভাবে, মাটির অভাবে তা ফুটতে পায় না। আজ থেকে আবার সপ্তসুরপুর তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে! এই এক মাসের কৃচ্ছসাধন ছিল তোর রেওয়াজ। তুই এখানে পাঠশাল খুলবি, কাব্যি-গান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে বড়ো করবি ছেলেপিলেদের। আর সময় হলে এই জ্ঞানপুষ্প থেকে বীজ হবে, তার থেকে হবে নতুন গাছ! তুই তা তুলে দিবি যোগ্য লোকের হাতে, বুঝলি নিড়বিড়েটা?”
চোখের সামনেই বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছেন নিতাই সোম।
“সেদিন আমার মাথায় লাঠি মেরে ওরা আমার প্রাণটা নিয়েছিল, কিন্তু আত্মাটা আটকে ছিল রে! মাটির কাব্য আমার শেষ, এবার আকাশের দেশে যাবার পালা।”
জোড়হাতে অবাক আকাশপানে চেয়ে জলভরা চোখে একটা পেন্নাম ঠুকল জ্ঞান-টলটলে রাগকুমার।
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল
Vlo laglo.. onekta sirrshedu mukhopadhyay odbhuture er chhaya pelam jeno...
ReplyDelete