যাদুকরের পাখি
সঙ্গীতা দাশগুপ্তরায়
সবাই বলে যাদুবুড়ো
খুঁজে বেড়ায় ছোটো ছেলেমেয়েদের। একা কোনও বাচ্চাকে পেলেই তুলে নিয়ে আসে ঘরে। তারপর মন্ত্র পড়ে মাটির নিচের ঘরে পাথর বানিয়ে শুইয়ে রাখে আর প্রাণটা
তুলে নেয় কালো বোতলের মধ্যে। লোকে বলে ওর বয়স
হয়েছে দুশো কি তিনশো। বুড়ো অবশ্য হাত
কচলায়, ছাতা পড়া কালো দাঁত দেখিয়ে হাসে আর বলে, ওসব কিছু না। আমি ছেলেপুলের প্রাণ নিয়ে কী করব অ্যাঁ! এসব কারা রটায়
রে বাপু!
একটা ভীষণ সুন্দর
দেখতে ঈগল আছে ওর। হলুদ ঠোঁট, সাদা মাথা আর
কালচে বাদামি শরীরের বিরাট ঈগলটা কি সত্যিকারের ঈগল পাখি না আসলে কোনও ছোটো ছেলে তা
কে জানে। যাদুবুড়ো থাকে চার্চের পিছনের ছোটো বাড়িটায়। পোড়ো বাড়িটার না আছে দরজা না আছে জানালা। কিন্তু যাদুর গন্ডি টানা ও বাড়িতে কেউ কখনও ঢোকেনি। বুড়োকে সব্বাই ভয় পায়। চার্চের বিশপ
অবশ্য বলেন যাদুবুড়োর মনে অনেক দুঃখ, তাই সে মানুষের ভালো সহ্য করতে পারে না। তা সে যাইই হোক, মোট কথা নিজে যেচে বুড়োর ছায়া কেউ মাড়ায়
না। বাজারে যখন যায় বুড়ো, তখন ওর দুশো বছরের
পুরোনো পাকানো লাঠির মাথায় পাখিটা বসে থাকে। ব্যাপারিরা যার
যার দোকানের ভালো ফলটা আনাজটা রুটির খন্ডটা দিয়ে দেয় বুড়োর ঝোলায়। ঈগলটার মুখের কাছে ধরে শুকনো মাছ কী পোড়া মাংসের এক টুকরো। না দিলে নিস্তার নেই যে। কবে কোন দোকানি
নাকি কিচ্ছু না দিয়ে হাঁকিয়ে দিয়েছিল বুড়োকে, বলেছিল পয়সা ফেলে
জিনিস কিনে নিয়ে যাও, মাগনা কেন দেব, ব্যস। সেই দোকানের কোনও ফল, সবজি দুধ আর কখনও বিক্রি হয়নি। হবে কী করে! যাইই এনে দোকানে সাজায়, মিনিটের মধ্যে
পচে যায় সে সব জিনিস।
তাই কেউ ওকে চটায়
না। আর ও যে ছেলে চোর, সেও সবাই জানে,
তাই তারা বাড়িতে বাচ্চাদের একা রেখে বেরোয় না কখনও। ও যে বাচ্চাদের মায়ের রূপ ধরে ডাকে, মায়ের গলা করে
দরজা ধাক্কা দেয়, তারপর দরজাটি খুলেছ কি ব্যস। ঝোলা তুলে নিয়ে সোজা ওর ওই ভাঙা বাড়ির মাটির নিচের ঘরে নিয়ে বন্দি করে
দেবে!
কিন্তু গ্রামের শেষে ভাঙা কুঁড়েঘরে
থাকা আলিয়াশার মায়ের কানে সে কথা তুলে দেওয়ার মতো কেইই বা আছে। এমনিতেও বরফে ঢাকা জংলি গাঁয়ে মানুষ থাকেই বা ক’টা। যারা থাকে তারা বেশিরভাগই বুড়োবুড়ি। ছেলে বউরা তাদেরকে রেখে কাজ করতে গেছে শহরে। ক্রিসমাসের সময় তারা আসবে বলে বুড়োরা মোটা মোটা আগুনের কাঠ কেটে জমা করে, বুড়িরা ভ্যানিলা
বিনস্ জোগাড় করে রাখে, ঘরের দুধ থেকে একটু মাখন আর একটু চিজ বানিয়ে
ভরে দেয় জানালাহীন কুঠুরির তাকে।
এরই মধ্যে বুড়ো
আলজিদান নিজের বাড়ির হাতার জমিতে খানিক মুলো, জুকিনি, কপি, কুমড়োর চাষ করে। ছোটো গাঁয়ের সেরা ফসলের প্রতিযোগিতায় আলজিদানের বুড়ি
বউ তাশানি বড়ো টুপিটি মাথায় দিয়ে, হলদে সবুজ গাউন পরে হাসিমুখে ইয়াব্বড়ো কপিখানা
বুকের কাছে ধরে এমনভাবে দাঁড়ায় যেমন ভাবে পঞ্চাশ বছর আগে সে তার কোলের খোকাকে নিয়ে
দাঁড়াত।
যাক, হচ্ছিল আলিয়াশার
কথা। আলিয়াশার বাপ কাজ করে রাজার আস্তাবলে। ছুটিছাটার বালাই নেই। বাড়ি আসার সুযোগ
পায় সে পাঁচ বছরে একবার। আলিয়াশার মনেও নেই তার বাপের মুখখানা। খালি মনে আছে বাপ হল ইয়া লম্বা চওড়া একটা
লোক যে অনেকখানি মাথা নিচু করে তাদের ছোটো দরজা দিয়ে বাড়িতে
ঢোকে আর কথায় কথায় আলিয়াশাকে আদর
করে বুকে চেপে ধরে।
বাড়ি আসতে না
পারলেও মাঝেসাঝে টাকা অবশ্য পাঠায় বাপ। আর দু’লাইনের
চিঠি। সে সব আসে আলজিদানের ঠিকানায়। গাঁয়ের সবারই চিঠি টাকা সবই আলজিদানের ঠিকানায় দিয়ে যায় ডাকের গাড়িখানা। জঙ্গল ঘুরে ঘুরে কে আর চিঠি বিলোবে। সময়ই বা কই! ডাকগাড়ির ঘোড়াগুলো যেমন বুড়ো তেমন বেতো। দু’পা হাঁটে এক পা লাফায় দু’মিনিট হাঁফায়। এই ভাবে আট-দশটা গাঁয়ের চিঠি বিলি কি মুখের কথা? অবশ্য বুড়ি তাশানি
হাসিমুখে সবার চিঠিচাপাটি গুছিয়ে রাখে। খবর পাঠিয়ে দেয়, চিঠি এল রে, টাকা এল গো। তেমন তেমন সময়ে চিঠির সঙ্গে একটা জুকিনি কী ছোটো একটা
আপেল দিয়ে দেয়। ঠান্ডার দিনে সামোভার থেকে
ঢেলে দেয় গরম স্বাদু চা।
মোটের ওপর গাঁয়ে যদি অবস্থাপন্ন
বল তো আলজিদান আর তাশানি কত্তাগিন্নিই। বছরে একটা নতুন স্কার্ট কী দু’বছরে একটা নতুন কোট
জুটে যায় তাদের। ওদের খামারেই কাজ করে আলিয়াশার মা। গরু দোয়ায়, দুধ আলাদা করে রাখে। মাখন বানায়। আলিয়াশাকে ঘরে রেখে আসে। গাঁয়ে তো কেউ জানে না যাদুকর বুড়োর কথা। তবে নেকড়েকে ভয় পায় মা। আলিয়াশাকে বলে দরজা বন্ধ করে ভেতরেই থাকতে। একা বেরোলে নেকড়েটা চুপিসারে পিছন
থেকে এসে ঘাড় কামড়ে ধরতে কতক্ষণ!
মা নিজেও দুপুরের মধ্যেই ঘরে ফেরে। সঙ্গে থাকে চারুশিন আর বিলকিন। গোটা পথ কুকুর দুটো লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে
মাকে সঙ্গ দেয়।
মা চলে যাওয়ার পর ঘর ঝেড়ে মুছে
চিমনি সাফ করে চিমনির মুখের জালি আটকে ঘরে বসে বাবার জন্য শীতের কোট সেলাই করে
আলিয়াশা। ময়দা ঠেসে বড়ো একখানা পাউরুটি
বানায়। জানালার কাচের ওপর বরফের গুঁড়ো জমে থাকে
রাতে। উনুনের দিকের সেই জানালাটাই বেলা বাড়লে স্বচ্ছ
হয়ে আসে। আগুনের তাপে বরফ জল হয়ে নেমে
যায় যে। আলিয়াশা গরম ঘরে ওর একটা মাত্র ছবির বই উলটে উলটে
দেখে। ছবির পাশের লেখাগুলো পড়তে চেষ্টা করে। কিছু কিছু পড়তে পারেও। যেগুলো পারে না
সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে, হাত বোলায় বইটায়, তারপরই হঠাৎ লাফিয়ে
উঠে উনুনের কাছে যায়। গন্ধেই বুঝতে পারে পাউরুটি তৈরি হয়ে গেছে। সেটাকে ঠান্ডা করতে দিয়ে আলিয়াশা ভাবে স্যুপ বানিয়ে রাখবে
আজ। ঘরে আছে এক ফালি কুমড়ো, একটু জুকিনি, অল্প মধুও। সারা দিন ঝিরি ঝিরি বরফ পড়ছে। আলিয়াশা চটপট উনুনে বসিয়ে দেয় লিক আর কুমড়োর কুচি। নেড়ে ঘেঁটে নুন মরিচ মিশিয়ে তৈরি হতে থাকে কুমড়োর স্যুপ। ঝুড়ির গায়ে জুকিনি ঘষে নেয়
মিহি করে, তারপর বড়ো বাটিতে ময়দা, মধু, দুধ মাখন আর আগের দিন মায়ের আনা দু’খানা ডিম
ভেঙ্গে মেশায়। ছোটো মুঠিতে চিপে চিপে জুকিনির জল ঝরায়
তারপর সেটিকে কেকের মিশ্রণে মিশিয়ে বসিয়ে দেয় উনুনের পেটে।
মা বাড়ি ফেরার
পথে নাক টানে। কোথা থেকে এমন
সুন্দর রসুনের সুবাস আসছে কে জানে। একটু যেন মিষ্টি কেকের গন্ধও আটকে আছে গাছগুলোর
গায়ে। মায়ের জুতোখানা ছিঁড়ে গেছে এখানে
ওখানে। তাও তাড়াতাড়ি পা চালায়। ছেঁড়া জুতোর মধ্যে ঢুকে যায় বরফের কুচি।
কেকের গন্ধে আর স্যুপের ওম্-এ ঘরটা ম’ ম’ করে। মা ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায়। এত সুন্দর গন্ধ চিমনি বেয়ে গোটা পাড়ায় ছড়িয়ে গেছে তারই ঘর থেকে! কত্ত বড়ো হয়ে গেছে
তার ছোট্ট মেয়েটা! আলিয়াশা মায়ের গা থেকে কোটখানা খুলে নেয়, জুতোটার দিকে
তাকিয়ে বলে তোমার জুতোটায় চামড়ার তাপ্পি না লাগালে আর পরা
যাবে না তো মা!
মা-র ওসব কানে ঢোকে না। সে কেবল ভেউ ভেউ করে বাচ্চাদের মতো কাঁদে আর
বলে তুই একা একা এসব বানিয়েছিস আলিয়াশা! তুই কি বড়ো হয়ে
যাচ্ছিস আলি? তোর বাপ দেখলে কী খুশি হত বল দেখি আজ!
চারুশিন আর বিলকিন এক টুকরো পাউরুটি নিয়ে
কাড়াকাড়ি করে। জঙ্গল থেকে তুলে আনা কাঠকুটো চিমনির
নিচে জ্বালিয়ে আরাম করে বসে মা। বাইরে তখন সবে আঁধার নেমেছে। কোথা থেকে যেন
ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসে হলুদ ঠোঁটের সাদা মাথার অদ্ভুত সুন্দর সেই ঈগলটি, এসে বসে আলিয়াশাদের
চিমনির ওপর…
এদিক ওদিক ঘাড়
ঘোরায় পাখিটা। এমন অজানা এক জঙ্গলে
সন্ধে নামার আগে কী করে চলে এসেছে উড়তে উড়তে! চারিপাশের ভারি
আর ঠান্ডা হাওয়ায় মিষ্টি একটা গন্ধ, চিমনির মধ্যে দিয়ে ভেসে আসছে অস্পস্ট
গলার আওয়াজ। ধীরে ধীরে পাখিটার আরও
অনেক কিছু মনে পড়তে থাকে। একটা ছোট্ট
বাড়ি, মোটা কড়া লাগানো কাঠের দরজা, বড়ো বড়ো কুলুঙ্গি
দেয়ালে। মাটির নিচে একটা ঘরে
সারি সারি তাক। তাতে পুরোনো বাসন, ট্রাঙ্ক। একটা তাকে গোল গোল চিজের চাঙর বসানো। বাচ্চা একটা ছেলে মাঝে মাঝে গিয়ে চিজ উলটে দেয়। কানে যেন ভেসে আসে মিহি গলায় একটা ডাক “পাভেল!” মা ডাক দিত
– “পাভেল! স্কুলের বেলা হয়ে যাচ্ছে। শিগগির তৈরি
হয়ে নে। আর শোন বাপু, টিচারের কথা
শুনে চলবি। তোর পড়াশুনোর দিকেই
তো তাকিয়ে আছি বাছা। ক’টা বছর মন
দিয়ে পড়। তারপর বড়ো অফিসার হবি, অফিস বিলডিং-এ
কোট টাই পরে চেয়ারে বসে কাজ করবি! তখন আর তোর মাকে এই সুতোর ফ্যাকটরিতে
সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেশিন চালাতে হবে না।”
পাখিটা উড়ে
গিয়ে জানালায় বসে। স্টোভের পাশের জানলা, কাচ বন্ধ, ঘরের মধ্যে
একটা ফ্রক পরা মেয়ে, পায়ে মোজা হাঁটু অবধি, দুটো কুকুর, আর ঠিক মায়ের
মতো একজন। সে চেয়ারে বসে চোখ মুছছে। হঠাৎই ডানায় যেন কীসের টান লাগে, মুহূর্তের মধ্যে
পাখিটা নিজেকে দেখে গির্জের পিছনের অন্ধকার বাড়িটার কোণের ঘরে। যাদুকরের যাদু তাকে উড়িয়ে এনেছে শহরের গির্জার পাশের বাড়িটায়। আরামকেদারার হাতলে পাখিটা গিয়ে বসে। যাদুকর ওকে হাতে তুলে নেয়, নাকের কাছে
আনে, গন্ধ শোঁকে, জঙ্গলের গন্ধ, পাইন গাছের
গন্ধ, আর নেকড়ের নিঃশ্বাসের গন্ধ। যাদুকর পাখির
দিকে তাকায়, “জঙ্গলে গেছিলি নাকি?” পাখির পায়ে তখনও চিমনির কালি লেগে। আঙুলে সেই কালি তুলে নিয়ে মোমবাতির নিচে ভালো করে দেখে যাদুকর, “হুম, বনের মধ্যে
কারুর ঘরের চিমনিতে বসেছিলিস। সেখানে ছোটো
ছেলেমেয়ে আছে?”
ছেলেমেয়ে শুনলেই
পাখিটা ডানা ঝাপটায়। সেভাবেই শিখিয়েছে
যাদুবুড়ো। কিন্তু আজ আর ডানা ঝাপটে
উঠল না পাখিটা। বোধহয় শুনতেও পেল না
কথাটা। তার কানে এখন বুড়োর
কথা ঢুকছে না একদম। কেবল কানে ভেসে আসছে, “পাভেল, নিচে যা, একটা ছোটো চিজের
টুকরো ভেঙে নিয়ে আয়। ক্র্যাকার দিয়ে
খেয়ে নে সোনা।”
কখনও ভেসে আসছে
একটা দরজা বন্ধ করার আওয়াজ, আর তার সঙ্গে খুব দূর থেকে যেন, “পাভেল, সামোভারে চা
রাখা থাকল, বাবা এলে দিস।”
ভোর হলে পাখি
যাদুবুড়োর ভাঙা বাড়ি থেকে বেরিয়ে উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে বনে
এসে পৌঁছোয়। আহ, ঐ তো সেই চিমনি। অল্প ধোঁয়া পাক দিয়ে উঠে আসছে আকাশের দিকে। পাখি চিমনির ওপর গিয়ে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখে, ছোট্ট একটা মেয়ে, পা অবধি গাউন আর মাথায় লাল বনেট টুপি
পরে ছোট্ট কাঠের বালতিতে জল ভরে রাখছে। “পাভেল, সামোভারে জল
দিয়ে গরম করে নিস বাবা,” পাখিটা আবার যেন শুনতে পায়, কিন্তু কিছুতেই
মনে করতে পারে না কোথায় শুনেছে কথাটা। পারবে কী করে? যাদুবুড়ো স্মৃতি
তুলে নিয়েছে না ওর নিজের লাঠি দিয়ে? তবে পুরোটা কই আর তুলতে পেরেছে? নইলে চিমনির
ওপর বসে পাখি কেবল ফেলে আসা কেক আর রুটির গন্ধ পায় কেন? কেন শুনতে পায়
মা ডাকছে, “পাভেল, ইস্কুল যাবি না বাবা?”
পাখি তো কাঁদতে
পারে না। তাই পাখি কেবল ডানা
ঝাপটায়। কষ্টে ছটফট করে সে আর
এই ছটফাটানির চোটে দুটো পালক ডানা থেকে খসে পরে আলিয়াশার সামনে। মুখ তুলে তাকায় আলিয়াশা।
কী অপূর্ব সুন্দর
একটা পাখি! জমাট ডিমের কুসুমের মতো ঠোঁটের রং, মাথা থেকে ঘাড়
অবধি ঠাসা দুধসাদা পালক বোনা আর তারপর বিরাট শরীরটা শুধু ধূসর বাদামীর থাক থাক পালকের
বাহার।
হাত তুলে পালকদুটো
দেখায় আলিয়াশা। জোর গলায় বলে, “পাখি, তোমার পালক
খুলে পড়ছে যে? এই নাও, ফিরিয়ে নিয়ে যাও।”
পাখি দেখতে
পায় আলিয়াশার চোখ। নীল সাগরের জলের মতো
চোখের মণি। সে একটু উড়ে কাছে এসে
বসে আর তখনি গন্ধ পায় ভীষণ তীব্র। এক ঝটকায় অনেকটা
উঁচুতে উঠে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে পাখিটা। ঐ তো! ঐ তো দেখা যাচ্ছে। বাড়ির পিছনে ভাঙা ঘরটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু, কুটিল চোখ, মুখটা অল্প
হাঁ করা, জিভ থেকে একটু একটু লালা ঝরে পড়ছে। ভয়ংকর নেকড়েটা আলিয়াশার দিকে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে।
যাদুবুড়োর পাখি
সে, বুড়োর থেকে শিখেছে অনেকরকম কৌশল। বুঝে নেয় এই নেকড়েকে সে কিচ্ছু করতে পারবে না। কাছে গিয়ে ঠোকরাতে পারে চোখে কিন্তু তার আগেই নেকড়ে ঝাঁপ দেবে হয়তো। তাই সেদিকে না গিয়ে উলটো ঘুরে এক মুহূর্তে পাখি উড়ে আসে আলিয়াশার দিকে। ঠোক্কর মারবে নাকি মাথায়? আলিয়াশা ভয় পেয়ে যায়, দৌড়ে যায় ঘরের
দিকে। পাখিও তো তাইই চাইছিল। আর এই দৌড়োদৌড়ির মাঝে নেকড়েটাও থমকে গেছে। আর একটু, আর একবার, বিরাট পাখিটা
আবার তেড়ে যায় আলিয়াশার দিকে। এক ছুট্টে ঘরে
ঢুকে পড়ে আলিয়াশা, দুম করে দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁফায়।
এ আবার কেমন
পাখি? এত সুন্দর দেখতে, অথচ কেমন হিংসুটে আর অকৃতজ্ঞ! পালকদুটো কুড়িয়ে
আলিয়াশা ওকে দিতেই তো ডাকছিল। কেমন তেড়ে এল! ছিঃ। ভারি রাগ লাগে আলিয়াশার।
পাখিটা ওদিকে
চিমনির ওপর গিয়ে বসে। দেখে নেকড়েটা
রাগে গরগর করছে গলার ভেতর। পাখি জানে নেকড়েটা
আলিয়াশাকে দেখে রাখল আজ। ও আসবেই আবার। ছটফট করতে থাকে পাখিটা। ভাবে এক কাজ
করা যাক। চিমনিতে বসেই থাকি না
কেন বরং। পাহারা দিই ওকে।
আলিয়াশা অবশ্য
আর ঘর থেকে বেরোয় না। পাখি ঘুরে ঘুরে
ওড়ে। জঙ্গল দিয়ে ঘেরা গ্রামটায়
ক’টা মাত্র বাড়ি, সেও অনেক দূরে দূরে। জংলি বাদামি খরগোশ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তা দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি গেল একগাদা শুকনো ঘাসের ওপর ক’টা সবজি
নিয়ে। পাখিটার এ জায়গা একদমই
অচেনা লাগে। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে
সে বুঝতে পারে তার মনে পড়ছে মায়ের মুখ, মনে পড়ছে মা তাকেই ডাকত
পাভেল নামে। তার হাতের গ্লাভসের
রং ছিল নীল। মায়ের সোয়েটারটাও ছিল
নীল রঙের। তাতে সাদা ছোটো ছোটো
ফুল। ঠিক যেমন ফুল ফুটে আছে
জঙ্গলের এদিক সেদিক ছোটো ছোটো ঝোপে।
ভারি ভালো লাগছিল
পাখিটার, না না, পাভেলের। পাখি নিজেকেই ডাকতে চায় “পাভেল!” ডাকতে চায় “মা!” কোনও ডাকই উঠে
আসে না পাখির গলায়। কর্কশ করাত চালানোর
মতো একটা আওয়াজ ঘুরতে ঘুরতে ধাক্কা মারে গেরস্তদের ঘরের বেড়ায়, রান্নাঘরের
জানালায়।
বেলা পড়ে এলে
পাখিরূপী পাভেল দেখে আলিয়াশার মা ফিরছে চারুশিন আর বিলকিনকে নিয়ে। কুকুরদুটো আগে পিছে দৌড়ে ছুটে লাফিয়ে ঘাস ঝোপ মাড়িয়ে আহ্লাদ দেখায়। হঠাৎই জোর বাতাস দেয়। মুহূর্তের মধ্যে
দেখা যায় পাখি তীর বেগে নেমে যাচ্ছে যাদুবুড়োর বাড়ির ছাদে।
বুড়ো পাখিকে
হাতে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, পা দেখে খুঁটিয়ে, ডানায় নাক ডুবিয়ে
গন্ধ নেয়, তারপর গলা দিয়ে একটা আওয়াজ করে শুধু “হুম্”। তারপর পাখিকে নিয়ে যায় চানের টবের কাছে। মাথায় জল ঢালে পাখির। সেই জল জমা
হয় টবের মধ্যে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থাকে বুড়ো সেদিকে। জল নামছে পাখির মাথা
গা বেয়ে, সেই জল জমছে টবে, জল জমে ফুটে উঠছে অদ্ভুত এক দৃশ্য। সারাদিন যা ঘটেছে সব যেন ছবির মতো পর পর ফুটে উঠছে। নেকড়েটা দাঁড়িয়ে আছে কাঠকুটোর ঘরের পাশে, আলিয়াশা দুটো
পালক উঁচু করে দেখিয়ে ডাকছে পাখিটাকে, বরফে ঢাকা জংলি রাস্তা, সাদা সাদা পাতা
ঝরা গাছ ভর্তি ছায়ামাখা জংলি গ্রাম।
হো হো, হাঃ হাঃ… হাততালি দিয়ে
নাচে বুড়ো, শিস দিয়ে গান গায়। এত খুশি কীসের? বাথটবের দিকে
তাকিয়ে পাখি হয়ে যাওয়া ছোট্ট পাভেল দেখে সারাদিন সে যা যা করেছে সেই সব ঘটনাই জল হয়ে
ঝরে পড়েছে তার গা থেকে। ডানা ঝাপটায়
পাখি, মনে পড়ে তার গা থেকে খুলে পড়া দু’খানা পালক রয়ে গেছে ছোট্ট একটা মেয়ের
কাছে।
বুড়ো নিজের
জন্য রান্না করেছে শুকনো মাংস, নরম রুটি, পুডিং। পাখিকে এক টুকরো মাংস দিয়ে নিজের টেবিলে বসায় বুড়ো।
“খেয়ে নে, কাল তোকে নিয়ে
যাব ঐ জঙ্গলে। দারুণ হদিস এনেছিস আজ
তুই আমার জন্য। ভালো, খুব ভালো,” মাথা নেড়ে হাতে
তালি দেয় বুড়ো, মুখের মধ্যে একগাদা মাংস আর রুটি পুরে কচর মচর করে চিবোয়।
পরদিন ঠান্ডাটা
যেন জমিয়ে দেয় শহর, গাঁ, গোটা দেশকেই।
বরফের রাজ্যে
রোদ্দুর উঠলে ঠান্ডা বেশি হয়। কড়া রোদ উঠেছে। মা আলিয়াশার গায়ে ভালো করে চাদর জড়িয়ে দেয়। মাথার স্কার্ফটা শক্ত করে বাঁধে। আলিয়াশা ঘরের পিছনের কাঠকুটোর চালা থেকে কাঠ নিতে গিয়ে মাকে ডাক দেয়। শিগগিরি এস, দেখ কাল কে এসেছিল।
মা দৌড়ে আসে। কাঠের ঘরের বাইরে নরম বরফ গুড়োর ওপর নেকড়ের থাবার দাগ। হে ভগবান। বাড়িতে নেকড়ে
এসেছিল! মা’র মাথায় হাত। মেয়েকে বলে,
ঘর থেকে একদম বেরোবি না আলি। আমি আজ চারুশিনকে
ঘরে রেখে যাচ্ছি। ভয়ে আলিয়াশার মুখ সাদা
হয়ে গেছে ততক্ষণে। মাকে বলে আমাকেও নিয়ে
চল মা। বুড়ি তাশানির পা টিপে
দেব। ঠান্ডায় পায়ের ব্যথায়
উঠতে পারে না, বল তুমি। আমাকে একা রেখে
যেও না মা গো।
মা’রও মনটা
যেন কু ডাকে। এমন ভয় আগে কখনও লাগেনি। ঘর তাদের জঙ্গলের মধ্যে, কিন্তু জংলি জানোয়ার আসার মতো ঘন বন তো নয়। ঠান্ডায় নেকড়েগুলো খাবার পাচ্ছে না গহিন জঙ্গলে হয়তো। ধীরে ধীরে গাঁয়ের মধ্যে ঢুকছে এসে। একা একটা কুকুর নেকড়ে তাড়াতে পারে না। দল বেঁধে তাড়াতে পারে অবশ্য। কিন্তু শুধু
চারুশিনকে রেখে গেলেও লাভ হবে না কিছু। ওদের ঘরের দরজার
হুড়কো নড়বড়ে। নেকড়েটা যদি ঘরে ঢোকে
এসে! ভয়ে মায়ের বুক ঠান্ডা হয়ে আসে। তাড়াতাড়ি খানিক কাঠকুটো তুলে নেয়, ঘরে গিয়ে রাখে
গুছিয়ে। তারপর আলিয়াশার গায়ে
চড়ায় মোটা জ্যাকেটখানা। নিজের ফাটা
জুতোর ভেতর পুরোনো কাপড় গুঁজে দেয়, আলিয়াশার পা দুটোতে জড়িয়ে দেয় খানিকটা
কাপড় আরও। এমন ঠান্ডা গত দশ বছরে
বোধহয় দেখেনি কেউ।
“পা চালিয়ে চল
দেখি,” মা তাড়া দেয়, “বুড়ো আলজিদানকে গিয়ে বলতে হবে গাঁয়ে নেকড়ে
ঢুকছে। তাশানি বুড়ি তোকে দেখে
খুশিই হবে। ভালো করে গরম তেল মালিশ
করে দিস পায়ে। ভারি কাঠ নিয়ে আসতে
হবে আজই। দরজা মজবুত করা দরকার। বুড়োর থেকে বুদ্ধি নিতে হবে কিছু।” বকবক করতে করতে পৌঁছে যায় মা আর আলিয়াশা।
ওদিকে ঠান্ডায়
জমে যাওয়া শহরে খাবার টেবিলটিতে বসে অঙ্ক কষছে যাদুবুড়ো। যাদুপুঁথির পাতা উলটে উলটে দেখে নিচ্ছে, ঝালিয়ে নিচ্ছে
বশীকরণের মন্ত্র, মানুষকে পাখি, কুকুর বানানোর
মন্ত্র, ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র। কত বার কোন
মন্ত্র পড়ে কটা তালি আর ক’বার তুড়ি দিতে হবে সে সবও পড়ে নিচ্ছে আর একবার। নিচের ঘরে কুড়িটা বাচ্চাকে পাথর বানিয়ে রেখেছে ও। একটা বড়ো কালো শিশিতে ধরে রাখা আছে তাদের প্রাণ। আজকেরটাকে ধরে এনে প্রাণটা তুলে বোতল বন্দি করতে পারলেই অমর হয়ে যাবে
বুড়ো। শুধু অমরই হবে না, এক্কেবারে যুবক
যাদুকর হয়ে যাবে সে। বার বার পুঁথি
খুলে দেখে, পড়ে, উত্তেজনায় মন্ত্রগুলো ভুলে না যায়! তারপর পাখির
মাথায় চুমু দিয়ে বলে চল্, যাওয়া যাক এবার।
যাদুবুড়োর হাতে
যাদুলাঠি, কাঁধে যাদুর পাখি, এক মিনিটে পৌঁছে যায় সে যেখানে খুশি। তেমনিই চোখের পলকে শহর থেকে উড়ে জঙ্গলের ধারে এসে যখন সে নামে ততক্ষণে
অবশ্য মা তার আলিয়াশাকে নিয়ে বুড়ি তামিশার কোলের কাছে ঠেলে দিয়েছে। বলেছে, “বাড়ির হাতায় নেকড়ে ঘুরছে, চারিদিকে পায়ের
ছাপ। এদিকে একটু ঝড়েই দরজা
ভেঙ্গে যেতে পারে। হুড়কোর ঠেকনাটাও খুলে
আসছে। কোন ভরসায় মেয়েটাকে
রেখে আসতাম বাড়িতে, তাই সঙ্গে নিয়ে এলাম। তোমার পায়ে
খানিক তেল মালিশ করে দেবে না হয়।”
বুড়ি তামিশা
আপত্তি করে না। ঘরে একটা ছোটো মেয়ে
বনেট টুপি মাথায় গোড়ালি অবধি স্কার্ট পরে ঘুরত সেইই কোন কালে। এতকাল পরে খুকি আলিয়াশার গায়ে যেন তামিশা নিজের মেয়ের গন্ধ পায়। কাছে ডাকে, বলে, “আলুর স্যুপ খাবি? একটু মাংস কুচি
আর ক্রুটন দিয়ে দেব ওপরে।”
ওদিকে আলিয়াশাকে
একলা পেলে চুরি করার অভিসন্ধিতে দরজায় ধাক্কা দেয় যাদুকর। কিন্তু সাড়া দেওয়ার জন্য কেউ থাকলে তো! আজ তো কেউ নেই
কোনোখানে। বিরক্ত হয়ে যাদুকর পাখিকে
হুকুম করে, “খুঁজে নিয়ে আয় মেয়েটাকে। আজ ওর প্রাণটা
বার করে বোতলে ভরে নিতে পারলেই ব্যস, কেল্লা ফতে। যা যা, খুঁজে বার কর শিগগির তাকে।” অমর হতে আর তর সয় না যাদুকরের।
ওদিকে ঐ বাড়ি, ঐ ভাঙা জানালার
সামনে গিয়ে আবার যেন পাখিটা মায়ের গলার ডাক শুনতে পায় “পাভেল!”
উড়তে থাকে পাখি। কিছুতেই ও আজ যাদুকরকে সফল হতে দেবে না। এতদিন ধরে যাদুকরের কথায় ও উড়েছে, খবর এনেছে, কিন্তু কী করে
কে জানে এই জংলি গাঁয়ে এসে, চিমনি থেকে উঠে আসা গেরস্থালির গন্ধে
ধীরে ধীরে মনে পড়ছে ওর অনেক কিছু। এলোপাথাড়ি ওড়ে
পাখি আর ভাবে কী করে বাঁচানো যায় মেয়েটাকে এই বদমায়েস বুড়োর হাত থেকে। নিচ থেকে বুড়োর চিৎকার কানে আসে। জ্যান্ত শয়তানটা চেল্লাচ্ছে দেখ! উড়তে থাকে পাখিটা। আর তারপর নিচের দিকে তাকিয়েই মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় একটা। ওই তো! আজও নেকড়েটা আসছে না ধীরে ধীরে! কাল ওর হাত
থেকে বাঁচাতে আলিয়াশাকে ঠোক্কর মেরে মেরে ঘরে ঢুকিয়েছিল পাখিটা। ফিরে গেছিল নেকড়ে। তাই আজ এসেছে
আবার।
কিন্তু যাদুবুড়ো
ওকে আগে দেখতে পেলে এখুনি মন্ত্র পড়ে হয়তো নেকড়েটাকে বুনো ইঁদুরই বানিয়ে দেবে। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না পাখিটা। যাদুবুড়োর দৃষ্টি নিজের দিকে টানতে পাখিটা কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকে আকাশে
ঘুরে ঘুরে। যা চেয়েছিল তাই হয়। যাদুবুড়ো চমকে ওপরে তাকায়। পাখিটাকে ও
নিজেও কখনও ডাকতে শোনেনি। তাই ওর পাখিই
যে ওরকম বিশ্রীভাবে চেঁচাচ্ছে সেটাও বুঝতে সময় লাগে একটু। এদিকে চড়া রোদ্দুর বরফের ওপর পড়লে চোখে ধাঁধা লেগে যায় এমনিতেই। কোনোরকমে সেই ধাঁধা লাগা চোখেই যাদুবুড়ো আকাশে তাকিয়ে পাখিটাকে খোঁজে, লাঠি তুলে চেঁচায়, “নেমে আয় শিগগির। মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে এখুনি। হাতে সময় নেই আমার।”
এইসব লম্ফঝম্প
আর পাখির বেয়াদবিতে বুঝি একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় যাদুবুড়ো, আর তখুনি পাখিটা যা চাইছিল
তাইই ঘটে। তড়িৎগতিতে বুড়োর ওপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে নেকড়েটা। পাখি আকাশ থেকে
দেখে বুড়োর ঘাড় কামড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বিরাট বুনো নেকড়েটা।
ক্লান্ত ডানা
মুড়ে মাটিতে নেমে আসে পাখিটা। বরফের ওপর যাদুবুড়োর
রক্তের দাগ আলপনার মতো এঁকে বেঁকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। অসাবধানে সেই রক্তের ওপরই এসে বসে সে আর তখুনি কী অবাক কান্ড! কোথাও কিছু
নেই, পাখিটা দেখতে দেখতে একটা ফুটফুটে ছেলে হয়ে ওঠে। তার মাথায় রেশম রেশম চুল, গায়ে সাদা সোয়েটার, পায়ে ঘিয়ে মোজা, কালো জুতো। অবাক হয়ে সে নিজের হাতগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। দূর থেকে যাদুবুড়োর চিৎকার কানে আসছে তখনও। ছেলেটা বরফের মধ্যে লাফিয়ে ছুটে খুশিতে পাগল হয়ে যায় যেন। বেচারা বুঝে উঠতে পারে না কে তাকে তার আগের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।
ওদিকে আলিয়াশার
মা তখন বুড়ো আলজিদান আর তার সাকরেদকে নিয়ে ঘরে ফিরছিল। নেকড়ে আটকানোর জন্য একটা বেড়ার ব্যবস্থা করা দরকার। কাঁধে কুঠার নিয়ে পায়ে হাঁটু অবধি জুতো পরে বিরাট চেহারার আলজিদান ছেলেটার
সামনে এসে দাঁড়াল, “কে রে তুই? কাদের বাড়ির
খোকা?”
“আমি পাভেল,” ছেলেটা বুট
ঠুকে বলে।
“কাদের ছেলে
তুই?”
এবার আর বেচারা
মনে করতে পারে না কিচ্ছুটি। কেবল বলে, আমাকে
মা বলেছিল একা রাস্তায় না যেতে। বলতে বলতে কাঁদে, আবার বলে, আবার কাঁদে। কান্না আর কথার মধ্যে থেকে বুড়ো আলজিদান এটুকু বুঝে যায় যে যাদুবুড়ো
ছেলেমেয়েদের ধরে পাথর বানিয়ে রাখে আর তাদের প্রাণ টেনে নেয় বোতলের মধ্যে। এও জানা যায় যে আলিয়াশাকেই তুলে নিয়ে যেতে এসেছিল যাদুবুড়ো। কিন্তু তার বদলে নেকড়েটা তাকেই টেনে নিয়ে গেছে জঙ্গলের ভিতরে।
ভুরু কুঁচকে
আলজিদান ভাবতে থাকে। তার অনেক বয়স। সে জানে না এমন কিচ্ছুই নেই হয়তো। আর সেই জন্যেই খুব বেশি ভাবতে হয় না। সে বুঝে যায় যাদুবুড়োর রক্তের ছোঁয়া লাগলে তার করা যাদু নষ্ট হয়ে যায়। সেইজন্যেই রক্তমাখা বরফে পাখি এসে বসার পরেই সে আবার মানুষ হয়ে গেছে।
চট করে খানিক
রক্তমাখা বরফ তুলে চামড়ার বটুয়াতে রাখে আলজিদান। তারপর আলিয়াশার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, “নেকড়ের পেট
ভরার ব্যবস্থা হয়ে গেছে ক’দিনের মতো। সে এখুনি এদিকে
আসবে না। তাও তুমি এখানে থেকো
না এখন। ফিরে চল। আমায় পাভেলকে নিয়ে এখুনি শহরে যেতে হবে। দেখি যদি বাকি ছেলেপুলেদের
শরীরের ওপর এই রক্ত ছুঁইয়ে দিতে পারি তো পাভেলের মতোই তারাও তাদের শরীর, তাদের প্রাণ
ফিরে পাবে। এখুনি বেরিয়ে পড়তে হবে
আমাদেরকে। ফিরে এসে মেরামতি হবে
‘খন।”
বেলা শেষ হয়ে
আসে। তামিশা বুড়ি ভিতু মানুষ। সে মা’কে বলে, “খবদ্দার এখন ঘরে ফিরে কাজ নেই। বুড়ো আসুক, তোমার ঘরের পিছনে বেড়া টেনে দিক সবাই
মিলে, তারপর আলিয়াশাকে নিয়ে ওখানে গিয়ে থেক। এখন দুটো দিন আমার ঘরেই কম্বল বিছিয়ে দিচ্ছি। দিব্যি ঘুমোতে পারবে।”
আলিয়াশা জানালায়
দাঁড়িয়ে দেখে ঘোড়ায় টানা গাড়ি ছুটিয়ে আলজিদান শহরে চলেছে, পাশে একটা রেশম
রেশম চুলে গরম টুপি পরা ছেলে, তার হাতে চামড়ার বটুয়া।
_____
ছবিঃ জয়িতা বিশ্বাস
খুব ভালো। ছোটবেলার সোভিয়েত দেশ এ এমন থাকতো না? কি ভাল ছিল পত্রিকা টি! একটাও যদি পেতাম, আগলে রাখতাম বাকী জীবন। কত স্মৃতি এমনধারা গল্পে!
ReplyDeleteঅসাধারণ লাগল
ReplyDeleteExcellent story telling
ReplyDelete