রিকির পার্কোরবিদ্যা
সহেলী রায়
(১)
রিকি এক্কেবারে মুখ খুলতেই
পারছে না। সেই থেকে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রিকির বাবা দীপকবাবু চেঁচামেচি
করে বাড়ি মাথায় করছেন।
“লেখাপড়া তো নেই
বাবুর, আমায়ও এই ঘরবাড়ি, পাড়া মায় দেশছাড়া করে ছাড়বে। আর কারও কাছে মুখ দেখানোর জো
রাখলে না বাঁদরটা।”
“আমি তো...”
মাঝপথেই থামতে হল রিকিকে। মুখের
কথা ছিনিয়ে নিয়ে দীপকবাবু বলতে শুরু করলেন, “আমি, আমি আবার কী? তোমার এই আমিত্ব ঘুচিয়ে
দেব। স্কুলে এই দীপক গাঙ্গুলির নামে ছেলেপুলেরা প্যান্ট ভিজিয়ে ফ্যালে। তুমি তো
আমার বাঁ হাতের খেলা।”
উফ্, রিকির যা রাগ হচ্ছে না
দশ নম্বর লেনের শচীজ্যাঠার ওপর। যতটুকু না দেখলেন তার চেয়েও বেশি রঙ চড়িয়ে বাবার
কান ভরলেন। সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে রিকি। খিদেতে পেট চোঁ চোঁ করছে। রিকির মা দেবারতি
অনেকক্ষণ ঘর-বার করছেন। এসময় অবশ্য দীপকবাবুকে কিছু বলাই বাহুল্য। আরও তেতে উঠবেন।
বলাইচাঁদ হাইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই হিসেবে যতটা রাশভারী হওয়া উচিত বরং তার চেয়ে
শান্তই দীপকবাবু। তবে রেগে গেলে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। পাড়াতে
দীপকস্যারের বেশ নামডাকও। রিকি অবশ্য বলাইচাঁদের ছাত্র নয়, সে লিলুয়াতে একটি
নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র। রিকি দু’মিনিট
আগেই ভাবছিল, ভাগ্যিস সে বাবার স্কুলে পড়ে না। তাহলে এতদিনে হাওয়ায় মিলিয়ে যেত।
দেবারতি চোখের ইশারায় রিকিকে ভেতরে যেতে বললেন। সেটা খেয়াল করতেই দীপকবাবু আরও
তেলেবেগুনে জ্বললেন।
“এই তো, যেই না ছেলেকে একটু
শাসন করতে গেছি অমনি মায়ের ইশারা শুরু। ছেলে বিগড়োবে না তো কী হবে? অমনি করে অন্যের
বাড়ির পাঁচিলে উলটো হয়ে ঝুলেই থাকবে। ছি ছি ছি ছি, পাড়ায় আমার একটা মান-ইজ্জত আছে। আর
আমার ছেলে কিনা লোকের বাড়ির পাঁচিলে উলটো হয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে? কী, মতলব কী তোর?”
“ওটা পার্কোর।”
“কীহ্?”
দেবারতি এবার খুব বিরক্ত
হলেন। “বেলা অনেক হয়েছে। ছেলেটাকে স্নান করে দুটো খেতে দাও, পরে কথা বলো। রবিবারেও
একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই।”
“না না, কী একটা বলল যেন, ঐটা
উদ্ধার না করে আজ আমি ছাড়ছি না। স্কুল থেকে নাম কাটিয়ে দেব। আমার স্কুলেই পড়বে। নজরবন্দী
করে রাখতে হবে ওটাকে।”
“তা রেখ’খন। এখন খেতে চল।”
এ যাত্রা কোনওক্রমে বাঁচল
রিকি। স্নান করতে করতে ঠিক করল শচীজ্যাঠার কেসটা জানাতে হবে সানি-টুবাইদের। বাড়ির
গেটে আবার নীল জল ঝুলিয়ে রেখেছে যাতে কুকুর না ঢুকতে পারে। পাড়ার সবক’টা কুকুরকে
গেট খুলে ঢুকিয়ে দিতে হবে। রিকিকে ডেকে আবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সত্যি নীল জল
ঝুলিয়ে রাখলে বাড়িতে কুকুর ঢোকা বন্ধ হয় কি না। রিকিও ভালোমানুষের মতো ইন্টারনেটের
সব তথ্য পড়ে শোনায় শচীজ্যাঠাকে। তার এই প্রতিদান! দেখাচ্ছি মজা। স্নান করতে করতে
রিকির চোখ ভিজে আসতে লাগল। খেতে বসে মায়ের হাতের জম্পেশ করে রাঁধা পমফ্রেট মাছটাও
আজ কেমন বিস্বাদ ঠেকছে। দেবারতি বুঝতে পারলেন। মাথায় হাত বোলালেন ছেলের।
“খেতে বসে অমন ব্যাজার মুখ
করতে নেই। ভালো করে খাও। আর দুষ্টুমি একটু কমালেই হয়। জানোই তো, বাবা রেগে গেলে কী
হয়। এমনিতে কি কিছু বলেন তোমায়?”
(২)
রিকির ঠামাই মালতীদেবী
ডিপ্রেশনের রুগী। বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা এমনিতে নিজের ঘরেই থাকেন। কারও সঙ্গে
বিশেষ কতাবার্তাও বলেন না। নিজের মতো টিভি দেখেন, গান শোনেন, বই পড়েন। তবে মাঝে
মাঝে হাইপার-অ্যাক্টিভ হয়ে যান। সেই সময় কাউকে সহ্য করতে পারেন না। জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি
করেন। এমনকি রিকিকেও তেড়ে মারতে আসেন। দীপকবাবু এ পর্যন্ত দু-তিনজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
দেখিয়েছেন। ওষুধপত্রে বেশ কিছুদিন ভালো থাকেন, আবার এরকমটা ফিরে ফিরে আসে। রিকির
এই সময় খুব মায়া হয় ঠামাইয়ের উপর। ভেতরে কী কষ্ট হয় কে জানে যার জন্য এমন হয়। আবার
যখন ভালো হয়ে যান তখন রিকিকে ডেকে আদর করে বলেন, “কিছু মনে কোরো না, ভাইয়া। শরীরটা
আমার খারাপ তো। তাই এমন হয়।”
রিকির তখন আরও কষ্ট হয়। সে দু’হাত
ধরে জড়িয়ে থাকে ঠামাইকে। রিকি তার দাদুকে কোনওদিন দেখেনি। এমনকি রিকির বাবাও দেখেননি।
রিকি শুনেছে, ওর দাদু স্বদেশী করতেন। অন্য আরেক স্বদেশী বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে
পুলিশের গুলিতে নিহত হন। দীপকবাবু জন্মানোর তিনমাস আগের ঘটনা। সেই সময় মালতীদেবী
মাত্র অষ্টাদশী। দীপকবাবু জন্ম থেকেই মাকে চুপচাপ দেখেছেন। মামাবাড়িতে মানুষ হলেও
দীপকবাবুর উপর কোনও কর্তব্যের ত্রুটিই রাখেননি মালতীদেবী। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে মামাবাড়ির
কাছাকাছি বাড়ি করে মাকে নিয়ে আসেন দীপকবাবু। নতুন বাড়িতে আসার পর হঠাৎই এরকম
অসুস্থতা শুরু হয় মালতীদেবীর। আজ বহু বছর ধরে চিকিৎসা চললেও পুরোপুরি কোনও সুরাহা
নেই।
ঠামাইয়ের ঘরের দরজা ভেতর থেকে
বন্ধ। রিকি বারান্দা থেকে ঘরের খোলা জানালার ভারী পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখল
ঠামাই অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। সেপ্টেম্বর মাসের বিকেল চারটে। এই সময় একটা ছায়া ছায়া রোদ
রিকিদের বারান্দায় চলাফেরা করে। রিকির মন উসুখুসু করতে থাকে বাইরে বেরনোর জন্য।
সানি-টুবাইরা হয়তো প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছে। ওদের দশ নম্বর লেনের কথা জানাতে
হবে। কিন্তু বেরনোর উপায় কই? বাবা দেখলেই
রক্ষে নেই। পায়ে চটিটা গলিয়ে স্টাডি রুমের পাশ দিয়ে চুপিচুপি পেরিয়ে যাবার চেষ্টায়
ছিল রিকি। বাবা দুপুরে ঘুমোন না। বই পড়েন স্টাডি রুমে বসে। ভেতর থেকে হাঁক এল, “রিকি...”
উফ্, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই
সন্ধে হয় আর কী। রিকি আবার কাঁচুমাচু মুখে স্টাডি রুমে
ঢুকল। মাও ঘুমোচ্ছে এসময়।
“তখন একটা কী বললি যেন? ঐ উলটো
করে ঝুলে থাকার কী নাম?”
“পার্কোর।”
“সেইটে কী বস্তু?”
“ফ্রান্সে মিলিটারিদের এটা
ট্রেনিং দেওয়া হত যাতে তারা কম সময়ে যে সব পথে নানারকম বাধা আছে সে সব জায়গা পেরোতে
পারে শারীরিক দক্ষতার সঙ্গে। দৌড়নোর সময় যে গতি উৎপন্ন হয় সেটাকে ধরে রাখার কৌশল
এটা। বাধাপ্রাপ্ত জায়গায় যাতে এই গতি কমে না যায়। এটা একধরনের মার্শাল আর্ট, বাবা।
এই ধরো, বাউন্ডারি ওয়াল বা এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ, এইভাবে পেরোনো যায়।”
“তা তুমি কোথায় দেখলে, বাবা?”
“ফ্রান্সে ছোটো ছোটো ছেলেরাও
প্র্যাকটিস করে বাবা, আমি দেখেছি ইউটিউবে। আমার চেয়েও ছোটো ওরা। কী দুর্দান্ত সব
টেকনিক! রানিং, ক্লাইম্বিং, ভল্টিং, হ্যান্ড স্ট্যান্ড। ফ্রি রানিং, বাবা। সিঁড়ি
দিয়ে স্টেপ বাই স্টেপ নামতে অনেক সময় লাগে। ওর চে’ সিড়ির রেলিং দিয়ে...”
“মারব সপাটে এক চড়। এটা
ফ্রান্স নয়, পঞ্চাননতলা। পার্কোর হচ্ছে? লোকে ভাববে পাক্কা চোর হবার প্র্যাকটিস
চলছে।”
“না বাবা, আমরা তো ঐদিন
শচীজ্যাঠার পাঁচিলে হ্যান্ড স্ট্যান্ড করছিলাম। হাত দিয়ে হাঁটছিলাম। সানি-টুবাইও
শিখে গেছে।”
“পা থাকতে হাত কেন, ভায়া? আর
তোমার সানি-টুবাইয়েরও ব্যবস্থা করছি আমি।”
রিকি একটুও দমল না। পার্কোরের
কথা বলতে গেলে তার চোখ চকচক করে ওঠে। ইউটিউবে অসাধারণ সব টেকনিক দেখেছে সে। ওরা
নিজেদের ট্রেসিয়ার্স বলে। যারা পার্কোর প্র্যাকটিস করে তাদের এই নামেই ডাকা হয় আর
মেয়েদের ট্রেসিউসেস। আজকাল সানি-টুবাই-রিকিরাও নিজেদের ট্রেসিয়ার্স বলে। স্কুলেও
ওদের এই নামে ডাকে বাকি বন্ধুরা। একটা অন্যরকম ফিলিং হয় সেই সময়। সাড়ে বারো বছরের
রিকির কাছে পুরো ব্যাপারটাই খুব গর্বের। স্কুলের বাকি ছেলেদের অজানা জগতের হদিশ
একমাত্র রিকিরাই জানে আর রিকিই এ-ব্যাপারে সানি-টুবাইদের পথপ্রদর্শক। ইউটিউবে
মাইনক্রাফট গেম খেলার পদ্ধতি খুঁজতে গিয়ে পার্কোরের সন্ধান পায় রিকি। সেই শুরু।
ছিপছিপে চেহারার রিকির পক্ষে এসব কৌশল রপ্ত করতে বেশি সময় লাগেনি। একা একা মজা
পাচ্ছিল না বলে সবচেয়ে প্রিয় দু’জন বন্ধুকেও ট্রেসিয়ার্স হবার দীক্ষা দেয়। আর
সানি-টুবাইরাও রিকিকে গুরু মানতে শুরু করে। তাই বাবার কথায় আমল দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বরং
সানি-টুবাইদের একটু সাবধান করতে হবে যাতে শচীজ্যাঠার চোখে না পড়ে।
(৩)
সোমবারের সকাল। ভোর থেকেই
দেবারতির ব্যস্ততা শুরু। রিকির স্কুলে দু’বার টিফিন, রিকি বেরনোর পরই দীপকবাবুর
ভাতের ব্যবস্থা। উনি খেয়ে ন’টা চল্লিশের মধ্যেই বেরোন। টিকিয়াপাড়ার কাছেই ওঁর
স্কুল। দুপুরে খাবার জন্য অবশ্য দীপকবাবুর কিছু ফলমূল হলেই চলে। খুবই
স্বাস্থ্যসচেতন। এর মধ্যে ঠিকে ঝি কমলা কাজ করতে আসে। তাকেও পরিচালনা করতে হয়।
কমলা বিহারী। ননস্টপ বকতে থাকে। তার হাতের চেয়ে মুখ বেশি চলে। দেবারতির মাথা খারাপ
হবার জোগাড় হয়। এর মধ্যে মালতীদেবীর সময়ে সময়ে খাবার ঘরে পৌঁছে দিতে হয়। এমনিতে
শাশুড়িকে নিয়ে কোনও ঝামেলাই নেই দেবারতির। উনি নিজে নিজের মতন থাকেন। এই সকল দশটা
অবধি দেবারতির নাভিশ্বাস ওঠে।
রিকিকে ছ’টা পঁয়তাল্লিশে
পঞ্চাননতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে দীপকবাবু বাড়ি এলেন। এই সময়
চা-বিস্কিট নিয়ে স্টাডি রুমে বসে তিনখানা খবরের কাগজে চোখ বোলান তিনি। দুটো
ইংরিজি, একটা বাংলা। ঠিক আটটায় স্নান সেরে স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে মালতীদেবীর
ঘরে গিয়ে একটু খোঁজখবর করেন। সোয়া ন’টায় ভাতদুটো খেয়ে ধীরেসুস্থে রওনা দেন। আজ
স্টাডি রুমে ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে বসতেই মালতীদেবীর ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসে। দৌড়ে
ঘরের কাছে পৌঁছতেই দেখেন ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালা দিয়ে দেখলেন, উনি ওঁর
আলমারি থেকে সমস্ত জিনিস আছড়ে মাটিতে ফেলছেন আর চিৎকার করছেন, “আজ সব শত্রু ধ্বংস
হবে।” দেবারতিও
ছুটে এলেন। শত চেষ্টা আর ডাকাডাকি করেও দরজা খোলানো গেল না। কমলা শিলনোড়ার নোড়া
নিয়ে এসে সেটা দিয়ে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে আর, “জয় বজরংবলী” বলে চ্যাঁচাতে থাকে।
দরজায় সোজা হয়ে থাকা ছিটকিনি আলগা হয়ে নেমে দরজা খুলে যায়। দীপকবাবু আর কমলা
মালতীদেবীকে ধরতে গেলে উনি নানারকম জিনিসপত্র ওদের দিকে ছুড়তে থাকেন। আলমারির
চাবির গোছাটা ছুড়ে মারতেই সেটা দেবারতির কপালে লাগে আর কপাল কেটে ঝরঝর করে রক্ত
পড়তে থাকে। মালতীদেবী, “রক্ত রক্ত” বলে অজ্ঞান হয়ে যান। দীপকবাবু মা আর দেবারতিকে
নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন। কমলার সঙ্গে ধরাধরি করে মালতীদেবীকে শুইয়ে দেন বিছানায়। ইতিমধ্যে
কমলার চেঁচামেচিতে পাড়াপ্রতিবেশী এক এক করে জড়ো হতে থাকেন। চাবির কোনা লেগে
অনেকটাই কেটেছে দেবারতির।
“ভাবী, মাইজীকে অস্পাতাল মে
ভর্তি করে দাও। কবে থেকে বলছি, ই পেসেন্ট ঘরে রাখে না। শুনতাই নেহি কোই, আমার
তাইজি ভি পাগল থি।”
তুলো আর স্যাভলন দিয়ে
দেবারতির রক্ত মুছতে মুছতে কমলার প্রলাপ। দেবারতির বেশ যন্ত্রণা হচ্ছিল।
তার চেয়েও বিরক্ত লাগছিল কমলার বাক্যালাপ।
“আহ্, যা করছ কর। অসুস্থ
উনি, পাগল হতে যাবেন কেন?”
“যাই বল বৌমা, কমলা কিন্তু
খারাপ কিছু বলেনি। মাস খানেক পরপরই তো দেখি এর’ম হয়। আজ আরও কত বড়ো বিপদ হতে পারত
বল দিকিনি। তোমার ছোটো ছেলে। তার কথাও তো ভাবতে হবে। দীপককে
বলো মামাদের সঙ্গে একবার কথা বলতে।”
পাশের বাড়ির অসীমকাকাবাবুর
স্ত্রীর বক্তব্য। দেবারতি কোনও উত্তরই দিলেন না। দীপকবাবু ততক্ষণে পাড়ার
ডিসপেনসারি থেকে দেবদাস ডাক্তারকে এনে হাজির। ডিসপেনসারি সাড়ে সাতটাতেই খোলে। পাড়ার
ওষুধের দোকানে অনেকেই বড়ো ডাক্তার বসেন। কিন্তু সবই সন্ধেবেলা। তাই এখন দেবদাস
ডাক্তারই ভরসা। মালতীদেবীর অল্প অল্প জ্ঞান ফিরছে। আচ্ছন্ন ভাব। ডাক্তারবাবু পালস,
প্রেশার সব চেক করে একটা ইঞ্জেকশন দিলেন।
“একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিলাম,
মাস্টারমশাই। বেশ স্ট্রেস গেছে। কমপ্লিট ঘুম দরকার ওঁর। আশা
করি আর কোনও সমস্যা হবে না। এরপর বাড়াবাড়ি হলে সাইকিয়াট্রিস্ট যে ওষুধ দিতে
বলেছিলেন সেটা ঘুম থেকে উঠলে খাইয়ে দেবেন। না কমলে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন।”
ডাক্তারবাবু সবকিছু বুঝিয়ে
দিলেন দীপকবাবুকে। তারপর দেবারতির ঘা পরীক্ষা করে
বললেন, “স্টিচ লাগবে, ডিসপেনসারিতে নিয়ে আসুন, আমি করে দিচ্ছি।”
“মা রক্ত দেখলে একটু নার্ভাস
হয়ে যান। ছোটোবেলায় আমার পায়ে একবার কেটে বেশ রক্ত পড়ছিল। মা দেখে ফেইন্ট হয়ে
পড়েছিলেন। রিকির কোথাও কেটেকুটে গেলে তাই মায়ের সামনে আসতে দিই না। তবে
আজ মনে হচ্ছে এই রক্তই সব বাঁচিয়ে দিল। তা না হলে মাকে আটকানোই যাচ্ছিল না। আরও কী
যে হত কে জানে।”
দীপকবাবু স্বগতোক্তির মতো বলে
গেলেন। কমলা দেবারতিকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে গেল, সঙ্গে পাশের বাড়ির অসীমবাবুর
ছেলে সোমনাথ। মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে
দীপকবাবু বসে রইলেন।
আড়াইটের সময় বাস স্ট্যান্ডে
রিকি বাস থেকে নামতেই দেখল কমলা দাঁড়িয়ে আছে। খটকা লাগল রিকির। এই সময় তো কমলাপিসি
থাকে না। মা আসেন রোজ। রিকি অবশ্য অনেকবার বারণ করেছে। ক্লাস সেভেন এখন। সে একাই
এটুকু ফিরতে পারে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
“তুমি এখনও আছ কেন?”
“মাইজীর তবিয়ৎ খারাপ। ভাবীর
মাথে পে চোট। তোমাকে খেতে দিয়ে আমি যাব। দাদা ভি স্কুল যায়নি।”
রিকির মনটা তেতো হতে শুরু
করল। গত তিনমাসে ঠামাইয়ের একবারও এমন হয়নি। মনে একটা বিশ্বাস এসে গিয়েছিল, ঠামাই
ভালো হয়ে গেছে। মা চোট পেল কী করে? তাহলে কি ঠামাই? বাড়ি ঢুকে বারান্দার জানালা
দিয়ে ঠামাইয়ের ঘরে উঁকি দিল রিকি। বাবা থমথমে মুখে বসে আছেন।
“স্নান করো, কমলা খেতে দেবে।
আজ বিকেলে বেরিও না।”
দীপকবাবু কথাগুলো বললেন বেশ
কেটে কেটে। তবে গলায় সেই রাগি ভাবটা নেই। বরং
বেশ ঠাণ্ডা আওয়াজ। রিকি বুঝল, বাবা খুব চিন্তায় আছেন। বড়ো শোয়ার ঘরে মা শুয়ে আছেন।
কপালে পট্টি বাঁধা। রিকি স্নান করে এসে কমলার রান্না করা মশুর ডাল আর ডিমের ওমলেট
দিয়ে ভাত খেয়ে নিজের ঘরে এসে শুয়ে রইল খানিকক্ষণ। বারান্দা জুড়ে একটা মনখারাপ করা
বিকেলবেলা ঝুলে রইল। সানি-টুবাইরাও ডাকতে এল না আজ। মনে হয় খবর পেয়েছে। এমনিতে সে
দুপুরে ঘুমোনোর পাত্র নয়। আজ চোখদুটো টেনে ধরছে ঘুম। সন্ধের কিছু আগে বাবা-মায়ের
টুকটাক গলার আওয়াজে রিকি ধড়মড় করে উঠল।
“পাশের কাকিমা ঠিকই বলেছেন।
তুমি মাকে হসপিটালে ভর্তির ব্যবস্থা কর।”
দেবারতির বিরক্তিমাখা কথা
শুনে দীপকবাবু চমকে উঠলেন। অতি সাধারণ, ঘরোয়া দেবারতি মুখ ফুটে কোনও চাহিদার কথাই
কখনও বলেননি। কিন্তু এমন কথা কেন?
“কী, বলছ কী? হসপিটাল বা হোম?
কিন্তু মা তো ওরকম উন্মাদ নয়। ওখানকার পরিবেশে আরও খারাপ হবে হয়তো।”
“আমি এতদিন কিছুই বলিনি।
কিন্তু ভাবো তো, আজ আমি সামনে না থেকে যদি রিকি থাকত? যদি চোখে লাগত? তুমি মামাদের
সঙ্গে কথা বল, প্লিজ।”
শুধুমাত্র সন্তানের চিন্তায়
দেবারতির এই আকুতি? দীপকবাবু চিন্তায় পড়লেন।
“ঠিক আছে, তুমি উত্তেজিত হয়ো
না। আমি কথা বলব।”
রিকির আজ পড়াশোনায় মন নেই।
ঠামাই চলে যাবে? মা কেন বুঝতে চাইছে না? বাবা কি তাহলে সত্যি মামাদাদুদের বলবেন?
নানা প্রশ্নের ভিড়ে রিকি জর্জরিত।
(৪)
দিনগুলো আবার স্বাভাবিক সুরে
গান গাইছে। রিকির স্কুল, দেবারতির ব্যস্ততা, দীপকবাবুর স্কুলে যাওয়া, বিকেলে সানি-টুবাইদের
সঙ্গে এপাড়া ওপাড়া পার্কোর অভিযান, ইউটিউব-গুগল ঘেঁটে আরও তথ্য তুলে আনা সবই
স্বাভাবিক, তবুও কোথাও কোথাও মাঝেমধ্যে ঠিক সুর লাগছে না। ঠামাইয়ের ঘরের দিকে তাকালেই
রিকির মনটা হু হু করে ওঠে। ঠামাই চলে যাবে স্থির হয়ে গেছে। বাবা মাঝেমধ্যেই রসুলপুরের
কোনও এক হোমে ফর্মালিটি পূরণ করতে যান। বৃদ্ধাশ্রমের পাশাপাশি সেখানে মানসিক রোগের
চিকিৎসাও হয়। শহর থেকে দূরে এই মফঃস্বলে চার-পাঁচজন
প্রবাসী ডাক্তার মিলে হোম বানিয়েছেন। অনেক বৈজ্ঞানিক সুযোগ সুবিধাও আছে এখানে।
মামাদাদুর পরিচিতর কাছ থেকে জানা এসব তথ্য। এখানেই সব ব্যবস্থা হয়েছে ঠামাইয়ের। তা
নিয়ে বাড়িতে দফায় দফায় মিটিং বসছে। রিকির এসব মোটেই ভালো লাগে না। আজকাল বাবাও খুব
চুপচাপ হয়ে গেছেন, নীরবে কাজকর্ম করে যাচ্ছেন শুধু। আগের মতো হম্বিতম্বি কমেছে। এর
মধ্যে আরও কয়েক জায়গা থেকে রিকির নামে কমপ্লেন এসেছে। কার বাড়ির পাইপ বেয়ে নাকি
রিকি ছাদে ওঠার চেষ্টায় ছিল। সব শুনেও বাবা রিকিকে কিছুই বলেননি।
“দেবী, দেবী...”
অনেকদিন পর রবিবারে দীপকবাবুর
হম্বিতম্বি শোনা গেল। রিকিও উৎসুক হয়ে শোনার চেষ্টা করল। মাকে বাবা এই নামেই ডাকেন।
“কী হল, এত চেঁচামেচি শুরু
করলে কেন?”
“আরে, টাকাগুলো পাচ্ছি না!”
“কীসের টাকা?”
“কুড়ি হাজার টাকা। তোমার
আলমারিতে শাড়ির ভাঁজে ছিল। আমায় আজই রসুলপুরে জমা করতে হবে।”
দেবারতির মুখটা সাদাটে হয়ে
গেল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল কাল থেকে আলমারির চাবিটা আলমারিতেই ঝুলছে। সে লাগাতে ভুলে
গেছে। কিন্তু একথা এখন বলা যাবে না দীপকবাবুকে। তাছাড়া আলমারি খুলে টাকাটা নেবে
কে? কমলা? না, তার এরকম স্বভাব কখনও প্রকাশ পায়নি। দেবারতিকে সাবধানে রাখতে
বলেছিলেন টাকাটা দীপকবাবু। কিছুতেই মাথা কাজ করছে না কী হবে ভেবে। খুব নার্ভাস বোধ
করলেন।
“ঠিক আছে, আজ না হয় নাই গেলে,
অন্যদিন জমা দিয়ে এলে।”
“অন্যদিন মানে? সব কি তোমার কথামতো
হবে নাকি? মাকে হোমে পাঠানোর প্রস্তাব তো তোমারই। আর তাছাড়া আমি যাই বা না যাই
টাকাটা তো পেতে হবে। টাকা তো তোমার ছেলের মতো পার্কোর জানে না যে এ-বাড়ি ও-বাড়ির
ছাদে ঝুলে বেড়াবে।”
দীপকবাবুর মুখ অস্বাভাবিকরকমের
লাল। বাবার মুখে পার্কোরের নাম শুনে রিকির মুখ জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ভয়ও লাগছে।
“আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি
না গো কী হল।”
“ব্যস, তাহলে আনন্দ করো। মনে
করতে পারছি না বলে সাত খুন মাপ। এটা বাড়ি না চিড়িয়াখানা বুঝছি না। মায়ের সঙ্গে
তোমাকেও পাঠাতে হবে মনে হচ্ছে।”
দেবারতি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
দীপকবাবু ঘরের চটি গলিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। দেবারতি সত্যি ভেবে উঠতে পারছেন
না কী হতে পারে। রিকি সোমবারের ম্যাথস টেস্টের প্রস্তুতিতে মন দিল। মাঝখানে একবার
উঠে গিয়ে দেখল ঠামাই নির্বিকারে একটা পুরনো বইয়ের পাতা উলটোচ্ছেন। বাড়িতে এত
শোরগোল তবে কিছুই যেন ওঁর কান পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।
রোদে অসম্ভব তেতে-পুড়ে দুপুর
আড়াইটে নাগাদ দীপকবাবু বাড়ি এলেন। একটা থমথমে পরিবেশে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ
হল। স্টাডি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন দীপকবাবু। দেবারতি আলমারি থেকে সব
জিনিসপত্র নামিয়ে খুঁজতে লাগলেন। রিকি খানিকক্ষণ এ-ঘর ও-ঘরের পর বারান্দায় এসে
বসল। বিকেলে আজ আর বেরোবে না ঠিক করল। দুটো হাতের উপর ভর করে ব্যালেন্স করার
চেষ্টা করল খানিকক্ষণ। এরকম একবার দু’বার তিনবার, একটু একটু
করে সময় বাড়াতে লাগল ব্যালেন্সের।
“ভাইয়া...”
জানালার পর্দা সরিয়ে
মালতীদেবী মুখ বাড়ালেন।
“আসি ঠামাই, বলো।”
“একবার ঘরে এসো তো।”
“হ্যাঁ, বলো।”
“তুমি এসব কী করো বলো তো,
ভাইয়া। সবাই রাগ করে যে!”
“এটাকে পার্কোর বলে ঠামাই,
ফ্রান্সের সেনাদের এটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।”
“তুমি সেনা হবে, ভাইয়া?”
“হব তো, দেশকে শত্রুদের হাত
থেকে রক্ষা করব।”
“করবে তো? প্রতিশোধ নেবে তো?
আহ্, এতদিনে শান্তি পেলাম। প্রতিশোধ নেওয়া হবে।”
রিকি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ঠামাইয়ের
দিকে। হাসলে এত সুন্দর লাগে ঠামাইকে। সত্যি যেন মনের কষ্টগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে এক এক
করে।
“আমার একটা কাজ করে দেবে,
ঠামাই?”
“বলো, ভাইয়া।”
“তোমার তোষকের নিচে কিছু টাকা
আছে। মাকে ডেকে দিয়ে দেবে?”
“টাকা? কে রাখল,
ভাইয়া?”
“আমি। কমলাপিসি যখন ঘর মুছছিল
তখন আমি এসে রেখে গেছি। অন্য সময় তো তোমার ঘর বন্ধ থাকে।”
“কিন্তু টাকা কোথায় পেলে
তুমি?”
“তোমায় সব পরে বলব। এখন দিয়ে
দাও, বোলো তুমি দিচ্ছ মাকে।”
দেবারতিকে মালতীদেবী ডাকছেন
শুনে অবাকই হলেন। এরকম ঘটনা সচরাচর ঘটে না।
“তোমায় তো কখনও কিছু দিইনি
দেবারতি, এটা তুমি রাখ।”
“এটা কী, মা?”
“আমার কিছু টাকা ছিল, তোমায়
দিলাম। সকালে মনে হল, দীপু খুব রাগারাগি করছিল। তুমি ওকে বোলো না আমি দিয়েছি। বোলো,
টাকাটা পেয়ে গেছ তুমি। আমি তো এখানে থাকছি না, এত টাকাপয়সা কী কাজে লাগবে আমার?”
এরকম একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটবে
দেবারতি স্বপ্নেও ভাবেননি। মালতীদেবীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন তিনি। বারবার মনে
মনে ভাবছিলেন আজ কী বিপদ থেকে বাঁচালেন মালতীদেবী তা হয়তো তিনি নিজেও জানেন না। প্রিয়জনেরা
বোধহয় এভাবেই প্রিয়জনের বিপদের আঁচ পায়।
সন্ধেবেলা স্টাডিরুমের দরজা
খুলল। চা হাতে দেবারতি দাঁড়িয়ে রইলেন।
“কিছু বলবে?”
“মা আমায় ডেকেছিলেন। দেখে মনে
হল, উনি এক্কেবারে সুস্থ। সবকিছুই স্বাভাবিক।”
“কী বলতে চাইছ তুমি?”
“আমি বোধহয় কিছু ভুল করে ফেলছিলাম।
মা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। মাকে কোথাও পাঠানোর দরকার নেই। আর টাকাগুলো আমি খুঁজে
পেয়ে গেছি।”
কথাগুলো বলে এক সেকেন্ডও
দাঁড়ালেন না দেবারতি। দীপকবাবুর মুখেও একটা প্রশান্তির ছায়া ঘোরাফেরা করছিল। এ
পরিবর্তন কী করে সম্ভব?
“ঠামাই, বিংগো!”
“কী হয়েছে, ভাইয়া?”
“আমার সব অঙ্ক মিলে গেছে, ঠামাই।”
“ভালো করে পড়ো ভাইয়া, তোমায়
সেনা হতে হবে যে।”
“হবই তো। তাই তো পার্কোর
শিখছি।”
মা এভাবে রিকির সঙ্গে কথা
বলছেন দেখে দীপকবাবু হতভম্ব। জিয়নকাঠি তাঁর ঘরের মধ্যেই আছে অথচ তিনি খুঁজে
মরছিলেন এতদিন! যে মাকে তিনি পাননি কোনওদিন এমন করে রিকি কেমন সহজেই পেয়ে গেল
তাঁকে। অবিশ্বাস্য একদম।
“বড়োমামু, তোমার বন্ধুকে বলে
সব ক্যানসেল করে দাও। মা কোথাও যাবেন না। মা একদম ভালো হয়ে গিয়েছেন, আর কোনও সমস্যা
হবে বলে মনে হচ্ছে না। কেউ যেন মায়ের বুক থেকে জগদ্দলের মতো পাথরটা সরিয়ে দিয়েছে,
বড়োমামু।”
ফোনটা রেখে দীপকবাবু জ্বালা-ধরা
চোখদুটোকে ঠাণ্ডা জলের ধারায় ভেজালেন। তারপর খোলা হাওয়ায়
নিঃশ্বাস নিতে বাইরে বেরোলেন। ফিরলেন বেশ রাত করে।
“এই নে, এটা তোর। অনেক খুঁজে
খুঁজে আনলাম।”
ঝপাং করে রিকির হাতে একটা
প্যাকেট দিলেন দীপকবাবু। ঝটপট প্যাকেট খুলে রিকি হাঁ। মুখ বন্ধই হয় না তার। স্টিভেন
ল-এর লেখা বই ‘ওভারকামিং গ্রাভিটি’ - পার্কোরের উপর লেখা বিখ্যাত বই। রিকি গুগলে
দেখেছিল যে দশটা বই আছে এই বিষয়ের উপর তার মধ্যে এটা সেরা। বইটা এই মুহূর্তে রিকির
হাতে, রিকির বিশ্বাসই হচ্ছে না।
“পেলে কী করে?”
“এখানে কোথাও নেই। খুঁজতে
খুঁজতে ডালহৌসি গেলাম। সেখানে এক ছোঁড়া আমাজন থেকে বিদেশি
বই আনিয়ে বেচে। তার কাছেই পেয়ে গেলাম। নে, এবার হাঁ বন্ধ কর।”
রিকির চোখভর্তি কুচি কুচি
স্বপ্ন দীপকবাবু প্রাণভরে দেখলেন।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
Shundor mishti paribarik golpo...
ReplyDelete