ক্যানসেলড
চেক
বাবিন
রোজ সকালে
উঠে তিয়াষের প্রথম কাজটি হল এক কাপ চা হাতে নিয়ে আনন্দবাজার আর টেলিগ্রাফ কাগজদুটো
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া। এই অভ্যাসটা ও দাদুর কাছ থেকে পেয়েছে। উনিও সকালে উঠে খবরের
কাগজটি হাতে নিয়ে বসতেন। সেই সময় কেউ ওঁকে বিরক্ত করত না। তিয়াষেরও একই স্বভাব। এই
একঘন্টা সময়টা সম্পূর্ণ নিজের মতো করে কাটায়। আজও তাই করছিল। ঠিক এই সময়ই ওর
মোবাইলটা আর্তনাদ করে উঠল। দ্বৈতা। বিরক্ত মুখে কলটা রিসিভ করল তিয়াষ।
“হয়ে গেছে!” দ্বৈতা হইহই
করে উঠল ফোনের ওপার থেকে,
“আর কোনও চিন্তা নেই,
সব সমস্যার সমাধান!”
“কী হয়েছে?” তিয়াষ ঠিক
বুঝে উঠতে পারে না।
দ্বৈতার এই
এক সমস্যা। পুরো ঘটনা খুলে না বলে দাঁতকপাটি মেলে বসে থাকে।
“এতদিন ধরে
যার অপেক্ষায় আমরা গালে হাত দিয়ে বসেছিলাম এবার তার দেখা মিলবে। অ্যান্ড উই উইল বি
সাকসেসফুল!”
“এই, আমি ফোন
রাখছি!” তীব্র
বিরক্তি ভরে তিয়াষ বলে ওঠে,
“তোর এটা ভয়ানক সমস্যা,
আদ্দেক কথা পেটে আদ্দেক মুখে। এইভাবে আমি পারি না। যদি পুরোটা খুলে বলতে পারিস
তাহলেই ফোন করিস।”
“ওহো-হো, সরি রে।
আসলে আমি এত্ত খুশি হয়ে গেছি যে আনন্দে পাগল হয়ে যাব!” ওদিক থেকে
দ্বৈতার যেন দম ফুরিয়ে গেছে। একটু থেমে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “লোন
স্যাংকশন হয়ে গেছে! আর শুধু তাই নয়, আমরা পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লোন পেতে
পারি!”
“ওহ্ মাই
গড! কী বলছিস রে!” তিয়াষ
আনন্দে হতবাক হয়ে যায়,
“পাঁচ লাখ?”
“তবে আর বলছি
কী! এবার আমাদের স্বপ্ন সত্যি হয়ে যেতে আর কোনও বাধা নেই। আমাদের ‘দ্বৈতি’র উদঘাটন
এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।”
আনন্দে
তিয়াষের চোখে জল চলে আসে। আসারই কথা। দেড় লাখ টাকা লোনের জন্য আজ প্রায় দেড় বছর
ধরে ওরা দু’জনে
এ ব্যাঙ্ক সে ব্যাঙ্ক করে কোথায় না ঘুরেছে। সব জায়গা থেকেই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।
সবাই চায় গ্যারান্টার কিংবা ফিক্সড ডিপোজিট নয়তো জমি-জমা-ফ্ল্যাট-বাড়ির দলিল বন্ধক
হিসেবে। আরে বাবা, সেটাই
যদি থাকবে তাহলে আর তোমাদের কাছে যাওয়া কেন? এটাই ব্যাঙ্কওয়ালারা বুঝতে চায় না।
দুটো কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী একটা বুটিক খুলতে চাইছে, স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে
চাইছে, কোথায়
তোমরা উত্সাহ দেবে, তা
নয় একরকম ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছ? পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও কয়েকটি ঋণ
প্রকল্প আছে, কিন্তু
সেখানেও সবকিছু ঠিকঠাক এগিয়ে যাবার পরও শেষমেশ ব্যাঙ্কে গিয়েই আটকে যাচ্ছে।
ব্যাঙ্কের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে যখন সব আশা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে সেই সময় দ্বৈতার
এই ফোন খুব সঙ্গত কারণেই তিয়াষের চোখে জল এনে দিল।
খুশি চেপে
রেখে তিয়াষ জিজ্ঞেস করে,
“কী করে হল রে? কাকু
কি গ্যারান্টার হতে রাজি হয়েছেন?”
“উঁহু। দশটার
সময় তোদের বাড়ি যাচ্ছি,
তখন সব খুলে বলব।”
ফোন রেখে দেয় দ্বৈতা।
দ্বৈতার
বাবা সরকারি চাকরি করেন। বেশ উঁচু পদে। উনি যদি একবার রাজি হতেন গ্যারান্টার হতে
তাহলে বহু আগেই এই লোনটা ওরা পেয়ে যেত। তিয়াষের বাবা রেলওয়েতে আছেন। দ্বৈতার মা
গৃহবধূ, কিন্তু
তিয়াষের মা চাকরি করেন পূর্তদপ্তরে। ওঁদের একজনও যদি গ্যারান্টার হিসেবে একটা
স্বাক্ষর করে দিতেন তাহলে ওদের এই স্বপ্ন সত্যি হয়ে যেত। কিন্তু তিনজনের কেউই ওদের
এই বুটিক খোলার স্বপ্নকে সাকার করতে এগিয়ে আসেননি। এখনও সবাই ওদের বাচ্চা বলেই মনে
করে। ধরে নিয়েছেন, লোনের
টাকা উড়িয়ে দিতে ওদের সময় লাগবে না। ওঁদের মুখে এক কথা, ‘বুটিক-ফুটিক
আবার কী? তার
চেয়ে বরং সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নাও গে! রেল, ব্যাঙ্কে মাইনে কত জানিস?’
দ্বৈতা আর
তিয়াষ দু’জনের
কেউই পড়াশোনায় তেমন একটা ভালো ছিল না। মোটামুটিভাবে টুয়েলভ পাশ করে আর্টস নিয়ে
পড়াশোনা করছে কলকাতার এক মাঝারি মানের কলেজে। ওরা জানে যে
ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-সফটওয়্যার প্রফেশনাল ওরা কোনওদিনই হতে পারবে না। কিন্তু আর
পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতো বাঁধাধরা জীবন দু’জনের কেউই বেছে নিতে চায় না। স্বপ্ন
দেখে বড়ো কিছু করার। তিয়াষের আঁকার হাতটি ভালো, আর দ্বৈতা ভালোবাসে ফটোগ্রাফি।
বিভিন্ন পেশাসংক্রান্ত পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করে ওদের মনে হয়েছে, বুটিক
ব্যাপারটা ওদের জন্য একদম সঠিক ব্যাবসা। সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়ে আরও পড়াশোনা শুরু
করল ওরা। তিয়াষ একটা বুটিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছুদিন একটা ক্র্যাশ কোর্সও করে
নিল। হিসেব করে দেখল,
আপাতত হাতে দু’লাখ
টাকা এলেই ব্যাবসাটা শুরু করা যেতে পারে। দ্বৈতার নামের প্রথম অক্ষর ‘দ্বৈ’ আর তিয়াষের ‘তি’ মিলে নাম
ঠিক হলো ‘দ্বৈতি’। দ্বৈতাদের
বাড়ির নিচে দুটো গ্যারেজ আছে। একটায় বাবা গাড়ি রাখেন আর অন্যটা ভাড়া দেওয়া হয়। তবে
এই মুহুর্তে দ্বিতীয়টা খালি আছে। বুটিক খোলার জন্য গ্যারেজটা নিলে ওর বাবার খুব
একটা আপত্তি নেই, তবে
লোনের ব্যাপারে আছে। আর বাকি টাকাটাও কেউ ধার হিসেবে ওদের দেবেন না। চেয়েচিন্তে
এদিক ওদিক করে দু’জনের
জমানো সমস্ত টাকা মিলিয়ে দেখা গেল মোটামুটিভাবে বাহান্ন হাজার হয়েছে। বাকি টাকাটার
জন্য মাথা খুঁড়ে মরছে ওরা। কোনওদিকে রাস্তা না পেয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, এমনি সময়
দ্বৈতার এই কল পেয়ে তিয়াষ অবাক হয়ে গেল।
“ভদ্রলোকের
সঙ্গে দেখা ব্যাঙ্কের সিঁড়িতে। কাল একবার ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। কথা বলে দেখছিলাম
যদি কোনও একটা রাস্তা বেরোয়। উনি বোধহয় শুনেছেন আমাদের কথাবার্তা। নিজে থেকেই যেচে
এসে আলাপ করলেন। উনি একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে আছেন। কী যেন নাম বললেন — ডায়মন্ড
ফিনান্স বোধহয়। ওদের সুদের হার সামান্য, মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট বেশি। তবে
লোনটা হয়ে যাবে।”
“গ্যারান্টার
লাগবে না?” তিয়াষের
যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। কারণ, এতদিন ধরে এত জায়গা থেকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে যে লোনের আশা
ছেড়েই দিয়েছিল।
“না রে, তাহলে আর
বলছি কী!” দ্বৈতার
চোখে খুশির ঝিলিক, “শুধু
আমাদের দু’জনের
মধ্যে যে কোনও একজনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এক লাখ টাকা থাকলেই হবে। তার নামেই
লোনটা অ্যাপ্রুভ করা হবে।”
“এক লাখ!” তিয়াষ আকাশ
থেকে পড়ে, “এক
লাখ কোত্থেকে আসবে? আমাদের
তো রয়েছে মাত্র বাহান্ন...”
মুখের কথা
কেড়ে নিয়ে দ্বৈতা বলে,
“সেসব আমি বলেছি। অনেক রিকোয়েস্ট করে ব্যাপারটা পঞ্চাশে নামিয়েছি। পাঁচ লাখ
অবধি আরামসে হয়ে যাবে।”
“আমি একটা
ব্যাপার বুঝতে পারছি না যে আমাদের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকার সঙ্গে লোনের কী সম্পর্ক? টাকার দরকার
বলেই তো লোন নিচ্ছি আমরা,
টাকা যদি থাকত তাহলে কে আর ধারদেনার চক্করে পড়ে?”
“ওরে বাবা, কাগজে-কলমে
ব্যাঙ্ক দেখতে চায় যে তোর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকার লেনদেন হয়। একেবারে ইন-অ্যাকটিভ
অ্যাকাউন্ট নয়। তাই এটা দেখাতে হবে। লোন পেয়ে গেলে তুই নিজের টাকায় যা খুশি কর না
গে!” দ্বৈতা
খুশিতে যেন ফুটছে টগবগ করে।
তিয়াষের
কপালের ভাঁজটা সোজা হচ্ছে না কিছুতেই। কোথাও যেন একটা খটকা লাগছে। যে লোনের জন্য
আজ ছ’মাস
ধরে ওরা জুতোর সুকতলা খইয়ে ফেলল সেটা যে এত সহজে হাতের মুঠোয় এসে যাবে এটাই
বিশ্বাস হচ্ছে না।
“তাহলে তোর
আঠাশ আর আমার চব্বিশ হাজারটা কোনও একটা অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে তো?”
“হ্যাঁ, তোর
অ্যাকাউন্টেই আমার টাকাটা ট্রান্সফার করে দেব। সামনের এটিএম থেকে কার্ড টু কার্ড
ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। তারপর তুই অনলাইনে লগ-ইন করে একটা স্টেটমেন্ট বের করে নে।”
“কী কী
ডকুমেন্ট দিতে হবে?”
“যা সব
ব্যাঙ্ককে দিতে হয় এদেরও তাই দিতে হবে — দুজনের ছবি, আইডি প্রুফ, অ্যাড্রেস
প্রুফ, ব্যাবসার
প্ল্যান ইত্যাদি আর একটা ক্যানসেলড চেক। তোর চেক বই আছে না?”
“হ্যাঁ, আছে তো।
একটাও ইউজ করিনি কোনওদিন।”
তিয়াষ জিজ্ঞেস করে,
“লোকটার সঙ্গে তোর কবে দেখা হল?”
“কালকে
ব্যাঙ্ক থেকে বেরোচ্ছি,
তখনই দেখা ভদ্রলোকের সঙ্গে। খুবই ভালো মানুষ। অমায়িক ব্যবহার। লোনটা পেয়ে গেলে
ওঁকে বাড়িতে ডেকে একটা ট্রিট দিয়ে দেব।” দ্বৈতা তৃপ্তির সুরে বলল, “পাঁচ লাখ
পেলে আমরা বেশ বড়ো করেই শুরুটা করতে পারব, বল?”
“আগে তো হাতে
পাই, তারপর
দেখা যাবে। না আঁচালে বিশ্বাস নেই!” তিয়াষ ছদ্ম অভিমানের সুরে বলে, “কালকেই যদি
কথাটা জেনেছিস, আমাকে
আজ বললি যে বড়ো?”
“ইচ্ছে করেই
বলিনি। কারণ, ভদ্রলোক
বলছিলেন ব্যাঙ্কে এক লাখ টাকা থাকতে হবে, আর আমাদের দু’জনের মিলিয়ে
তো বাহান্ন হচ্ছে। উনি বললেন, ওদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে কথা বলে কনফার্ম করবেন। আমার মোবাইল
নম্বর নিয়েছিলেন। এতবার আমরা আশা করেও শেষমেশ কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না বলে তোকে
আমি আর বলতে চাইনি। আজ সকালে উনি জানাতেই তোকে ফোন করলাম। এগারোটার সময় উনি আসবেন
এখানে।” তিয়াষকে
জড়িয়ে ধরে দ্বৈতা উত্ফুল্ল সুরে বলে, “ডিয়ার, এবার আমাদের বুটিক হবেই হবে! আর কোনও
টেনশন নেই!”
এগারোটার
একটু আগে তিয়াষের বাবা-মা দু’জনেই অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবার পরই এলেন ভদ্রলোক। বছর
চল্লিশেক বয়স। কাঁচাপাকা চুল। রংটা কালো, কিন্তু বেশ মার্জিত কথাবার্তা। পোশাকেও
রুচির ছাপ। হাতে বেশ কয়েকটি সোনার আংটি। তার মধ্যে জ্যোতিষ-পাথরও রয়েছে। পরিষ্কার
কামানো গাল। দেখে মনেই হয় না প্রাইভেট ব্যাঙ্কের এজেন্ট। বরং উচ্চপদস্থ সরকারি
কর্মচারী হিসেবেই বেশি মানায়। করজোড়ে নমস্কার করে নাম বললেন, “সৈকত বসু।”
“আপনি কী করে
জানলেন যে আমরা লোনের জন্য চেষ্টা করছি?” তিয়াষ জিজ্ঞেস করল।
“হেঁ হেঁ, আসলে কী
জানেন, আমাদের
— মানে, বিভিন্ন
ব্যাঙ্কের এজেন্টদের নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়। এর থেকেই খবরাখবর পাওয়া যায়।
সরকারি বা নামী বেসরকারি ব্যাঙ্ক সাধারণত রিস্ক নিতে চায় না। মজবুত জামিনদার না
পেলে কিংবা ভালো রোজগার না থাকলে লোন পাওয়া একটু মুশকিল হয় বৈকি। তখন এইসব কেসগুলো
আমাদের কাছে চলে আসে।”
“তাহলে
আপনারা কীসের ভরসায় লোন দেন?”
দ্বৈতা এবার
খুব সাবধানে সৈকতবাবুর নজর এড়িয়ে তিয়াষকে একটা চিমটি কাটে। এসব কী ফালতু কথাবার্তা
জিজ্ঞেস করছে তিয়াষ?
লোন পাচ্ছিস, চুপচাপ
নিয়ে নে না বাবা! এত ভিতরের খবরে কী দরকার তোর? বাই চান্স যদি ভদ্রলোকের মাথা ঘুরে
যায় তো হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা হয়ে যাবে না?
তিয়াষ
দ্বৈতার হাতটাকে সরিয়ে দিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় সৈকতবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। উনি
হেসে বলেন, “সঙ্গত
প্রশ্ন। প্রথম কথা, আমরা
দেখি যে বাড়িটায় আপনারা রয়েছেন সেখানে কতদিন ধরে আছেন। এলাকায় আপনার সুনাম কতটা।
আর তাছাড়া দু’জন
অ্যাপ্লিক্যান্ট হলে সমস্যাটা কমই হয়। আমাদের লাভ তো ওই এক্সট্রা ওয়ান পার্সেন্ট!”
“তার মানে কি
আপনারা এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেবেন?”
“না না, ব্যাপারটা
তেমন কিছু নয়, ম্যাডাম।” সৈকতবাবু
হাত তুলে আশ্বস্ত করে বলেন,
“প্রতি এলাকাতেই আমাদের কিছু এজেন্ট থাকে, তারাই মোটামুটি সব খবরাখবর রাখে।
আপনার বাবা রেলওয়েতে চাকরি করেন, ওঁর বাবাও সরকারি চাকরি করেন, নিজের বাড়ি — ব্যস, আর কী চাই?”
সৈকতবাবুর ‘ম্যাডাম’ সম্বোধনে
তিয়াষ খুশি হয়। এখনও ম্যাডাম সম্বোধনের মতো বড়ো হয়ে উঠতে পারেনি বলেই জানত এতদিন।
আজ জীবনে প্রথমবার এই ডাকটা শুনে ভালো লাগে। মনের খটকাটাও ধীরে ধীরে উবে যায়।
দ্বৈতাও বুঝতে পারে,
তিয়াষ সন্তুষ্ট হয়েছে। তিয়াষের উদ্দেশে সে বলে, “ডকুমেন্টগুলো কাকুকে দিয়ে দে, তিয়াষ।”
তিয়াষ সমস্ত
দরকারি কাগজপত্র একটা প্লাস্টিক ফোল্ডারে গুছিয়ে রেখেছিল। সৈকতবাবুর দিকে এগিয়ে
দেয়। “দেখে
নিন সব ঠিক আছে কি না।”
ভদ্রলোক
ফোল্ডার থেকে সমস্ত ডকুমেন্ট বের করে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন। তারপর দ্বৈতার দিয়ে
চেয়ে বললেন, “ক্যানসেলড
চেকটা?”
তিয়াষ পাশে
রাখা চেক বইটা বার করে। এই প্রথমবার ও চেক ব্যবহার করছে। এতদিন এটিএম কার্ডই
ব্যবহার করে এসেছে। কোনওদিন চেক ব্যবহার করার দরকার পড়েনি।
“চেক কীভাবে
ক্যানসেল করতে হয় জানেন তো?”
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন।
লোনের জন্য
বারবার ব্যাঙ্কে যাবার সূত্রে তিয়াষ জেনে ফেলেছে যে চেকের ওপর কোনাকুনিভাবে ‘ক্যানসেলড’ কথাটা লিখে
তার ওপর নিচে দুটো লাইন টেনে দিলেই চেক ক্যানসেল হয়ে যায়। পাশে রাখা পেনটা তুলে
টেবিলে রাখা চেক বইটার প্রথম চেকটায় ও সেটাই করতে গেল। কিন্তু ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে
উঠলেন।
“আরে না না, ওইভাবে নয়,” সৈকতবাবু
চেক বইটা নিজের দিকে টেনে নিলেন। ওঁর নিজের হাতের পেনটা দিয়ে চেকটার মাঝ বরাবর
কোনাকুনিভাবে দুটো লাইন টেনে তার মধ্যিখানে ক্যানসেলড কথাটা লিখে দিলেন। তারপর
খানিক আত্মপ্রসাদের সুরে বললেন, “এইভাবে করতে হয়। আপনি হয়তো প্রথম করছেন তাই নিয়মটা ঠিক
জানেন না। এবার সিগনেচারের জায়গায় ব্যাঙ্কে যেভাবে করেন ঠিক সেরকমভাবে একটা সই করে
দিন।”
তিয়াষ
জুলজুল চোখে ভদ্রলোকের পেনটার দিকে চেয়েছিল। ভারি সুন্দর দেখতে। কালোর ওপর সাদা
স্ট্রাইপ। নীল রঙের কালিতে উজ্জ্বল হয়ে লেখাটা পড়েছে। উফ্, ফের কোথাও
একটা খটকা লাগছে! এইরকম পেন ও কোথাও দেখেছে।
একটা কথা
ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। এই প্রথম তিয়াষ কোনও চেকে স্বাক্ষর করল, আর
ক্যানসেলড চেক তো একেবারেই প্রথম।
“আচ্ছা,” তিয়াষ ভ্রূ
কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ক্যানসেলড চেকে কি সই করতে হয়?”
স্মিত মুখে
সৈকতবাবু বললেন, “অবশ্যই!
করতে হয় বৈকি? আপনি
চিন্তা করবেন না, এই
যে কোনাকুনি ক্রসড করে দিলেন এটা আর কেউ ব্যবহার করে টাকা তুলতে পারবে না। এটা
জাস্ট একটা নিয়মরক্ষা,
ফরমালিটি বলতে পারেন।”
ব্যস, খটকাটা
পরিষ্কার হয়ে গেল তিয়াষের। মনে পড়ে গেছে। ও তড়াক করে উঠে পড়ে বলে, “আরে, আমি ভুলেই
গেছিলাম যে গ্যাসে চায়ের জল চড়িয়ে দিয়ে এসেছি! আপনি বসুন, আমি আপনার
জন্য চা নিয়ে আসছি। দ্বৈতা তুই খাবি?”
দ্বৈতা ঘাড়
নেড়ে সায় দেয়। ভদ্রলোক মৃদু আপত্তি করেন, “এসবের আর কী দরকার? আমার কাজ
শেষ, আমি
বরং উঠে পড়ি, আপনাদের
আর বিরক্ত করব না।”
তিয়াষ হাসি
মুখে বলে, “আপনি
আমাদের জন্য এত করছেন আর আমরা আপনার জন্য এটুকু করব না? বসুন বসুন।”
এর পরেরটুকু
সবাই খবরের কাগজেই পড়েছেন।
‘বেশ কয়েকবার
ভ্যানিশিং ইঙ্ক ব্যবহার করে ক্যানসেলড কথাটা লিখিয়ে নিয়ে, পরে সেই চেক
ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেবার অপরাধে পলাতক অপরাধী ধরা পড়ল এক তরুণীর
বুদ্ধিমত্তায়।’
সপ্রশংস
দৃষ্টিতে তাকিয়ে লোকাল থানার ওসি সুবীর দত্ত তিয়াষদের বাড়িতে ঘরভর্তি লোকের সামনে
জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি
কী করে আন্দাজ করলে যে ব্যাপারটায় একটা গোলমাল আছে?”
তিয়াষ
হাসিমুখে বলে, “ভদ্রলোকের
দুটি কাজ আমার আশ্চর্য লাগে। প্রথমত, ক্যানসেলড চেকে সই করতে হয় না, আর দ্বিতীয়ত
উনি আমার থেকে চেক বইটা একরকম কেড়ে নিয়ে নিজেই নিজের পেন দিয়ে ক্যানসেলড কথাটা
লিখে দেন। অথচ আমিও ঠিক ওইভাবেই ক্যানসেলড লিখতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, আমার
পদ্ধতিটা নাকি ঠিক নয়।”
দ্বৈতা
গোলগোল চোখ করে বলে উঠল,
“বাপরে, তোর
কী বুদ্ধি রে! আমি তো কিছুই আঁচ করিনি!”
“এই জন্যই
বলি খবরের কাগজ পড়, নইলে
পিছিয়ে পড়বি যে!” তিয়াষ
একটু গর্বের ভঙ্গিতে বলে,
“কিছুদিন আগেই এইধরনের একটা ঘটনার কথা পড়েছিলাম, তাই খটকাটা লাগল। ওরা নিজের
ভ্যানিশিং ইঙ্ক ভরা পেন দিয়ে ক্যানসেলড কথাটা লিখে দেয় আর আবেদনকারীর সাধারণ পেন
দিয়ে সইটা করিয়ে নেয়। ঘন্টাখানেক পর ক্যানসেলড লেখাটা মুছে গেলে নিজের ইচ্ছেমতো
টাকার অঙ্ক ভরে ব্যাঙ্ক থেকে চেকটা ক্যাশ করে নিতে কোনও অসুবিধা হয় না। অ্যাকাউন্ট
হোল্ডারের নামের চেক আর সই থাকার জন্য ব্যাঙ্কও কোনও সন্দেহ করে না। এইভাবে
মানুষের বিশ্বাসের সঙ্গে প্রতারণা করার দারুণ একটা ফাঁদ এরা পেতে বসেছে।”
দ্বৈতার মা
একটু বিভ্রান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে ভ্যানিশিং ইঙ্ক বলছিস, আদতে
জিনিসটা কী?”
তিয়াষ স্মিত
মুখে বলল, “এটা
আমাদের ছোটোবেলায় কেমিস্ট্রিতে পড়ানো হয়েছিল বলে জানি, একরকম
রাসায়নিক তরল আছে যেটার নিজস্ব একটা রং থাকে। কিন্তু বাতাসের সংস্পর্শে আসার পর
একটা বিক্রিয়া হয়ে এর রং পাল্টে গিয়ে বর্ণহীন হয়ে যায়। এইধরনের দুটি রাসায়নিক
পদার্থ হল, ফেনলফথ্যালিন
যার রং লাল বা গোলাপি আর নীল রঙের থাইমলফথ্যালিন। এদেরকেই ভ্যানিশিং ইঙ্ক বলা যেতে
পারে। এইধরনের রাসায়নিক কলমের মধ্যে কালির বদলে ব্যবহার করে লিখলে লাল বা নীল রঙে
চমত্কার লেখা যায়, কিন্তু
একঘন্টার মধ্যেই সমস্ত রং গায়েব হয়ে যাবে আর রঙের সাথে সাথে ব্যাঙ্কের টাকাও হবে
লোপাট!”
দ্বৈতা অবাক
হয়ে বলে, “কিন্তু
উনি তো দেখলাম একটা জেল পেন দিয়ে লিখছিলেন। এর মধ্যে ভ্যানিশিং ইঙ্ক ভরলেন কী করে?”
তিয়াষ
দ্বৈতার অজ্ঞানতায় যেন ভারি হতাশ হয়। করুণার সুরে বলল, “অনলাইন শপিং
সাইটে গিয়ে ভ্যানিশিং ইঙ্ক বা ইনভিজিবল ইঙ্ক পেন লিখে সার্চ করে দ্যাখ, এক সে এক
রেডি পেন পাওয়া যাবে। আমি ঠিক ঐরকম পেন দেখেছিলাম ওয়েবসাইটে, তাই খটকাটা
লাগল। কোত্থাও যাবার দরকার নেই, ঘরে বসে অনলাইন অর্ডার কর, তিন-চারদিনের মধ্যেই ডেলিভারি। দেখতে
এক্কেবারে বল পয়েন্ট পেনের মতো। কারও কোনও সন্দেহ করার অবকাশই নেই।”
ওসি তিয়াষের
কথায় ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, “এইধরনের প্রতারকদের উত্পাত আজকাল ভীষণ বেড়ে গেছে। মানুষ
নিজে যদি সচেতন না হন,
তাহলে আমরা নাচার। আপনাদের মেয়েরা দারুণ বুদ্ধির কাজ করেছে। লোকটিকে বসিয়ে
রেখে চুপিচুপি লোকাল থানায় ফোন করেছিল। শুধুমাত্র ওদের বুদ্ধির জোরেই একটা গ্যাং
ধরা পড়ল। ওদের দলে এরকম বেশ কয়েকটি ঝানু পাজি আছে। মানুষকে চটপট লোন পাইয়ে দেবার
লোভ দেখিয়ে ব্যাঙ্কের জমা টাকা নিয়ে চম্পট দেয়।”
দ্বৈতা এবার
একটু বিষণ্ণভাবে বলল,
“কিন্তু আমাদের বুটিকটার কী হবে তাহলে?”
তিয়াষের
বাবা এতক্ষণ হাঁ করে মেয়ের কান্ডকারখানার কথা শুনছিলেন। উনি তড়াক করে বলে উঠলেন, “কী আর হবে, আমাদেরই
কিছু করতে হবে।” দ্বৈতার
বাবার দিকে চেয়ে বললেন,
“কী মশাই, আপনি
এক ছাড়ুন আমিও এক ছাড়ছি। কী রে, আপাতত দু’লাখ পেলে তোদের বুটিক খুলতে পারবি তো? ফালতু এইসব
লোনের চক্করে কোথায় ফেঁসে যাবি!”
দ্বৈতার
বাবা নাচার ভঙ্গিতে বললেন,
“অগত্যা।”
_____
অলঙ্করণঃ
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
ভালো লাগল।
ReplyDeleteথ্যাঙ্কিউ
ReplyDeleteথ্যাঙ্কিউ ঋজুদা
ReplyDeleteNicely articulated, special mention about the awareness to be spread. Timely written with good structure.
ReplyDeleteথ্যাঙ্কিউ
ReplyDeleteখুব ভাল, একদম রিসেন্ট একটা সমস্যা নিয়ে, জানা, কিন্তু প্রেজেন্টেশন খুব ভাল
ReplyDelete