গল্পের ম্যাজিক:: ওভার ট্রাম্প - সত্যজিৎ দাশগুপ্ত


ওভার ট্রাম্প
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত

()

গত সপ্তাহেই ফিরলাম মাইশোর-ব্যাঙ্গালোর ট্যুর সেরে একটা মারাত্মক কেস হাতে নিয়ে গেছিলাম আমরা চটজলদিতে টিকিট পাইনি বলে এবার এতটা পথ যাতায়াতে ফ্লাইট নিতে হয়েছিল যেটা কিনা আমার আর অনিদার দু’জনেরই না পসন্দ কারণ, ফেরার সময় ঠিক আছে, কিন্তু যাবার সময় যাচ্ছি যাচ্ছি যে ব্যাপারটা মাথায় ঘোরে তার অনুভূতিই আলাদা। প্লেনে সেটা কোথায়? তবুও বাধ্য হয়ে আকাশে উড়তে হল।
আমাদের কেসটা ছিল মাইশোরে। জায়গাটার বাংলা নাম মহীশূরব্যাঙ্গালোরে আমাদের এক পরিচিত থাকায় সেখানে দু’দিন ছিলাম। মহীশূর থেকে ব্যাঙ্গালোর ফিরেছিলাম গাড়িতে। রাস্তায় এক কান্ড হয়েছিল। হাইওয়ে ধরে আসছিলামড্রাইভার নতুন। রাস্তাঘাট তেমন একটা চেনে না। তাই রাস্তার ধারে লাগানো তিরচিহ্ন দেওয়া বোর্ডে লেখা রাস্তার নামের ওপরই ওকে ভরসা করতে হচ্ছিল।
একটা জায়গায় এসে আবিষ্কার করলাম হঠাৎ রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকেরটায় ব্যাঙ্গালোর লেখা তিরচিহ্নের বোর্ডটা দেখে সেদিকেই গাড়ি ঘোরাল আমাদের ড্রাইভার কিন্তু মিনিট দশেক চলার পর হঠাৎ কী মনে হতে জিপিএস অন করে দেখি ব্যাঙ্গালোর থেকে আমাদের দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়ছে! ভাবলাম সেরেছে! ভুল রাস্তায় এলাম নাকি? সামনে একটা রেস্তোরাঁ দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে কথাটা জানাতে তার মালিক অনেক কষ্টে কর্ণাটকি ঢংয়ের হিন্দিতে জানালেন যে আমরা উলটোদিকে চলে এসেছিসঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘোরালাম আমরা। এবার সেই মোড়টাতে এসে একটা পুলিশকে দেখে ব্যাঙ্গালোর কোনদিকে জিজ্ঞাসা করতে সে যেদিকে ইশারা করল, আমরা সেদিকে প্রথমটায় যাইনি। লক্ষ করলাম, তিরচিহ্ন দেওয়া বোর্ডটা এখনও ভুল দিকে তাক করা! জিনিসটা পুলিশটাকে বলতে সে দুর্বোধ্য ভাষায় কড়মড়িয়ে কী যে বলতে শুরু করল তার একবর্ণ বুঝতে পারলাম না। শুধু হাত-পা নাড়া দেখে বোঝা যাচ্ছিল লোকটা খুব রেগে গেছে আমাদের ড্রাইভার কর্ণাটকেরসে বলল, লোকাল কিছু ছোকরা টাইপের ছেলে মজা করার নামে প্রায়ই বোর্ড অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। আর লোকজন ভুল করে ফেলে। যেমন আমরা করেছিলাম। এতেই নাকি ওদের আনন্দ। আমাদের গাড়ি যখন আবার ব্যাঙ্গালোরের রাস্তা নিয়েছে, তখন দেখি পুলিশটা বোর্ড ঠিক করতে ব্যস্ত।
আজ সকাল থেকেই অনিদার ফ্ল্যাটে বসে রয়েছি। গতকাল বিশ্বকর্মাপুজো গেছে। আমরা শিয়ালদা গেছিলাম ঘুড়ি ওড়াতে। ওখানে অনিদার এক কাকার বাড়ি আছে। এখন সেই ব্যাপারেই কথা হচ্ছিল। আমাদের ফ্ল্যাট কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মেঘমালা অ্যাপার্টমেন্টে। দোতলার দুটো ফ্ল্যাটের একটাতে থাকি আমরা আর তার পাশেরটাতে অনিদারা। ফ্ল্যাটের গা ঘেঁষেই আদিগঙ্গা। তা থেকে ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নব্বই দশকের একটা খুব জনপ্রিয় বলিউড সিনেমার গান ভেসে আসছিল। কিছু দূরেই একটা কারখানায় বিশ্বকর্মাপুজো হয়েছে। মনে হয় গানটা সেখান থেকেই আসছিল।
অনিদা নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল। থেকে থেকে বলছিল, আশি আর নব্বই দশকের গান না বাজলে নাকি কলকাতার পুজো ঠিক পুজো হয়ে ওঠে না। বয়সে ও তিরিশ ছুঁয়েছে। সেখানে আমি আঠারোতাই ওর ফিলিংস আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এর মধ্যে বিজুদা পুরনো চায়ের কাপগুলো তুলে নিয়ে ধোঁয়া উঠতে থাকা দুটো নতুন চায়ের কাপ সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে গেল। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে দিয়ে গেল পনিরের পকোড়া
গত কয়েক বছরে গোয়েন্দা হিসেবে বেশ নাম করেছে অনিদা। এখন কেসও পাচ্ছে অনেক। তাই পেশাগত দিক থেকে ওকে বেশ ব্যস্ত বলা চলে। আর ওর সাগরেদ হিসেবে আমারও আগের থেকে অনেক দায়িত্ব বেড়ে গেছে। আসলে ওর কেসগুলো শুরু থেকে শেষপর্যন্ত গল্পের আকারে লিখে মানুষের কাছে পৌঁছে দিই আমি। তাই জনপ্রিয়তাটা আমিও কম উপভোগ করছি না।
দ্বিতীয় ইনিংসের চায়ের কাপগুলো আমরা দু’জনেই প্রায় অর্ধেক শেষ করে এনেছি, এমন সময় ওর মোবাইলটা শব্দ করে নড়েচড়ে উঠল। স্ক্রীনে অচেনা নম্বর দেখে একবার ভুরু কোঁচকাল অনিদা। তারপর ফোনটা কানে দিল। এবার মাথাটা একবার সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আপনি ঠিকই এসেছেন। দোতলায় উঠে আসুন। ডানদিকের ফ্ল্যাট।” শেষে ফোনটা রেখে গলা তুলে বিজুদাকে চায়ের কথা বলে দিল।
অনিদা জানাল, কেউ ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেনআর সেটা কে তা জিজ্ঞাসা করতে বলল, তাঁকে ও চেনে না। তবে আগন্তুক পুরুষ মানুষ। গলা শুনে মনে হয়েছে বয়স্ক। কথার উচ্চারণ শুনে মনে হয়েছে সম্ভ্রান্ত ঘরের। নাক টানা শুনে মনে হয়েছে ওঁর ঠান্ডা লেগেছে। আর ভদ্রলোকের সঙ্গে নাকি গাড়ি আছেসেটা অনিদা কী করে বুঝল জিজ্ঞাসা করতে বলল, ভদ্রলোক ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাউকে বলছিলেন, “ফাঁকা দেখে দাঁড় করাও তাতেই ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে যে ভদ্রলোক গাড়ি নিয়ে এসেছেন আর সঙ্গে ড্রাইভার রয়েছে। এছাড়া ভদ্রলোক প্রায় ছ’ফুট লম্বা। মানে অনিদার থেকে ইঞ্চি দুয়েক বেশিসে কী! হাইট শুনে অবাক হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “সেটা জানলে কী করে?” তাতে ও মুচকি হেসে জানাল যে ভদ্রলোক নাকি ওকে জিজ্ঞাসা করেছেন আমাদের বিল্ডিংয়ের একতলার গ্রিলের দরজাটা দিয়েই ঢুকতে হবে কি না। আসলে বাউন্ডারির পাঁচিলের দরজা পেরিয়ে তারপর একটা ছোটো উঠোন। আর সেটা পেরোলে আমাদের বিল্ডিং। কাউকে আসতে গেলে সেই গ্রিলের দরজা খুলেই আসতে হয়। আর বাইরে থেকে পাঁচিলের ওপর দিয়ে গ্রিলের দরজাটা দেখতে গেলে একটা মানুষকে প্রায় ছ’ফুট লম্বা হতেই হয়।
অনিদার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, “আরিব্বাস! দারুণ ধরেছ তো!”
উত্তরে সামান্য একপেশে হাসিটা হাসা ছাড়া আর কিছুই করল না অনিদা আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “মক্কেল?
তাতে ও নিচের ঠোঁটটা ওলটাল এর মধ্যে ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে গেছে দরজা খোলার শব্দ শুনে বুঝলাম সে কাজটা বিজুদাই করল কারণ, অত ব্যস্ততা নিয়ে সে ছাড়া আর কেউ দরজা খোলে না এরপর কাটল আরও প্রায় দশ সেকেন্ড এবার দরজা দিয়ে শ্যামবর্ণ যে ভদ্রলোক ঘরে এসে ঢুকলেন, তার সামান্য বর্ণনা অনিদার আন্দাজ থেকেই পেয়েছি যেটা কিনা একশো ভাগ ঠিক বাকিটা বলতে গেলে বলতে হয়, বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই দাড়িগোঁফ কামানো গোলপানা মুখ গালে সামান্য মাংসের আধিক্য রয়েছে স্বাস্থ্যও একেবারে ফেলনা নয় বেশ শক্তপোক্ত পরনে সাফারি স্যুটের হাফ হাতা জামা আর একই কাপড়ের প্যান্ট মজবুত হাত মোটা কবজি সোনালি চেনের ঘড়িটা বাঁ হাতের কবজির ওপর ঝুলছে
ঘরে ঢুকে আমাদের নতুন অতিথি এবার অনিদার দিকে চেয়ে বললেন, “অনিরুদ্ধ সেন?
তাতে হেসে মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকাল অনিদা
ভদ্রলোক তখন বুকের কাছে দু’হাত জোড় করে বললেন, “নমস্কার আমার নাম অর্ক রায়
অর্ক? নামটা বেশ সুন্দর মনে মনে ভাবলাম, চেহারার সঙ্গে লোকটার নামটা একেবারেই যায় না এর মধ্যে অনিদাও নমস্কারের উত্তরে নমস্কার জানিয়েছে
“আসলে একটা দরকারে...” কথাটা শেষ করলেন না ভদ্রলোক কারণ, অনিদা ওঁকে ইতিমধ্যেই সামনের সোফাতে বসতে অনুরোধ করেছে এবার উনি বসতে ও বলল, “বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?
এর মধ্যে বিজুদা ওঁর জন্য চা আর পনিরের পকোড়া দিয়ে গেছে। অনিদা এবার ওঁকে সেদিকে দেখিয়ে ইশারা করতে উনি ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে বুড়ো আঙুল, মধ্যমা আর তর্জনী দিয়ে তিনটে তুলে নিলেন। তারপর একটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বললেন, “একটা সমস্যা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। সেই ব্যাপারেই হেল্প চাই।”
অনিদা তখন চায়ের কাপে একটা চুমুক মেরে বলল, “ব্যাপারটা খুলে বলুন।”
তাতে ভদ্রলোক কিছু একটা বলতে গিয়েও গলাখাঁকারি মেরে একবার আমার দিকে তাকালেন। ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন নয়। তাই আমি এবার মুচকি হেসে অনিদার দিকে তাকাতে ও মিঃ রায়কে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, “ও আমার সহকারী। আমার মাসতুতো ভাই। ওর সামনে আপনি স্বচ্ছন্দে সব বলতে পারেন।”
কথাটাতে ভদ্রলোক কতটা মানলেন বোঝা গেল না। ইতস্তত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মজুমদার অবশ্য আমাকে এই ছেলেটির কথা বলেছে।”
অনিদা তখন জিজ্ঞাসা করল, “কোন মজুমদার?”
“নীলাদ্রী মজুমদার।” বললেন অর্ক রায়।
“মানে, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট নীলাদ্রী মজুমদার? যিনি গড়িয়াহাটের কাছে থাকেন?” বলল অনিদা।
“হ্যাঁ সেই। ও বলেছিল যে আপনার একজন সহকারী আছে।” বলে আমাকে বললেন, “কী নাম যেন তোমার? ও হ্যাঁ, রণজয় বোস।” নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলেনতারপর ভুরু নাচিয়ে বললেন, “পপুলারলি নোন অ্যাজ জয়।”
আমি মুচকি হেসে ওঁর কথায় সায় দিলাম। অবশ্য এখানে একটু ভুল হল। আমি অনিদার মাসতুতো ভাই নই। আমার আর ওর মা ছেলেবেলাকার বান্ধবীআমরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকি। তবে বাইরের লোকের কাছে অনিদা আমাকে মাসতুতো ভাই বলেই পরিচয় দেয়। কিন্তু অর্ক রায়ের সঙ্গে অত কথায় গেলাম না আমি।
ভদ্রলোক দেখলাম এর মধ্যে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। এবার ওঁর সমস্যা সম্পর্কে যা বললেন তা অনেকটা এইরকম –
অর্ক রায় পেশায় একজন ব্যবসায়ী। থাকেন যোধপুর পার্কে। ওঁর অ্যান্টিক জিনিসের ব্যাবসা। রাজা-বাদশা থেকে শুরু করে জমিদারবাড়ির জিনিসপত্র কিনে এনে মোটা টাকায় বিক্রি করেন। কখনও কখনও তো একেকটা জিনিস বিক্রি করে লাখ টাকাও লাভ করেছেন! ব্যাবসার খাতিরে বেশ রেয়ার জিনিসপত্রের দিকে নজর রাখতে হয় ওঁকে গত রবিবার এমনই এক দুর্মূল্য জিনিস নিয়ে লখনউ থেকে কলকাতায় এসেছিলেন আমীর আলী। ভদ্রলোকের কাছে ছিল স্বয়ং শাহজাহানের ব্যবহার করা একটা হিরের আংটি, যার বর্তমান দাম প্রায় দশ লাখ!
এতটা বলে থামলেন অর্ক রায়।
একটা আংটির দাম দশ লাখ শুনে আমি চোখ কপালে তুলতে উনি হেসে বললেন, “জিনিসটার মালিক কে ছিলেন সেটা একবার ভেবে দেখ!” তারপর বললেন, “আমার জিনিসটা কেনার কথা ছিল। তারপর বেচতাম আরব-কান্ট্রিতে।”
“ছিল?” বলে অনিদা বলল, “তার মানে অন্য কেউ বেশি দাম দিয়ে জিনিসটা কিনে নেয়?”
“একদম তাই!” বলে ডান হাত দিয়ে সোফার হাতলে একটা ঘুসি মেরে রাগ প্রকাশ করলেন মিঃ রায়।
“কিন্তু সেটা তো হতেই পারে।” বলল অনিদা।
তাতে রেগে গিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “না, হতে পারে না। যে কিনেছে তার প্রথমে আট লাখে বিড করার কথা ছিল। আমার কাছে খবর ছিল। কিন্তু পরে বেশি ফেলে দিল! অথচ দশ লাখই ছিল হায়েস্ট। যেটা ছিল আমার!”
বিড করা মানে আমি জানি। নিলামে যারা জিনিস কিনতে চায় তারা একেকটা জিনিসের জন্য নিজের সাধ্যমতো দাম দেবার কথা বলে। তাতে বিক্রেতা তাকেই জিনিসটা বিক্রি করে যে সবথেকে বেশি দাম দিতে রাজি হয়।
অর্ক রায়ের দোকান গড়িয়াহাটে। কর্মচারী বলতে তিনজন। ম্যানেজার সুব্রত বক্সী, অ্যাকাউন্টেন্ট-কাম-ক্যাশিয়ার অনুতম মিত্র আর বেয়ারা ভোলা মাহাতো। ব্যাবসার কাজে সুব্রত বক্সীর ওপরই বেশি ভরসা করেন অর্ক রায়। এমনকি নিলামের গোপন খবরও থাকে তাঁর কাছে। এই আংটির বেলাতেও একই ব্যাপার ছিলমিঃ রায়ের বদলে সেদিন ওঁর প্রতিনিধি হয়ে আমীর আলীর কাছে গেছিলেন মিঃ বক্সী
আমীর আলীর নিলামের ধরনটা ছিল অন্যরকম। যারা সেদিন ওঁর ঘরে ছিলেন, মানে ইচ্ছুক ক্রেতারা, আমীর আলী তাঁদের প্রত্যেককে তাঁদের অফারের অঙ্কটা একটা কাগজে লিখে খামে করে তাঁর কাছে জমা রাখতে বলেন। সুব্রত বক্সীও সেইমতো দশ লাখ লেখা কাগজটা খামে ঢুকিয়ে আমীর আলীর কাছে জমা করেন। সুব্রত বক্সী ছাড়া সেদিন আরও চারজন আংটিটা কিনতে এসেছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম তিনজনের টাকার অঙ্ক দশের নিচেই ছিল। কিন্তু গোল পাকালো চার নম্বর লোকটা। নাম মলয় ঘোষাল। এর আগে অর্ক রায় মিঃ বক্সীকে বলেছিলেন দশ অফার করতে। কারণ, তাঁর কাছে খবর ছিল মলয় ঘোষাল আট লাখ অফার করছেন। অথচ আখেরে দেখা যায় মলয় ঘোষালের অফার করা টাকার পরিমাণ দশ লাখ পঞ্চাশ হাজার! আর তাই শেষপর্যন্ত শাহজাহানের আংটি চলে যায় মলয় ঘোষালের কাছে
এতটা বলে থামলেন মিঃ রায়। তারপর বললেন, “আমার প্রশ্ন হল, লোকটা আমার থেকে বেশি টাকা অফার করল কী করে? আমার কোনও লোকই কি এর সঙ্গে জড়িয়ে? থাকলে সেটা কে?”
প্রশ্নগুলোই বলে দিল ভদ্রলোক কী সাহায্যের আশা নিয়ে অনিদার কাছে এসেছেনকয়েক মুহূর্ত মেঝের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল অনিদা। এর মধ্যে বিশ্বকর্মাপুজোর প্যান্ডেল থেকে অবিরাম গান ভেসে আসছে। অনিদাকে অতক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে মনে হয় ধৈর্য হারালেন মিঃ রায়। এবার গলাখাঁকারি মেরে বললেন, “দিস ওয়াজ দ্য ফার্স্ট টাইম। এখনই কালপ্রিটকে না ধরতে পারলে জিনিসটা তো চলতেই থাকবে!”
মিঃ রায়ের কথা শুনে মাথাটা দু’বার সামনের দিকে ওপরনিচ করল অনিদা। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “আপনি সুব্রত বক্সীকে কখন টাকার অ্যামাউন্টটা জানান?”
“কাগজ জমা করার ঠিক আধঘণ্টা আগে।” বললেন মিঃ রায়।
“মলয় ঘোষাল কি তারপর কাগজ জমা করেন?” আবার প্রশ্ন করল অনিদা।
“না।” মাথা নেড়ে মিঃ রায় বললেন, “সবাই একসঙ্গেই কাগজ জমা করেছিলেন। তেমনটাই বলেছিলেন আমীর আলী।”
“টাকার অঙ্কটা আর কে কে জানত?”
“শুধু সুব্রত।”
“লোকটা বিশ্বাসযোগ্য?”
অনিদার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে মিঃ রায় বললেন, “অবশ্যই! এতদিন কাজ করছে আমার কাছে। কোনওদিন কিছু করেনি। আর এখন হঠাৎ...”
তাতে অনিদা বলল, “মিঃ রায়, মানুষের মন খুব আশ্চর্য জিনিস। কখন কী করে...”
তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন, “তাহলে আর মানুষ কোনওদিন কারও ওপর বিশ্বাস করতে পারবে না, মিঃ সেন!”
অনিদা আবার প্রশ্ন করল, “টাকার অঙ্কটা জানানোর সময় আপনি কোথায় ছিলেন?”
“দোকানে” বললেন মিঃ রায়।
“আশেপাশে কেউ ছিল সেই সময়?”
“হ্যাঁ, ছিল তো। অনিদার প্রশ্ন শুনে মাথা নেড়ে মিঃ রায় বললেন, “অনুতম আর ভোলা, দু’জনেই ছিল। অনুতম তখন আমার সামনেই বসে। আর ভোলা আমাদের চা দিচ্ছিল। একজন কাস্টমারও ছিল সামনে। আর হ্যাঁ, আমার ড্রাইভার আমাকে তখন টিফিন দিতে এসেছিল।”
“সে কী!” মিঃ রায়ের কথা শুনে হঠাৎ সোজা হয়ে বসে অনিদা বলল, “আপনি ওদের সামনেই বলে দিলেন!”
মিঃ রায় তাতে বললেন, “ফোনে বললাম কোথায়? আমি তো সুব্রতকে এসএমএস করে দিয়েছিলাম।”
কথাটা শুনে অনিদার মুখ কিছুটা স্বাভাবিক হল“ও, তাই বলুন!” বলল ও।
তাতে, “হ্যাঁ,” বলে মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকালেন মিঃ রায়।
“কিন্তু তাও মলয় ঘোষাল জেনে গেছিলেন যে আপনি দশ অফার করছেন?” বলল অনিদা।
“রাইট কিন্তু প্রশ্ন হল, কী করে?” বললেন মিঃ রায়।
অনিদা তাতে বলল, “আপনি সন্দেহ করছেন, কেউ হয়তো আপনার খবর বাইরে লিক করছে। আর সেই লোককে আমাকে ধরে দিতে হবে।”
“তা তো বটেই!” বলে হাত পাকিয়ে মিঃ রায় বললেন, “শয়তানটার শাস্তি চাই! আমাকে জানতেই হবে গোপন খবরটা বাইরে বেরোলো কীভাবে
মিঃ রায়ের ট্যাবটা সামনের সেন্টার টেবিলে রাখা ছিল। উনি বললেন, ওটা নিয়ে চলাফেরা করতে ওঁর সমস্যা হয়। তাই একটা ছোটো মোবাইল কিনবেন। অনিদা সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “এটা থেকেই মেসেজ করেছিলেন?”
তাতে মিঃ রায় মাথা ঝুঁকিয়ে, “হ্যাঁ,” বলতে ও ওঁর থেকে ট্যাবটা দেখতে চাইল। উনি সেটা অনিদার হাতে দিতে ও প্রথমেই ফোন মেসেজের সেন্ট অপশনে গেল। এবার একটা মেসেজ খুলে মিঃ রায়ের চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, “এটাই?”
তাতে মিঃ রায় আবার মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকালেন।
“ক’টা নাগাদ?”
“ঠিক একটায়।”
“টাইম নিয়ে এত শিওর হচ্ছেন কী করে?”
“আমার মনে আছে। মেসেজ পাঠানোর সময় সামনে চার্চের ঘড়িতে একটার ঘণ্টা বেজেছিল।”
“ও।” বলে একবার মিঃ রায়ের দিকে চাইল অনিদা। তারপর কেন জানি না একটা সন্দেহজনক নজরে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাল
মেসেজে কী লেখা ছিল তা জানার জন্য আমি উসুখুসু করছিলাম। অনিদা আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে আমি সেটা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে স্ক্রিনের ওপর মেসেজটা দেখতে পেলাম। ‘10L আর মেসেজটা যে বক্সী বলে লোকটাকেই পাঠানো হয়েছিল, তাও দেখলাম
অনিদা এবার ফোনটা আমার থেকে নিয়ে স্ক্রিনটা আপ আর ডাউন করে বার দুয়েক দেখে তারপর সেটা মিঃ রায়কে ফেরত দিয়ে দিল উনি তখন জিজ্ঞাসা করলেন, “কিছু বুঝতে পারলেন?
অনিদা তাতে ঠোঁট উলটে বলল, “একটা ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে উঠতেও হারিয়ে যাচ্ছে
ওর এই কথাটার মানে আমি জানি নিশ্চয়ই কিছু একটা আন্দাজ করছে ও ব্যাপারটা ভেবেই উত্তেজনায় শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল আমার ভাবলাম, বা রে! এত তাড়াতাড়ি অনিদা অপরাধী ধরে ফেলবে! সেটা হলে কিন্তু বেজায় হবে তবে যে লোক অর্ক রায়ের মতো লোকের থেকে এভাবে খবর বের করেছে, সে নিশ্চয়ই এলেবেলে নয়
অনিদা মিঃ রায়ের থেকে দিন চারেকের সময় নিয়ে নিল বলল, “বেশ কিছু ক্যালকুলেশন করতে হবে
তাতে মিঃ রায় ওকে দশদিন পর্যন্ত ছাড়তে রাজি হলেন অনিদা অবশ্য জানাল, কেসের সুরাহা হবার হলে ওর মধ্যেই হবে, নতুবা নয় তাতে মুখে একটা চওড়া হাসি এনে মিঃ রায় বললেন, “তাহলে তো কথাই নেই!”
অর্ক রায় আজকের মতো বিদায় নেবার আগে অনিদা ওঁকে আরও গোটাকয়েক প্রশ্ন করে নিল
“আপনি মিঃ বক্সীকে এসএমএস করবেন তা উনি জানতেন?
“জানত তো কারণ, দোকানে আসার সময়ই আমি ওকে সেকথা জানিয়ে দিই
“আচ্ছা” বলে ও এবার একটা বে-লাইনের প্রশ্ন করল “আপনার কি পোস্ট পেইড কানেকশন? বিল আসে বাড়িতে?
তাতে অবাক হয়ে মিঃ রায় বললেন, “হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো?
“না, এমনি আপনি বরঞ্চ আপনার দোকানের ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে যান” বলে বুকের কাছে হাতদুটো এনে জড়ো করল অনিদা


()

গতকাল অর্ক রায় চলে যাবার পর কেস নিয়ে আর খুব একটা মাথা ঘামায়নি অনিদা। দুপুরে খাবার আগে সময়টুকু খবরের কাগজ পড়ে কাটিয়েছে। আসলে রবিবারের কাগজে এত খবর থাকে যে তার একটাও ছাড়তে ইচ্ছে করে না। তারপর মাংস-ভাত খেয়ে ভাতঘুম দিয়েছে। বিকেলে হাই তুলতে তুলতে আমাকে নিয়ে গেছে একাডেমিতে নাটক দেখতে। তারপর রাতে আবার পেট পুরে ভাত খেয়ে দশটার মধ্যেই বিছানা নিয়েছে। সব দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে এমন খামখেয়ালিপনাটা একমাত্র ওর পক্ষেই সম্ভব।
আজ সোমবার। অনিদাকে বেশ পরিচিত মেজাজে পেলাম। দুপুরবেলা কেসটা নিয়ে দুয়েকটা কথা হল আমার সঙ্গে। বলল, “কী আশ্চর্য বল তো! মিঃ রায় এসএমএস করলেন সুব্রত বক্সীকে। আর জেনে গেল ওঁর অপোনেন্ট! এটা কী করে সম্ভব?”
আমি বললাম, “মলয় ঘোষাল লুকিয়ে লুকিয়ে সুব্রত বক্সীর মোবাইল ঘেঁটে দেখেননি তো?”
“না,” মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে অনিদা বলল, “সেটা কী করে সম্ভব? মলয় ঘোষালকে সুব্রত বক্সীর মোবাইল দেখতে হলে সুব্রত বক্সীকে নিজে থেকে মোবাইলটা তুলে দিতে হবে মলয় ঘোষালের হাতে
ওর কথা শুনে আমি মাথা নেড়ে বললাম, “সে অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ।”
বিকেলে আমরা গেলাম কলেজ স্ট্রিট। আগামী মাসে আমাদের মুর্শিদাবাদ যাবার কথা। তাই তার ওপর একটা বই কিনল অনিদা। একটু পড়াশুনা করে নিলে ঘোরাটা বেশি কার্যকর হয়, তাই। দোকানদার আমাদের চেনেন। বললেন, “আজকাল তো বই কিনে পড়ার চল চলে যাচ্ছে। সব মোবাইল আর ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত।”
তখন অনিদা বলল, “পড়াশুনা করতে আমিও নেট ব্যবহার করি। তবে আমার কিন্তু বইয়ের পাতার লেখাগুলো হজম করতে বেশি মজা লাগে।”
কলেজ স্ট্রিটে এসে অনিদার হঠাৎ ইচ্ছে হল ও হাতে টানা রিক্সা চড়বে। সেইমতো উঠেও পড়ল একটা রিক্সা দেখে। উদ্দেশ্য ছিল সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পর্যন্ত যাবে। কিন্তু মাঝপথে ব্যাপারটা অমানবিক মনে করে ঝপ করে রিক্সা থেকে নেমে পড়লএকটা মানুষ এত কষ্ট করে দুটো মানুষকে টেনে নিয়ে চলেছে। ব্যাপারটা ও মেনে নিতে পারছিল না। অবশ্য তার জন্য ভাড়ার টাকা কমায়নি।
ও হ্যাঁ, একটা কথা আমি বলতে ভুলে গেছি। আজ আমরা গাড়ি আনিনি। তাই সেন্ট্রাল থেকে মেট্রো ধরলাম। নামলাম এসপ্ল্যানেডে। বড়ো বড়ো বাড়ি দিয়ে জায়গাটা ঘেরা বলে নাকি ফিরিঙ্গিরা এর নাম দিয়েছিল ‘এসপ্ল্যানেড’পৌনে দুশো বছর আগে এখান থেকে নাকি গঙ্গা দেখা যেত। এতটাই ফাঁকা ছিল এলাকাটা।
কেএফসি-তে ঢুকে চিকেন স্ট্রিপ চিবোতে চিবোতে আবার কেসটার কথা তুলল অনিদা। আমি বললাম, “হতেও তো পারে সুব্রত বক্সী টাকার জন্য খবরটা মলয় ঘোষালকে দিয়ে দিয়েছেন।”
তাতে অনিদা ঠোঁট উলটে বলল, “উঁহু, এমন কাঁচা কাজ উনি করবেন না।”
“কেন?”
“তাতে লোকে যে ওঁকেই সন্দেহ করবে তা উনি ভালোমতোই জানেন। তাই যেচে বিপদ ডেকে উনি আনবেন না। তবে ভদ্রলোকের ভাগ্য ভাল যে অর্ক রায় ওঁকে সন্দেহ করছেন না।”
“তাহলে? উনি ছাড়া তো কেউ টাকার কথাটা জানতেনও না।”
“হুম,” বলে এবার একটা স্ট্রিপ না খেয়ে মুখের সামনে ধরে রেখে কী যেন চিন্তা করল অনিদা। প্রায় পনেরো সেকেন্ড পর স্ট্রিপে একটা কামড় মেরে বলল, “এবার একে একে সবার সঙ্গে দেখা করার সময় এসেছে।”
বুঝলাম, এবার ও বেশ কয়েকটা জেরা পর্ব চালাবে।

()

অর্ক রায়ের অফিসে সুব্রত বক্সীর মুখোমুখি বসেছিলাম আমরা। বেচারা এমনিতেই এমন একটা ধাক্কা খেয়ে মনমরা হয়ে ছিলেন। তারপর এখন গোয়েন্দার জেরার সামনে পড়ে ওঁকে দিশেহারা লাগছিল।
অনিদা ওঁকে বলল, “মলয় ঘোষাল শেষপর্যন্ত বাজি মেরে বেরিয়ে গেলেন?”
সুব্রত বক্সী তাতে ভয়ে ভয়ে বললেন, “এতে আমার কোনও হাত নেই। বিশ্বাস করুন, স্যার হয়তো আমাকে...”
“না না,” ওঁর কথা কেটে অনিদা বলল, “আপনি মিঃ রায়কে শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। উনি কিন্তু আপনাকে সন্দেহ করছেন না।”
তাতে ‘ও’ বলে মাথা নামিয়ে নিলেন সুব্রত বক্সী।
অনিদা ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনারা সবাই একসঙ্গেই খাম জমা করেছিলেন?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে মিঃ বক্সী বললেন, “মলয় ঘোষাল আমার দশ মিনিট আগেই খাম রেডি করে ফেলেছিলেন।”
“দশ মিনিট আগে?” তথ্যটা জেনে অনিদা দু’সেকেন্ড কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, “আপনাকে তো মিঃ রায় এসএমএস করেছিলেন
“হ্যাঁ,” বলে মাথা ঝোঁকালেন মিঃ বক্সী।
“আপনার কাছে এখনও আছে এসএমএসটা?”
“হ্যাঁ, এই যে।” বলে মিঃ বক্সী মোবাইলের মেসেজ বক্স থেকে মেসেজটা বের করে অনিদাকে দিলেন। সেটা দেখতে দেখতে লক্ষ করলাম অনিদার কপালে প্রথমে কয়েকটা ভাঁজ পড়লতারপর চোখজোড়া গোল গোল হয়ে ভুরুজোড়া কপালে উঠে গেল। আমি ওর মুখের ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। কারণ, বেশ জানি যে একটা কোনও তথ্য ওর হাতে চলে এসেছে! আমি তাই এবার উৎসুক হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্জাসা করলাম, “মেসেজে কি কোনও ক্লু আছে?”
তাতে অনিদা কোনও কথা না বলে সুব্রত বক্সীর মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলআমি তাতে লেখা মেসেজটা দেখে বললাম, “এখানেও তো ‘10L’ লেখা রয়েছে, অনিদা। যেটা অর্ক রায় পাঠিয়েছিলেন।”
অনিদা তখন আমাকে অন্ধকারে রেখে বলল, “আমি মিঃ বক্সীর মোবাইলটা দেখার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম। লেখাটা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই, আসল জিনিস হল টাইমটা।”
“টাইম? মানে?”
ও বলল, “মিঃ বক্সী লেখাটা পেয়েছেন দুপুর একটা বেজে পঁচিশ মিনিটে। অর্ক রায়ের মোবাইলেও দেখেছি দুপুর একটা পঁচিশেই মেসেজটা পাঠানো হয়েছে। অথচ মিঃ রায় বলেছিলেন মেসেজটা উনি পাঠিয়েছিলেন ঠিক দুপুর একটায়তাহলে এই পঁচিশ মিনিটের হিসেব মিলছে না কেন? সার্ভারে প্রবলেম ছিল? মিঃ রায় একটায় মেসেজ সেন্ট করলেও সেটা কি একটা পঁচিশে ডেলিভার হয়েছিল? নাকি অন্য কিছু?”
“অন্য কিছু মানে?” আমি অনিদার কথার মানে ধরতে পারলাম না।
অনিদা তখন ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “সেটা কিছুতেই মাথায় আসছে না রে, জয়।”
আমি বললাম, “একবার অন্যদের সঙ্গে কথা বলে দেখো না।”
“ঠিক বলেছিস।” একবার আলতো করে দু’চোখ বুজে আমার প্রশংসা করে ও বলল, “অন্যরা কী বলে দেখি।”
মিঃ বক্সী এতক্ষণ হাঁ করে আমাদের কথা শুনছিলেন। এবার যখন বুঝতে পারলেন যে কেসে ওঁর সঙ্গে সঙ্গে দোকানের অন্য কর্মচারীদেরও জড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে, তখন যেন উঠে পড়ে লাগলেন। বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ভোলা আর অনুতম, দু’জনেই তো রয়েছে, ডাকব?”
তাতে আমি আর অনিদা একবার নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে নিলাম। তারপর একে একে ভোলা মাহাতো আর অনুতম মিত্র, দু’জনের সঙ্গেই কথা বললাম।
ভোলা ছেলেটা বেশ বেপরোয়া। ব্যবহার আর চেহারা, দুটোতেই। রোগা শরীরে স্কিন-টাইট গেঞ্জি আর আর চুজ জিনসের প্যান্ট পরেছিল ও। কোঁকড়ানো চুলে মাথার সামনের দিকটা সামান্য ঘন। দু’কানের ওপরে আর মাথার পেছনদিকে অনেকটা করে চুল কাটা। সেখানের চুলের উপস্থিতি শুধুমাত্র কালো আভা দেখেই বুঝে নিতে হয়। গায়ের রং একটু মাজা। তবে রোগা হলেও শারীরিক দিক থেকে ছেলেটাকে দেখে কিন্তু বেশ শক্তপোক্তই মনে হল জেরা করা হবে বলে ভয় করছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বেশ তেরিয়া ভঙ্গীতে ও বলল, “স্যারের লস হয়ে গেছে। খুব খারাপ ব্যাপার। কিন্তু তাতে আমার ভয় পাওয়ার কী আছে?”
অনিদা ওকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি জানো ওঁর কী ক্ষতি হয়েছে?”
তাতে ও ভুরু কুঁচকে বলল, “জানব না কেন? একটা দামি আংটি উনি কিনতে পারেননি। কেউ ওঁকে কীভাবে যেন চিট করেছে।”
“কে? সেটা জান?”
“হবে কেউ। ওঁর আশেপাশের।”
“আশেপাশের?” বলে অনিদা আমার দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল, “বিশেষ কারও কথা বলতে চাইছ তুমি?”
তাতে ডান গালে একটা হাসি টেনে ও বলল, “আমাদের বলাতে কী আসে যায়, স্যার?” তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি ও-ব্যাপারে কিছু জানি না, স্যার। তবে জানতে পারলে বলে দেব
অনুতম মিত্রর সঙ্গে কথা বলেও তেমন কিছু পাওয়া গেল নাভদ্রলোক খুবই কম কথা বলেন। যা  বলেন, তা বলার আগে একবার মাটির দিকে আর একবার ডাইনে-বাঁয়ে চেয়ে নিয়ে বলেন। কথা বলার সময় কারও চোখের দিকে চাইতে পারেন না। অনিদা বলে, এধরনের লোকেদের নাকি আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকে।
বয়সের বিচারে মিঃ মিত্র মাঝবয়স থেকে বয়স্ক হওয়ার দিকে পা বাড়িয়ে ফেলেছেন। পরনে হাফ হাতা জামা আর প্যান্ট। মাথায় পাতলা হয়ে আসা কোঁচকানো চুল। তার অর্ধেকেরও বেশিতে পাক ধরেছে। খয়েরি মোটা ফ্রেমের চশমাটা নাকের ওপর বসানো। ওটা শুধুমাত্র লেখাপড়ার সময়ই ব্যবহার হয়। কারণ, কথা বলার সময় উনি অনিদাকে চশমার ওপর দিয়েই দেখছিলেন। ইনিও আংটির ব্যাপারে ভোলার থেকে খুব একটা বেশি কিছু জানেন না। তবে ভোলার মতো মুখ-ফসকা কিছু বললেন না। তাছাড়া কারও ওপর সন্দেহও নেই ওঁর
অনিদা যখন জিজ্ঞাসা করল, “আপনার কী মনে হয়, মিঃ বক্সী টাকার জন্য এই কাজ করেছেন?”
তাতে অনুতম মিত্র জানালেন, কে কী করেছেন তা উনি জানেন না। তবে সুব্রত বক্সী এমনটা করবেন বলে মনে হয় না। শেষ কথাটা বলার আগে বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন মিঃ মিত্র।
অনিদা আবার জিজ্ঞাসা করল, “আপনি টাকার অঙ্কটা জানতেন?”
তাতে উনি বললেন, “সেটা কী করে জানব? স্যার তো আমাদের সামনে কিছু বলেননি।”
অনিদা কিন্তু এগুলো জানত। তবু জানা জিনিসের ওপর ও কেন প্রশ্ন করছিল কে জানে? হয়তো কথা বের করার জন্য।
অর্ক রায় ওঁর চেয়ারে বসেছিলেন। আমরা এবার ওঁর ঘরে ঢুকতে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কী মিঃ সেন, কিছু পেলেন?”
তাতে অনিদা বলল, “শুধু দুটো ব্যাপারে আটকে যাচ্ছি।”
“কোন দুটো ব্যাপার?” নড়েচড়ে বসলেন অর্ক রায়।
“কখন, আর কীভাবে বলার পরই অনিদার চোখ আটকে গেল অর্ক রায়ের সামনের টেবিলটার ওপর। এবার টেবিল থেকে যে জিনিসটা ও হাত বাড়িয়ে নিল সেটা হল কোনও একটা দোকানের বিল।
“এটা?” বিলটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
তাতে অর্ক রায় বললেন, “ওটা একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বিল। সেদিন দোকানটায় ঢুকেছিলাম।”
“কোন দিন?”
“ওই তো, যেদিন নিলামি ছিল।” বললেন মিঃ রায়।
তাতে কেন জানি না উত্তেজিত হয়ে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “কখন?”
“অফিস থেকে একবার বেরিয়েছিলামবাড়ির জন্য কিছু জিনিস কেনার ছিল।”
“টাইমটা মনে আছে?”
“টাইম?” বলে কিছু ভাবলেন মিঃ রায়। তারপর বললেন, “ওই তো, সুব্রতকে যখন এসএমএস পাঠালাম। মানে প্রায় তখনই।”
“তখন তো দোকানে কাস্টমার ছিল
“হ্যাঁ, কিন্তু অনুতমের হাতে ওঁকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছিলাম। পরে সময় পেতাম না কেনাকাটি করার, তাই।”
“কতদূরে দোকান?”
“এই তো, গাড়িতেই গেছিলাম। মিনিট পাঁচেক লাগে।”
“মানে কাস্টমারকে মিঃ মিত্রর কাছে ছেড়ে দোকান থেকে বেরনো, গাড়িতে ওঠা, এইসব মিলে একটা কুড়ির মধ্যে দোকানে পৌঁছে গেছিলেন?”
“হ্যাঁ,” বলে আবার কিছু একটা ভেবে মিঃ বললেন, “হ্যাঁ, তাই হবে।”
“তারপর দোকানে ফিরে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কতক্ষণ ছিলেন?”
“এই ধরুন, আধঘণ্টা।”
অর্ক রায়ের উত্তর শুনে কী যেন চিন্তা করতে লাগল অনিদা। এবার ডান হাতটা থুঁতনিতে ঘষতে ঘষতে বলল, “কীভাবে?”
প্রশ্নটা ওর নিজেরই নিজেকে করা। তাই উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। ও এবার ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে খুব বিরক্ত হয়ে বলল, “কোথাও একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছি, মিঃ রায়!”
অর্ক রায় ওর দিকে চেয়ে ছিলেন। ও বলল, “আমার আরেকটু সময় চাই।”
তাতে ঘাড় কাত করে মিঃ রায় বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিন না। আপনি সময় নিন। অপরাধী ধরা পড়লেই হল।”
মিনিট দশেকের মধ্যেই অর্ক রায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা।

()

আজ সকালে অনিদার এক আত্মীয় এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে মহীশূর-ব্যাঙ্গালোর ট্যুরটা নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর কথা প্রসঙ্গে উঠল সেই রাস্তার ঘটনাটা। বোর্ড ঘুরিয়ে দেবার জন্য আমরা ব্যাঙ্গালোর না গিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছিলাম। আড্ডা আর মিনিট পাঁচ এগিয়েছে, এমন সময় তড়াক করে লাফিয়ে উঠল অনিদা।
“সর্বনাশ!”
কী হল? আমরা আচমকা ওর এমন আচরণে তখন অবাক।
অনিদা আমাদের কথা যেন কানেই নিল না। ঝট করে মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিল। তারপর অর্ক রায়কে ফোন করল। এবার যেটা ফোনে বলল, তা শুনে আমার উত্তেজনার পারদ নিজে থেকেই ওপর দিকে উঠতে শুরু করল
“হ্যাঁ মিঃ রায়, আজ বিকেলেই আমরা আপনার ওখানে যাচ্ছি। তৈরি থাকুন।”
এবার ফোন কেটে বলল, দুপুরে ও যেন কোথায় বেরোবে।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম নাটকে শেষ সিনের পর্দা পড়ার সময় হয়ে গেছে। তাই প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলাম যে ও কোথায় যাবে। তাতে ও আমায় চোখ পাকিয়ে বলল, “সময় হলেই জানতে পারবি।”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কারণ, জানি যে অপরাধী যেই হোক না কেন, সে আজ বিকেলেই ধরা পড়বে।

আমরা অর্ক রায়ের দোকানে বসেছিলাম। ভদ্রলোক উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন অনিদার দিকে। আমার মতো উনিও যে অপরাধীর পরিচয় জানার জন্য ছটফট করছিলেন, তা ওঁর পর পর দু’গ্লাস জল খাওয়া দেখেই বুঝতে পারলাম।
সুব্রত বক্সীরও একই অবস্থা। বুঝতে পারছিলাম, বেচারা ভীষণভাবে জানতে চাইছেন অপরাধীর পরিচয়। যার জন্য সেদিন ওঁরা আংটিটা খুইয়েছিলেন। অনুতম মিত্রর মুখ একেবারে ভাবলেশহীন। থেকে থেকে চোখ পিট পিট করছিলেন আর একবার করে অর্ক রায় আর অনিদার দিকে তাকাচ্ছিলেন। ভোলা মাহাতোর কুছ পরোয়া নেহি ভাবটা এই মুহূর্তেও বজায় ছিল। সেই প্রথম থেকেই লক্ষ করছিলাম যে ছেলেটা মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছে। একবার ওর মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ গেছিল। সেই অল্প সময়ের মধ্যে দেখলাম ও ফেসবুকটা বন্ধ করে হোয়াটস অ্যাপ খুলল। এরা ছাড়াও দোকানে ছিল অর্ক রায়ের ড্রাইভার রাজেশ লোকটাকে এই প্রথম দেখলাম। মাঝারি উচ্চতা। মিশকালো গায়ের রং। মোটা গোঁফ। দুই কানের ওপর একগুচ্ছ করে কালো চুল ছাড়া সারা মাথা জুড়ে টাক। কালো প্যান্টের ওপর চেক হাফ হাতা জামাটা ছেড়ে পরা। বুকের একটা বোতাম খোলা। লোকটার শূন্য চোখ দেখেই মনে হচ্ছিল যে এই আলোচনায় ওর থেকে কিছু আশা করাই অন্যায়।
সবার প্রথমে মুখ খুলল অনিদা। অর্ক রায়ের উদ্দেশে বলল, “আপনি দারুণ ঘোল খেয়েছেন, মিঃ রায়!”
তাতে অর্ক রায় বললেন, “কাজটা কে করেছে, মিঃ সেন?”
“কে করেছে সেটা না হয় পরে শুনবেন। কিন্তু তার আগে শুনুন কাজটা করা হল কীভাবে।” বলে অনিদা একবার ঘরে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে নিল। তারপর বলতে শুরু করল, “অপরাধ করার ধরনটা সত্যিই অভিনব আপনি এসএমএসটা পাঠিয়েছিলেন সুব্রত বক্সীকে অথচ ইনফরমেশন চলে গেল মলয় ঘোষালের কাছে কিন্তু কী করে? সুব্রত বক্সী কি খবরটা চালান করে দিলেন?”
অনিদার কথা শুনে সুব্রত বক্সী যে একটা ঢোঁক গিললেন তা আমার নজর এড়াল না অনিদাও সেটা লক্ষ করল তারপর আবার বলতে থাকল সাধারণভাবে সবাই ওঁকেই সন্দেহ করবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু অপরাধ করার হলে এত বোকার মতো সেটা উনি করতেন না তাছাড়া উনি যেমন মানুষ তাতে করে এত বছরের বিশ্বাস একদিনে উনি ভেঙে দিতেন না তাই প্রথমেই বলি, উনি এ-কাজ করেননি
অনিদার কথা মিঃ বক্সীকে যেন ধড়ে প্রাণ দিল
অনিদা আবার বলল, প্রথমটায় সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না যে এসএমএস অর্ক রায় সুব্রত বক্সীকে পাঠিয়েছিলেন সেই এসএমএস আমি দেখেছি সুব্রত বক্সীর মোবাইলে তাহলে খবরটা মলয় ঘোষালের কাছে পৌঁছল কী করে? কিন্তু প্রথম সন্দেহ হল যখন জানলাম অর্ক রায় মেসেজটা পাঠিয়েছিলেন দুপুর একটায় অথচ মিঃ বক্সী সেটা পান একটা বেজে পঁচিশ মিনিটে! এই দেরিটা হল কেন? মেসেজটা এই পঁচিশ মিনিট ধরে কী করছিল? এটা কি সার্ভারের সমস্যা? তাই যদি হয় তবে তা মেনে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু না হলে? অন্যকিছু? আর অন্যকিছু হলে সেটা কী? কোথায় ঘুরছিল মেসেজটা? কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এমন সময় একটা ঘটনা আমার চোখ খুলে দিল দিন কয়েক আগে মহীশূর থেকে ব্যাঙ্গালোর যাবার সময় আমরা ভুল পথে চলে গেছিলাম লোকাল কিছু ছেলে বোর্ডের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল কথাটা মনে পড়তে ভাবলাম, এখানেও এমন কিছু করা হয়নি তো? যদি তাই হয়, তাহলে বলতে হয়, অর্ক রায় মেসেজ পাঠিয়েছিলেন সুব্রত বক্সীকে আর সেটা চলে গেছিল মলয় ঘোষালের কাছে
কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব?” অনিদার কথার ফাঁকে একটা সুযোগ পেয়ে প্রশ্ন করলাম আমি বললাম, “তুমি তো নিজের চোখে দেখেছ যে সুব্রত বক্সী মেসেজটা পেয়েছিলেন
অনিদা তখন হেসে বলল, “আমি কখনওই বলিনি যে উনি মেসেজটা পাননি কিন্তু তাঁর আগে ট্রেন একটা অন্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল
মানে?” প্রশ্ন করার ধরন দেখেই বুঝলাম অর্ক রায় ঘোর অন্ধকারে
মানে আর কিছুই নয়, মিঃ রায় অপরাধী একটা দুর্দান্ত চাল চেলেছিল আপনার অলক্ষ্যে সে আপনার মোবাইলে সুব্রত বক্সীর নম্বরের জায়গায় মলয় ঘোষালের নম্বরটা সেভ করে দিয়েছিল তাই আপনি সুব্রত বক্সীকে মেসেজ পাঠাচ্ছেন ভেবে সেটা মলয় ঘোষালকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন! একেবারেই আপনার অজান্তে কারণ অন্য নম্বর হলেও নাম তো একই ছিল, তাই না মিঃ রায়? আর সত্যি কথা বলতে কী, কার নম্বর কে মনে রাখে বলুন তো? তাই দেখেও আপনি বুঝতে পারেননি যে গোপন তথ্যটা আপনি কাকে পাঠাচ্ছেন কারণ ফোন করা বা মেসেজ পাঠানোর সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা শুধু নামটাই দেখি নম্বরটা নয় ফোন নম্বর যে বদলে যাবে সেটা কী করে বুঝবেন, বলুন তো?”
ঘরে সবাই থম মেরে ছিল বুঝতে পারছিলাম, অপরাধটা কী করে হয়েছিল জানার থেকেও সবাই জানতে চাইছে সেটা করেছে কে?
অনিদা আবার কথা শুরু করল, এবার কাজ হয়ে গেলে পর আবার আপনার অলক্ষ্যে সে মোবাইলের সেন্ট অপশনে গিয়ে আসল মেসেজটা সুব্রত বক্সীকে ফরোয়ার্ড করে দিল একটা পঁচিশে আর শেষে সুব্রত বক্সীর নামে মলয় ঘোষালের নম্বরটা মুছে আবার সুব্রত বক্সীর নম্বরটা আগের মতো সেভ করে দিল আর মলয় ঘোষালকে পাঠানো আপনার মেসেজটা ডিলিট করে দিল ব্যস, এভাবেই সে কাজ হাসিল করে নিল আর পুরস্কারস্বরূপ মলয় ঘোষালের থেকে পেল মোটা টাকা
“কী সর্বনাশ! আমি মেসেজ পাঠালাম একটায় আর সুব্রত সেটা পেল একটা পঁচিশে?” অনিদার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন মিঃ রায় ঘরের সবাই ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল অনিদার দিকে এমনকি এবার ভোলাও
“সুব্রত বক্সীর নম্বর মুছে মলয় ঘোষালের নম্বর লেখার সময় অপরাধীকে যতটা রিস্ক নিতে হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি রিস্ক ছিল সুব্রত বক্সীর নম্বরে মিঃ রায়ের মোবাইল থেকে ওই মেসেজটা ফরোয়ার্ড করে তারপর সুব্রত বক্সীর নম্বরটা আবার জায়গামতো ফিরিয়ে দেওয়া এই কাজটা তাকে করতে হয়েছিল খুব সাবধানে এবং ভীষণ অল্প সময়ের মধ্যে আর এইসব কারণেই অর্ক রায়ের পাঠানো থেকে শুরু করে সুব্রত বক্সীর সেটা পাওয়ার মধ্যে পঁচিশ মিনিট সময় লেগে গেছিল
কিন্তু এগুলো করল কে? দোকানে তো তখন সবাই ছিল!” অবাক হয়ে বললেন মিঃ রায়
অনিদা তখন বলল, “মনে করে দেখুন, মিঃ রায় সেদিন মিঃ বক্সীকে মেসেজটা পাঠানোর পর আপনি ঠিক কী কী করেছিলেন সেই সময় আপনার দোকানে একজন খরিদ্দার এসেছিলেন আপনি তাকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন আর সেই সময়েই কাজ সেরেছিল অপরাধী
তাতে আবার অবাক হয়ে মিঃ রায় বললেন, “তাহলে তো বলতে হয়, সেই সময়ে দোকানে যারা ছিল, তাদের মধ্যেই কেউ একজন এ-কাজ করেছে! মানে ভোলা বা অনুতমের মধ্যে কেউ একজন?”
কী বলছেন, স্যার?” মিঃ রায়ের কথা শুনে এবার ক্ষেপে গেল ভোলা বলল, “আপনি আমাকে এতদিন দেখছেন একটা টাকাও আপনাকে না বলে নিয়েছি?”
পাশ থেকে অনুতম মিত্রও প্রতিবাদ করে উঠলেন, আমাদের আপনি এভাবে সন্দেহ করছেন কেন, স্যার?”
অনিদা একদৃষ্টে মিঃ রায়ের দিকে চেয়ে ছিল এবার বলল, “আপনি আপনার ড্রাইভার রাজেশের কথা ভুলে যাচ্ছেন, মিঃ রায়
রাজেশ!” ওর কথা যে মাথায় নেই তা ওঁর কথা শুনেই বুঝলাম
হ্যাঁ, মিঃ রায়,” একবার রাজেশের দিকে চেয়ে নিয়ে অনিদা বলল, “মনে করে দেখুন, সেই সময় আপনার ড্রাইভার আপনার কাছে এসেছিল টিফিন বক্স নিয়ে আপনাকে খাবার দিতে ওকে সেই সময় আপনারা কেউ খেয়ালই করেননি আর সুযোগ বুঝে ও সেদিন এই কাজটা করে
অনিদার কথা শুনেশ’-এর দোষ নিয়ে এবার প্রতিবাদ করে উঠল রাজেশ কী মশাই, কেন বেফালতু বকছেন? এসব আমি আবার কখন করলাম?”
অনিদা তখন হেসে বলল, “কখন করেছ তা তো তুমি ভালোমতোই জানো আর মলয় ঘোষাল কী বলেছেন জানো? উনি বলেছেন, তোমার মতো মানুষের শাস্তি হওয়া উচিত কারণ, নিজের অন্নদাতার সঙ্গে যে বেইমানি করে সে সবার সঙ্গেই বেইমানি করতে পারে
এতে দমে গেল রাজেশ বোঝা গেল মলয় ঘোষালের ব্যাপারটা ও আশা করেনি সে যে ওর নামে অনিদাকে বলে দেবে সেটাও ওর চিন্তার বাইরে ছিল এতক্ষণে বুঝলাম, দুপুরে অনিদা কোথায় গেছিল মলয় ঘোষালের সঙ্গে দেখা করতে
অর্ক রায় এর মধ্যে পুলিশে খবর করেছেন আশ্চর্যের ব্যাপার, রাজেশ কিন্তু পালানোর চেষ্টা করল না অথচ ও দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে দরজার সামনে ওর মাথা নিচু করে দাঁড়ানো দেখে মনে হল ও মনে মনে নিজেকেই দোষ দিচ্ছে
অর্ক রায় এবার অনিদার দিকে এগিয়ে এসে ডান হাতটা এগিয়ে দিতে অনিদাও ওর ডান হাতটা এগিয়ে দিল মিঃ রায় এবার বললেন, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিঃ সেন কিন্তু একটা কথা বলুন, ও সুব্রতর নম্বরটা মলয় ঘোষালের নম্বরের জায়গায় বসাল কখন? আর মেসেজটা সুব্রতকে পাঠালই বা কখন?”
তাতে অনিদা হেসে বলল, “সেদিন যখন আপনি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকেছিলেন, তখন অভ্যাসবশত আপনি সেদিনও ফোনের সেটটা গাড়িতে রেখে গেছিলেন কারণ, অত বড়ো মোবাইল হাতে নিয়ে চলাফেরা করতে অসুবিধে হয় আপনার আর সেই সুযোগেই কাজ সারে রাজেশ
অনিদা কেসগুলোতে এখন বেশ মোটা টাকা নেয় সেইমতো পুরো টাকাটাই ওকে অনলাইনে পেমেন্ট করে দিলেন অর্ক রায়
অর্ক রায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম এক, দুইয়ের পর গিয়ার তিনে ফেলে অনিদা বলল, “ক্যামন যেন চোরের ওপর বাটপাড়ি গোছের ব্যাপার
ওর কথা বুঝতে না পেরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “মানে?”
তাতে অনিদা বলল, “দেখ, অর্ক রায়ও কিন্তু কম অন্যায় করেননি কারণ, উনিও তো মলয় ঘোষাল সমেত বাকি তিনজনের গোপন তথ্য বের করে এনেছিলেন তা না হলে উনি জানবেন কী করে যে কে কত টাকা আংটিটার জন্য দিচ্ছেন কিন্তু শেষে মলয় ঘোষাল ওঁর ওপর দিয়ে চালটা চাললেন
আমি তখন হেসে উঠে বললাম, “ঠিক বলেছ, একেবারে ওভার ট্রাম্প!”
তাতে অনিদাও হেসে বলল, “দারুণ বলেছিস তো! গল্পটার নাম দিয়ে দিস
_____
অলঙ্করণঃ শ্রীময় দাশ

1 comment:

  1. সত্যজিৎ দাসগুপ্ত না হয়ে সত্যজিৎ রায়ের গল্প বলেও চালানো যায়, স্টাইলটা এতটাই এক। পড়তে ভালই লাগে কিন্তু নিজস্ব স্টাইল না তৈরি হলে দু তিনটে গল্পের পরে আর ভালো লাগবে না

    ReplyDelete