ত্রয়ীর অভিযান
পল্লব বসু
।। ১।।
বলাকার মামা মারা যাবার পর থেকেই তাঁর অফিস-কাম-বাগানবাড়িটা ফাঁকাই পড়েছিল।
বিকেলের দিকে সেখানেই আড্ডা বসত অতনু, জয়ন্ত আর বলাকার। অতনু আর জয়ন্ত বরানগর
রামকৃষ্ণ মিশনের ক্লাস এইটের ছাত্র আর বলাকা রাজকুমারী হাই স্কুলের। কিন্তু সেটাই
তাদের একমাত্র পরিচয় নয়। এলাকায় তারা পরিচিত ‘ত্রয়ী’ বলে। সেটা কিন্তু শুধু তারা
তিনজনে গলায় গলায় বন্ধু, আর সর্বদা এক সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় বলেই নয়। পাড়ার গয়নার দোকানে প্রায় বাইশ
লক্ষ টাকার চুরির কিনারা করতে পুলিশ যখন হিমসিম খাচ্ছিল, সে সময় সামান্য কয়েকটা সূত্রের
সুতো ধরে ওরা তিনজন পুরো চোরেদের গ্যাংটাকেই ধরিয়ে দেয়। এসব ব্যাপারে অতনুর
বুদ্ধিই খোলে বেশি, আর তাই ওই ওদের টিমের অলিখিত লিডার। এরপর থেকেই ওরা পাড়ায়
ত্রয়ী বলে বিখ্যাত হয়ে যায়। ওরা মিলিতভাবে আরও বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করেছে
এরপরে। আর তখন থেকেই পাকাপাকিভাবে একটা আস্তানা-কাম-অফিসঘর বানানোর পরিকল্পনা
চলছিল। অবশেষে আজ রোববার, এক্কেবারে নারকেল ফাটিয়ে পুজো দিয়ে উদ্বোধন হল ওদের অফিস
বলাকার মামার বাগানবাড়িতে। গেটের উপরে ‘ত্রয়ী’ লেখা বড়ো বোর্ডটাও আজই লাগিয়ে দিয়ে গেছে। পাড়ার সব
সমবয়সী আর ছোটো বন্ধুদের নিয়ে ছোটোখাটো একটা খাওয়াদাওয়ারও আয়োজন হয়েছে,
মাটন-বিরিয়ানি আর সঙ্গে চিকেন ভর্তা।
খাওয়ার শেষে এখন বাগানে বসে চলছে জম্পেশ আড্ডা সবাই মিলে। জমায়েতে আজ
অনুপস্থিত বলাকার প্রিয় বন্ধু ভাস্বতী। ভাস্বতী আর তার খুড়তুতো ভাই গেছে বর্ধমানে
ভাস্বতীর মাসির বাড়ি। আজই তাদের ফেরার কথা। বলাকার তাই মনটা একটু খারাপ। মাঝে মাঝে সবার মাঝেই
একটু আনমনা হয়ে পড়ছিলও তাই। ছোটো ছেলেমেয়েগুলো পেস্ট্রির ক্রিমগুলো এর ওর মুখে
মাখিয়ে দুষ্টুমি করছে, আর ওরা সবাই মিলে অন্তমিল খেলায় মেতেছে।
বলাকা বেশ কয়েকবার ফোনে ট্রাই করল ভাস্বতীকে। কিন্তু কেবলই বলছে, নট রিচেবল।
এরকমটা কোনওদিন হয় না। দু’জনের একজনও দূরে থাকলে মাঝেমধ্যেই ফোনে কথা হয়। আজ যে কী
হল, বোঝাই যাচ্ছে না।
একে একে সবাই চলে গেল। ধীরে ধীরে সন্ধের উদাস অন্ধকার নেমে এসেছে বাগানে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন
আসে বলাকার।
“হ্যালো?”
“হ্যালো, আমি ভাস্কর বলছি, দিদি। সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
“কী হয়েছে?” অজানা আশঙ্কায় বলাকা কেঁপে ওঠে।
“সোনাদি (ভাস্বতীর ডাক নাম) কিডন্যাপ হয়েছে!”
“কী, বলছিস কী?”
“হ্যাঁ দিদি, আমার সামনে। আমরা দু’জনে দুটো সাইকেলে গোলাপবাগের কাছে দিদির
এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকাই ছিল দুপুরবেলা। একটা মারুতি ওমনি আমাদের পথ আগলে
দাঁড়ায়। কালো মুখোশ পরা দু’জন লোক নেমে আসে। একজন দিদির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জোর
করে গাড়িতে তোলে। দ্বিতীয়জন আমায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। গাড়ি ততক্ষণে চলতে
শুরু করে দিয়েছে। দ্বিতীয় লোকটিও লাফিয়ে চলন্ত গাড়িতে উঠে যায়। আমি কিছুই করতে পারলাম না
দিদি।” ভাস্কর ফোনের ওপাশে ফোঁপাতে থাকে।
বলাকার হাত থেকে মোবাইলটা ছিটকে পড়ে বাগানের ঘাসের উপরে।
।। ২।।
“জে এইচ ২৪ ডবলু ২৭২৭ - এই গাড়ির নাম্বারটা ফলস, দাদা। পুলিশ অলরেডি খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে। আমরা বর্ধমানে ছোটোবেলায়
অনেকদিন ছিলাম। জেঠুর ছেলেবেলার বন্ধুর ছেলে ছোটো নীলপুরে একটা জিম খুলেছে। কাল
ছিল তার উদ্বোধন। আমি আর সোনাদি সেখানেই গেছিলাম। ওখান থেকে বেরিয়ে যখন গোলাপবাগের
দিকে যাচ্ছি, আমার মনে হয়েছিল, ওমনিটা আমাদের জিমের ওখান থেকেই বেশ খানিকটা সময়
ধরে ফলো করছে।
কিন্তু গ্রাহ্য করিনি। আর খানিক পরে ওমনিটাকে আর দেখতেও পাইনি। তবে নাম্বারটা মনে রয়ে গেছিল,”
অতনুর প্রশ্নের জবাব দেয় ভাস্কর, “সোনাদিকে লোকটা যখন টেনে গাড়িতে তুলছিল, দিদি
লোকটার জামা খামচে ধরেছিল। মনে হয় তখন লোকটার পকেট-টকেট ছিঁড়ে গেছিল। মাটিতে পড়ে যেতে যেতে দেখলাম,
একটা কাগজ উড়তে উড়তে রাস্তায় পড়ছে। আমি ওটা তোমাদের দেব বলে পুলিশের কাছে চেপে
গেছি।”
ভাস্কর কাগজটা এগিয়ে দেয়। অতনু কাগজটা হাতে নিয়ে ভালো করে উলটেপালটে দেখে। তারপর
বলাকার দিকে এগিয়ে দেয়। জয়ন্ত পাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে দেখে। পেট্রোল পাম্পের প্রিন্টেড
বিল। গতকাল রাত এগারোটা পনেরোতে ডিজেল ভরা হয়েছে হাজার টাকার। কাগজটার পিছনে লেখা
আছে, ১০০/১০ এফ।
“ভাস্কর, এটা কী জান?”
“না, অতনুদা, বুঝতে পারছি না।”
“আমি তো কোনও কিছুর কোনও লিঙ্ক খুঁজে পাচ্ছি না। কীভাবে এগোবি ভাবছিস,
অতনু?” বলাকা জানতে চায়।
“ভাস্কর, একটু ভেবে বল তো ভাই। তোরা যখন জিম থেকে বেরিয়ে গোলাপবাগের দিকে যাচ্ছিস, ঠিক কোন জায়গা থেকে
ওমনিটাকে মিস করেছিলি?”
“এটা অসম্ভব বলা। তবে জান অতনুদা, কার্জন গেটের আধা কিমির মতো আগে সাইকেলের
চেন পড়ে যায়। আমি নেমে যখন চেন ঠিক করছি, গাড়িটা আর দেখতে পাইনি। তার একটু আগেও
খেয়াল করেছিলাম। আর একটা কথা এইমাত্র মনে পড়লো দাদা, ওমনির সামনে বাঁদিকটা
বিচ্ছিরিভাবে তোবড়ানো ছিল।”
“তার মানে গাড়িটা তোদের ফলো করছিল ভাস্বতীকে অপহরণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু মাঝে
এমন কিছু একটা ঘটেছিল, যাতে ওরা আর তোদের ফলো করতে পারেনি। কিন্তু ওরা জানত তোরা
কোথায় যাচ্ছিস। তাই
ফেরার পথে কিডন্যাপ করে। তোরা যে গোলাপবাগে ভাস্বতীর বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিস, এই
কথাটা কে কে জানত?”
“আসলে জিমে রণজিৎদা উপস্থিত সবার জন্য লাঞ্চের আয়োজন করেছিল। কিন্তু
চুমকিদির বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার কথা থাকায় আমরা সেটা জানিয়ে জিম থেকে বেরিয়ে আসি।
জিমে সে সময় উপস্থিত প্রায় সবাই তাই জানে, আমরা চুমকিদির বাড়ি যাচ্ছিলাম।”
।। ৩।।
ছোটো নীলপুরে বেশ বড়ো জিম-কাম-মেডিটেশান সেন্টার ‘স্বাস্থ্য মন্দির’। রণজিতের বহুদিনের স্বপ্ন ছিল এই
সেন্টারটা খোলা। আজ সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। জিমের পাশেই ওর বাড়ি। সকালে যারা জিম করতে এসেছেন,
তাঁদের ও বডি ওয়েট আর প্রয়োজন অনুযায়ী জিমের কোন যন্ত্র তাঁরা ব্যবহার করবেন সেটা
দেখিয়ে দিচ্ছিল। ভাস্কর আর সঙ্গে অতনুদের দেখে ইশারায় জিমের পাশে কাঁচে ঘেরা ওর
সুসজ্জিত অফিস ঘরে গিয়ে বসতে বলে রণজিৎ।
“বল ভাস্কর, দিদির কোনও খবর পেলি? পুলিশ কতদূর এগোল? আমি কাল সন্ধেবেলাতেই
খবরটা জেনেছি। কী কান্ড বল তো?”
“আচ্ছা রণজিৎদা, তুমি কিছু আন্দাজ করতে পার? তুমি তো দিদিকে ছোট্টবেলা থেকে
জান।”
“আসলে ও বাবা-মার সঙ্গে কলকাতায় চলে গেল, তারপর থেকে ফোনে আর ফেসবুকেই যা
মাঝেমধ্যে যোগাযোগ ছিল। মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এসেছে নিশ্চয়ই?”
“না, এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই আসেনি। জেঠু-জেঠিমারা এসেছেন বর্ধমানে। ওঁদের
কান্নাকাটি আর আমি দেখতে পারছি না।”
“সেদিন এখান থেকেই একটা ওমনি ওদের ফলো করছিল। আপনি জিমের বাইরে কোনও ওমনি গাড়ি খেয়াল করেছিলেন?”
অতনু জানতে চায়।
“তুমি কি ভাস্বতীর বন্ধু? আমি আসলে ইনঅগরেশান নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম, খেয়াল
করিনি।”
“হ্যাঁ, ওরা তিনজন দিদির বন্ধু।”
“আপনার কি প্যাথোলজি ল্যাব আছে?” টেবিলের উপরে রাখা কিছু কাগজ দেখে অতনু বলে
ওঠে।
“আমার একার নয়। এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে।”
“বেশ দাদা, দরকার হলে আপনার সঙ্গে আবার কথা বলব। আপনার ফোন নাম্বারটা একটু লিখে দিন।” অতনু অনুরোধ করে।
।। ৪।।
বলাকার স্করপিও চড়েই ওরা বর্ধমান এসেছে। জিম থেকে বেরিয়ে গাড়িতে যেতে যেতে বলাকা
শুধোল, “অতনু, এবার প্ল্যান কী? কোথায় যাবি?”
“দেখ, ফলো করতে করতে মারুতিটা হারিয়ে গেল। এটা সম্ভব যদি হঠাৎ করে গাড়ি খারাপ হয়ে যায় বা টিউব
লিক করে। সেক্ষেত্রে কার্জন গেটের কিছু আগে কোনও গ্যারেজে গাড়িটা সারাতে নিয়ে
যাওয়া উচিত। আর
আমার থিওরি বলে, যেথায় দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।
হারুদা, আমরা কার্জন গেটের থেকে কিলোমিটার দুই দূরে। তুমি একটু আস্তে চালাও গাড়ি। রাস্তার পাশে কোনও গ্যারেজ
দেখলে থামতে হবে। আরে আরে, ঐ যে, হারুদা হল্ট!”
চোদ্দো-পনেরো বছরের একটা ছেলে একটা মারুতি-৮০০-এর সার্ভিস করছিল। ওদের স্করপিওটা এসে দাঁড়াতেই
এগিয়ে এল। অতনু একটা একশো টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “ভাই, আমার একটা খবর
লাগবে। একটু আলাদা কথা বলা যাবে?”
টাকাটা পেয়ে ছেলেটার মুখে খুশির আবেশ। বাড়িতে বাবার টিবি রোগ। ওষুধপথ্যি
স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে দেয়। কিন্তু ডাক্তার বলেছে, ভালো খাবার না জোটালে এ রোগ পিছু ছাড়বে না। আজ কার
মুখ যে সকালে দেখেছিল!
“আসুন আসুন, বাবুরা। দিদি, ওই বেঞ্চিতে বসুন।”
ওরা তিনজনে গিয়ে বেঞ্চে বসল।
“আমার নাম ভজা। একটু চা আনি?”
বলাকা ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, “না রে ভজা, আমাদের একটু তাড়া আছে। বল তো
ভাই একটু মনে করে, কাল দুপুর দেড়টা নাগাদ একটা ওমনি গাড়ি, সামনে বাঁদিকটা তোবড়ানো,
তোর এখানে সার্ভিস করাতে এসেছিল?”
“আমার মনে আছে, দিদি। দুপুরের দিকটা একটু ফাঁকাই যায়। আমি বেঞ্চিতে একটু
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে মুকুল কাজ করে, ওর জ্বর। ক’দিন আসছে না, গ্যারেজের
কাজ তাই একাই সামলাচ্ছি। হঠাৎ একটা লোক আমায় ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। ধড়মড় করে উঠে
পড়ি। আমায় ওদের ওমনিটা দেখায়। মোট তিনটে লোক ছিল। খুব তাড়ায় ছিল ওরা। বাকি একটা
লোক হাত কচলাচ্ছিল আর পায়চারি করছিল। অন্যজন ফোনে কার সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথাও বলছিল। গাড়িটার ডানদিকের পিছনের
টায়ার লিক ছিল। আমি জানতে চাই লিক সারাব কি না। বলল, সময় নেই। স্টেপনিটা লাগিয়ে
ছেড়ে দিতে। গাড়িটার সামনেটা তোবড়ানো। আমি ওটা সারাব কি না জানতে চাইলে বেমক্কা
আমায় থাপ্পড় মারল। বলল,
যেটা বলছি সেটা কর, বুঝেছিস!”
জয়ন্তর হাতে তখন সাদা খাতা আর পেন্সিল চলে এসেছে। যে কোনও বর্ণনা শুনে নিখুঁত
ছবি আঁকার ক্ষমতা আছে ওর। সে বলে, “ভাই ভজা, এক এক করে লোকগুলোর চেহারাগুলো আমায়
বল তো।”
“ও, তুমি বুঝি খুব ভালো আঁকো! জান, আমি খুব ভালো আঁকতে পারি। কিন্তু
কারখানায় বাবার মেশিনে হাত কাটা গেল, কাজ থেকে ছাঁটাই করে দিল। এখন তো ভালো খেতে না পেয়ে পেয়ে
বাবার টিবি ধরে গেছে। মা তো আমার জন্মের সময়েই মরে গেছে। তবু জান, সময় পেলে আমি
গ্যারেজে বসে বসে আঁকি। ওমা, তোমাদের চোখে জল কেন? এই ফালতু ছেলেটার জন্য বুঝি তোমরা কাঁদছ?”
বলাকা ভজাকে কোলের কাছে টেনে নেয়। ভজার চোখের জল মুছিয়ে দেয়। ও ভুলেই যায়
গাড়ির কালিঝুলিতে ওর শালোয়ার-কামিজ নোংরা হয়ে যাচ্ছে। ভজাই লজ্জায় নিজেকে ছাড়িয়ে
নিয়ে বলে, “কী করছ, দিদি! তোমার জামা নোংরা হয়ে গেল যে। তোমরা চলে গেলে আমার যে মনখারাপ
লাগবে গো...”
“জামাকাপড় নোংরা হলে কেচে নেওয়া যাবে। কিন্তু আমার সামনে একটা ছোটোভাই
কাঁদলে আমি চুপ থাকি কী করে?” বলাকা ভেজা গলায় বলে ওঠে।
ভজা জয়ন্তর হাত থেকে খাতা-পেন্সিল টেনে নেয়। তারপর মাটিতেই বসে পড়ে পেন্সিলের
আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলতে থাকে অবয়ব। প্রায় আধাঘণ্টা লাগে তিনটে মুখ ফুটিয়ে তুলতে। ভজার
আঁকা দেখে ওরা অবাক হয়ে যায়। এমন এক প্রতিভা গ্যারেজে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
ওরা যখন বেরিয়ে আসছে গ্যারেজ থেকে ভজা টাকাটা অতনুর হাতে গুঁজে দেয়। এই দাদাদিদিদের
কাছ থেকে ও টাকা নিতে পারবে না!
।। ৫।।
“কাকু, দেখুন তো এই তিনজনের কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কি না?” ভাস্কর ছবি
তিনটে এগিয়ে দেয়।
থানার আই সি সজীব ঘোষ তিনটে ছবি টেবিলে ফেলে দেখতে লাগলেন। “খুব চেনা লাগছে। এ ছবি কে আঁকল? তোমার দিদির
কিডন্যাপের সাথে এদের কোনও যোগ আছে?”
ভাস্কর উত্তর করে, “আমার দিদিকে যারা ওমনিতে করে তুলে নিয়ে গেছে, এ তাদেরই
ছবি।”
“বল কী? তারা তো মুখোশ পরে ছিল। তাদের মুখ আঁকলে কী করে!”
অতনু সমস্ত ঘটনা একে একে খুলে বলে। সজীববাবু উঠে দাঁড়িয়ে অতনুর পিঠ চাপড়ে
দেন। বেল বাজাতেই একজন কনস্টেবল ওঁর চেম্বারে এল।
“শোন অনিল, কম্পিউটারে ক্রিমিনাল রেকর্ড চেক করে দেখ এই তিনটে ছবি কারও
সঙ্গে মেলে কি না। অন্যান্য থানায় ছবি তিনটে ফ্যাক্স করে দাও। কোথাও থেকে কোনওরকম
ফিডব্যাক পেলেই আমায় তৎক্ষণাৎ জানাবে।
“তোমরা কোনও চিন্তা কোরো না। এদের কারও নামে যদি কোনও পাস্ট পুলিশ রেকর্ড
থাকে, আমরা ঠিক ওদের ট্র্যাক করে ফেলব। একটি মুখ আমার খুব চেনা লাগছে। আমার মনে হচ্ছে ওদের রেকর্ড খুব তাড়াতাড়ি
পাওয়া যাবে।”
।। ৬।।
‘নির্ণয়’-এর রিসেপশনে এসে অতনু ডাক্তারের একটা প্রেসক্রিপশন জমা দিল। বেশ কিছু রক্তপরীক্ষা আর
ইউরিনের পরীক্ষা। রিসেপশনের দিদিটা একটা প্ল্যাস্টিকের পট এগিয়ে দিল। জয়ন্ত, ভাস্কর আর বলাকাকে বসিয়ে
অতনু গেল টয়লেটে। দরজা বন্ধ করেই জানালার কাছে এল। ওর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, নতুন মডেলের এই জানালাগুলোয় কোনও গরাদ
থাকে না।
বাইরে সরু একটা বাগান, তারপরে একটা পাঁচিল। কেউ নেই এদিকে। অতনু ধীরে ধীরে
মাথা একটু উঁচু করে একে একে পরপর জানালাগুলো দিয়ে ভিতরে দেখতে দেখতে এগোতে থাকে। কোনও
ঘরে ব্লাড টানা হচ্ছে, কোনওটা আবার অফিস। এরপরেই দেয়াল শেষে বাঁক নিয়ে প্রথম ঘর। এই
জানালাটা বন্ধ, আর গরাদও আছে। গরাদের উপর দিয়ে জানালার দুই পাল্লার ফাঁক বরাবর চোখ
রেখে অতনু ভিতরটা দেখার চেষ্টা করতে থাকে।
অতনু ফিরে আসে। টয়লেট থেকে কতগুলো ঘর পরেই ওই ঘরটা, তার একটা হিসেব অতনু করে
নিয়েছে। বলাকা, জয়ন্ত আর ভাস্করকে নিয়ে টয়লেট ছাড়িয়ে ও এগিয়ে যায়। বারান্দার একটা বাঁক পেরিয়ে ওই
ঘরটার সামনে আসে ওরা। এদিকে খুব নির্জন। কাছাকাছি কেউ নেই। একটা সিঁড়ি উঠে গেছে
ছাদের দিকে। ছাদের দরজা দিয়ে আলো এসে পড়েছে। সিঁড়ির সামনে, নিচে পরিত্যক্ত প্যাকিং
বাক্স, রি-এজেন্টের বোতল, গ্লাভসের খালি প্যাকেট এসব জমানো আছে। সিঁড়ির পাশে বাইরে
বেরোনোর একটা দরজা আছে। মেঝেতে ধুলো পড়ে গেছে। তবে তার উপরে বেশ কিছু টাটকা পায়ের
ছাপ। মাস্টার কী দিয়ে তালা খুলে ফেলে অতনু।
ভাস্বতীর বাবা আর মা একবার ভাস্বতীকে, একবার অতনুদের তিনজনকে জড়িয়ে শুধু
কেঁদেই যাচ্ছেন। ভাস্বতীর মাসি-মেসোর চোখেও আনন্দাশ্রু। ওর মা খালি ওর থুতনি ধরে
চুমো খাচ্ছেন আর বলছেন, “দু’দিনেই কী রোগা হয়ে গেছিস মা! ভালো করে শয়তানগুলো তোকে
খেতেও দেয়নি, না?”
ওরা সবাই হেসে ওঠে। এই হচ্ছে ইউনিভার্সাল মা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাও, একইরকম।
পুলিশকাকু থেকে বাড়ির সক্কলে ত্রয়ীকে ঘিরে বসেছে সোফায়। মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার
সামান্য বেশি সময়ের মধ্যে কেমন করে ত্রয়ী খুঁজে বার করল হারানো ভাস্বতীকে, তাই এখন
সবার কৌতূহল।
অতনু বলতে শুরু করে, “ভাস্করের সাহায্য ছাড়া এত সহজে আমাদের পক্ষে এই রহস্য
সমাধান করা সম্ভব হত না। ও যে কাগজটা কুড়িয়ে পেয়েছিল সেটা আমাদের বিশেষ সাহায্য
করেছে। ওতে দেখলাম একহাজার টাকার ডিজেল নেবার হিসেব আছে। ওমনির ডিজেল মডেল আমার
জানা নেই। তার মানে ওই বিলটা তার, যে ওই ভাড়াটে গুণ্ডাদের টাকা দিয়েছিল কাজটা করার
জন্য। আর কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওই পাম্পের বিলটার পিছনেই লিখে ওদের দিয়েছিল। হতে পারে সেসময় ওই লোকটি নিজের
ডিজেল গাড়িতে বসে ছিল, আর হাতের কাছে কাগজ বলতে ওই বিলটাই লেখার মতো ছিল। ওই
লেখাটাতে একটা অদ্ভুত জিনিস ছিল। শূন্যের পেটগুলো আড়াআড়ি কাটা। এটা লোকটির বদ
অভ্যাস। যেমন কেউ কেউ সেভেনের পেট কাটে, তেমন আর কী। কিন্তু লেখাটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
“আমার মনে হয়েছিল, যখন মারুতিটা ওদের জিম থেকে ফলো করছিল তখন খোঁজখবর ওখান
থেকেই শুরু করা যাক। সেইমতো আমি প্রথমেই রণজিৎদাকে জেরা করা শুরু করি। এইসময়েই ওর
টেবিলে কিছু লেটার-হেড চোখে পড়ে, যেগুলো একটা প্যাথোলজি ল্যাবের। আর ল্যাবের নামের
তলায় দেখি ল্যাবের ঠিকানা, ১০০/১০ এফ, নীলগঞ্জ রোড, বর্ধমান। বিদ্যুৎ চমকের মতো সেই
বিলের লেখাটার মানে বুঝতে পারি। রণজিৎদাকে তার মোবাইল নাম্বারটা লিখে দিতে বলি,
৮০৪৪০০২৭০০। প্রত্যেক শূন্যের পেট কাটা ছিল।
“মাসির পরিচিত এক ডাক্তারের কাছ থেকে একটা ফলস প্রেসক্রিপশন করিয়ে নিই। মাসির কাছে জানতে পারি রণজিতের
ইতিহাস। রণজিৎদার বাবা বিকাশবাবু, অমলকাকুর (ভাস্বতীর বাবা) ব্যাবসার ম্যানেজার ছিলেন। কাকু ওঁকে খুব বিশ্বাস করতেন।
কিন্তু কয়েক লাখ টাকার হিসাবে গণ্ডগোল করেন। কাকু ওঁকে ব্যাবসা থেকে বহিষ্কার
করেন। তারপর কাকু ব্যাবসা বর্ধমান থেকে গুটিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসেন। পরে বিকাশকাকুর
ছেলে কলকাতায় কাকুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, ভাস্বতীর সঙ্গেও আলাপ করেছিল। কাকু পুরনো
কথা ভুলে রণজিৎদাকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। বাবার অন্যায়ের জন্য তাঁর বন্ধুর ছেলেকে
কেন দূরে সরাবেন! ভুল মানুষ মাত্রেই করে। কিন্তু বুঝতে পারেননি, বাবার প্রতিশোধের
আগুন তুষের মতো নিজের বুকে জ্বালিয়ে রেখে পরিকল্পনা করেই ওদের সঙ্গে পুনরায় আলাপ
জমাচ্ছে রণজিৎ। আর সেই প্রতিশোধেরই ফল এই কিডন্যাপ। আর তাই মুক্তিপণ চায়নি ও। আসলে
ভাস্বতীদিকে দেশের বাইরে সরিয়ে দেবার খারাপ পরিকল্পনা ছিল ওর। কিন্তু সেটা আর হল
না। ওর ভাড়াটে গুণ্ডারাও সজীবকাকুর জালে ধরা পড়েছে আর সব কথা স্বীকার করেছে।
রণজিৎদার নিস্তার নেই।”
পরিশিষ্ট
ত্রয়ী তাদের আরেকটা বিজয় অভিযান শেষ করে আজ কলকাতায় ফিরবে। তবে তার আগে একটা
কাজ আছে। ওরা এসেছে ভজার বস্তিতে। ওর বাবার জন্য অনেক ফলমূল সঙ্গে এনেছে। আর এনেছে
বেশ কিছু বইপত্র। ভাস্বতীর মাসি রোজ রাত্রে এসে কিছুক্ষণ করে ভজাকে পড়িয়ে যাবেন। বলাকা
ওকে বলেছে, “তোর আত্মসম্মানবোধ খুব বড়ো। কিন্তু জানবি, দিদির কাছ থেকে ভালোবাসা নিতে কুণ্ঠা করতে নেই। তাই এইগুলো
নে। আর পড়াশোনাটা ভালো করে শেখ। যারা দেরিতে পড়াশুনা করছে, তাদের জন্যও সরকারের কিছু
স্কুল আছে। সময়মতো সেখান থেকে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে পারবি। আর এই আঁকার জিনিসপত্র দিয়ে
গেলাম। দুই-একমাস পরেই অ্যাকাডেমিতে আমি তোর আঁকার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবই। প্রাণভরে
ততদিন আঁক।”
ভজা জড়িয়ে ধরে বলাকাকে। আজ যে তার চোখের জলে দিদিটার জামা ভিজে যাচ্ছে
সেদিকে তার কোনওই খেয়াল নেই!
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়
চমৎকার গল্প। ত্রয়ীর রহস্যভেদের পরবর্তী কাহিনি পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
ReplyDelete