ট্রেন জার্নির আগে
রঞ্জন ঘোষাল
“লাল ট্রেন, হলুদ হাতল। পানি
পাঁড়ে, ভাঁড়ের চা।”
এইটুকু বলতেই দুই বোন কাছে
এসে ঘন হয়ে বসল। চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা। চাপা গলায় বলে চলল, “বল না, ছোড়দা। বল
না। তারপর, তারপর? কোথায় যাচ্ছি আমরা? দিনের ট্রেন না রাত্তিরের? হাওড়া থেকে না
শেয়ালদা? কে কে যাচ্ছি রে আমরা?”
আমি পিঠ ঘুরিয়ে বসলাম। সঙ্গে
সঙ্গে মালা পিঠে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। শুক্লা চুলে
বিলি কেটে দিতে শুরু করল। আমি গলার স্বরকে আরও রহস্যময় করে তুললাম।
“ট্রেনের নাম দার্জিলিং মেইল।
শেয়ালদা থেকে ছাড়ে দুপুর বারোটা পঁচিশে। ট্রেনের রঙ ম্যাজেন্টা লাল। সদ্য
ধোয়ামোছা হয়ে রেলের ইয়ার্ড থেকে বেরিয়েছে। একটা স্টিম এঞ্জিন ষোলো কামরার
ট্রেনটাকে টেনে এনেছে। শেয়ালদা মেইনের আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে। কুলিরা চঞ্চল হয়ে
উঠেছে। গাড়িটা এসে থামতে না থামতেই তাদের হাঁকাহাঁকি শুরু হয়ে গেছে। হৈ
হৈ, রৈ রৈ কাণ্ড।”
“ছোড়দা, আমরা উঠব কী করে?”
আমি বললাম, “ভাবিস না। আমরা
কি আর থার্ড ক্লাসের প্যাসেঞ্জার নাকি? আমরা যাচ্ছি সেকেন্ড ক্লাসে। আমাদের সবার
সীট রিজার্ভ করাই আছে। চামড়ার গদি-আঁটা সীট আমাদের। কুলি আসছে আমাদের সঙ্গেই,
হেলতে দুলতে। কোনও তাড়া নেই ওদের। জানে তো। আমাদের হোল্ড-অলগুলো, তিনটে ট্রাঙ্ক,
স্টোভ, জলের কুঁজো সব একে একে উঠে গেল কামরায়। মা আর কাকিমাকে নিয়ে আমরা ছ’জন তো।
আমরা উঠে গুছিয়ে বসতেই টিটিই এসে আমাদের টিকিট দেখতে চাইবে। তোদের তিনজনের তো হাফ
টিকিট। আমি, মা আর কাকিমার ফুল। বাবার আর্দালি আমাদের তুলে দিতে এসেছিল। সে
স্টেশন ওয়াগন নিয়ে ফিরে গেছে। হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছাড়ল। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর
ট্রেন ক্রমশ স্পীড তুলতে লাগল। আমি স্টেশনে নেমে ঘোরাঘুরি করছিলাম। চলন্ত
ট্রেনে আমি ঠিক দৌড়ে উঠে গেছি। তোদের তো কণ্ঠাগত প্রাণ। ছোড়দা গেল কোথায়? আমার
হাতে হুইলার বুক ট্রলি থেকে কেনা নতুন বেরনো পুজোসংখ্যার উল্টোরথ আর দেব সাহিত্য
কুটিরের শারদীয়া সংখ্যা। আমার জমানো টাকা থেকে। উল্টোরথ পেয়ে মা আর কাকিমা কীরকম
খুশি হবে বল?”
মালা-শুক্লা দু’জনেই সায় দিল।
শুক্লা বলল, “বিশেষ করে মেজো-মা। মেজো-মা পড়বে আর মাকে ডেকে ডেকে বলবে, শোন ফুলি,
বসন্ত চৌধুরীর একটা সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে। নিয়েছেন সুচিত্রা সেন। একটু পড়ে শোনাই।”
কাঞ্চন বলল, “ছোড়দা, আমাদের
হাফ টিকিটে কি পুরো দার্জিলিং অবধি যেতে দেবে, নাকি হাপ রাস্তায় নামিয়ে দেবে?”
কাঞ্চনের বয়েস আট। মালার সাড়ে
দশ। শুক্লার সাড়ে এগারো। আমি তেরো।
আমি
কাঞ্চনকে আশ্বস্ত করলাম। “এই ট্রেন তো পুরো দার্জিলিং অবধি একটানা যাবে না। আমরা
প্রথমে সকড়িগলি ঘাট যাব। সেখানে ট্রেন থেকে নেমে কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে অনেকটা
হাঁটতে হবে নদীর চরের ওপর দিয়ে। সেখানে স্টিমারে উঠব আমরা। বিরাট গঙ্গা পার হয়ে
ওপারে মণিহারিঘাটে নেমে আবার হাঁটা। তারপর দেখব সেখানে আর একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে।
হুবহু এই ট্রেনের মতোই দেখতে। কিন্তু মিটার গেজ। বহরে একটু ছোটো। সেখানে আমাদের
কামরাটা খুঁজে নিয়ে আমাদের উঠে বসতে হবে। ভোরবেলায় শিলিগুড়ি জং। সেখান থেকে ন্যারো
গেজের টয় ট্রেনে করে তবে না দার্জিলিং যাওয়া। সব আমাদের এক সঙ্গে। সেইরকমই টিকিট
করা আছে সবার।”
“শেয়ালদা
থেকে তো ট্রেন ছাড়ল আমাদের। তারপর, তারপর কী হবে ছোড়দা?”
আমি
বললাম, “কাকিমা বেতের বাক্সর ডালা খুলে সবাইকে লুচি, ঝাল ঝাল আলুর দম আর মোহনভোগ
খেতে দেবে। শুধু কাঞ্চন ঝাল খেতে পারে না বলে ওকে একটু বেশি করে মোহনভোগ।”
সেই
শুনে কাঞ্চনের আকর্ণ হাসি। ছোড়দা সব আগে থেকে ভেবে রেখেছে।
সামনেই
সেকেন্ড টার্মের পরীক্ষা। তারপরে না পুজোর ছুটি। সেই ছুটিতে বেরোনো হবে। মহালয়ার ঠিক
পরের দিন। সেই উত্তেজনার রুটি সেঁকা হচ্ছে রোজ। মা, কাকিমা বা কাকু এলেই আমরা পড়ার
ভান করছি। আবার ওরা চলে গেলেই যে কে সেই।
শুক্লা
বলল, “অত লুচি খেলে আমরা ঘুগনিয়ালার ঘুগনি কখন খাব?”
আমি
বললাম, “লাল শালুতে অ্যালুমিনিয়ামের বড়ো মুখওয়ালা হাঁড়ির কমলা রঙের ধোঁয়াওঠা
ঘুগনি? শালপাতায় করে? সে তো এখন নয়। সে তো নবদ্বীপ পেরিয়ে তারপর। তার আগে তো
ব্যান্ডেলে ভাঁড়ে করে চা। সে অবশ্য তোরা পাবি না। চা শুধু যাদের ফুল টিকিট লাগে,
তাদের।”
মালা-শুক্লা
একটু গোঁজ হয়ে গেল। কিন্তু সে মুহূর্তেকের জন্য। মালা বলল, “তাতে কী? মা তো আমাদের
জন্য হরলিকস বানিয়ে নিয়ে যাবেই। আমরা মা আর কাকিমার চা খাওয়া হয়ে গেলে সেই ভাঁড়ে
ঢেলে হরলিকস খাব।”
কাঞ্চন
বলল, “আমি ছোড্ডার ভাঁড়ে হল্লিস্ক খাব।”
আমি
উদারতার সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম।
আমাদের
গল্প থামতেই চায় না। “তারপর ছোড়দা, তারপর? আমাদের জলতেষ্টা পেলে?”
আমি ভালোমানুষের
মতো মুখ করে বললাম, “কেন? জলের কুঁজো তো যাচ্ছেই সঙ্গে। কাঁসার গেলাসও থাকবে। যত
ইচ্ছে জল খেগে যা না!”
শুক্লা
অধৈর্য হয়ে মনে করিয়ে দিল, “না না, ছোড়দা, ঐ যে, পানি পাঁড়ে।”
আমি
তখন বললাম, “ও হ্যাঁ, সে তো কৃষ্ণনগর স্টেশন এলে সেখানে। তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে।
স্টেশনে একটা বিরাট রাধাচূড়াগাছ ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ট্রেন এসে থামতেই মিঠাইওয়ালারা
কামরায় ঢুকে পড়ল। সরভাজা, সরের নাড়ু আর রাজভোগ। আর
প্ল্যাটফর্মে পেতলের বালতি ভরা টলটলে জল নিয়ে খাকি উর্দি পরা পানি পাঁড়েজী ‘পানি
পানি, পীনে কা পানি’ বলে হাঁকতে হাঁকতে চলেছে। জানালার গরাদ দেওয়া থাকে না তো।
সেখান দিয়ে আমরা ঝুঁকতেই একটা পেতলের লম্বা হাতল লাগানো ঘটিতে করে বালতি থেকে জল
তুলে ঢেলে ঢেলে দিচ্ছে আর আমরা আঁজলা করে খাচ্ছি।”
কাঞ্চন
বলল, “আমি আঁজলা করে খাই না। আমি গ্লাসে করে খাব।”
শুক্লা
বিরক্ত হয়ে বলল, “তাই খাস। অ্যাই ছোড়দা, ঐ সরপুরিয়া সরভাজা কি কেনা হবে?”
আমি
বললাম, “বেড়াতে বেরিয়ে পেট কামড়ানো কিম্বা কিরমির ভয় করলে চলে নাকি? সে আমি
কাকিমাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব।
“সন্ধে ছ’টা বাজতে ট্রেন পৌঁছোবে সকড়িগলি ঘাট। আমাদের নেমে
পড়তে হবে। কুলিরা যতক্ষণে মাল নিয়ে ওপারের ট্রেনে তুলে দেবে, আমরা নদীর চরের সারি সারি
যে চালাঘরের হোটেলগুলো, সেখান থেকে ‘আসুন মা, আসুন দিদি, ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে
আসুন, ব্রাহ্মণের হোটেল’, বলে হাঁক দিচ্ছে সে সব অগ্রাহ্য করে স্টিমারের দিকে
এগিয়ে যাব। সেখানে ফার্স্ট ক্লাস আর সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা।
মুরগির ঝোল আর ভাত। নয়তো ইলিশ আর ভাত। যার যেমন পছন্দ।”
* * *
সেবার কেন, কোনওবারই আমাদের
যাওয়া হয়নি। উনিশশো আটষট্টিতে একটা বড়ো রকমের বন্যায় মালদহের কাছটায় রেললাইন ভেসে
গিয়েছিল। ঠিক মহালয়ার আগের দিন। অনেকেরই মনে থাকার কথা। ভাগ্যিস টিকিট কাটা ছিল না
আগে থেকে। নইলে ফেয়ারলি প্লেসে গিয়ে টিকিটের রিফান্ড নাও
রে, হ্যানো রে, ত্যানো রে করে হ্যাপা কম হত না।
সে না হোক। কিন্তু বারবার
গিয়ে গিয়ে সেই যাত্রাপথ আমাদের একদম মুখস্থ ছিল।
_____
অলঙ্করণঃ অরিজিৎ ঘোষ
মানসভ্রমণ! সত্যিই পড়তে পড়তেই মনে হচ্ছিল সব চোখের সামনেই ঘটছে। স্মৃতি দুরকম হয়, প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ, আবার মনে পড়ল।
ReplyDeleteধন্য হলুম।
ReplyDeleteগল্পটায় রঞ্জন ঘোষালের সিগনেচার লক্ষ্যণীয়। নিখুঁত ডিটেলিং,যার তুলনা চলে একমাত্র সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে।
ReplyDelete