খবরগুলো
সব যাচ্ছে কোথায়?
দীপ ঘোষ
কাটুম আর কাটামের রবিবার এলেই খুব মজা লাগে। সক্কাল
সক্কাল উঠে ট্যাব হাতে কলোনির ইস্কুলে দৌড়োন নেই। বাবাই ও আজ সারাদিন বাড়িতে
থাকবে; মামমাম ও সকাল সকাল জানালার কাঁচের কভারটা সরিয়ে বাইরের উজ্জ্বল গোলাপী
আকাশের আলোয় ঘর ধুইয়ে দেবেন না। ওদের এই গ্রহ ভেগা - ২৪৫বি ঘুরছে দ্বৈত সূর্যের
চারিদিকে। তাই এখানে রাতেও সূর্যের আলো থাকে, তবে তার তেজ অনেক কম। ওদের বয়স যখন
মাত্র দুই বছর তখন বাবাই আর মামমামের কোলে চেপে গ্যালাক্সির অপর প্রান্তের এই
গ্রহে এসে নেমেছিল ওরা। বাবাই এই কলোনির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার; আর মা স্কুলে পড়ান।
তবে রোব্বারের সব থেকে মজা হল বাবাই-এর কাছে পৃথিবীর গল্প শোনার সময়। সকালবেলা
অতি-বেগুনী রশ্মি দিয়ে ঝট করে চান সেরে, ফুড ট্যাবলেটগুলো কোনও রকমে মুখে গুঁজে,
দুজনে লাফিয়ে পরে বাবাই এর উপর। “পৃথিবীর গল্প শোনাও!” বাবাই-ও নিউজ কনসোলটা সরিয়ে
হাসি মুখে বলেন, “কোন গল্পটা শুনতে চাস বল?”
আর এর মধ্যে ওদের সব থেকে প্রিয় গল্প হল ব্ল্যাক
হোলের গল্প। যেটা না থাকলে তো পৃথিবী থেকে এত দূরে কলোনি তৈরি অথবা পৃথিবীর সাথে
যোগাযোগ রাখা সম্ভবই হত না। স্কুলের ইতিহাস বইয়ে ব্ল্যাক হোলের কথা পড়েছে ওরা। তবে
সে তো রোবো স্যারের একঘেয়ে পড়ানো। কিন্তু
বাবাই-এর মুখে সেই গল্প আবার শোনার মজাই আলাদা।
“বাবাই, পৃথিবীর লোকগুলো কি বোকা ছিল না? ব্ল্যাক
হোল দিয়ে কত কিছু করা যায়, কিচ্ছু জানত না!”
“কাটুম, এমন বলে না, তুমি তো জানোই আজ থেকে প্রায়
৮০০ বছর আগে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মানুষ ব্ল্যাক হোল আর ওয়ার্ম হোল নিয়ে তেমন
কিছুই জানত না।”
“আচ্ছা, তারা কী জানতো, আবার বল!” কুটুম দাবী করল।
“সেই ১৭৮৩ সালে, মানে আজ থেকে হাজার বছরেরও আগে, জন
মিশেল নামে এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রথম ব্ল্যাক হোলের মতো কিছুর অস্তিত্বের কথা
বলেন। তবে আলোর তরঙ্গ ধর্মের কথা তখনও কেউ ভাবতে পারেনি।”
“মহামতি আইনস্টাইন তো আরও কয়েকশো বছর পরে জেনারেল
রিলেটিভিটি থিওরি বলেছিলেন। খুব সহজ কথাগুলো, আমরা আগের বছরই বিজ্ঞান ক্লাসে ওটা
পড়েছি। ওই মহাকর্ষ দ্বারা আলোর গতি কিভাবে প্রভাবিত হয়, সেই নিয়ে।” কাটামের আবার
বিজ্ঞানে খুব আগ্রহ।
“হ্যাঁ, মহাকর্ষ, এই দুনিয়ায় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ
শক্তি। বৈজ্ঞানিকরা সেটা বিংশ শতাব্দীতেই বুঝতে পেরেছিলেন।” বাবাই বললেন।
কুটুম আবার ইতিহাসে খুব আগ্রহী, সে বলল, “আচ্ছা
বাবাই, সেই সময় লোকে ব্ল্যাক হোল তো নিউট্রন তারা থেকে তৈরির কথা বলেছিল? তাই না?”
“ঠিক! তোমরা ত জানোই, এই মহাবিশ্বে বিভিন্ন উপাদানে
তৈরি সম মাপের পদার্থের ভর বিভিন্ন হতে পারে। এর কারণ হল পিরিওডিক টেবিলের যত উপর
দিকে যাবে তত অ্যাটমগুলির ভর আর আয়তন বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর তাই পদার্থের ঘনত্বও
বাড়তে থাকে তার সাথে সাথে। কিন্তু এছাড়াও পদার্থের ঘনত্ব বাড়াবার অন্য উপায় আছে।”
“মহাকর্ষ! আমি এটা পড়েছি! সূর্যের মধ্যে ক্রমাগত
শক্তি আর পদার্থের পরিবর্তন না হলে কবেই সেটা মহাকর্ষের জন্যে সাদা বামন তারায়
পরিণত হত।” কাটুম তার বিজ্ঞান ক্লাসের পড়া মনে করে।
“হ্যাঁ, আর সাদা বামন হলে সূর্যের আকার প্রায়
আমাদের পৃথিবীর মতোই হয়ে যেত তার নিজের অভিকর্ষের জন্যে। কিন্তু তার ঘনত্ব বেড়ে
পৃথিবীর সব থেকে ঘন পদার্থেরও হাজার গুণেরও বেশি হয়ে যেত। এবার যেসব তারার ভর
সূর্যের ভরের ১.৩৫ থেকে ২.১ গুণ হয়, তারা যখন পুড়ে শেষ হয়ে যায়, তখন সাদা বামনের
জায়গায় নিউট্রন তারায় পরিণত হয়। তোমরা তো ইতিহাসে প্রাচীন শহর কলকাতার কথা পড়েছ?
একটা নিউট্রন তারা আকারে ওর থেকে বড় হবে না।”
“তাহলে তো তার ঘনত্ব খুব খুব বেশি হবে, তাই না?”
কুটুম বলল।
চিত্রসূত্রঃ নাসা |
“আসলে নিউট্রন তারার মহাকর্ষ এতটাই বেশি যে সব
প্রোটন আর ইলেকট্রন গিয়ে নিউট্রনে পরিণত হয়। আর যদি সেই তারার ভর এর থেকেও বেশি হয়
তাহলে তারা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হতেই পারে।”
“আচ্ছা মানুষ বুঝল কী করে ব্ল্যাক হোল কোথায় আছে?
ওরা তো তখন ব্ল্যাক হোল দেখার মত যন্ত্র আবিষ্কার করেনি?”
“ঠিক বলেছ কাটুম,” বাবাই বললেন, “দেখ, পৃথিবী বা
আমাদের ভেগা, যার ভর একেবারে পৃথিবীর মতো, এখান থেকে মহাকর্ষের বাঁধন পেরিয়ে যেতে
প্রায় ১১.২ কি.মি./ সেকেন্ড গতির দরকার। সেখানে নিউট্রন তারার বাঁধন কাটতে গতির
দরকার ২০০০০০ কি.মি./সেকেন্ড, যা আলোর গতির অর্ধেকের থেকেও বেশি। আর
ব্ল্যাক হোল তো আরও শক্তিশালী। তার কবল থেকে কেউই রক্ষা পায় না, না পদার্থ, না
আলো।”
“সেই জন্যেই তো মহাকর্ষ থেকেই একমাত্র বোঝা যেত
কোথায় ব্ল্যাক হোল আছে। যেখানে অন্য তারারা মহাশূন্যে কোনও অঞ্চলকে ঘিরে আবর্তন
করছে, অথচ সেই জায়গায় কোনও অন্য তারা বা আর কিছুই নেই, সেখানেই ব্ল্যাক হোল আছে
বলে ধরা হয়। আর আমাদের ছায়াপথের মাঝেই তো সূর্যের থেকে কোটি কোটি গুণ ভারী ব্ল্যাক
হোল আছে। তবে অন্য ছায়াপথগুলির ব্ল্যাক হোলের কথাও কিন্তু তখনকার বিজ্ঞানীরা
জানতেন।”
“ছায়াপথ রাস্তা তো তখনও কেউ তৈরি করার কথা ভাবেইনি,
২৪০০ সালের আগে সেই থিওরি মানুষ জানত না। তাহলে অন্য ছায়াপথের ব্ল্যাক হোল খুঁজে
পেল কী করে বিজ্ঞানীরা?” কুটুম বলল। বিজ্ঞানটায় ও বরাবরই একটু কাঁচা। তবে রোবো
স্যার বলেছেন ওর আঁকার হাত নাকি খুব ভালো।
“আসলে ব্ল্যাক হোলের অভিকর্ষের টান এতই বেশি যে তার
কাছে কোনও উল্কা, তারা বা গ্রহ এলেই তাকে টেনে নেয় নিজের ভিতর। ব্ল্যাক হোলের
ইভেন্ট হরাইজন কী সেটা জানো তো? ব্ল্যাক হোলের ভিতরের সেই এলাকা যেখানে একবার ঢুকে
পড়লে আলোও আর মুক্তি পায় না, সেই পরিধিকেই বলে ইভেন্ট হরাইজন। এবার অন্যান্য তারার
মতো কিন্তু ব্ল্যাক হোলেরও খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষমতা আছে। যে কোনও পদার্থ
ইভেন্ট হরাইজনের চৌম্বকশক্তির মধ্যে দিয়ে যাবার সময় শক্তি বিকিরণ করে। এই
চৌম্বকশক্তি যত বেশি হবে, শক্তি বিকিরণও ততটাই বেশি। তাই সেই সময়ের বৈজ্ঞানিকরা এক্স-রশ্মির
বিকিরণ খুঁজতে লাগলেন অন্য ছায়াপথে। দেখা গেল মেসিয়ার-৬০ ছায়াপথে একটি বিরাট
ব্ল্যাক হোল আছে, যার থেকে এক্স-রশ্মির বিকিরণ ভীষণ বেশি। সুতরাং যদিও ব্ল্যাকহোল
কোনও আলো বিকিরণ করে না, কিন্তু তার এই শক্তি বিকিরণই তাকে চিহ্নিত করার জন্যে যথেষ্ট।”
চিত্রসূত্রঃ নাসা |
“কিন্তু যদি ব্ল্যাক হোলের টেনে নেবার মতো চারপাশে কিছু
না থাকে? তাহলে তো আর এক্স রশ্মি পাওয়া যাবে না?”
“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছ, তবে এমন ঘটনা খুব কমই হয়।
হকিং নামে এক বিজ্ঞানী প্রথম এই কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন যদি সত্যি এমন শূন্যতা
তৈরি হয় ব্ল্যাক হোলের চারপাশে, তাহলে সেখানে কণা আর বিপরীত কণার লড়াই শুরু হয়ে যাবে।
আর মাঝে মাঝে কিছু বিপরীত কণা ব্ল্যাক হোলের টানে তার ভিতরে চলে যায়। আর তার জোড়ের
কণাটি ব্ল্যাক হোলের বাইরে পালাতে পারে। এই কণাটির সাথে যে শক্তিটা বেড়িয়ে যায়
ব্ল্যাক হোল থেকে, তার জন্যে কিছুটা ভরও কিন্তু কমে যায় ব্ল্যাক হোলের। একেই নাম
দেওয়া হয় হকিং বিকিরণ। এই বিকিরণে শক্তির পরিমাণ কিন্তু অস্বাভাবিক কম, হিসেব করে
দেখা গেছে আকাশগঙ্গার মাঝের ব্ল্যাক হোলের বিকিরণ শক্তি ১০-১৫
কেলভিনের মত।”
“আচ্ছা বাবাই, কিন্তু হকিং বিকিরণের জন্যেই তথ্যের
নিত্যতা সূত্র নিয়ে অসুবিধা হয়েছিল, তাই না? ওই ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বল না
প্লিজ, এবার ক্লাসে ওইটা বুঝতে অসুবিধা হয়েছিল।” ম্লান মুখে বলল কাটুম।
চিত্রসূত্রঃ বিবিসি ডকুমেন্ট্রি |
“দেখ, ইভেন্ট হরাইজনের বাইরের দিকে, যেখানে
পদার্থরা ব্ল্যাক হোলের টানে বাঁধা পড়ে ঘুরছে তাদের নিয়ে একটা ত্বরণ বলয় তৈরি হয়।
এই বলয়ের পদার্থগুলি যে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে আর মহাকর্ষ বলের জন্যে চৌম্বক
শক্তির বিকিরণ ঘটায় সেটা আগেই বলেছি। এখন এই বলয়ের মধ্যে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটে।
সময় ধীরে চলতে থাকে যত ভিতরের দিকে যাওয়া যায়। আর তার সাথে ব্ল্যাক হোলের টানে
আলোর গতিও কমতে থাকে। দাঁড়াও, তোমায় একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাই। ধর আমরা একটা ঘড়িকে
ত্বরণ বলয়ের সব থেকে বাইরের দিকে ফেলে দিলাম। ঘড়িটা যত বলয়ের ভিতরের দিকে যাবে তত
তার সময় আস্তে চলবে। রিলেটিভিটি থিওরিতে একে সময়ের প্রসারণ বলা হয়। এই ভাবে
ব্ল্যাক হোলের দিকে এগোতে এগোতে যখন ঘড়িটা ইভেন্ট হরাইজনে গিয়ে পৌঁছবে তখন সময়
একেবারেই থেমে যাবে। এবং এরপরে ঘড়িটা থেকে নির্গত সব ফোটন কণাই ব্ল্যাক হোলের দিকে
চলে যেতে থাকবে। যদি আমরা কোটি কোটি বছর ব্ল্যাক হোলের দিকে তাকিয়ে থাকি তাহলে
কিন্তু তার ভিতরে চলে যাওয়া সব কিছুই আমরা দেখতে পাব। বিজ্ঞানীরা অংক কষে দেখলেন,
ব্ল্যাক হোলের মধ্যে যাওয়া প্রতিটা অ্যাটম আর ফোটনের চরিত্র কিন্তু নির্ণয় করা
সম্ভব। যেহেতু কণাগুলি সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে অনন্তকাল লেগে যাবে, তাই সেগুলির
জাগতিক অস্তিত্ব না থাকলেও তাদের কোয়ান্টাম তথ্য আটকে থেকে যাবে বাইরের বলয়ে। কখনও
যদি ব্ল্যাক হোলটা খুলে ফেলা যেত, তাহলে সে এতদিন যা যা খেয়েছে তার সবকিছুর তথ্য
খুঁজে পাওয়া যেত তার মধ্যে।”
“কিন্তু হকিং বিকিরণ যা বলছে তাতে যে তথ্য হারিয়ে
যাবে!” কুটুম বলে উঠল।
“একজ্যাক্টলি! কুটুম মন দিয়ে পড়াশুনা করছে দেখছি!
হকিং-এর কথা অনুযায়ী কোটি কোটি কোটি বছর ধরে ভর কমতে কমতে একদিন ব্ল্যাক হোলগুলো
হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাহলে সে এতদিন যা খেয়েছিল সেই তথ্যগুলো যাবে কোথায়? এইটা ছিল
সেই সময়ের সবথেকে বড় ধাঁধা বা প্যারাডক্স। কারণ কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলে যাই হোক না
কেন তথ্যকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কণার চরিত্রের তথ্যই এই মহাবিশ্বের এক বস্তুকে
আরেক বস্তুর থেকে আলাদা করছে। তাহলে বিজ্ঞানীরা ভাবলেন এর সমাধান কী কী হতে পারে।
প্রথমত, হয়তো হকিং ভুল বলেছেন, ব্ল্যাক হোল কখনওই নষ্ট হতে পারে না, অথবা হকিং
বিকিরণের সাথে সাথেই তথ্য বেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা সেটা ধরতে পারছি না। কিংবা ব্ল্যাক
হোল ধ্বংস হয়ে গেলেই সব তথ্য হুস করে বেরিয়ে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আবার এও হতে
পারে তথ্যগুলি নিয়ে ব্ল্যাক হোলের থেকে নতুন কোনও মহাবিশ্ব তৈরি হচ্ছে। তখন তো কেউ
জানত না যে সে সবই ঠিক নয়। ২১০০ সালের মাঝে ভারতের বিজ্ঞানীরা এই তথ্যের ধাঁধার
সমাধান করেন, আর যার জন্যেই এত সহজে আমরা পৃথিবী থেকে ভেগায় আসতে পারছি। আবার
পৃথিবীর মানুষের সাথে কথাও বলতে পারছি। কাটুম বল তো সেই থিওরিটা কী?”
কাটুম উত্তর দেবার আগেই মামমাম ঘরে এসে ঢুকলেন।
“অনেক হয়েছে আড্ডা! আজ দুপুরের খাওয়া হবে না নাকি? ওদিকে দুপুর ২টো থেকে পৃথিবী
বনাম মঙ্গল একাদশের খেলা আছে। উঠে পড় সবাই।”
মামমামটা সবসময় আড্ডাটা ভেঙে দেয়, নইলে তথ্যের
প্যারাডক্সের সমাধানটা বলে বাবাইকে কাটুম বুঝিয়ে দিত সেও বিজ্ঞানটা আজকাল মন দিয়ে
পড়ছে।
______
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট ও স্টিফেন হকিং-এর ‘আ ব্রিফ হিষ্ট্রি
অফ টাইম’
দারুন লাগলো পড়ে দাদা।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteদুর্দান্ত! আজকের সবচেয়ে উপযোগী পাঠ ছিল এটাই।
ReplyDelete