টিন্টো লিও কুশু
যশোধরা রায়চৌধুরী
কে যেন বলেছিল, লিওনার্দো
দ্য ভিঞ্চি ছিলেন বেজায় কুঁড়ে। অনেক বেলা অবধি ঘুমোতেন। খুব আলসেমি করে কাজ করতেন।
আদ্ধেক কাজ করে ফেলে রাখতেন।
এই শুনেই কুশু ঠিক করে
নিয়েছিল,
ও ভিঞ্চি হবে।
বেশ কিছু না শেষ করা ছবি
আবিষ্কার হয়েছে ভিঞ্চির। লোকটা ছবি আঁকা শুরু করে শেষ করত
না।
কুশু যদি অঙ্ক ফেলে রাখে, তাহলেই
দোষ?
একটাই তফাৎ, লিওনার্দোর
কোনও বাবা-মা ছিল না যারা সারাক্ষণ কানের কাছে টিকটিক করবে। কুশুর আছে।
আর কুশু ক্লাস সিক্সে পড়ে।
লিওনার্দো বিশ্ববিখ্যাত, তাই সাতখুন মাপ।
লিওনার্দো শুধু কুঁড়ে ছিলেন
না। তিনি খেতেও ভালোবাসতেন। সুন্দর গেরুয়া বা গোলাপি কাপড়ের আলখাল্লা পরতেও। আর
খুব অগোছালো ছিলেন। কিন্তু বড়ো বড়ো পুরনো গির্জের দেওয়ালে ছবি আঁকতেন যখন, সব
ভুলে শুধু মাসের পর মাস ঐ করে যেতেন। লাস্ট সাপার নামের যে ছবিটা এত বিখ্যাত, ওটা
সাধুবাবাদের মঠের খাবার ঘরের দেওয়ালে ওপর দিকে এঁকেছিলেন।
সে দেওয়াল ফ্রেস্কোর জন্য
তৈরি করতেই নাকি লেগে গেছিল কয়েক মাস। ফ্রেস্কোর জন্য দেওয়ালে কী কী মেশানো হয় সে
ফিরিস্তি পড়লেও কুশুর অবাক লাগে। ইতিহাস পড়তে ঘুম পেয়ে যায়, কিন্তু এই বইটার
লেখাটা যেন জ্যান্ত। কী চমৎকার করে বলা আছে, সেকালে ছবি কীভাবে আঁকা হত।
এইটুকু পড়েই তোমরা যারা খুব
ভালো গল্প-পড়িয়ে, মনে মনে ভাবতে শুরু করে দিয়েছ তো, এর পর কী
হবে? এর
পর কুশু ঘুমিয়ে পড়বে, আর লিওনার্দো স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে বলবেন, ‘আমি
কুঁড়ে ছিলাম কিন্তু পরিশ্রমীও ছিলাম। নইলে এত্তগুলো ছবি শেষ করলাম কী করে বল তো?’
নাহ্, সেরকম কিছুই এই গল্পে
হবে না কিন্তু। কারণ, এটা আসলে লিওনার্দো আর কুশুকে নিয়ে গল্পই নয়। এটা আসলে একটা
বেড়ালের গল্প।
কুশুর বেড়ালের নাম টিন্টো। টিন্টোরেটো
নয়। শুধু টিন্টো। সাদা বেড়াল। কপালের বাঁদিকে কালো ফুটকি। খুব চালাক। মাছের টুকরো
চুরি করে সাতদিন পালিয়ে ফেরে। কুশুর মাছ। মাছ খেতে ভারি বাজে লাগে তাই কুশু খুশিই
হয়েছিল। মা খুশি হয়নি।
সেই আসলে টাইম ট্রাভেল করল।
কুশু না। ঘুমিয়ে পড়েনি কুশু। ঘুমলো বেড়াল।
কুশুর প্রিয় বইটা, বাংলায়
লেখা লিওনার্দোর ছবিওলা বইটার ভাঁজে ঘুমলো। আর সেই ছবি ধরে ধরে পৌঁছে গেল একেবারে
লিওনার্দোর সময়ে। কারণ, বইটা তখন আর বই নেই। হয়ে গেছে যাদুবাক্স। টাইম মেশিন।
সময়যান।
সোজা পৌঁছে গেল একটা শহরে
ইতালির। শহরের নাম ফিরেনৎসে। ইংরিজিতে বলে ফ্লোরেন্স। চৌখুপি চৌখুপি সব পাথর পাতা রাস্তা। হাঁটলে বা ঘোড়া
চললে শব্দ ওঠে খটখট খট। সে রাস্তাগুলো শহরের মাঝখানে প্লাজা
বলে একটা চৌকো উঠোনের মতো জায়গায় এসে মিলেছে। কী চমৎকার যে সেই প্লাজা!
রোজ সেখানে মেলা বসে যায়।
কখনও বিক্রি হয় গরম রুটি তো কখনও মিষ্টি পিঠে। ছেলেমেয়েরা কুকুরের ল্যাজে রঙিন ফিতে
আর ঘুঙুর বেঁধে বিরক্ত করে। বড়োরা বকুনি দেয়। দুষ্টু ছেলেরা পিঠে চুরি করে। বেড়ালেরা
সরু সরু অলিগলিতে ঘোরে।
টিন্টো তেমনি করে ঘুরবে ক’দিন
পর। কিন্তু আপাতত সে কর্মশালায়। লিওনার্দোর কর্মশালা। সেখানে
কেউ পাথর ঘষে রঙ বানাচ্ছে। কেউ রঙ পাকা
করার জন্য ঘুঁটছে উনুনের ওপর কাথ। কাথে মেশান হচ্ছে মুরগির রাশি রাশি ডিম, আর
তিসির তেল।
১৫০৩ সাল এটা। আঁকা হচ্ছে
মোনালিসার ছবি। চল্লিশ পরত রঙ আর কাথ বুলিয়ে তবে লিওনার্দো শেষ করবেন ছবিটা। তৈরি
হবে সেই বিখ্যাত হাসি। রহস্যময়! গায়ে কাঁটা দেওয়া হাসি। জ্যান্ত মতো!
টিন্টো রাস্তায় বেরিয়ে
কুকুরের মুখে পড়ে আর কি! চট করে সেঁধিয়ে গেল কর্মশালায়। ডিম
শুঁকল খানিক। তারপর ভাবল, যে ছবিটায় মোনালিসা হাসি হাসি মুখে
বসে, ওই
ছবিটার ভেতর দিয়ে আবার পালিয়ে যাবে কুশুদের বাড়ি। ভাবতে ভাবতেই দেখে, বেড়াল দেখে
খুশি হয়ে দাড়িওয়ালা আলখাল্লা পরা বৃদ্ধ কোমরবন্ধনী থেকে রুটির টুকরো বার করে ওকে
দিচ্ছেন। মাথায় হাতও বুলিয়ে দিলেন। কী চমৎকার বুড়োর হাতখানা! খসখসে
কিন্তু স্নেহ যেন ঝরে পড়ছে তা থেকে। টিন্টো
লিওনার্দোর আলখাল্লার ভাঁজে ভাঁজে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ঘুরে বেশ গদগদ হয়ে
পড়েছে তখন।
কিন্তু কোথা থেকে যেন
লিওনার্দোর পোষা কুকুরটা টের পেয়ে গেল। হিংসুটেটা ঝাঁপ দিয়ে এল টিন্টোর দিকে। ব্যস,
আর যায় কোথায়। টিন্টো পাঁই পাঁই দৌড় দিল।
ছবিটায় খামচে-খুমচে চড়ল। আর
বেরিয়ে এল অন্যদিকের পৃষ্ঠা থেকে।
কুশু দেখল ঘুমনোর আগে টিন্টোর
মাথার বাঁদিকে কালো ফুটকি ছিল। এখন ডানদিকে।
লিওনার্দো দেখলেন, তাঁর
আঁকা মোনালিসার ছবিতে একটা ছোট্ট বেড়ালের থাবার ছাপ। ইতালিয় ভাষায় বেড়ালকে বলে
গাত্তো। আর মোনালিসার নাম তো আসলে মোনালিসা না। জিওকোন্দা। জিওকোন্দায় গাত্তোর
জাম্পে! জাম্পে মানে থাবা।
কুশু দেখল, বইটা
খোলা আছে। কিন্তু অক্ষর সব উলটে গেছে। আর মোনালিসার ছবিতে ছোট্ট থাবার দাগ। বইটা
ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কুশু সব ঝেড়ে ঝেড়ে দেখল। খানিক পরে একটা তুলি পড়ল।
লিওনার্দো ঐ তুলিটা হারিয়ে
ফেলেছেন ততক্ষণে। বড্ড অগোছালোও বটে। কুঁড়ে তো ছিলেনই।
বছর
দশেক পর কুশু কিন্তু
অঙ্ক আর ফিজিকস করেনি। ও হয়েছে আঁকিয়ে। আর শিখে নিয়েছে ইতালিয় ভাষাও। এখন ও নিজের আঁকার একজিবিশন করতে যাবে ফ্লোরেন্স। টেবিলের ওপর লাগানো লিওনার্দোর ছবিটা। ও তাকিয়ে
দেখল। কেমন মুচকি মুচকি হাসছে যেন!
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জী
ছোটোদের জন্য সুন্দর গল্প
ReplyDeletethank u!!! that coming from u... means a lot
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
Deleteযশোধরাদি, আপনার গদ্যের মধ্যে একটা কবিতার ভাষা আছে। গল্প তাই আপনগতিতে এগিয়ে যায়। ছোটদের মুগ্ধ করে।
ReplyDeleteশুধু গল্প নয় :) সাথে আরো কত কিছু জানা গেল !
ReplyDeleteকি ভাল। টিন্টো ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড।
ReplyDeleteভারী মিষ্টি একটা রঙীন ছবি এঁকেছ।
ReplyDelete--- শান্তনু(রাজা)
Bhari sundor laglo☺☺
ReplyDeleteকি সুন্দর!
ReplyDeleteঅপূর্ব
ReplyDeleteBah bah eta khub sundor
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteকল্পবিজ্ঞান নয়, মিষ্টি একটি রূপকথার গল্প এটা।
ReplyDeleteMitti goppo
ReplyDelete