হাইওয়ের কালো বাস
দ্বৈতা গোস্বামী
এক
১৯ জুলাই, ২০১৬
“কালো বাস? আবার সেই কালো বাস? যে দেখেছে তার অবস্থা কীরকম?”
অফিসার অরুণ একটু দূরে তাকিয়ে বললেন, “সে আর নেই। যাওয়ার আগে এই দুটো শব্দই বলেছে।”
“তাহলে রিপোর্টে কী লিখব? এইরকম ঘটনা বারবার ঘটছে, এর তো একটা জবাবদিহি করতে হবে।”
অফিসার অরুণ অন্যমনস্কভাবে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “স্যার, সেই পিকনিকের কেসটার কথা মনে আছে? এতগুলো প্রাণ! বাসে বিস্ফোরক থাকার খবরটায় আমি বিশ্বাস করিনি। আপনি তখন ছুটিতে ছিলেন তাই আপনাকেও জানাইনি।”
তেওয়ারিজি অরুণের চোখে তাকিয়ে বললেন, “সে তো পাঁচবছর আগের কথা। গড়ে মুর্দে উখারকে অব ক্যায়া হোগা? আর এসব আলতু-ফালতু
কথা বলছ কেন? এগুলোর মধ্যে কানেকশন কী?”
দুই
৮ নভেম্বর, ২০১০
সন্ধে নেমে এসেছে। রৌনক তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল। কাল সকালের মধ্যেই
সিমলা হয়ে রওনা দেবে - ও আর ওর পাঁচ সঙ্গী। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়বে ওরা। স্কুল, কলেজ, শপিংমলগুলোই টার্গেট।
নতুন প্রজন্মের নিঃশ্বাস রোধ করতে পারলেই কাজ সিদ্ধ হবে। আর যারা অল্পের জন্যে বেঁচে যাবে, আজীবন তাদের মনে বাসা বাঁধবে ভয়। সেই ভয়মাখা অন্ধকারেই ওদের সব আশা, স্বপ্নের অঙ্কুরগুলো শুকিয়ে যাবে। এখানকার কাজটা সফল। পুলিশও কোনও কুলকিনারা করতে পারেনি। হাসছিল রৌনক। হাইওয়েতে ওর কালো ছায়াটাকে একটা বিরাট দৈত্যের মতো দেখাচ্ছিল। হঠাৎ রৌনকের পায়ে এসে লাগল একটা কিছু। রৌনক মাটিতে ঝুঁকে ওটা হাতে তুলে নিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। একটা লাল রঙের বল, পিং-পং বল। এখানে এই বলটা এল কোথা থেকে! এখানে চারপাশে কোনও বাচ্চা থাকার কথা তো নয়। দু’পাশে উপত্যকা আর ঘন জঙ্গল। ও বলটা হাতে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিল। তারপর আবার দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করল।
কিছুদূর যাওয়ার পর আবার কিছু একটা পায়ে ঠেকল। মনে হল, কাঠের কোনও জিনিস। রৌনক অল্প আলোয় দেখতে পেল একটা ক্রিকেট ব্যাট। আশ্চর্য, এসব কী! রৌনক ওটা পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। এবারে ওর পিঠে এসে একটা কিছু ধাক্কা খেল। যেন কেউ ওকে দেখেই কিছু ছুঁড়েছে। রৌনক পেছন ফিরে দেখল সেই পিং-পং বলটা। তাহলে কি কেউ ওকে ফলো করছে? রৌনক এবার নিজের গতি আরেকটু বাড়াল। হঠাৎ পেছন থেকে ঘড় ঘড় একটা শব্দ শুনে একটু সরে দাঁড়াল।
এটা তো সেই বাসটা! তাই না? কিন্তু এটাকে তো তিনদিন আগেই...!
বাসটা দ্রুতগতিতে ওর দিকেই ছুটে আসছে। রৌনক দৌড়তে শুরু করল। দৌড়তে দৌড়তে কলিজা প্রায় ফেটে যাওয়ার জোগাড়। একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে ও উল্টে পড়ল। মাথায় খুব আঘাত লেগেছে মনে হল। কিছুক্ষণ পর মনে হল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। ‘পানি, পানি...’ করে আর্তনাদ করে উঠল রৌনক। খুব কষ্টে চোখ খুলে দেখল, হাতে ওয়াটার-বটল নিয়ে বাস থেকে নেমে আসছে একটা বাচ্চা ছেলে। তার দিকেই এগিয়ে আসছে। রৌনক হাত বাড়িয়ে দিল...
তিন
৫ নভেম্বর ২০১০
“ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ হ্যাভ ইউ এনি উল?”
“শিপ মানে জাহাজ, তাই না রে, তানি?”
“আরে বুদ্ধুরাম, এই শিপ মানে তো ভেড়া। ঠিক তোর মতো।”
“আচ্ছা ড্রাইভার আঙ্কল, কালো বাস হয়?”
“কালো বাস? কেন, আমাদের এই বাসের রঙটা তোমার পছন্দ নয়?”
“ড্রাইভার আঙ্কল, ও একটা ছাগল। ওর মতো বোকা ছেলে আমি একটাও দেখিনি। আমাদের পুরো অনাথ আশ্রমে একটাও না। ওকে পিকনিকে নিয়ে আসা উচিত হয়নি।”
“তানি, তোর মতো খরূস্ মেয়েও আমি দেখিনি।”
“কী বললি?”
“বললাম, খরউউউস্।”
“আঙ্কল, ভিখুকে এক্ষুনি বাস থেকে ফেলে দেওয়া হোক।”
ভিখু ওর লাল রবারের পিং-পং বলটা তানির মাথায় ছুঁড়ল। তানি বলটা ক্যাচ করে ভিখুকে জিভ দেখাল।
“হা হা। ঝগড়া মত্ করো। অউর এক ঘন্টে মে হামলোগ পিকনিক স্পট মে হোঙ্গে।”
চার
১৩ অক্টোবর, ২০১৫
সিমলা থেকে আমরা যাব নালদেরা। পুজোয় কলকাতা ছেড়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস। ধোঁয়া-ধুলোর মধ্যে আজকাল দমবন্ধ লাগে আমার। সঙ্গে বেস্টফ্রেন্ড অগ্নিভ।
আকাশ সেন আর অগ্নিভ চক্রবর্তী। আমাদের জুটি সেই স্কুল-লাইফ থেকে এখনও অক্ষয়। অগ্নিভ আর আমার অনেক কিছু একরকম। আমাদের দুজনেরই পরিবার বলতে যা বোঝায় সেটা নেই। অগ্নিভ ওর বাবা মাকে হারিয়েছে একদম ছোট্টবেলায়। মামা-মামীর কাছে মানুষ। আমি বড়ো হয়েছি একটা অনাথ আশ্রমে। তারপর অনেক স্ট্রাগল করে ইঞ্জিনিয়ারিং। স্কুল কলেজ, খেলাধুলো - সবকিছুতেই আমি আর অগ্নিভ একসঙ্গে। এছাড়া, সময় অসময়ে ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং
- এসবও আমরা করে থাকি। এবার একটা বেশ বড়ো প্ল্যান নিয়ে এখানে আসা হয়েছে। সিমলা, নালদেরা, কুফরী, চেইল – এক সপ্তাহ হাতে নিয়ে এসেছি। আমাদের যে নালদেরা নিয়ে যাবে সেই মনোহর সিং চা খাচ্ছিল দোকানে দাঁড়িয়ে। অগ্নিভ ডাক দিল, “মনোহর, উই আর রেডি টু গো ।”
আমি সিটে রাখা নিউজপেপারটা তুলে
উলটেপালটে দেখছিলাম। অগ্নিভ ড্রাইভার মনোহরের সঙ্গে গল্প করছিল। আধঘন্টা যাওয়ার পর একটা ফোন পেয়ে মনোহর হঠাৎ বলল, “আজ বহত মুশকিল হো গয়া। রাম জানে ক্যায়া হোগা!”
আমি কারণ জিজ্ঞেস করতে সে বলল যে আজ রাস্তায় ধস নেমেছে তাই অন্য একটা রাস্তা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে নাকি কোনও ড্রাইভারই যেতে চায় না।
অগ্নিভ জিজ্ঞেস করল, “এটাই কি সেই ‘কিলার হাইওয়ে’, যেটা নিয়ে ক’দিন আগে পেপারে পড়েছিলাম?”
মনোহর ঢোঁক গিলে বলল, “ইয়েস স্যার। উহা সে যানা ঠিক নহি। পর অউর কোই দুসরা রাস্তা ভি নহি।”
আমি এই ব্যাপারে কিছুই পড়িনি পেপারে। ব্যাপারটা কী? সন্দিগ্ধভাবে প্রশ্ন করলাম।
অগ্নিভ কী যেন ভাবছিল। বলল, “গত পাঁচবছরে ষোলোটা দুর্ঘটনা হয়েছে শুনেছিলাম এই রাস্তায়। সেজন্য এই রাস্তা নিয়ে একটা অন্ধবিশ্বাস তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। তাই নয় কি? স্বভাবতই ড্রাইভারদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে।”
স্থানীয় লোকেরা এই রাস্তাটাকে ‘কিলার হাইওয়ে’ বলে, মনোহর জানাল। এখানে যেসব দুর্ঘটনা হয়েছে তাতে একজন লোকও বাঁচেনি। তবে মনোহরের এক বন্ধু, সেও ড্রাইভার – রামলাল রস্তোগী। সে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় রয়েছে এখনও। তার কাছে যখন রিপোর্টাররা এসেছিল, সে একটা কালো বাসের কথা বলেছে।
“কালো বাস?” অগ্নিভ ভ্রূ কোঁচকাল। “তা সেই বাসের কোনও খবর নেই?”
মনোহর বলল, “সেটাই তো সমস্যা। এরকমের কোনও বাসকেই কোনোদিন এই এলাকায় দেখা যায়নি। সবগুলো দুর্ঘটনা এমন রহস্যজনকভাবে হয়েছে যে তার কোনও কুলকিনারা হয়নি।”
সত্যি কথা বলতে কি, এসব শুনে আমার মনে যে একটু সংশয় হচ্ছিল না তা নয়। বললাম, “আচ্ছা, ফিরে যাওয়া যায় না এখান থেকে? কাল রাস্তা পরিষ্কার হলে না হয় অন্য রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে।”
অগ্নিভ হেসে বলল, “হল কী তোর? এসব জিনিস রং চড়িয়ে নিউজপেপারগুলো পরিবেশন করে পাঠকদের আগ্রহ তৈরীর জন্যে।”
আমি উদাসীনভাবে বললাম, “হবে হয়তো।”
“চারদিকে এত সুন্দর প্রকৃতি, একবার তাকিয়ে দ্যাখ। এখানে কি কোনও খারাপ জিনিস থাকতে পারে?”
বাইরে মনভোলানো পাহাড়-উপত্যকা দেখে সত্যিই এসব আর ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। গাড়িটা একটু থামাতে বললাম একটা বাঁকে। এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রি উপত্যকার ভিউ। ছবি না তুলে রাখলেই নয়। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে নেমে গেলাম।
বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছি, এমন সময় শুনলাম গোঁ গোঁ আওয়াজ। উল্টোদিক থেকে দৈত্যের মতো ছুটে আসছে একটা প্রকান্ড কালো বাস। চিৎকার করলাম, “অগ্নি, অগ্নি!” দেখলাম ইতিমধ্যে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। আমাকে ছেড়েই গাড়ি দৌড় দিয়েছে উল্টোদিকে। অগ্নিভ দু’বার ‘আকাশ, আকাশ। গাড়ি রোকো।’ বলে চেঁচাল। কিন্তু গাড়ির স্পিড এতো বেশি ছিল যে আর কিছু বলার সময় পেল না। আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের সামনে গাড়ি উধাও হয়ে গেল আর পেছনে ধাওয়া করল কালো বাসটা।
বুঝে পেলাম না আমার কী করা উচিত। কয়েক মুহূর্ত কালো বাসটার পেছনে দৌড়ে গেলাম। কিন্তু ওটাও কিছুক্ষণ পর একটা বাঁক ঘুরে আমার নাগালের বাইরে চলে গেল। দু’তিন মিনিট ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্য কোনও গাড়ি দেখতে পেলাম না। অগ্নিভর ফোন সুইচড অফ বলছে।
হঠাৎ দেখলাম আমার পেছনে গোঁ গোঁ আওয়াজ। সেই দৈত্যের মতো প্রকান্ড কালো বাসটা এবারে আমার পিছু নিয়েছে। হতবুদ্ধি হয়ে দৌড়তে শুরু করলাম। কতক্ষণ দৌড়চ্ছি জানি না, তবে বাসটা পেছন ছাড়েনি। আমার ফুসফুস মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। দুটো পা ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রনায়। তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।
এখন দিন না রাত জানি না। কতক্ষণ এভাবে পড়ে আছি তাও জানি না। জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে।
চোখ খুলতে আবছা অন্ধকারে একটু একটু করে ঠাহর করলাম, অগ্নিভ দাঁড়িয়ে। “উঠে আয়,” বলে হাতটা বাড়িয়ে দিল। আমি কাঁপা গলায় জানতে চাইলাম, “মনোহর? আমাদের গাড়িটা?”
অগ্নিভ বলল, “তোকে ছেড়ে যখন ও গাড়ি স্টার্ট দিল আমি ওকে অনেকবার গাড়ি থামাতে বললাম। শুনল না। বেগতিক দেখে আমি গাড়ির দরজা খুলে ঝাঁপ দিলাম। গড়িয়ে পড়লাম অনেকটা দূর। তারপর…”
“তারপর?”
“আয়, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে।”
দেখলাম প্রকান্ড কালো বাসটা যেন অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে। ভেতর থেকে হৈহৈ শোনা যাচ্ছে।
অগ্নিভ বাসটাতে চড়ে হাত বাড়াল। বলল,
“উঠে আয়, আমরা যে বেস্টফ্রেন্ড! যেখানে যাব একসঙ্গে যাব, তাই না?”
পাঁচ
১৮ জুলাই, ২০১৬
“হ্যালো, হ্যালো...”
“টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।”
“শুনতে পাচ্ছেন?”
“এখন সিমলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে…”
“পৌঁছে আপনাকে আবার কল করে কালকের মিটিং ফিক্স করব।”
“এই তো একটা বাস আসছে।”
“বাসটার রং? কেন? রং নিয়ে কী?”
“কালো, কালো রঙের বাস।
হ্যালো, হ্যালো... দূর, ফোনটা কেটে গেল!”
-----
ছবিঃ সুমিত রায়
besh bhalo lekha
ReplyDeletedhanyobaad... aapnar lekha aamar anuprerona...bhalo legechhe jene khub khushi holaam
ReplyDeletesmart presentation
ReplyDeletedhanyobad :)
ReplyDeleteভালো লাগলো
ReplyDelete