গোলটেবিল:: কিছু মেঘ, কিছু কুয়াশা:: আলোচনাঃ কৌস্তভ সরকার


বইঃ কিছু মেঘ, কিছু কুয়াশা
অনীশ দেব পরিবেশিত (পত্র ভারতী) - ১৬০ টাকা
আলোচনাঃ কৌস্তভ সরকার

কোনান ডয়েলের কলমেশার্লক-এর জন্ম ১৮৮৭ জানুয়ারি মাসে। তাঁর শতবর্ষ পূর্তিতে ১৯৮৭-তে . সুকুমার সেন প্রতিষ্ঠিতহোমসিয়ানাথেকে প্রকাশিত হয়পঞ্চজন্য পাঁচ লেখকের কলমে উঠে আসা ছয় অধ্যায়ের এক রহস্য উপন্যাস। তা এর লেখক তালিকা কিন্তু বেশ আকর্ষনীয়! আনন্দ বাগচী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ বসু, সুকুমার সেন তার ছেলে সুভদ্রকুমার সেন। সত্যজিৎ রায় আর নীহার ঞ্জন গুপ্ত সময় বা অন্যকিছুর কারণে লিখে উঠতে পারেননি। তথ্য অনুযায়ী বাংলার প্রথম বারোয়ারি রহস্য উপন্যাস হল এইপঞ্চজন্য আমি নিজে পঞ্চজন্য পড়িনি। তাই মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছেকিছু মেঘ, কিছু কুয়াশা-র মুখবন্ধে অনীশ বাবুপঞ্চজন্য কথা বলেও কেন যে বললেন “....এই নজিরটিকে মনে রেখেও বলা যায়, আমাদের এইবারোয়ারিরহস্য উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে প্রথম..” সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। সত্যিইপ্রথম হতে কে না চাই!” ওকে, এবার বরং বইটার কথায় আসা যাক। কিশোর ভারতীর পাতায় সম্ভবতরহস্যের সিরিয়াল (আমার ঠিক মনে পড়ছে না) নামে এটা শুরু হয়েছিল। বৈশিষ্ট্য? ওই যে আগেই বললাম, ‘বারোয়ারি’! একদম বারোজন। আর এই লেখক তালিকাও কিন্তু কম আকর্ষনীয় নয়। অনীশ দেব, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, সৈকত মুখোপাধ্যায়, হিমাদ্রিকিশোর দাগুপ্ত, নির্বেদ রায়, দীপান্বিতা রায়, অনন্যা দাশ, দেবতোষ দাশ, জয়ন্ত দে, ইন্দ্রনীল সান্যাল, কাবেরী রায়চৌধুরী। বারো কলম। এখন কলম যখন বারো, তখন গল্পের ভালো মন্দ, ভূতভবিষ্যৎ সমস্তটায় বারো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এখন সমস্যা হচ্ছে পুরোটা নিয়ে নিরপেক্ষ বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে প্লট ভালোমতই স্পয়েলড হয়ে পড়ে।

সেক্ষেত্রে একটা কাজ করা যাক। যারা বইটা পড়েননি, তারা নিচের সেকেন্ড ব্র্যাকেট দিয়ে দাগানো অংশটুকু প্লিজ এড়িয়ে যান। থ্রিলারের স্বার্থে। যদি পড়ার মজাটুকু নষ্ট করতে না চান তো। আর যারা পড়েছেন তারা আমার সাথে আসুন……

[১) অনীশ দেব - প্রথম লেখা শুরু করেছেন অনীশ বাবু। মানে গল্পের পরিবেশ আর ভবিষ্যৎ-এর অনেকটাই ছিল তার হাতে। এবং ভয়পাতালের সেই কলম যে তাতে যথেষ্ট যোগ্য তা বোধহয় আর বলে দিতে হবে না। ওঁর লেখনী দিয়ে খুব সুন্দর একটা রহস্য ঘন পরিবেশ তৈরি করেছেন তিনি। সেখানে প্ল্যানচেট এসেছে, পাঁচ বন্ধু এসেছে। আর নার কিশোর সাহিত্যে একরকম অনিবার্যভাবেই যেটা চলে আসে, সেইপ্রাপ্ত বয়স্কএলিমেন্ট দিব্যি কিশোর ভারতীর পাতায় এসে হাজির হয়েছে। কিশোর সাহিত্যে প্রাপ্তবয়স্ক এলিমেন্টএই ব্যাপারটা নিয়ে হালে ভালোরকমই আলোচনা হচ্ছে। পুরনো অনেক উদাহরণও টানা হচ্ছে। আমি বরং জল না ছুঁয়েই, মাছটা ধরি।
হ্যাঁ শিশুসাহিত্যে রাজপুত্র, রাজকন্যার ভালোবাসা থাকে। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কিশোর সাহিত্যের অনেক লেখাতেই উঠে এসেছে - টিউশানের খাতায় লুকিয়ে দেওয়া চিঠি, কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বান্ধবী। কিন্তু সেটা এসেছে কিশোর সাহিত্যের মোড়কেই। সেটা বোধহয় মাথায় রাখলে ভালো হয়। আমরা তো বাচ্চাদের অকালে পেকে যাওয়ার জন্য টিভি, সিনেমা বা ইন্টারনেটকে ভালো দোষারোপ করি। সেই আঙুলটা যাতে ভবিষ্যতে কিশোর সাহিত্যের দিকে না ওঠে সেটা দেখলে ভালো হয় না কি?
যাই হোক, এর জের কিন্তু শেষ লেখিকা অবদি ছিল। তাই প্রথম জনের আরও সতর্ক হওয়া উচিৎ ছিল। ছাড়া আর কিছু বলার নেই। বলা যায় উনি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন।

) ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় - সত্যি কথা বলতে কি উনি ওঁর আগের লেখকের পাশে একটা দাগ দেওয়া  ছাড়া তেমন কিছু করেননি। কোনও টুইস্ট এখানে নেই। তবে থ্রিলটা উনি বে বজায় রেখেছেন।

) অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী - আমরা যারা নার লেখার সাথে পরিচিত তারা ভালো জানি অনীশ বাবুর সাথে সেই লেখনী বা স্টাইলের তফাৎ বেশ অনেকটা। আর উনি জাত এবং মূলতই কিশোর সাহিত্যিক (উল্লেখ্য - নার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তবয়স্ক গল্প আছে) তাই উনি এনেছেন টুইস্ট। এবং নার অধ্যায়টার জন্য আমার তরফ থেকে বিগ ক্লাপ। ওঁর আমদানি করারক্তিমশেষজন অবধি রহস্য জুগিয়ে গেছে। বজায় রেখেছে কুয়াশা।

) সৈকত মুখোপাধ্যায় - অনীশ বাবুর জের এখানে একদম প্রথম লাইনেইকৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি। কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক!” যাই হোক এই ব্যাপার নিয়ে আগেই বলেছি। নতুন করে আর নাই বা চিবোলাম।
উনি কিছু রহস্যের জাল কেটেছেন আবার কতক বুনেছেন। ওনার লেখনীর গুণে আর ভাষায় সবটাই একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে।

) হিমাদ্রিকিশোর দাগুপ্ত - খুব সুন্দর ভাবে অর্ক আর রক্তিমের চ্যাটের বর্ণনা দিয়েছেন। এছাড়াও শ্মশানের বর্ণনা আরও অনেক কিছু খুব ভালো লাগল। তবে একজায়গায় দেখা যাচ্ছে সিতির ছাই থেকে মেটাল ক্যাপসুল উদ্ধার করা হচ্ছে। খুন যখন, তখন নিশ্চয় পোস্ট মর্টেম হবে? তাতে কি মেটাল ক্যাপসুল আগেই ধরা পড়ত না?

) নির্বেদ রায় - আচ্ছা ওঁর ওপর কি তাড়াতাড়ি গল্পের ইতি টানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল? না, মানে নার টার্নে উনি যেভাবে তড়িঘড়ি করে গল্পের বারো বাজানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, তার থেকেই প্রশ্নটা আসছে আর কী!
লজিকের অভাব ওঁর লেখায় মুড়ি-মুড়কি। যেমন একটা ধরা যাক, একজায়গায় লিখেছেন পোস্ট মর্টেম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল সোর্স অ্যাপ্লাই করে। পরে আবার একজায়গায় সিতির পোস্টমর্টেম রিপোর্টের উল্লেখ আছে। মরাল অফ দ্যা কোয়েশ্চেন সেই একই। পোস্টমর্টেম-মেটাল ক্যাপসুল ধরা পড়ল না কেন?
তারপর এখানে দেখা যাচ্ছে অর্ককে ভবানীপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অথচ ঠিক এর আগে অধ্যায়তেই অর্ককে কিডন্যাপ করার সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করা হয়, কারণ অর্ক জেনে গিয়েছিল রক্তিম ভবানীপুরে থাকে। তারপরেও কি অর্ককে ওরা ভবানীপুরে রাখবে? জল ঘোলা করে খাওয়া, লম্বা লম্বা কানের মত? আর যদি রেখেও থাকে, সেক্ষেত্রে তো অর্ককে ভবানীপুর থেকে উদ্ধার করার পরেই প্রথম সন্দেহটা যাওয়া উচিৎ ভবানীপুরের বাসিন্দাটির ওপর। তাই নয় কি?
ওই যে বললাম না, কোনও অজ্ঞাত কারণে উনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন সব শেষ করার জন্য এবং এটা করতে গিয়ে কাঁচা কাঁচা কাজগুলো করে বসলেন এই ধরণের বারোয়ারি উপন্যাসে সকলেরই খুব সতর্কভাবে কলম ধরা উচিৎ। কারণ একটা ভুল পুরো উপন্যাস ডোবানোর জন্য যথেষ্ট!

) দীপান্বিতা রায় - নির্বেদ বাবুরঐতিহাসিক লেখনীরপর একটা স্ট্রং সাপোর্টের দরকার ছিল এবং দীপান্বিতা সেটা ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন। ওঁর থ্রিলার টাইপ কিছু লেখা আগে পড়েছি। সত্যি কথাই বলছি আমার ভালো লাগেনি। বরং উনি আমার কাছেসামারক্যাম্প-এর প্রিয় লেখিকা। কিন্তু বলতেই হচ্ছে এখানে নার পাফরমেন্স দুর্দান্ত! যেভাবে থেমে আসা গল্পটা নিয়ে উনি আবার ছোটা শুরু করেছেন। তার জন্য আরও একটাবড় হাততালিরাখা যেতেই পারে।

) অনন্যা দাশ - বেশ সাবলীল কলম। গল্পের কয়েকটা টুইস্টও দিব্যি উপহার দিয়ে গেছেন। আর থিওরিটিক্যালি কোনও ফল্ট আমি অন্তত পাইনি। বরং রহস্যে বেশ আলাদা একটা মাত্রা যোগ হয় অষ্টম অধ্যায়ে।

) দেবতোষ দাশ - ওঁর অবদান মধুবন্তী সেন! সিনিয়ার আইপিএস। দুর্ধর্ষ এক মহিলা চরিত্র। আর অবশ্যই কল্কি। উনি রহস্যের পর্দা অনেকটাই উঠিয়েছেন। আবার কোথাও জমেছে কুয়াশা। চিন্নির পুলিশকে ধোঁকা দেওয়া, ড্রেস বদল এসব জায়গায় অনেকখানেই বেরিয়ে পড়েছেন বিষকন্যার লেখক এবং তার লেখনী! হ্যাঁ এখানে অ্যাটাকের ডেট কিন্তু ধার্য করা হচ্ছে সেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি!

১০) জয়ন্ত দে দুর্দান্ত। সত্যি কথা বলতে কি আসল থ্রিল অনুভব করেছি এই ১০ নম্বর অধ্যায়ে এসে। আর কিছু বলব না, লেখককে কুর্নিশ!

১১) ইন্দ্রনীল সান্যাল - ভালো লিখেছেন। তবে কয়েক জায়গায় সেই লজিকের গর্ত! . মিশ্র বলছেন ফুলবাগানের ওসি তাকে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য বকাবকি করেছে। কিন্তু সিতির ডেডবডি ছিল পুলিশের আন্ডারে, শুরু থেকেই। তবে উনি ডেথ সার্টিফিকেট দিতে যাবেন কোন দুঃখে? এখানে আবার দেখানো হচ্ছে কল্কির ওপরেও কাঠি ঘোরানোর লোক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক পরিস্কার করেননি লেখক। তবে টুইস্ট একটা বেশ দিয়েছেন ইন্দ্রনীল বাবু।

১২) কাবেরী রায়চৌধুরী - আচ্ছা মেঘনা তো সিদ্ধেশদের বাড়ি প্রথম এসেছিল প্ল্যানচেটের দিন! তাহলে মেঘনা দলে আসে কী করে? আর থানায় বিস্ফোরণ-এর সময় চিন্নি ছিল। আশেপাশে। কিন্তু, ব্লাস্টের সাথে সাথেই নিশ্চয় মিডিয়া ক্যামেরা চলে আসেনি। যে টিভি-তে মধুবন্তী সেন চিন্নিকে দেখতে পেয়ে যাবেন। আর, আগে বলা হয়েছে রক্তিম ছিলো ণামিকা। ওর ল্যাপটপেও সেটা পাওয়া গেছে। তবে মেঘনা রক্তিম হয় কী করে? আর হলেও তো সিতির ফ্ল্যাটে যায় নি। so what about the cash memo of antiviras?
এরকম অনেক ফাঁকফোকর আছে শেষ অধ্যায়ে। তবে ওঁর চাপের কথাও মাথায় রাখতে হবে। এত জনের, এত ভাবে দেওয়া টুইস্ট। সবটাতেই ইতি টানার দায়িত্ব ওঁর ওপর।]

অনেক ফাঁক, অনেক ফোকর। মেঘ, কুয়াশা কিছুটা থেকে গেল শেষের পরেও। তবে বইটা অবশ্যই পড়তে বলব। থ্রিলড হবেন কিনা জানি না। কিন্তু ইতিহাসের সাক্ষী অবশ্য হবেন
________

1 comment: