ডকের পারে
অপর্ণা গাঙ্গুলি
দিম্মা আমাদের বার বার করে বলে দিয়েছিলেন, ‘সোনা মাণিক ছেলেমেয়েরা ডকের পারে যেও না যেন কোনও দিনও। ওখানে চ্যাংমুড়ি কানি, ব্যাঙ্গার মা বেদেনী থাকে।’ দিদিমা যত বলেন আমাদের ওই ডকের পার ততই হাতছানি দেয়।
দুক্কুরবেলা। ইস্কুলের ছুটি পড়ে গেছে আমাদের সব্বার আর তাই না মা মাসি আর আমরা ভাইবোনেরা দিদিমার এই পুরনো বাড়িটাতে থাকতে এসেছি। এই বাড়িটার কত্ত মজা। কলের পার, ছাদ, তুলসীতলা, সিঁড়ির ঘর, ডেমির ঘর, চিলে কোঠা, চৌবাচ্চা, পুরনো লাইব্রেরি ঘর, সব মিলিয়ে একটা ভুলভুলাইয়া যেন। তবে সব থেকে ভালো জায়গা এ
বাড়িটার দালান। তার কোল ঘেঁষে সার সার ঘর আর দালানে কাঠচাঁপা গাছ, একটু দূরেই বাগানে, আমগাছ, তেঁতুল গাছ, গাব গাছ আর তাতে কত্ত রকম কিচির মিচির পাখি আর কাঠবেড়ালির বাসা। আমরা সেই দালানে বসে পা দোলাই, গপ্প করি, কুমির ডাঙ্গা খেলি, চু কিত্ কিত্ বা এক্কা দোক্কা খেলি কখনো সখনো। এই যে বিশাল চবুতরায় আমাদের বসবাস সে কি আর গাছের তেনারা জানেন না? দিম্মা বলেন, দুক্কুরবেলাতে নাকি ভূতে ঢেলা মারে। তা আমরা কোনওদিন ঢেলাটেলা খাইনি বাপু, শুধু যখন ডকের পারের দিক থেকে একটা সিমসিমে হাওয়া দেয়, তখন ওই গ্রীষ্মের দুপুরেও হাত পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসে আর হঠাৎ করে একটা আম পড়ে বা তেঁতুল পড়ে কিম্বা একটা গাব পড়ে ধুপ করে। আর অমনি দুপুরের নির্জনতা কাটিয়ে একটা কাক কা কা করে ডেকে ওঠে। আমরা ওসব গায়ে মাখি না। ভয় ডরের বালাই নেই আমাদের ভাই বোনের, মানে আমার, সিজুর, গাজীর, কালির, পুপুর আর পিউ এর। মামা আমাদের নাম দিয়েছেন ছয়দস্যি। আমাদের চোখে ঘুম নেই। তাই দুপুর বেলা দিদিমা, মা মাসীরা, বুড়ো মা মানে দিম্মার মা, মানদা মাসীরা যখন জানলাতে বেশ করে মাদুর ভিজিয়ে, ঘরে জল ঢেলে ঘর ঠান্ডা করে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘুমায়, আমরা দস্যিচাল্লি করে বেড়াই। তা বলে বাড়ি থেকে বেরুনোর সাধ্যি নেই আমাদের, গেটে মস্ত তালা। যে আমরা দাওয়াতে খেলা করি, চক দিয়ে সারা দাওয়া ভর্তি করে পুতুল, বাড়ি, ধানক্ষেত, ইস্কুল, পথ ঘাট, পাখি, কুকুর আঁকি, বুড়ি বসন্তী খেলি; এই সব আর কী।
তা সেদিন হয়েছে কী, বেশ একটা কী রকম যেন ঘর ছাড়ানো, মন-কেমন-করা হাওয়া দিয়েছে ডকের পারের দিক থেকেই। ওই দিকেই জল, মানে খাল আর ওই দিকের হাওয়াটা ভারী মিষ্টি আর ঠান্ডা। সেই হাওয়াটা গায়ে লাগতেই আমাদের খুব মন কেমন করতে লেগেছে। যেন অনেক দিনের চেনা কোনও সুর আমাদের বুকে বেজেছে আর অনেক দূর থেকে কে যেন ডেকেছে – আয় আয় আয়। আমরা এ
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কে কেমন করে যেন বাড়ির পাঁচিল টপকিয়ে সেই ডকের পারে বিরাট বিরাট গাছে ঘেরা জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছে গেছি, নিজেরাই জানি না। তখন চারিদিক কী শীতল, কী অন্ধকার অন্ধকার, মেঘ অল্প করেছে কিন্তু এ
দিকটাতে যেন রোদ্দুর এসেই পৌঁছয় না। আর সেই ডাক সমানেই বাতাসে শোনা যায় – আয় আয় আয়। বাতাসে কার ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস, কে যেন কাঁদছে হায় হায় হায়। আর আমরা ছয়জন আসতে আসতে কলকে ফুলের গাছটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পা একসাথেই পড়ছে, কেউ আগেপিছে নেই আর সবাই সবার হাত ধরা ।কোঁচর ভরে ফুল কুড়িয়ে চলেছি আমরা, এমন সময় কে যেন পেছন থেকে ডাক দিল না? দূরে ব্যাঙ্গার মা’র বাড়ি আর সেইখান থেকে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে আসছে ব্যাঙ্গার মা। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ, স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি তার আসা, তার যত চুল পা অবধি সাপের মত লম্বা, হাওয়ায় দুলছে যেন লক লকে এক অজগর। তার পরনে একটা লাল শাড়ি, হাতে ব্যাঁকা লাঠি আর মাথায় ঢিপি করা সিঁদুর ঠিক যেমন মা মনসার থানে পাথরের উপর চাপানো থাকে। ব্যাঙ্গার মা তখন হাত দশেক দূরেই, আমাদের দেখে খিলখিলিয়ে হাসে। বলে – ‘তরা ভালো মেয়ে ছেলে গো, আমাকে দেখে ভয় করলো লাই? এখেনে যে কেউ আসে না। আমি নাকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে খাই গো। ফুল, নিবি, ফুল?’ বলেই, বলব কী, চোখের সামনে, দুই হাত দিয়ে ওই অত্ত বড় কলকে ফুলের গাছটিকে ধরে নাড়াতে থাকে ব্যাঙ্গার মা আর ঝর ঝর করে ঝরতে থাকে ফুল। চারিদিকটা হলুদ ফুলে ভরে ওঠে। হাওয়া দেয় তীব্র, আর সেই সঙ্গে হাসির দমক ওঠে – হা হা হা হা হা হা হা হা হা! আর আমরা? আর সেখানে দাঁড়াই? দে ছুট দে ছুট…… মাঠ ঘাট পেরিয়ে সব্বাই এসে বাড়ির দাওয়ায় থামি শেষে আর তাড়া করে ফেরে ব্যাঙ্গার মার গলা, ‘ফুল নিবি নে? ফুল ফুল…. হা হা হা হা হা হা হা হা হা! দ্যাখ রে কত্ত ফুল কুড়িয়েছি তদের জন্যি।’
আর যাইনি সেখেনে। সেই গপ্প শুধু দিম্মাকে বলেছিলাম সন্ধেবেলাতে দিম্মার বুকের ভেতর ঢুকে পড়ে। নিশুত রাত, এখানে তখন খুব আলো যেত, হারিকেনের আলোয় চারিদিকেতে বড় বড় ছায়া পড়েছে আর সব খুব ভুতুড়ে আর মায়াবী লাগছে। সবাই দিম্মার কোল ঘেঁষে বসে বলছি সে কথা। দূরে মানদা মাসি বসে শুনছে। হঠাৎ কী হাসি তার এই কথা শুনে। আর আশ্চর্য, আর কারও না, খালি আমারই কেন যে মনে হয়েছিল ওই আলো আঁধারিতে মানদা মাসির মুখটা অবিকল ব্যাঙ্গার মায়ের মত দেখতে লাগছিল।
বড় হয়ে অনেকবার ভেবেছি ব্যাঙ্গার মায়ের কথা। মনে পড়েছে, তার হাত ভর্তি ফুল তার হিলহিলে খোলা চুলের গোছা আর হা হা আর্তনাদ। তার হাসিটা এখন কানে হাহাকার-এর মত মনে হয়। লোকে তাকে দুষতো। দিম্মা বলেছিলেন ফুলের লোভ দেখিয়ে ওরা ছোটো ছেলেমেয়েদের টেনে নিয়ে যায় তারপর আস্ত গিলে খায়, ওরাই ডাইনি। এখন ভাবি, বুড়ি মানুষটা বড় একা ছিল গো। ওর ছেলে ব্যাঙ্গা মারা যাবার পর ও
হয়তো ছোটো ছেলেমেয়েদের সঙ্গ চাইতো, তাই ফুল দিয়ে ডাকত তাদের। বুড়ো মানুষ, প্রকৃতির জিনিস ছাড়া আর কিই বা দিতে পারত আমাদের। আহা রে, কেন ঘুরে দাঁড়ালাম না, কেন গেলাম না তার কাছে!
হাহাকারটা এখনও বড় গভীর ভাবে বাজে আমার বুকে।
_________
ছবি-পুস্পেন মণ্ডল
লেখক পরিচিতি - অপর্ণা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, এম
এ, বি এড. এবং অ্যাপটেক অ্যারেনা, সিমবায়োসিসের
থেকে এমবিএ ও আইটি ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন। সুনিপুণ
গৃহিণী ও মাতা যেমন তাঁর পরিচয়, অনলাইন জার্নালিস্ট হিসেবেও তিনি কর্মরতা বটেন। একাধারে গল্পকার, শিল্পী
ও আবৃত্তিকার অপর্ণার ইংরেজি ও বাংলা উভয় সাহিত্যের অঙ্গনে অনায়াস, বলিষ্ঠ
গতায়াত গত ৭ বছর ধরে। তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয় বিভিন্ন আন্তর্জাল
পত্র-পত্রিকায়। প্রকাশিত বই: নারায়ণী পুতুল, চুড়িওয়ালী
গলি ও অন্যান্য গল্প (ছোট গল্পের সংকলন)।
দারুণ...... অপর্ণার লেখা ভাল না হয়ে যায়?
ReplyDeletemisti
ReplyDelete