গল্পের ম্যাজিক:: বানর বউ - রাজীবকুমার সাহা


বানর বউ
রাজীবকুমার সাহা

অনেক কাল আগেকার কথা এক প্রত্যন্ত গ্রামে বাস ছিল এক জুমিয়া পরিবারের এ গাঁয়ের মোড়লকে বলা হত নারান স্ত্রী আর সাত পুত্র নিয়ে বৃদ্ধ নারানের ছিল সুখের সংসার
বৃদ্ধ নারান তাঁর সাত পুত্রের বিয়ে দেওয়ার মনস্থ করলেন ছেলেদের ডেকে বললেন, “বাবারা, আজ আছি কাল নেই, ভালোমন্দ কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগে আমার পুত্রবধূদের মুখ দেখে যেতে চাই
এই বলে ছেলেদের পুলকিত মুখগুলোর পানে তাকিয়ে অত্যন্ত আমোদ বোধ করলেন তারপর আবার বললেন, “বয়সের ভারে গাঁ গাঁ ঢুঁড়ে কনের সন্ধান করার সামর্থ্য আমার যে নেই সে তোমরা বিলক্ষণ জানো তাই আমি অন্য এক উপায় ভেবেছি
সেটা কী, বাবা?” সমস্বরে প্রশ্ন ওঠে
জবাবে বৃদ্ধ বলেন, “তোমরা নির্দিষ্ট এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তির ছুড়বে যার যেদিকে মন চায় যার তির যে ঘরের চালে গিয়ে বিঁধবে সে ঘরের কন্যাই হবে তার স্ত্রী
ছেলেরা অমত করল না
নির্দিষ্ট দিনে টিলার মাথায় একটা খোলা জায়গা বেছে নিয়ে জড়ো হল সবাই সাত ছেলের হাতে তির-ধনুক তাদের ঘিরে রয়েছেন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর অগুনতি দর্শক শুরু হল তির ছোড়া
বৃদ্ধ প্রথমে তাঁর প্রথম পুত্রকে তির ছুড়তে আদেশ করলেন তারপর একে একে বাকি ছয় পুত্র প্রথম ছয় পুত্র নিজেদের ইচ্ছেমতো দিক নিশানা করে তাদের কনে নির্বাচন করে নিলে কিন্তু মন্দভাগ্য কনিষ্ঠ ছেলের ছোড়া তির গিয়ে আটকালে এক গাছের মরা ডালে অথচ এই ছেলের মতো দক্ষ তিরন্দাজ আশেপাশের দশ গাঁ খুঁজলেও মেলা ভার সমবেত দর্শক প্রত্যেকেই যারপরনাই বিস্মিত হল
তবে বিস্ময়ের সেখানেই শেষ নয় গাছের নিচে পৌঁছে দেখা গেল, সে গাছের শেকড়ের কোটরে লেজ গুটিয়ে চুপটি করে বসে পিট পিট তাকাচ্ছে এক বানরী নারানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে বানরীর সঙ্গেই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহ সম্পন্ন হল
নারান কনিষ্ঠ পুত্রের অকর্মণ্যতায় এতটাই রুষ্ট হলেন যে, বিবাহের অব্যবহিত পরেই বউ সমেত তাকে গাঁয়ের সীমানার বাইরে গিয়ে বসবাসের আদেশ শোনালেন বানর-বউ নিয়ে কোনও মানুষের পক্ষে এ সমাজে বাস করা চলে না নারানের স্ত্রীর কোনও অনুরোধ উপরোধই কাজে এল না নারান বানর-বউয়ের মুখ দর্শন করতে রাজী নন
যেহেতু নারানের স্ত্রী ছোটো ছেলেকেই সবার চাইতে বেশি ভালোবাসতেন তাই তিনিও ছোটো ছেলের সঙ্গে চলে গেলেন গাঁ ছেড়ে চোখের জলে বিদেয় নিল তিনজনে বৃদ্ধা মা আর বানরী স্ত্রীকে নিয়ে ছেলে গাঁয়ের বাইরে গিয়ে ঘর বাঁধল
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে - নারানেরও দিন ঘনিয়ে আসে
একদিন সব ছেলেদের ডেকে পাঠালেন বৃদ্ধ বললেন, “আমার হাতে আর সময় বেশি নেই বুঝতে পারছি বিলক্ষণ একদিন আমার সকল পুত্রবধূদের হাতের রান্না খেতে সাধ জেগেছে কাল সকালে তোমরা সে ব্যবস্থা কোরো
ছোটো ছেলে বাড়ি ফিরে বাবার সাধের কথা মাকে জানিয়ে আক্ষেপ করে, “হায়, হতভাগা এক আমিই বাবার সে সাধ পূরণ করতে অক্ষম কী যে কষ্ট হচ্ছে মনে
বানর-বউ কোন ফাঁকে স্বামীর কথা শুনে ফেলল রাত গভীর হলে সে এক সুন্দরী নারীর রূপ ধারণ করে পরিপাটি করে নানাবিধ ব্যঞ্জন রেঁধে পাত্র ভরে রেখে দিল ঘুমন্ত স্বামীর পাশে ছোটো ছেলে ঘুম ভেঙে পাত্রভরা খাদ্য দেখে বেজায় অবাক হয়ে গেল এ কোন দৈববল? সে আর বিলম্ব না করে সে-পাত্র গামছায় বেঁধে নিয়ে ছুটে চলল বাবার কাছে
নারান একে একে সব ছেলের আনা খাবার চেখে দেখলেন আনন্দে ভরে উঠল তাঁর মন ছোটো ছেলে খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল পুঁটুলি হাতে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন বৃদ্ধ খাবার খুলে সামনে রাখতে বললেন আর তারপরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা সারা ঘর, বাড়ি ম ম করতে লাগল সুগন্ধি খাবারের সুবাসে আর আশেপাশের পাড়াপ্রতিবেশীরা ছুটে ছুটে আসতে লাগল সে সুগন্ধির টানে উপস্থিত সকলে থ হয়ে গেল একেবারে
বৃদ্ধ খেতে শুরু করলেন একেকটা পদ মুখে দেন আর মাথা নাড়েন শেষে খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, “ছোটো বৌমার হাতের রান্নার মতো খাবার আমি এ জীবনে আর খাইনি কখনও কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি প্রত্যেকটাই অমৃত সমান
খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বৃদ্ধ এবারে নতুন আবদার ধরলেন তিনি এবারে সব ছেলেবউয়ের হাতে বোনা সর্বোৎকৃষ্ট কাপড়ের পোশাক পরতে চান
যথা ইচ্ছা তথা কর্ম ছেলেরা যে যার ঘরে ফিরে গেল বাবার নতুন সাধ মেটাতে স্ত্রীদের যথাশীঘ্র জানাতে হবে তা
ছোটো ছেলে নিজের ঘরে ফিরে আদ্যোপান্ত খুলে বলল মাকে আবারও আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার গলায়, “আমার বউ তো আর মানুষ নয় যে সুতো কেটে পোশাক তৈরি করে দেবে বাবার এ সাধ আর পূর্ণ করা সম্ভব হল না আমার
মা আশ্বাস দেন, “ভাবিস না বাবা, মাথার ওপর ঈশ্বর রয়েছেন, তাঁকে স্মরণ কর
বানর-বউ যথারীতি আড়ালে কান পেতে শুনল সে কথা সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নিশুতি রাতে সে চলে গেল তার মায়ের কাছে স্বয়ং স্বর্গের ইন্দ্রাণী তার মা ভোরের আগেই ফিরে এল একটা সুদৃশ্য বাক্স হাতে
সকালে ছোটো ছেলে ঘুম ভেঙে উঠে প্রথমেই দেখে শিয়রের পাশেই কে এক ঝকমকে বাক্স রেখে দিয়েছে ভেতরে থরে থরে মখমলি কাপড় সাজানো সে বাক্স হাতে দৌড়ল বাবার কাছে ততক্ষণে বড়ো ভাইয়েরাও হাজির হয়েছে একে একে স্ত্রীদের বোনা কাপড় হাতে কিন্তু বৃদ্ধের সবচেয়ে পছন্দ হল ছোটো বউয়ের বোনা কাপড় অন্য ভাইদের মুখ চুন হয়ে গেল
রাশি রাশি আশ্চর্য সব পশুপাখি আর রং বাহারি নকশায় বোনা সে মোলায়েম কাপড় হাতে নিয়েই বৃদ্ধের কেমন একটা সন্দেহ হল অসম্ভব! এ কাপড় বোনা কোনও মানুষের দ্বারা সম্ভব নয় ছোটো বউ নিশ্চয়ই কোনও ছদ্মবেশী তিনি ছোটো বউয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের মনস্থ করলেন ছেলেদের ডেকে বললেন, “শোনো তোমরা বৌমারা আমার জন্যে রেঁধেবেড়ে খাবার পাঠিয়েছে, কাপড় বুনে দিয়েছে, আমি তাতে অত্যন্ত খুশি হয়েছি দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ নেই আগামী সোমবার তোমরা তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এসো আমার কাছে যাতে চোখ বোজার আগে আমি তাদের মুখ দেখে যেতে পারি
সে সোমবারের আগের রাতে ছোটো ছেলে আর তার মা গভীর নিদ্রায় মগ্ন বানর-বউ সে সুযোগে পৌঁছে গেল তার মায়ের কাছে স্বর্গে আর তাঁর কাছ থেকে চেয়ে আনলে এক জাদু আংটি জাদু আংটিকে হুকুম করতেই সে নিমেষে সুরম্য এক রাজপ্রাসাদ তৈরি করে তাতে সান্ত্রী-সেপাই, সোনাদানা আর হাতিঘোড়ায় ভরে তুললে বানর-বউ তার শাশুড়িমাতাকে যথাস্থানে রেখে ঘুমন্ত স্বামীকে শুইয়ে দিল এক সোনার পালঙ্কে আর নিজে বানরী-রূপ ছেড়ে রাজকন্যের বেশে শুয়ে রইল রুপোর পালঙ্কে
রাতে হঠাৎ জেগে উঠে ছোটো ছেলের চোখ তো ছানাবড়া চোখ কচলে দেখে সে সোনার পালঙ্কে বসে রয়েছে আর পাশেই রুপোর পালঙ্কে অপরূপ এক রাজকন্যে সুখনিদ্রায় মগ্ন রাজকন্যের বিছানার পাশে পড়ে আছে এক বানরের ছাল-চামড়া বুঝতে কিছুই বাকি রইল না তার সে তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে সে ছাল-চামড়া আগুনে নিক্ষেপ করল যাতে তার স্ত্রী আর কোনোদিন সে-রূপে ফিরে যেতে না পারে
পরদিন সোমবার নারানের ছয় বৌমা তাঁর সামনে হাজির হয়েছে, কিন্তু ছোটো বৌমা আসেনি নারান বিশ্বস্ত কজন অনুচরকে পাঠালেন ছোটো বৌমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার অভিমান ভাঙিয়ে তাঁর কাছে নিয়ে আসতে
আধবেলা পরেই তারা এসে জানাল, “আপনার ছোটো বৌমা সাধারণ কোনও বানরী নন, নারান তিনি এক অতীব সুন্দরী রাজকন্যে মন্ত্রী-সান্ত্রী, হাতিঘোড়া নিয়ে প্রকাণ্ড রাজপ্রাসাদে বাস করছেন
নারান অশক্ত শরীরেই রওনা হলেন সে রাজপ্রাসাদ অভিমুখে পৌঁছে দেখলেন, তাঁর অনুচরেরা একবর্ণও মিথ্যে বা বাড়িয়ে বলেনি তিনি হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলেন রাজপ্রাসাদের পানে ছোটো ছেলে আর রাজকন্যে খবর পেয়ে সিংহদরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে যথাবিহিত আদর আপ্যায়নে বাবাকে নিয়ে গেল অন্দরমহলে ছোটো বৌমা আর কেউ নয়, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যা জেনে নারান অত্যন্ত প্রীত হলেন বৌমা জানাল, “দেবরাজ ইন্দ্র আমার পিতা তিনি একদা অত্যন্ত রুষ্ট হয়ে আমাকে বানরী-রূপে পরিণত হয়ে যেতে অভিশাপ দিলেন আমার মা পিতার হাতে-পায়ে ধরে অনেক অনুনয় বিনয় করলেন; কিন্তু পিতার মন গলানো গেল না আমি নিজের রূপ আর ফিরে পেলাম না তবে তিনি শেষে এটুকু বললেন যে, কোনও মানব যদি কখনও আমায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে তবে একদিন সঠিক সময়ে আমি নিজের রূপ পুনরায় ফিরে পাব গত রাত ছিল আমার সে সঠিক সময়
ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ নারান করজোড়ে বললেন, “আমাকে তুই ক্ষমা করে দে, মা না চিনে তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি
বৃদ্ধ নারান তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ছোটো ছেলে-বৌমার সঙ্গে রাজপ্রাসাদেই বাস করতে লাগলেন অচিরেই মস্ত ধুমধাম করে রাজকন্যের সঙ্গে পুনরায় বিয়ে দিলেন ছেলের সবাই অনন্ত সুখে দিন অতিবাহিত করতে লাগল
_____
(ত্রিপুরদেশের লোককাহিনি)
ছবিঃ মৈনাক দাশ

1 comment: