গল্পের ম্যাজিক:: অভিশপ্ত সেই রত্নভাণ্ডার - দেবদত্তা ব্যানার্জী


অভিশপ্ত সেই রত্নভাণ্ডার
দেবদত্তা ব‍্যানার্জী

(১)

সকাল বেলা খবর কাগজ পড়তে পড়তে রাজেশ বাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “সেই এক খুন আর চুরি ডাকাতি। এর বাইরে খবর হয় না। পরশু আবার শিলিগুড়িতে এক চাইনিজ ট্যুরিস্ট খুন হয়েছে। ঘুরতে এসেও শান্তি নেই। সরকার আবার সিবিআই তদন্ত করতে চাইছে যদি চিনা গুপ্তচর বা স্মাগলার হয়!!
ওনার স্ত্রী টেবিলে জলখাবার সাজাতে সাজাতে বললেন, “ওসব খবর না পড়লেই পারো। কি দরকার পড়ার!!

রুবাই স্কুলের থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণে রাজগির যাবে। দুপুরে ট্রেন। ব্যাগ গুছাতে গুছাতে বাবা-মায়ের আলোচনা শুনে ভাবছিল এখুনি না ওর উপর এর প্রভাব এসে পড়েরুবাইয়ের বাবা রাজেশবাবু ডাক্তার, মা শ্রমণাদেবী মেয়েদের স্কুলের বড়দি। তাই একটু কড়া শাসনেই থাকতে হয় ওকে। ওর আবার একটু শখের গোয়েন্দা হওয়ার প্রবণতা আছে। দুবার বেশ কিছু সমাজ বিরোধী ওর জন্য ধরা পড়ায় আজকাল মা-বাবা ওকে একটু গুরুত্ব দেয়। এই প্রথম এমন ভাবে স্কুল থেকে ঘুরতে যাওয়ার পারমিশন পেয়েছে ও। স্কুলের ইতিহাস স্যার প্রলয়দা, ভূগোল স্যার অর্কদা আর গেমস টিচার অন্বয়দার সঙ্গে ওরা মোট তিরিশ জন যাচ্ছে রাজগির নালন্দা।
মা নিজে ওকে ট্রেনে তুলতে এসেছিল। এক ঘণ্টা লেটে ক‍্যাপিটাল এক্সপ্রেস আসতেই ওরা নির্দিষ্ট কামরায় উঠে পড়েছিল। মা অন্বয়দাকে খুব ভরসা করে। কারণ রুবাইয়ের আগের দুটো ঘটনাতেই অন্বয়দার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ছ’ফুট হাইটের ছিপছিপে চেহারার অন্বয়দা সায়েন্স নিয়ে পড়লেও খেলাধূলায় জেলার সেরা। খেলার টিচার হিসাবে ওদের স্কুলে আজ তিন বছর ধরে রয়েছে অন্বয়দা। ক্যারাটেও শেখে ওরা অন্বয়দার কাছে।
অর্কদা আর প্রলয়দাও ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেএই তিন জন স্কুলের সবার প্রিয় স্যার। চা বাগানের বুক চিরে ট্রেন এগিয়ে চলেছে পাহাড়ের দিকে। এই পথে দুটো গুহা পড়ে তিস্তা-ব্রিজে ওঠার আগে। ব্রিজ পার হলেই মহানন্দা অভয়ারণ্য।
ট্রেনের এস থ্রি কোচের নয় থেকে আটত্রিশ ওদের সিট। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সবাই গুছিয়ে বসল। অর্কদার সঙ্গে কিছু ছেলে অন্তাক্ষরি খেলছিল। রুবাই আর আকাশ প্রলয়দাকে ধরল রাজগির আর নালন্দার গল্প বলার জন্য। প্রলয়দা বলছিল রাজগৃহের স্বর্ণযুগের গল্প।
“বিহার নামটা এসেছে বৌদ্ধ বিহার থেকে। ভারতের এই অঞ্চল তখন সর্বাপেক্ষা উন্নত। বুদ্ধদেবের উপাসকরা জায়গায় জায়গায় বিহার বা আশ্রম তৈরি করে সেখানে সাহিত্য চর্চা, শিক্ষা, চিকিৎসা এসবের ব্যবস্থা করত। সাতটি পাহাড়ে ঘেরা মগধের রাজধানী ছিল রাজগির। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৩ - ৪৯২ বিম্বিসার ছিলেন এই বৃহৎ ভূ-খণ্ডের অধিপতি। বুদ্ধদেব ওনার পরম মিত্র। এদিকে দেবদত্তর প্ররোচনায় অজাতশত্রু পিতাকে বন্দি করল। রবীন্দ্রনাথের পূজারিণী সেই আঙ্গিকে লেখা। যাই হোক তখনকার দিনে এভাবেই সবাই রাজা হত। পিতাকে বন্দি করে পুত্র সিংহাসনে বসতেই রাজ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হল।”
গল্পের মধ্যেই ট্রেন ঢুকে পড়েছিল এনজেপি। উনচল্লিশ আর চল্লিশ সিটে দুই সাদা চামড়া উঠে বসতেই ট্রেন চলতে শুরু করল। তবে চামড়া সাদা হলেও চোখ-মুখ বলছে ওঁরা চিন বা জাপানের লোক। প্রলয়দা গল্পে ফেরার আগেই সবাই মিলে দুটো ঝালমুড়িওয়ালাকে পাকড়াও করেছিল। লাঞ্চ করে বেরিয়েছিল সেই কখন। হালকা খিদে সবার পেয়েছে। অন্বয়দা এই ঝালমুড়ি স্পনসর করল। আনারস বাগান চিরে ট্রেন চলেছে আলুয়াবাড়ির পথে। উত্তর দিকে আবছা হয়ে আসছে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাতছানি। প্রলয়দা দুই বিদেশির সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিয়েছিল ওঁদের গন্তব্য পাটনা। ওঁরা ট্যুরিস্ট। একজন স‍্যু শে তাং, অন্য জনের নাম কিয়াং সিংলাই। ওঁরা গয়া, নালন্দা, রাজগির এসব যাবেন। গয়া যে কোনও বৌদ্ধিষ্টদের পবিত্র তীর্থ। কামরার প্রথম অংশে দু’জন লামা উঠেছিল। ওঁরাও বোধহয় গয়ায় যাচ্ছেন।
রুবাইরা বুঝতে পেরেছিল গল্প আর জমবে না। ও আর আকাশ লুডো নিয়ে উপরে উঠে গেছিল। তিরিশ জন ছাত্র একসঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছে। হাহা হিহি তো হবেই। সারা ট্রেন ওদের বকবকানিতে বিরক্ত। ট্রেন যা লেট, ভোর চারটের আগে ওরা বখতিয়ারপুর পৌঁছবেও না। রাতের খাবার স্কুল ক্যান্টিন থেকে বানিয়ে এনেছিল অন্বয়দা, আলুর দম, লুচি, আর কালাকান্দ। খাওয়া মিটতেই দশটা, ঠিক হয়েছিল পালা করে ঘুমোবে ওরা। অক্টোবর মাস। না গরম, না ঠাণ্ডা, সুন্দর ওয়েদার। প্রলয়দাকে এবার ধরেছিল রুবাই, আকাশ আর ময়ূখ গল্পর জন্য। ওদের প্রথম রাতটা জাগার কথা।
প্রলয়দা একে একে বলছিল রাজগিরের বিভিন্ন ঘটনা। নালন্দার গল্প। কোরান খুঁজে না পেয়ে বখতিয়ার খিলজী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বই। বিভিন্ন দেশ থেকে সে সময় ছাত্র আসত নালন্দায় পড়তে। সব শেষ করে দিয়েছিল বখতিয়ার।
ঐ দুই ট্যুরিস্ট না ঘুমিয়ে ওদের গল্প শুনছিল। হঠাৎ একজন ওদের জিজ্ঞেস করে, “আর ইউ বৌদ্ধিষ্ট? ডু ইউ নো দা হিষ্ট্রি অফ সোন ভান্ডার ?
প্রলয়দা একটু হেসে ইংরাজিতে বলে যে আমাদের মধ্যে কেউ হিন্দু, কেউ মুসলিম, কেউ শিখ, কেউ জৈন, কেউ মারোয়াড়ি, কেউ খ্রিষ্টান, হ‍্যাঁ রাজনরা বৌদ্ধিষ্ট।
লোকটার ছোটো বুজে আসা চোখ বড়ো হয়ে গেছিল শুনে। অন্বয়দা ওকে বুঝিয়ে বলে ভারতে বহু ধর্মের লোক রয়েছে পাশাপাশি, একসঙ্গে।
লোকটা বেশ খুশি হয়। হঠাৎ ওর বন্ধু ওকে চিনা ভাষায় কিছু বলতেই ও আবার সোন ভাণ্ডার সম্পর্কে জানতে চায়। এই গল্পটা প্রলয়দা ক্লাসেও বলেছিল একদিন। রুবাইয়ের মনে ছিল। প্রলয়দা বলে যে বিম্বিসারকে ওর ছেলে অজাতশত্রু যখন বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল, বিম্বিসারের বিশাল রত্ন ভাণ্ডার যাতে ছেলের হাতে না পড়ে, রানি তাই বৈভার পর্বতের এক গুহায় লুকিয়ে রাখে। এক তান্ত্রিককে দিয়ে গুহার দরজা বন্ধ করিয়ে দেয়। আর পাশের দেওয়ালে শঙ্খলিপিতে কিছু সূত্র লিখে রাখে।
কিন্তু সে ধন ভাণ্ডার আজও ওভাবেই পড়ে রয়েছে। গুহার দরজা কেউ খুলতে পারেনি। ইংরেজ সরকার কামান দেগেও পারেনি ঐ দরজা খুলতে। কামানের গোলাও ব্যর্থ হয়েছে। শঙ্খলিপি সে সময় খুব কম লোক জানত। নালন্দায় হত সে লিপির পঠনপাঠন। কিন্তু বখতিয়ার খিলজী নালন্দার সব বই জ্বালিয়ে দেওয়ায় সে লিপির পাঠোদ্ধার আর সম্ভব হয়নি। তবে অনেকে বলে এটা একটা মিথ। সত্যি মিথ্যা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

আকাশ এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার বলে, “স্বাধীন দেশে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও খনন কার্য চালানো হয়নি কেন? অত বড়ো ধন ভাণ্ডার তো সরকারী সম্পত্তি। দেশের কত উন্নয়নে লাগত।”
“না, ঠিক তা নয়, ধন ভাণ্ডার পাওয়া গেলে হয়তো মিউজিয়ামে থাকত। তার আগে কিছু চুরি খুন জখম হত। তাই সরকার মাথা ঘামায়নি। নালন্দার খনন কার্যই তো আজ কত বছর বন্ধ। এমন বহু ঐতিহাসিক জিনিস এ দেশে অবহেলিত।”

চাইনিজ লোক দুটি আবার নিজেদের ভাষায় গল্পে মগ্ন হয়ে পড়েছিল। রাত একটা নাগাদ একটা আপার বার্থে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রুবাই। অর্কদা বলেছিল সবাইকে ডেকে দেবে।

()

একটা সরু অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর মশাল হাতে হামাগুড়ি দিয়ে ও আর আকাশ এগিয়ে চলেছে। সামনে একটা পাথরের দেওয়াল। তার উপর অজানা ভাষায় কিছু লেখা।
হঠাৎ পাশের একটা বেদির ওপর আড়াআড়ি ভাবে রাখা পাথরটা ঘোরাতে শুরু করল রুবাই। আর চিচিং ফাঁকের মতো খুলে গেল দরজা। মশালের আলোয় ঝকমকিয়ে উঠল হাজার মণিমাণিক্য। চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল ওসব দেখে। ওরা দুজন ঢুকতে যেতেই উপর থেকে পাথর পড়তে শুরু করেছিল। হঠাৎ ওরা লক্ষ করল বেশ কিছু কঙ্কাল পড়ে রয়েছে চারপাশে। ওদিকে পাথর পড়ে বন্ধ হতে বসেছে বেরোবার সরু পথ। হঠাৎ মনে হল ওদের নাম ধরে কেউ ডাকছে। বহু দূর থেকে ভেসে আসছে সে ডাক। ধড়মড় করে উঠে বসেছিল রুবাই। প্রলয়দা ডাকছিল, ট্রেন ঢুকছে বখতিয়ারপুরে। সবাই প্রায় রেডি নামার জন্য। রুবাই লাফ দিয়ে উঠে পড়ে।
ছোট্ট স্টেশনের ঘুম তখনো ভাঙেনি। ওরা ছাড়া আর কেউ নামল না ওখানে। তিরিশ জন ছাত্র সহ তেত্রিশ জনের দলটার কোলাহলে দুটো কুকুর ভৌ ভৌ করে ডেকে ওদের বিরক্তি জানাল। আগে থেকে ওদের বড়ো বাস বুক করাই ছিল। স্টেশনের বাইরে বেরিয়েই গাইড আর বাসটা দেখতে পেল ওরা। একটা চাওয়ালা সবে উনুন ধরিয়েছে। হৈ হৈ করে সবাই চা খেতে ঢুকে পড়ল। অর্কদা বলেছিল বাসে দেড় ঘণ্টা লাগবে রাজগির পৌঁছতে। অক্টোবরের শেষ, হালকা কুয়াশায় মাখা চারপাশ, হাওয়ায় শিরশিরে আমেজ। বাস ছুটে চলল ইতিহাসের পথ ধরে এক প্রাচীন জনপদ রাজগৃহের দিকে।
সরকারি অতিথিশালায় উঠেছিল ওরা, সব ডবল বেড রুমে তিনজন করে, উপর নিচ মিলিয়ে এগারোটা ঘর। আকাশ আর রুবাই অন্বয়দাকে ছাড়েনি। ওরা দোতলার একটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল অন্বয়দাকে নিয়ে। প্রলয়দা বলেছিল সবাইকে ফ্রেশ হয়ে ন’টায় ডাইনিং-এ আসতে। জলখাবার খেয়ে দশটায় গাড়ি ছাড়বে। প্রথম ওরা রোপওয়েতে চড়বে ঠিক হল। রাজগিরের রোপওয়ে বহু পুরোনো এবং চেয়ার কার, অনেকটা নাগরদোলার মতো। চারদিক খোলা এই রোপওয়ের একটা আলাদা ঐতিহ্য আছে। বিশাল লাইন দিয়ে টিকিট কেটে ওরা রোপওয়েতে চড়তে পারল। রোপওয়ে গুলো থামে না, দুটো লোহার চাকতি ঘুরেই চলেছে, ঘুরতে ঘুরতেই চড়তে হবে এবং নামতে হবে। তবে ওরা সাহায্য করে। পাহাড়ের মাথায় একটা বুদ্ধ শান্তি স্তূপ রয়েছে। সেটাই দেখতে যাচ্ছে সবাই। উপর থেকে বেশ লাগছিল চারপাশটা দেখতে।
এরপর ওরা গেল জরাসন্ধের আখড়া দেখতে। ধংসস্তূপের মধ্যে একটা অংশ দেখিয়ে গাইড বলল এখানে ভীমের সঙ্গে জরাসন্ধের তেরো দিন ব্যাপী মল্ল যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর লুপ্তপ্রায় জরাসন্ধের প্রাসাদ দেখে ওরা গেল রথের চাকার দাগ দেখতে। কাদা মাটি শুকিয়ে পাথর হয়ে গেছে। একটা গর্ত দেখিয়ে গাইড বলছিল মহাভারতের কথা। এই নাকি অর্জুনের রথের চাকার দাগ। রুবাইয়ের মন পড়ে রয়েছে সোন ভাণ্ডারের দিকে। ভোর রাতে দেখা স্বপ্নটা বার বার মনে পড়ছিলহঠাৎ ও টাঙ্গায় করে দু’জন লামাকে যেতে দেখে আকাশকে দেখাল। ওদের ট্রেনের সেই লামা দুটো মনে হল ওর।
“সব লামাদের আমার একই রকম লাগে রে। ওরা অবশ্য আগেই নেমে গেছিল কোথাও। আমি নামার আগে ওয়াশ রুমে যেতে গিয়ে ওদের ফাঁকা সিট দেখেছি,” আকাশ বলল।
এর পরেই ওরা গেল বহু প্রতীক্ষিত স্বর্ণ ভাণ্ডারে। গুহা কক্ষটিতে বহু বৌদ্ধ মূর্তি খোদাই করা। গাইড প্রলয় স্যারের বলা সেই গল্পটাই বলল। দরজার আদলে অংশটি পাথর দিয়ে আটকানো। দেওয়ালে কিছু লিপি খোদাই করা। একটা ফাটল দেখিয়ে গাইড বলল ওটা কামানের গোলার দাগ। কামান দেগেও কিছু করা যায়নি। অনেকে এটাকে জরাসন্ধের ধনভাণ্ডারও বলে। গুহার ভেতর কক্ষের ভেতর রয়েছে সেই সুড়ঙ্গ। এক জৈন সাধু ওখানে তপস্যা করত। রানি সেখানেই গচ্ছিত রেখেছিল সব সম্পদ।
রুবাই ভিড়ের মধ্যে লামা দুটোকে দেখতে পেয়েছিল। ওদের একজনের কাঁধে কমলা হলুদে একটা ঝোলা ব্যাগ যা কাল ট্রেনেও ছিল। ওকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্বয়দা বলল, “ওভাবে দেখিস না, ওরা আগের স্টেশনে নেমে গেছিল ভোরে। সেখান থেকে বাই রোডে প্রায় একই সময় লাগে এখানে আসতে। হয়তো ওদের পরিচিত কেউ ওখানে ছিল।”
রুবাই লজ্জা পেয়ে এগিয়ে গেল।

পরের গন্তব্য বেণুবন। রাজা এই বন উপহার দিয়েছিল বুদ্ধদেবকে, বর্তমানে এটা একটা পার্ক। জৈন মিউজিয়াম দেখে ওরা গেল উষ্ণ প্রস্রবণ দেখতে, মকদুম কুণ্ডটি মুসলিমদের পবিত্র তীর্থ, পাশেই সপ্তধারা, জৈন এবং হিন্দুদের দখলে। পাহাড়ের বুক চিরে ভূগর্ভস্থ জল এসে পড়ছে, কোনোটা বেশি গরম, কোনোটা একটু কমউগ্ৰ সালফারের গন্ধ। জায়গাটা বেশ নোংরা। অর্কদা বলল, “খনিজ মিশ্রিত এই জল চর্মরোগ দূর করে বলে এত লোক এতে স্নান করছে।”

সন্ধ্যায় ট্রেনে দেখা ঐ দুই ট্যুরিস্টকে দেখল ওদের হোটেলে। প্রলয়দা আর অর্কদা কথা বলে এল। কিন্তু ওঁরা একটু যেন গম্ভীর। পরদিন রুবাইদের নালন্দা আর পাওয়াপুরি যাওয়ার কথা। সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল।

()

পরদিন সকালে ঠিক দশটায় ওরা রওনা দিল পাওয়াপুরির উদ্দেশে। মহাবীরের দেহ এখানে পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছিল বলে হাজার হাজার মানুষ এখানকার মাটি ও ছাই সংগ্ৰহ করেছিল। সেই খননে এখানে একটা জলাশয় তৈরি হয়। বর্তমানে রয়েছে একটা খুব সুন্দর জলন্দির। পদ্ম ফুটে রয়েছে চারপাশে। প্রচুর পাখি চোখে পড়ল। এসব দেখে ওরা পৌঁছল নালন্দায়।  প্রথমেই মিউজিয়াম ঘুরে দেখল সবাই। পোড়া চাল ও পোড়া বাসন এখনও সংরক্ষিত আছে এখানে। দুপুরের খাবার খেয়ে গাইড ওদের নিয়ে গেল ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনে। ছাত্রদের আবাসস্থল, ক্লাসরুম, মন্দির, ধ্যান কক্ষ এসব দেখতে দেখতে ওরা পৌঁছে গেছিল সেই সব লাইব্রেরি ঘরে। পোড়া দেওয়াল ইতিহাসের লজ্জার অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছয় মাস ধরে নাকি সব পুঁথি পুড়েছিল। ভারত শিক্ষাদীক্ষায় ছিল পৃথিবীবিখ্যাত একটি দেশ। চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে হিসাবশাস্ত্র, সাহিত্য সব পড়ানো হত এখানে। শিক্ষার্থীরা বিনা পয়সায় পড়ত। দেশ বিদেশ থেকে সবাই আসত এখানে শিক্ষা গ্ৰহ করতে।
একধারে সমাধি ক্ষেত্র। বুদ্ধের প্রিয় শিষ‍্য এবং বহু শিক্ষার্থীর সমাধি রয়েছে। এসব জায়গা দেখলেই রুবাইয়ের মনটা ভার হয়ে যায়।
বিকেলে হোটেলে ফিরেই ওরা দেখল বেশ কিছু পুলিশ এসেছে। হঠাৎ এক অফিসারকে দেখে অন্বয়দা বলল, “আরে, কমলেশ তুই?
ছিপছিপে চেহারার পুলিশটি অন্বয়দাকে দেখে বেশ অবাক। জানা গেলো ওরা একসঙ্গে খেলাধূলা করত। দুজনেই ছোটোবেলার বন্ধু। কমলেশ পুলিশের চাকরি পেয়ে এখন এখানে রয়েছে। ওঁর থেকেই ওরা শুনল, একটা ছোটো দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুই চাইনিজ ভদ্রলোক স‍্যু শে তাং আর সিংলাই টাঙ্গায় করে ঘুরতে বেরিয়েছিল। ওদের টাঙ্গায় হঠাৎ করে একটা গাড়ি ধাক্কা মারে। একজনের হাত ভেঙ্গেছে। অন্যজন চোট পেয়েছে কোমরে ও পায়ে। ওদের ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে। ওঁরা ফরেন ট্যুরিস্ট, তাই পুলিশ বেশ তৎপর। কমলেশজির সঙ্গে অন্বয়দা আর প্রলয়দা গেছিল ভদ্রলোকদের দেখতে। ট্রেনে আলাপ ভালোই জমেছিল ওদের সঙ্গে। রুবাই ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারেনি। একটু পরেই গম্ভীর মুখে অন্বয়দা ফিরে এল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল অন্বয়দা। রুবাই এসে বলল, “কী হয়েছে?
“ওদের উপর অ্যাটাকটা এমনি এমনি হয়নি। চুরিটাই উদ্দেশ্য মনে হয়। কিন্তু কী ছিল ব্যাগে বলল না ওরা।”
রুবাই বুঝতে পারছিল না কিছুই। অন্বয়দা বলল, “কাল সবাই গয়া যাচ্ছে। আমার ঐ মন্দির, পাণ্ডা এসব ভালোই লাগে না। যাবো না ভাবছি।”
রুবাই লাফিয়ে ওঠে। বলে আমিও যাবো না। ঐ মন্দির দেখতে আমারও ভালো লাগে না। আকাশও ওদের দলে যোগ দিল।
রাতে খাওয়ার টেবিলে আরও দু’চারজন বলল যাবে না। মোট ছ’জন ছাত্র আর অন্বয়দাকে ছেড়ে বাকি দলটা গয়ায় চলে গেল পরদিন ভোরে। সারা রাত অন্বয়দা নেট ঘেঁটেছে, রুবাই জানে। ভোর রাতেও অন্বয়দাকে ফোনে নেট ঘাঁটতে দেখেছে রুবাই।
একটু বেলায় উঠে রুবাইরা পায়ে হেঁটে ঘুরতে বেরিয়েছিল অন্বয়দার সঙ্গে। প্রথমেই ওরা বৈভার পর্বতে উঠেছিল বিম্বিসারের কারাগার দেখতে। এক অন্ধ কূপের মতো জায়গায় বন্দি ছিল রাজা। যদিও এখন সব পাথরের স্তূপ। অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল বিম্বিসারের। প্রথম প্রথম রানি লুকিয়ে খাবার পাঠালেও অজাতশত্রু রানিকেও আর যেতে দিত না ওখানেভগ্নপ্রায় সে সব ধ্বংসস্তূপ কালের সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরও কিছুটা উঠে একটা চাতাল। নিচের প্রস্রবণগুলো দেখা যায় পরিষ্কার। এরপর পায়ে চলা পথ গেছে সপ্তপর্ণী গুহায়। জৈনদের কিছু মন্দির আছে পাহাড়ের মাথায়। ট্যুরিস্ট খুব কম এ পথে। বেশ কিছুটা উঠে অনেকেই হাঁপিয়ে গেছিল। অন্বয়দা বলল, যারা যেতে চায় না ওখানেই বসে থাকুক। বাকিদের নিয়ে সে চলল। প্রথমেই একটা মন্দির পড়ল। তা পার করে আরও উপরে উঠে গেছে পথ। খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে ওরা অনেকটা উঠে এসেছিল। জায়গায় জায়গায় ধ্বংসস্তূপ, দুর্গের ভগ্ন দেওয়াল। রুবাইয়ের পেশিতেও টান ধরছিল। ও বসে পড়েছিল একটা পাথরের আড়ালে। আকাশদের বলেছিল এগিয়ে যেতে, ও ওখানেই থাকবে। আকাশ আর ঋষি অন্বয়দার সঙ্গে এগিয়ে গেল।
হঠাৎ রুবাই লামা দুটোকে দেখতে পায়একটা ঝোপের আড়ালে ওরা কিছু করছিল। রুবাই ওদের দিকে একটু এগিয়ে যায়। বড়ো পাথরের আড়ালে লুকিয়ে দেখে, ওদের হাতে একটা বড়ো পুরোনো তুলোট কাগজ। পরিষ্কার বাংলায় একজন অন্যজনকে বলছে, “এত অবধি তো ঠিক এসেছি। এর পর বুঝতে পারছি না আর।”
“তুই আগেই মিশু চ্যাং-কে মেরে দিলি। বাকিটা তো শোনাই হয়নি ঠিক করে,” অন্য জন বলে।
রুবাই ঘামতে থাকে। এরা ট্রেনে সিকিমিজ আর হিন্দিতে কথা বলছিল আর এখন বাংলা বলছে। আবার খুনের কথাও বলছে।
ওদিকে অন্য জন বলল, “সেদিন না মারলে ওর বন্ধুরা এসে যেত পরদিন।”
“এখন এই প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধার কর তুই।”
“ওকে না মারলে এটা পেতিস না,” প্রথম জন বলে।
“দেখ, কাল ঐ ব্যাগটা চুরি করে এই ডাইরিটা পেয়েছিলাম। এটা মিশুর লেখা। এটায় কিছু কোড আছে। কিছু ইংরেজিতেও আছে। এত কাছে এসে ফিরব না খালি হাতে।” একটা ডাইরি বার করে ওরা। সোনালি ডাইরিটা রুবাই ট্রেনে দেখেছিল ঐ স‍্যু তাং এর হাতে। তার মানে....
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে রুবাই। বহু দূরে পাহাড়ের গায়ে আকাশি শার্ট পড়া অন্বয়দাকে দেখতে পায়। একবার ভাবে অন্বয়দাকে ডেকে আনবে। হঠাৎ দেখে ঐ লামা দু’জন এগিয়ে যাচ্ছে একটা ধ্বংসস্তূপের দিকে। ও পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ওদের অনুসরণ করে। কী মনে করে রুমালটা ছোটো পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখে ওখানে। কিছুটা গিয়েই একটা গুহার মুখ দেখতে পায়। লামারা ঢুকে যায় ওখানে। রুবাই পাঁচ মিনিট ওয়েট করে ঢুকে পড়ে। ছোট্ট গুহা, কিন্তু লামা দুটোকে আর দেখতে পায় না। ভালো করে গুহার ভেতরটা খুঁজে দেখে ও। অদৃশ্য হয়ে গেল নাকি!! একটু ভয় পায় রুবাই। আবার গুহার দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে এগোয়, ঠিক ডান দিকে একটা ফাটল চোখে পড়ে। একটা মানুষ গলে যেতে পারে। দু’মিনিট চিন্তা করে নিজের লাল স্কার্ফটা গুহার বাইরের ঝোপে টাঙিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ও। কোমরের বেল্টটা খুলে রাখে ফাটলের কাছে। ফাটলটা আস্তে আস্তে বেশ সরু হয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা যেতেই একটা বড়ো ঘরের মতো। তবে ছাদ নিচু, দেওয়াল জুড়ে বৌদ্ধ মূর্তি আর শঙ্খলিপি খোদাই করা। লামা দুটো কোথাও নেই। ভয়ে ভয়ে ঘরটা ভালো করে ঘুরে দেখে রুবাই। মাথার ফাটল দিয়ে আবছা আলো আসছে। উত্তর দিকের দেওয়ালে একটা মূর্তির পেছনে গর্তটা চোখে পড়ে এবার। একটা আলগা পাথর রয়েছে পাশে। মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকে পড়ে রুবাই। ঘুটঘুটে অন্ধকার, চামচিকের ভ‍্যাপসা গন্ধ। এভাবে কিছুটা গিয়ে একটা সিঁড়ি পায়। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কিছুটা নেমেই আবার দিনের আলো দেখতে পায়। কোনও ফাটল চুইয়ে অল্প আলো আসছে। ভেজা ভেজা পথে সালফারের কটু গন্ধ, ও বুঝতে পারে এটা উষ্ণ প্রস্রবণের কাছাকাছি জায়গা হয়তো। লামা দুটোর কথা কানে আসছে এবার। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। সামনের বাঁকটা ঘুরতেই একটা হল ঘর। মেঝেতে মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে ঝুঁকে বসেছে দু’জন লামা। একপাশে বড়ো বেদিতে বৌদ্ধ মূর্তি।
“এই নিরেট দেওয়াল ভাঙা যাবে না বলছে। তাহলে উপায়?
“ভাঙতেই হবে। আমি ডিনামাইট এনেছি। কিন্তু ভাঙলে আওয়াজ হবে। লোক জেনে যাবে। তাই ওটা লাস্ট অপশন।”
হঠাৎ রুবাইয়ের পায়ের ওপর দিয়ে সর সর করে ঠাণ্ডা মতো কী একটা চলে যায়। ভয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে গেছিল মুখ দিয়ে। একটা বিছা। এদিকে দু’জন লামাই ঘুরে তাকিয়েছে। রুবাই পিছন ফিরতে যাবে, ওদের মোবাইলের আলো এসে পড়ে ওর ওপর। ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় ওর। কুটিল হেসে একটা লামা ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। ওকে টেনে নিয়ে যায় ঘরের মাঝখানে।
অন্যজন বলে, “কী করছিস তুই এখানে?
“ঘুরতে ঘুরতে এসে গেছি,” উত্তর দিতে গিয়ে রুবাই টের পায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ। জলের বোতলটা বড়ো পাথরটার কাছে রেখেছিল ও।
“এবার এখানেই থাকবি।” নাইলনের দড়ি দিয়ে ওর হাত-পা বেঁধে ফেলে ওরা। মুখে টেপ লাগিয়ে দেয়। রুবাইয়ের মা-বাবার মুখটা মনে পড়ে। চোখে জল এসে যায়। এমন বিপদে ও আগে পড়েনি। ওরা দেওয়ালগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। হঠাৎ একটা খাঁজের মধ্যে হাত দিয়ে কী করে প্রথম লামাটা। একটা গুর গুর আওয়াজ হয়। দুটো লামা এবার জোর দিয়ে ঐ খাঁজটা ঠেলতে থাকে। মেঝের একটা অংশ সরে যায়। ওরা রুবাইকে ছেড়ে নেমে যায় ওদিকে। কিন্তু হঠাৎ চিৎকার করে উঠে আসে উপরে। দু’জনেই বেশ ভয় পেয়েছে। ওদের কথায় রুবাই বুঝতে পারে নিচে রয়েছে ফুটন্ত জলের প্রস্রবণ। ওরা আরেকটু হলেই পুড়ে যেত। আবার ডাইরি আর ম্যাপটা খুলে বসে ওরা। কিছুক্ষণ পর দেওয়ালের আরেকটা খাঁজে ধাক্কাধাক্কি শুরু  করে ওরা, এবার দেওয়ালের একটা দিক অল্প সরে যায়। কিন্তু ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না ওরা। তীব্র সালফারের গন্ধ। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে গুহামুখ। এবার ওরা একটা বড় মূর্তির বেদির নিচে একটা ফাটল দেখতে পায়। ধাক্কা দিতেই নড়ে ওঠে বেদি। সিঁড়ি দেখা যায়, কিন্তু  ছাদ থেকে পাথর খসে পড়ে হঠাৎ। ওরা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে স্ট্যাচুর মতো। রুবাই ঐ আবছা আলোয় দেখে কয়েকটা সাপ উঠে এসেছে ঐ গহ্বর থেকে। একদিকে পাথর খসে পড়ছে, একদিকে বিষাক্ত সাপ। পুরো মৃত্যুপুরী মনে হয় জায়গাটা। একটা পাথর প্রথম লামাটার মাথায় পড়তেই ও নড়ে উঠেছিল। আর নড়তেই ছোবলটা ঠিক পায়ের মাঝামাঝি দিয়েছিল সাপটা। এদিকে রুবাই বুঝে পায় না কী করবে। ভোরের স্বপ্ন যে এমন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে ও বোঝেনি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পার হয়েছে। অন্বয়দা কি ওকে ভুলে গেল!!
ঠিক তক্ষুনি অন্বয়দার গলা পায় ও। চিৎকার করতে গিয়েও পারে না। টেপ লাগানো মুখে। ওদিকে প্রথম লামাটার মুখ দিয়ে গ‍্যাঁজলা উঠছে। তিনটে সাপ ওর শরীরে উঠেছে। অন্য জনের পা বেয়েও উঠছে মৃত‍্যুদূত। সে নড়তেও ভুলে গেছে। চাঙ্গড় খসে পড়া বন্ধ হয়েছে আপাতত।
এমন সময় বড়ো টর্চের আলো এসে পড়ে ঘরের মধ্যে। কমলেশজি আর অন্বয়দা ঢুকে ঐ দৃশ‍্য দেখে থমকে যায়। পেছন পেছন ঢুকেছে বেশ কিছু পুলিশ। জোরালো টর্চের আলোয় আলোকিত পুরো ঘর। একসঙ্গে অত আলো দেখেই হয়তো সাপগুলো আবার গর্তে ঢুকে যায়। ওরা দীর্ঘ দিন ধরে অন্ধকারে থাকতে থাকতে আলোকে ভয় পায়। ততক্ষণে রুবাইয়ের বাঁধন খুলে দিয়েছে অন্বয়দা। সবাই ধীরে ধীরে গুহার বাইরে বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় লামাকে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয়। প্রথম জনকে বের করে আনে পুলিশ। ওর শরীর  নীল হয়ে গেছে, প্রাণের লক্ষণ আর নেই।

()

সন্ধ্যায় সবাই এসে বসেছিল ওদের হোটেলের ডাইনিং-এ। কমলেশজির সঙ্গে আরও দুজন অফিসার এসেছিল। চিনা পর্যটক দু’জনকে সম্মানের সঙ্গে বসানো হয়েছিল। অন্বয়দা আজ বক্তা।
প্রথমেই ও দুই চাইনিজ ভদ্রলোকের পরিচয় দিল স‍্যু শে তাং ও সিংলাই। ওঁরাও নাম করা ইতিহাসের প্রফেসর। ওদের বন্ধু ছিল মিশু চ্যাং, যে খুন হয়েছিল শিলিগুড়ির হোটেলে।
তবে গল্পের শুরু সেই ইতিহাসের পাতায়। অজাতশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে রত্নভাণ্ডার সরিয়ে ফেলেছিল রানি। তা গচ্ছিত রেখেছিল পাহাড়ের গুহায়। কেউ সেই রত্ন ভাণ্ডারের হদিশ পায়নি। শঙ্খলিপিতে সঙ্কেত লিখিয়েছিল রানি। শঙ্খলিপি এক অতি প্রাচীন ভাষা যাতে বুদ্ধদেবের বাণী খোদাই করা হত। এই শক্ত ভাষা খুব কম লোক অধ্যয়ন করেছিল। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ভাষার চর্চা হত। হিউ-এন-সাং শীলভদ্রের কাছে এই ভাষা শিখেছিলেন। তখন শীলভদ্রের বয়স ১০৬, দেশে ফেরার সময় হিউ-এন-সাং ছয়শোর উপর পুঁথি সঙ্গে করে নিয়ে যান। সে সময় পুঁথি হত গাছের ছালে হাতে লেখা। সেই সব পুঁথি চিনা ভাষায় অনুবাদ হয়। ভারত থেকে চিকিৎসা, সাহিত্য, অর্থশাস্ত্র, হিসাবশাস্ত্র, এমনকি বাস্তুবিজ্ঞান সব পৌঁছে যায় চিনে। এদিকে বখতিয়ার খিলজীর হাতে ধ্বংস হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। ধ্বংস হয় শঙ্খলিপিসহ দেশের সব শাস্ত্র। কিন্তু চিনে হিউ-এন-সাং-এর অনুগামীদের মধ্যে কয়েকজন এ লিপি শিখেছিল। এভাবেই কয়েকশো বছর আগে শঙ্খলিপিতে পারদর্শী এক পর্যটক ভারতে এসেছিল। সে এই ধনভাণ্ডারের হদিশ পায়। শঙ্খলিপির কিছুটা সে উদ্ধার করেছিল। কয়েকজনকে নিয়ে গোপনে অভিযানে নেমেছিল সে। কিন্তু মাঝপথে সে মারা যায়। কয়েক পুরুষ পর তার সেই দিনলিপি ও ম্যাপ খুঁজে পায় তার বংশধর। সে এই অসমাপ্ত অভিযানে নামে। কিন্তু হোঁচট খায় শঙ্খলিপির পাঠোদ্ধারেততদিনে এই লিপি জানে না আর কেউ। রাজগির ঘুরেও সে কিছুই করতে পারেনি। এরপর তার ছেলে মিশু চ্যাং রহস্য উদঘাটনে নামে। আমি ওর লেখা ডাইরি পড়েই এসব জেনেছি আজ ওঁর বাবা কাজ অনেক এগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমেই দুই ঐতিহাসিকের সাহায্য নেয় ও। এর মধ্যে চ্যাং জানতে পারে সিকিমের এক প্রাচীন গুম্ফায় রয়েছে এক তিনশো বছরের পুরোনো লামা, যে শঙ্খলিপি জানে। মিশু চ্যাং চলে আসে সিকিম। কিন্তু লামা আমরণ মৌন ব্রত নিয়েছেন। এদিকে মিশুর সঙ্গে সিকিমে আলাপ হয় দুই স্মাগলার জনি আর হরির। ওরা চিন থেকে আসা চোরাই মালের ডিলার। এদিকে মদের ঘোরে মিশু চ্যাং ওদের বলে ফেলেছিল শঙ্খলিপির পাঠোদ্ধার ও  ম্যাপের কথা, পরদিন ওর দুই ঐতিহাসিক বন্ধুর ওর কাছে আসার কথা এবং ওদের রাজগির যাওয়ার কথা। জনি আর হরি এই দু’জনের ছিল স্মাগলিং ছাড়াও নানা দু’নম্বরি ব‍্যাবসা। ওরা সময় নষ্ট না করে ওকে খুন করে হাতিয়ে নেয় ম্যাপ আর মিশু চ্যাং এর পূর্বপুরুষের দিনলিপি। কিন্তু ওর ডাইরিটা পায়নি। লামার ছদ্মবেশে রাজগির এলে কেউ নজর করবে না। অতঃপর এভাবেই আসে ঐ দুই জন। মিশু চ্যাং-এর বাবা মোকামায় নেমে এসেছিল বলে ওরাও ঐ পথে আসে। কিন্তু এখানে এসে বোঝে ভুল করেছে, শঙ্খলিপি জানে না ওরা। ওদিকে মিশু চ্যাং-এর বন্ধুরা এসে দেখে চ্যাং খুন হয়েছে। ওরা পায় চ্যাঙয়ের ডাইরি, যেখানে সব পরিষ্কার লেখা ছিল ইংরাজিতে। সময় নষ্ট না করে ওরাও চলে আসে এখানে। অবশ্য ওরা বুঝতে পেরেছিল ওদের কেউ ফলো করতেই পারে। তাই এখানে না নেমে এগিয়ে গেছিল। কিন্তু  তবুও হরি আর জনি ওদের দেখে ফেলে। ওদের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ছিনিয়ে নেয় মিশুর ডাইরি।
শঙ্খলিপি না জানলেও ম্যাপ আর ডাইরি নিয়েই অভিযানে নামে ওরা। ঐ গুহায় ঢোকার দুটো মুখ খুঁজে পেয়েছিলেন চ্যাং-এর পূর্বপুরুষ। উনি বুঝেছিলেন লোক দেখানো প্রথম পথটা আসলে বোকা বানানোর জন্য। দ্বিতীয় পথেই এগিয়ে ছিলেন। ম্যাপ দেখে এরাও সে ভাবেই এগোয়। এদিকে রুবাই ওদের দেখতে পেয়ে পিছু নেয় কিছুটা কৌতূহল থেকেই। ভাগ্যিস রুবাই চিহ্ন রেখেছিল। তাই গুহাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। বিপদ বুঝে কমলেশকে ফোর্স আনতেও বলেছিলামকিন্তু এতটা বিপদে রুবাই পড়েছে বুঝিনি। রুবাইয়ের জন্যই আজ মিশু চ্যাঙয়ের খুনি ধরা পল।”
এতটা বলেই জলের বোতল টেনে নেয় অন্বয়দা।
“আর গুপ্তধন? সেটা কোথায়? বলে আকাশ আর রাজন।
“গুপ্তধন আছে গুপ্ত জায়গাতেই। রানি চায়নি তা কারও হাতে পড়ুক। কারণ রাজার শেষ জীবন কেটেছিল অনাহারে এক অন্ধ কূপে। তার অভিশাপ বহন করছে ঐ রত্নরাজি। সেই জরাসন্ধের আমল থেকে পর্বত বেষ্টিত রাজগৃহ ছিল সুরক্ষিত। ইতিহাস বলে – ‘বৈভারো বিপুলশ্চৈব রত্নকুট গিরিব্রজ, রত্নাচল ইতিখ্যাতা পঞ্চইতি পবনা নগা।’
“অর্থাৎ সেই জরাসন্ধের গিরিব্রজপুরের উত্তরে বৈভারগিরি এবং বিপুলাচল, দক্ষিণে গিরিব্রজগিরি, মধ্যে রত্নাচল এবং রত্নকূট বা রত্নগিরি পর্ব্বতমালা অচল অটল-ভাবে দণ্ডায়মান; পূর্বদিক বিপুল এবং  রত্নগিরি বা রত্নকূট পর্ব্বত প্রাচীরের মত, পশ্চিমদিক বৈভারের একাংশ চক্রা নামক পর্ব্বতে, দক্ষিণ গিরিব্রজগিরির উন্নত শিখরমালায় এবং উত্তর দিকে বিপুলাকায় বিপুল এবং বৈভারের অভেদ্য পর্ব্বত প্রাচীরে সুরক্ষিত। ঐ বৈভার  এবং  রত্নাচল পর্ব্বতের মাঝের উপত্যকায় ছিল জরাসন্ধের রাজপ্রাসাদ এবং তা থেকেই  গিরিব্রজপুরের আধুনিক নাম রাজগৃহ হয়েছিল। ‘রাজগৃহে’ প্রবেশ করবার চারটি দ্বার ছিল। প্রথম, বিপুল ও বৈভারের মাঝে গিরিসঙ্কটে, দ্বিতীয় গিরিব্রজগিরির মধ্যস্থিত গিরিসঙ্কটে, তৃতীয় গিরিব্রজগিরি এবং রত্নকূট বা রত্নগিরির মধ্যস্থিত ভূমিতে এবং চতুর্থ বোধহয় রত্নাচল এবং বৈভারের অংশ চক্রর মধ্যে এই সব পর্ব্বতমালার মধ্যে প্রচুর তেজস্ক্রিয় খনিজ রয়েছে। এই উষ্ণ প্রস্রবণগুলির আশেপাশে সালফার গন্ধক ছাড়াও বহু আণবিক খনিজ রয়েছে। যখন ইংরেজরা কামান দাগতে গেছে, কয়েকজন ভূবিজ্ঞানী ইংরেজ সরকারকে বুঝিয়েছিল এখানে কামান দাগলেই বড়োসড়ো ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে। হয়তো কোনও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠবে। কোনও রত্নরাজিই পাওয়া যাবে না। থাকলে এতদিনে কেউ না কেউ সে সব খুঁজে বার করত। তাই একবার কামান দেগেই ক্ষান্ত হন সরকার। এই সব গুহায় প্রচুর মরণ ফাঁদ রয়েছে। লোভে পড়ে প্রবেশ করলেই মৃত্যু। হয়তো এমন কোনও অন্ধকূপেই রানি বিসর্জন দিয়েছিল সব সম্পদ। বুদ্ধদেব ক্ষমায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিম্বিসার প্রথমে ছেলেকে ক্ষমাও করেছিলেন। কিন্তু অন্তহীন লোভ মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায় - এই হল শেষ কথা। আজ অবধি ঐ রত্নভাণ্ডারের খোঁজে যারাই এসেছে, মৃত্যুই পেয়েছে পুরস্কার স্বরূপ।”
“মানে গুপ্তধন পাওয়া গেল না,” বলে উঠল অর্ক।
“তার বদলে আমরা ইতিহাসের কত কী জানতে পারলাম। এতদিন জানতাম অন্বয় গেমস টিচার। এখন দেখছি আমার চাকরি ও খেয়ে নিতে পারে যে কোনও সময়,” প্রলয়দার উত্তরে হেসে ফেলল সবাই।
কমলেশজি এবং অন্য দুই অফিসার রুবাইয়ের খুব প্রশংসা করল। ওর জন্য পুরস্কারের সুপারিশ হবে তাও বলল। এর মধ্যেই গাইড তাড়া লাগাতে শুরু করেছিল। ঘড়িতে তখন আটটা, রাত একটায় ওদের ফেরার ট্রেন। খেয়েই সবাইকে বাসে উঠতে হবে। তাই সবাই খেতে চলে গেল।
সাত পাহাড়ে ঘেরা রাজগৃহকে বিদায় জানিয়ে এবার ঘরে ফেরা পালা।
_____

6 comments:

  1. গল্পটা ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. তথ্য সম্বলিত থ্রিলার। খুব সুন্দর লাগল।

    ReplyDelete