প্রবন্ধ:: ক্যাপ্টেনকে লেখা চিঠি - সৌগত সেনগুপ্ত


ক্যাপ্টেনকে লেখা চিঠি
সৌগত সেনগুপ্ত

প্রিয় ক্যাপ্টেন,

তোমাকে এই চিঠিটা অনেকদিন ধরে অনেকবার লেখার কথা ভেবেছি, কিন্তু কোনও কারণে লিখে উঠতে পারিনি
কখনও রেগে গিয়ে লিখব ভেবেছি, কখনও খুশি হয়ে, কখনও আবার দুঃখ পেয়ে একবার ঈর্ষায় সবুজ হয়ে লিখব ভেবেছিলাম, পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে লেখা মুছে ফেলেছি আজ যখন তুমি অনেক দূরে তখন সাহস করে চিঠিটা লিখেই ফেললাম
খুব ছোটোবেলায় যখন আমি নিজে নিজে পড়তেও শিখিনি, তখন বাবা একটা বই কিনে দিয়েছিলআনন্দমেলা উপরে নাম লেখা ছিল, দুঃসাহসিক অভিযাত্রীরা সেই প্রথম তোমার সঙ্গে পরিচয় তারপর একের পর এক সংখ্যা ডুবোজাহাজ, উড়োজাহাজ, বনসাই, রোবট, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল সঅঅঅব ক্যাপ্টেন, তখন তুমি ছিলে সম্পাদক
আনন্দমেলার শুরু থেকে প্রায় পনের বছর তুমি ছিলে সম্পাদক আমাদের মনের মতন রঙিন একটা করে সংখ্যা প্রতি পক্ষে পৌঁছে যেত আমার মতো আরও অনেক ছোটো ছোটো বন্ধুর বাড়িতে শুনেছি সমসাময়িক সব লেখক লেখিকাকে তুমি ধরে এনেছিলে আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য কাউকে আদর আপ্যায়ন করে, আবার কাউকে ধরে বেঁধে বন্দি করে লেখা আদায় করেছ

  

আচ্ছা, সত্যজিৎ রায় আমাদের প্রথম টিনটিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন কৈলাসে কেলেঙ্কারি উপন্যাসে সেই টিনটিনকে তুমি বাংলায় অনুবাদ করে দু’পাতা দু’পাতা করে আমাদের পড়ালে ফরাসি ত্যাঁ ত্যাঁ কে টিনটিন আর স্নোয়ি কুকুরকে কুট্টুস বানিয়ে দিলে! ক্যাপ্টেন, এ শুধু তোমার পক্ষেই সম্ভব আর তাই তো আমরা পেলাম আর এক ক্যাপ্টেনকে, যিনি কথায় কথায় গালি দেন, গেঁড়িগুগলির দল কিংবা লক্ষ কোটি পোড়া ফোসকা সত্যি বড়ো হয়ে যাওয়ার পরও রেগে গেলে কাউকে গালি দিতে হলে সেই ক্যাপ্টেনের গালিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে
তুমি বলেছিলে, অনুবাদ করার সময় আক্ষরিক নয়, ভাবানুবাদ করা দরকার। তাই তো প্রয়োজন মতো লেখা, এমনকি ছবিও বদলে দিয়েছ ভারতীয় সংস্কৃতি আর মূল্যবোধ তোমার থেকে ভালো কে জানবে? সম্পাদক হিসেবে তুমি কেমন কড়া ছিলে শুনেছিলাম রতনকাকুর কাছে রতনকাকু হলেন রতনতনু ঘাটী, তখন আনন্দমেলার সম্পাদকীয় বিভাগে ছিলেন রতনকাকু প্রেমেন্দ্র মিত্র-র থেকে ঘনাদার লেখা নিয়ে এসেছিলেন সেই সময় বয়সজনিত কারণে ঘনাদার স্রষ্টার দৃষ্টিশক্তি খুব ক্ষীণ হয়ে পড়েছিল কিছু লেখা কাগজের বাইরে লেখা হয়ে গিয়েছিল তুমি নাকি রতনকাকুকে দিয়ে সেই লেখা ঠিক করিয়েছিলে

ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমি
স্কুলের উঁচু ক্লাসে তোমাকে অন্যরকম ভাবে চিনলাম কোথায় রঙিন দুনিয়া! সাদা-কালো পিঁপড়ের মতো সারি সারি লেখা হলুদ মলাটের পাঠ সংকলন আর সহায়ক পাঠ কার লেখা নেই সেখানে? ভারতচন্দ্র থেকে জীবনানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে তারাশঙ্কর, নজরুল ইসলাম থেকে শামসুর রাহমান তার মধ্যে তোমারও একটা কবিতা ছিল, ‘সবাই দেখছে রাজা উলঙ্গ...
খুব রাগ হত, জানো! কবি কী লিখেছেন, কেন লিখেছেন এসব কঠিন কঠিন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হত দু’বছর ধরে সে সব নিঙড়ানি সহ্য করে দাঁতে পেন চিপে লিখে যেতে হত ছয়, নয় কিংবা বারো নম্বরের প্রশ্ন নম্বর বড়ো বালাই তবে কী জানো, আমাদের সময়ে তো বিখ্যাত প্রকাশনার সহায়িকা ছিল না, তাই নামকরণের সার্থকতা নিজেদের বানিয়ে বানিয়ে লিখতে হত
মিথ্যে বলব না, এই যে চিঠি লেখা, এটাও কিন্তু ওই সময়ই শেখা তারপরে পড়ার বাইরে কবিতা বেশি হত না যখন একটু বড়ো হলাম, তখন মন টানত রহস্য রোমাঞ্চ এক পুজোসংখ্যায় পরিচয় হল ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে কী নির্বিকার ভাবে জটিল রহস্য সমাধান করতেন সত্যি ক্যাপ্টেন, ভাদুড়িমশাই তোমারই এক অল্টার ইগো
জানো ক্যাপ্টেন, আমি জানতাম না, তুমি আমার বাড়ির কাছেই থাকো কতবার তোমার বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি, কিন্তু কখনও জানতেই পারিনি চার দিকে উঁচু ফ্ল্যাট দিয়ে ঢাকা একটা দোতলা বাড়িতে তুমি থাকো আমার বন্ধু সমুদ্র তোমার ইন্টারভিউ নিতে না গেলে আমার যাওয়াও হত না তোমার ছবি তোলার জন্য
সেদিন তোমার জ্বর, তাও আমাদের সঙ্গে কত গল্প করলে কত পুরোনো দিনের কথা, গল্প, অভিজ্ঞতা আমাদের শোনালে সত্যি আমরা কত কম জানতাম! তারপর পড়লাম নীরবিন্দু - তোমার আত্মজীবনী জানলাম চান্দ্রা গ্রাম থেকে কলকাতা আসার গল্প পড়াশোনা আর খবরের কাগজে যোগ দেওয়ার ঘটনা
এই তো সেদিন তোমার লেখায় পড়ছিলাম তুমি সিঁথির মোড়ে বাস থেকে নেমে বাড়ি ফিরতে আমার বাবা, দাদু, এমনকি শ্বশুরমশাইও সিঁথির মোড় হয়ে বাড়ি ফিরতেন আর একটা মজার ঘটনা জানো, তুমিও যে আমার বাবার মতো ছেলের স্কুলভীতি কাটাতে স্কুলের সামনে বসে থাকতে এটা সদ্য জানলাম ওঁর স্মৃতিচারণ থেকে

    

এতক্ষণ ধরে ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন বলে তোমাকে ডাকছি, তোমার মনে প্রশ্ন জাগছে কি? আসলে কী জানো, তোমার প্রথম যে লেখা আমি পড়েছিলাম তার নাম ছিল ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন মিলিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, অ্যাস্ট্রোনট সেই যে পরাশর নক্ষত্রের বার্বেরিস গ্রহের এক উপগ্রহে অভিযান চালাতে গিয়ে সাংঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন কীভাবে দলকে ক্যাপ্টেনের মতো নেতৃত্ব দিয়ে সবাইকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন যতই লেখা থাক বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে, আমি জানি ক্যাপ্টেন তুমি ছাড়া আর কেউ নয়
গত পঁচিশে ডিসেম্বর যখন সবাই আনন্দ করতে ব্যস্ত, তখনই খবর পেলাম তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলে ক্যাপ্টেনের মহাকাশযান যত দূরে যেতে পারে তার থেকেও অনেক দূরে, এক না ফেরার দেশে সেই দূর দেশ থেকে তুমি এই চিঠিটা পেলে পড়ে দেখো জানি, তোমার বন্ধু অমলকান্তির সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটাচ্ছ আর আমি নিশ্চিত সেই দুনিয়াতেও এক নতুন আনন্দমেলা সাজিয়ে নিয়েছ
ভালো থেকো ক্যাপ্টেন!
ইতি
তোমার এক কখনও বড়ো না হতে চাওয়া বন্ধু
_____

12 comments:

  1. fatafati...anek dhanyobad Saugata da

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সুদীপ

      Delete
  2. Darun hoyechey Sougata...

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ সুমিতদা

      Delete
  3. Khub valo likhecho. 👍

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

      Delete
  4. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  5. যখন আদর আর ভালবাসা দিয়ে কোন লেখা হয়, তখন অনেকটা এরকম হয়

    ReplyDelete
  6. বড় ভালো লাগলো। নির্মল এক ভালোবাসার চিঠি। থ্যাংক ইউ এরকম একটা লেখার জন্যে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হেঃ হেঃ কী যে বল, তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগল

      Delete
  7. অপূর্ব লেখা গো। কী ঝরঝরে। আরো লিখো প্লিজ

    ReplyDelete