অনুবাদ গল্প:: তেরো - এম আর জেমস :: অনুবাদঃ ঋজু গাঙ্গুলী


তেরো
ঋজু গাঙ্গুলী

নর্থ সি আর বাল্টিক সি যে জমিটুকু দিয়ে আলাদা হয়ে গেছে, সেটাই য়াটল্যান্ড। ডেনমার্কেরোমান ক্যাথলিক ধর্মের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে অ্যান্ডারসন শুনেছিল, এই য়াটল্যান্ডের প্রধান শহর ভিবর্গ-এর আর্কাইভে নাকি বহু প্রাচীন কিছু দলিল-দস্তাবেজ আছেসেগুলোর টানেই ভিবর্গে এসেছিল ও ভিবর্গে হরেক কিসিমের মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া লেগেই থাকে তাই ওখানে ভালো হোটেলের অভাব ছিল না। কিন্তু অ্যান্ডারসনের দরকার ছিল একটা বড়ো ঘর, যা শোয়া ও পড়াশোনা দুয়ের জন্যই কাজে লাগে। বহু বছর পর হতে চলা কী একটা প্রাচীন অনুষ্ঠান উপলক্ষে শহরে তখন পর্যটকদের ভিড়। তার মধ্যে ওইরকম ঘর জোগাড় করতে অ্যান্ডারসনের ঘাম ছুটে গেল। সেইরকম ঘর শেষ অবধি পাওয়া গেল একটা বহু পুরোনো হোটেলের দোতলায়। ওর ঘরের নম্বর ছিল ‘বারো’ঘরটা বিশাল লম্বা তার তিনটে জানলাই রাস্তার দিকে হওয়ায় দিনে তো বটেই, রাতেও ঘরটা বেশ আলো-ঝলমলে হয়ে থাকবে বলে আশা করেছিল অ্যান্ডারসন ঘর পাওয়ার আনন্দে সেদিন অ্যান্ডারসন একটু বেশিই খাটাখাটনি করে ফেলেছিল। তাই ও যখন রাতের খাওয়ার টানে নীচে নামল, তখন হোটেলের অন্যান্য বোর্ডাররা খাওয়া সেরে ফেলেছেন। খাবার আসার আগের সময়টুকু কথা বলার মতো কাউকে না পেয়ে অ্যান্ডারসন রিসেপশনে রাখা খাতাটাই উলটে-পালটে দেখেছিল। তখনই একটা জিনিস ওর নজরে পড়ল কারও নামের পাশেই তেরো নম্বর ঘরটা দেওয়ার কথা লেখা হয়নি এই ব্যাপারটা অবশ্য আরও কয়েক জায়গায় ও দেখেছিল অপয়া সংখ্যা বলেই অনেকে, এই যুগেও, হোটেলে ওই নম্বরের ঘরটা এড়িয়ে চলেন এখানেও সেটাই হয়েছে ভেবে ও আর মাথা ঘামায়নি

খাওয়া-দাওয়া সেরে নিজের ঘরে উঠে গেছিল অ্যান্ডারসন সারা ঘরে ছড়িয়ে থাকা বই, কাগজ, দুর্মূল্য দলিল, এগুলো যত্ন করে গুছিয়ে শেষ অবধি ও যখন শোয়ার জন্য তৈরি হল, তখন প্রায় মাঝরাত
সারাদিন ভারী ও ভারিক্কি বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও বালিশে মাথা রেখে কিছুক্ষণ হালকা-পলকা বই না পড়লে অ্যান্ডারসনের ঘুম আসে না সেদিনও তাই হল বিছানায় শরীরটা এলিয়েই ওর খেয়াল হল, টেবিলে স্তূপীকৃত দস্তাবেজ, কাগজ, আর মোটা বই থাকলেও মন যেমনটি চাইছে, তেমন বইটা রয়েছে ওর ওভারকোটের পকেটে আর ওভারকোটটা রয়েছে নীচে, খাওয়ার ঘরে টেবিলের পাশে কোট ঝোলানোর হুকে! বেজার মুখে বিছানা ছেড়ে নীচে গেল অ্যান্ডারসন কোটটাকে নিয়ে দোতলায় উঠল ঘরের দরজার হাতল ঘোরাল দরজা খুলল না অ্যান্ডারসনের মাথাটা গরম হল এর মানে কী? সারা দিনে অন্তত দশবার ও এই ঘরের দরজা খুলেছে, বন্ধ করেছে কোনও সমস্যা হয়নি আর এই মাঝরাতেই দরজাকে অসহযোগ আন্দোলন করতে হল! হাতলটাকে ডানদিকে, বাঁদিকে, এমনকি হ্যাঁচকা টানে সামনে-পেছনে করেও দরজাটা না খোলায় ও ভাবছিল, দরজাটা নিজেই ভাঙবে, না হোটেলের কারও সুখনিদ্রার বারোটা বাজিয়ে তাকে দিয়ে এই মহৎ কাজটা করাবে হঠাৎ, ওর চোখের লেভেল থেকে কিছুটা ওপরে, যেখানে একটা ফলকে ঘরের নম্বরটা লেখা থাকে, সেদিকে ওর নজর পড়ল তেরো! দুত্তোর! তার মানে ঘুমের ঘোরে নিজের ঘরের দরজা না খুলে ও পাশের ঘরের দরজার হাতলের সঙ্গে এতক্ষণ যুদ্ধ করছিল অ্যান্ডারসনের এবার বেশ লজ্জাই হল নেহাত এই ঘরটা ফাঁকা, নইলে এতক্ষণ ও যে পরিমাণ টানাহ্যাঁচড়া করেছে তাতে তার ঘরের বাসিন্দার ঘুম ভেঙে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল সেটা মোটেই ভালো হত না বাঁদিকে তাকিয়েই অ্যান্ডারসন নিজের ঘরের দরজা, এবং তার ওপর জ্বলজ্বল করা ফলকে বারো সংখ্যাটা দেখতে পেল ঘরে ঢুকে, বই হাতে নিয়ে বিছানায় শোয়ার একটু পরেই ওর চোখজোড়া আটকে গেল বিছানা থেকে নেমে, ঘষটে-ঘষটে লাইটের সুইচ নিভিয়ে বিছানায় পড়েই ও একেবারে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল

পরদিন আর্কাইভে গিয়ে অ্যান্ডারসন একটা বেশ মোটাসোটা কাগজের বান্ডিল পেল একসময় ভিবর্গের প্রায় সমস্ত বাসিন্দা রোমান ক্যাথলিক হলেও তখন বাদবাকি ডেনমার্কের মতো এখানেও প্রোটেস্টান্ট ধর্মের মানুষেরা সংখ্যাগুরু হয়ে উঠছেন সেই সময়ে শহরের শেষ রোমান ক্যাথলিক বিশপ য়োহান ফ্রিস, এবং প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের নেতা রাসমুস নিলসেন-এর মধ্যে হওয়া উত্তপ্ত চিঠিচাপাটি ছিল ওই বান্ডিলটায় অ্যান্ডারসন যা খুঁজছিল, তার সঙ্গে ঠিক সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও বাদানুবাদের বিষয়টা ওর কাছে দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হল বিশপ ফ্রিস-এর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি শহরে তাঁর একটা বাড়ি নিকোলাস ফ্র্যাংকেন নামে একজনকে ভাড়া দিয়েছিলেন সে নাকি শয়তানের উপাসনা করে চিঠিতে অভিযোগের আকারে তার নানা ধরনের কার্যকলাপ, মন্ত্র-তন্ত্রের যে বর্ণনা ছিল, মহাফেজখানার ওই গম্ভীর, ফাঁকা পরিবেশে সেগুলো পড়তে গিয়েই অ্যান্ডারসনের রীতিমতো গা ছমছম করছিল বিশপ এইসব অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, এই নিয়ে বিচার হওয়া উচিত সর্বোচ্চ আদালতে, নইলে এগুলো মানহানিকর অপবাদ ছাড়া কিছু নয় তার উত্তরে পালটা অভিযোগ করে বলা হয়েছিল, রোমান ক্যাথলিক চার্চের চাপানো সর্বোচ্চ আদালতের রায় মানতে ভিবর্গের মানুষ আর বাধ্য নয় এইসব গরমাগরম চিঠির পাঠোদ্ধার করতে ও পড়তে গিয়েই অ্যান্ডারসনের দিনটা কেটে গেল আর্কাইভ বন্ধ হওয়ার পর ও যখন হোটেলমুখো হল, তখন প্রধান আর্কাইভিস্ট স্ক্যাভেনিয়াস ওকে সঙ্গ দিলেন কথায়-কথায় চিঠির বান্ডিলের ব্যাপারটা উঠে এল অ্যান্ডারসনের প্রশ্নের উত্তরে স্ক্যাভেনিয়াস বললেন, “বিশপ ফ্রিস-এর ভাড়াটেকে নিয়ে হওয়া ওই গোলমালটার কথা অন্য দলিল-দস্তাবেজেও দেখেছি কিন্তু ১৫৬০ সালের ভিবর্গের ইতিহাস-ভূগোল এখনকার শহরের সঙ্গে মেলানো অসম্ভব তাই কোথায় বিশপের ভাড়াটে, মানে নিকোলাস ফ্র্যাংকেন থাকত, সেটা আমি বের করতে পারিনি

সঙ্গী গপ্পোবাজ হলে যা হয়, অ্যান্ডারসনেরও তাই হল স্ক্যাভেনিয়াসের সঙ্গে প্রায় নগর পরিক্রমা করে ও যখন হোটেলে পৌঁছল, তখন অনেক রাত খাওয়া-দাওয়া সেরে দোতলায় ওঠার পর অ্যান্ডারসনের খেয়াল হল, এই ভরা মরসুমেও তেরো নম্বর ঘরটা ফাঁকা রেখে দেওয়া নিয়ে হোটেলের কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি এইসব ভাবতে-ভাবতে ও হঠাৎ আবিষ্কার করল, ও তেরো নম্বর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যান্ডারসন শুনতে পেল, ঘরের ভেতর ভারী পায়ে কেউ হাঁটাচলা করছে কারও কথা বলার আওয়াজও পেল ও ওর হঠাৎ খেয়াল হল, এইভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক নয় লোকে কী ভাববে? তাছাড়া... দরজার ঠিক ওপাশেই ও কারও, খুব ধীরে-ধীরে শ্বাস ফেলার আওয়াজ পাচ্ছিল তখন অ্যান্ডারসনের মনে হচ্ছিল, যেন ওর পরের কাজটা কী হবে, সেটা জানার জন্য দারুণ আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছে এই ঘরের বোর্ডারটি ঝটপট নিজের ঘরের দরজা খুলে, ঘরে ঢুকে, তবেই নিশ্চিন্ত হল অ্যান্ডারসন তারপরেই ওর খেয়াল হল ব্যাপারটা। তেরো নম্বর ঘরটা তাহলে কাউকে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু তাহলে রেজিস্টারে তার কোনও উল্লেখ নেই কেন? সারাদিনের পড়াশোনা, তারপর অত হাঁটাহাঁটির ধকল, এসবের পর ঘরের উষ্ণ আরামে ঢুকেই অ্যান্ডারসনের চোখগুলো ঢুলুঢুলু হয়ে গেল কোনও রকমে রাতের পোশাক পরে বিছানায় শুয়েই ওর মনে হল, ঘরটা ছোটো লাগছে ব্যাপারটা এতটাই বিস্ময়কর, যে অ্যান্ডারসনের ঘুম ছুটে গেল বিছানায় উঠে বসল ও হ্যাঁ! ঘরটা ছোটো হয়ে গেছে কীভাবে? ঘুমের ঘোরে ঘরটা বড়ো বলে মনে হলে অস্বাভাবিক লাগত না কিন্তু ছোটো লাগবে কেন? বিছানা ছেড়ে নেমে, একটা ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে, ও ঘরের চারপাশটা দেখল হ্যাঁ কোনও ভুল হওয়ার জায়গাই নেই ঘরটা রীতিমতো ছোটো ঠেকছে কিন্তু তার মানে কি এই যে ঘরটা এই সাইজেরই ছিল, দিনের বেলায় দেখতে গিয়ে সেটা বড়ো লেগেছিল ওর? বিভ্রান্ত অ্যান্ডারসন কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে বুঝল, ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে বিরক্ত হয়ে তামাকের পাউচ বের করে সিগারেট বানাতে গিয়ে ও দেখল, পাউচে আর খুব কম তামাকই পড়ে আছে ওর ফেভারিট ব্র্যান্ডটা এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা কম ভেবে ও আরও বেশ কয়েক প্যাকেট তামাক নিজের সঙ্গেই এনেছিল একটা প্যাকেট বার করে হাতের কাছে রাখবে ভেবে নিজের বড়ো ব্যাগটা খুঁজল অ্যান্ডারসন ব্যাগটা নেই!
না! এতে ওর রাগ হল না ও খুব একটা অবাকও হল না ব্যাগটা চুরি হয়নি, কারণ চুরি হওয়ার মতো কিছু ওতে ছিল না এর মানে একটাই হতে পারে ঘর পরিষ্কার করার সময় জিনিসটা সরিয়ে কোথাও রেখেছিল হোটেলের সাফাই কর্মচারীটি তারপর সেটা আর যথাস্থানে রাখা হয়নি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, রাতে আর সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হবে না এই আশা নিয়ে অ্যান্ডারসন জানালায় গিয়ে দাঁড়াল শান্ত রাত আকাশ একদম পরিষ্কার অল্প-অল্প হাওয়া দিচ্ছে রাস্তার ওপাশের উঁচু বাড়িটার দেওয়ালে হোটেলের নানা ঘরের খোলা জানলা দিয়ে আলো পড়ছিল ঘরের বাসিন্দাদের ছায়াও পড়ছিল তাতে সেদিকে দেখেই অ্যান্ডারসন বুঝল, এগারো নম্বর ঘরের বাসিন্দা ঘুমোয়নি, বরং গোছগাছ করছে আর... হ্যাঁ, তেরো নম্বর ঘরের বাসিন্দাও জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অ্যান্ডারসনের মাথায় কৌতূহলের পোকাটা নাড়াচাড়া দিল ও উলটোদিকের দেওয়ালে ছায়া দেখেই বোঝার চেষ্টা করল, প্রতিবেশী বোর্ডারটি কেমন দেখতে লোকটি... মহিলাও হতে পারেন অবশ্য, কারণ মাথা আর ঘাড় ছাপিয়ে চুল আছে মনে হচ্ছে... রোগা, এবং বেশ লম্বা তবে তার ছায়াটা সামনের দেওয়ালে ঠিক জমাট বাঁধতে পারছে না, কারণ ঘরের মধ্যে যে আলোটা জ্বলছে সেটা অ্যান্ডারসনের ঘরের মতো স্থির হলুদ বাতির নয় বরং একটা লম্ফমান লালচে-হলুদ আলো... অনেকটা আগুনের মতো কিছুক্ষণ এভাবেই কাটল তারপর রাস্তা দিয়ে একটা বড়ো দল হইচই করতে-করতে আসার আওয়াজ পাওয়া গেল পাশের ঘরের বোর্ডার সাঁত করে জানলার সামনে থেকে সরে গেল অ্যান্ডারসনও বুঝতে পারল, অভিমানিনী নিদ্রাদেবী আবার সদয় হয়েছেন সিগারেটটা নিভে গেছিল ওটার শেষ অংশটুকু জানলার কাঠেই রেখে অ্যান্ডারসন চাদরের তলায় ঢুকল, এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল পরদিন একটু বেলার দিকেই অ্যান্ডারসনের ঘুম ভাঙল ততক্ষণে ঘরদোর সাফ করার জন্য লোকজন ঘরে ঢুকে কাজ করা শুরু করেছে
ল্যাটিন, জার্মান, আর ইংরেজি দিয়ে আর্কাইভে কাজ চালানো গেলেও হোটেলে, বা শহরে কারও কাছে কিছু জানার জন্য ড্যানিশ বলতে গিয়ে অ্যান্ডারসনের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় তবু ও যথাসাধ্য গুছিয়ে জানতে চাইল, ওর ব্যাগটা কেন সরিয়ে রাখা হয়েছে? যে মেয়েটি চাদর বদলাচ্ছিল, সে খিলখিল হেসে চলে গেল রেগে গিয়ে কড়া কথা বলতে গিয়েই অ্যান্ডারসনের নজরে পড়ল, ব্যাগটা যেখানে রাখা ছিল, সেখানেই আছে দেওয়ালের পাশে এবার অ্যান্ডারসন সত্যিই চিন্তিত হল একটা ঘরের মধ্যে নিজের আস্ত ব্যাগ যার নজর এড়িয়ে যায়, গবেষক হিসেবে তার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার! দুশ্চিন্তা হলেই অ্যান্ডারসেনের সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে ব্যাগ খুলে, তামাকের পাউচ বের করে সিগারেট বানিয়ে, ধরিয়ে ও জানলায় গিয়ে দাঁড়াল আরে! কাল রাতের সিগারেটের টুকরোটা এই জানালায় কীভাবে এল? অ্যান্ডারসনের স্পষ্ট মনে আছে, দেওয়ালের লাগোয়া জানলায় দাঁড়িয়েছিল ও রাতে নিভে যাওয়া সিগারেটের শেষাংশও সেখানেই রেখেছিল অথচ এখন সেটা রয়েছে ঘরের মাঝের জানলায়! নিজের অবস্থানটা আরও একবার বুঝে, আগের রাতের সঙ্গে সেটা তুলনা করতে গিয়েই অ্যান্ডারসন আবার ধাক্কা খেল ঘরটা আবার বড়ো হয়ে গেছে! ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা অবধি একবার জোরে-জোরে, একবার পা টিপে-টিপে হেঁটে মাপ নিয়ে অ্যান্ডারসন নিশ্চিন্ত হল ও ভুল করছে না ওর ঘরটা সত্যিই অনেকটা লম্বা কিন্তু তাহলে কাল রাতে...?
মাথাটা আরও বেশি গুলিয়ে যাচ্ছে বুঝে অ্যান্ডারসন সিদ্ধান্ত নিল, ঘরের রহস্যভেদ পরে করলেও চলবে আপাতত ফ্রেশ হওয়া, এবং ব্রেকফাস্ট অনেক বেশি জরুরি ঝটপট তৈরি হয়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে-বেরোতেই অ্যান্ডারসন ভাবল, এত বেলায় ব্রেকফাস্ট হিসেবে আদৌ কিছু জুটবে কিনা তবে পাশের দরজার বাইরে একজোড়া ভারী জুতো দেখে ও মনে-মনে আশ্বস্ত হল প্রতিবেশীও এখনও খেতে যাননি যখন, তখন খাবার পাবার সম্ভাবনা আছে দরজাটা পার হওয়ার সময় অ্যান্ডারসন আরেকবার জুতোজোড়া দেখে বুঝল, ওর পাশের ঘরের বাসিন্দা পুরুষই চোখ বোলানোর মতো করেই দরজার ওপরদিকেও ও একবার দেখল চোদ্দো! ব্রেক কষার মতো করে থেমে গেল অ্যান্ডারসন এটা কী হল? ও কি এতই বেখেয়ালি যে তেরো নম্বর ঘরটা কখন পেরিয়ে এসেছে, সেটাও না দেখে ও সোজা তার পাশের ঘরের সামনে এসে গেছে? বারো ঘণ্টারও কম সময়ে তিন-তিনটে এমন ভুল হওয়া কি স্বাভাবিক? ধীরে-ধীরে পেছন দিকে হাঁটল অ্যান্ডারসন হ্যাঁ, এই হল চোদ্দো-র পাশের ঘর আর তার নম্বর হল... বারো! ওর ঘর! তার মানে, তেরো নম্বর ঘর বলে কিচ্ছু নেই? চুপচাপ করিডরে দাঁড়িয়ে গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে অ্যান্ডারসন কী কী করেছে, পড়েছে, বিশেষত খেয়েছে, তার একটা ফিরিস্তি বানাল নিজের মাথায়নাহ্‌! ও এমন কিছুই করেনি বা খায়নি যার ফলে এইরকম গোলমেলে ভুল, বা জেগে-জেগে স্বপ্ন দেখার অভিজ্ঞতা হবে ওর হাল ছেড়ে দিল অ্যান্ডারসন

সেদিন আর্কাইভে নিজের কাজের ফাঁকে তেরো নম্বর ঘরের রহস্যটা অ্যান্ডারসনকে ভাবিয়েই চলল কাজে উৎসাহ ফিরিয়ে আনার জন্য বিশপ ফ্রিস আর নিলসেন-এর চিঠিচাপাটি পড়তে গিয়েও ও হতাশ হল আগের দিনের তুমুল বাদানুবাদ বিশপের একটা চিঠির পর দুম করে শেষ হয়ে গেছিল চিঠিতে নিলসেন-এর উদ্দেশে বিশপ লিখেছিলেন, এই ধরনের অপপ্রচার এবং ঘৃণ্য আক্রমণ ইত্যাদির শিকার নিকোলাস ফ্র্যাংকেন আর এখানে উপস্থিত নেই, তাই তাঁকে নিয়ে আলোচনা অনুচিত কী হয়েছিল নিকোলাস ফ্র্যাংকেন-এর? এই রহস্যেরও সমাধান হল না অ্যান্ডারসন বিস্তর খুঁজেও আর কোথাও এমন কিছু পেল না যাতে বোঝা যায়, ফ্র্যাংকেন কোথাও চলে গেছিল কিনা, নাকি তার হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল, বা অন্য কিছু হতাশ হয়ে, একবার চোখের ডাক্তার দেখাবে কিনা সেই নিয়ে খানিক ভেবেও মনস্থির করতে না পেরে, অন্য নানা কাজে দিন কাটিয়ে হোটেলে ফিরল অ্যান্ডারসন রাতের খাওয়ার সময় অ্যান্ডারসনের পাশেই বসেছিলেন হোটেলের মালিক ক্রিশ্চেনসেন ভদ্রলোক রসিক মানুষ, মারাত্মক গপ্পোবাজও অজস্র গল্প এবং ঠাট্টার ফাঁকে অতিকষ্টে অ্যান্ডারসন ওর ঘরের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল সরাসরি কিছু বললে পাছে ভদ্রলোক রেগে যান, তাই একটু ঘুরিয়ে ও জানতে চাইল, “আচ্ছা, এই হোটেলে তেরো নম্বর ঘরটা কাউকে দেওয়া হয়নি কেন? এর উত্তরে ক্রিশ্চেনসেন নানা অভিজ্ঞতা, পিতৃ-স্মৃতি, পারিবারিক হোটেল ব্যাবসা, দিনকাল খারাপ হয়ে যাওয়া, এইসব মিলিয়ে যা বললেন তার সার হল, উনি নিজে অত্যন্ত আলোকপ্রাপ্ত হলেও হোটেলে যারা আসে সেই ব্যবসায়ী, সেলসের লোকজন, আর অল্প কিছু ভ্রমণপিপাসু, তাঁরা কিছুতেই ওই সংখ্যাটার সঙ্গে জড়িত নানা কুসংস্কার কাটিয়ে উঠতে পারেন না উনি দম নেওয়ার জন্য একটু থামামাত্র অ্যান্ডারসন সেখানে নিজের পরবর্তী প্রশ্নটা গুঁজে দিল, “তাই আপনি তেরো নম্বর ঘরটা কাউকে দেন না? এবার ভদ্রলোক একটু অবাক হয়েই বললেন, “না-না আমি তো সেটাই আপনাকে বোঝাচ্ছিলাম এতক্ষণ ঘর থাকলে কেউ সেটা নেয় না টাকা আর জায়গা দুটোই জলে যায় তাই এই হোটেলে তেরো নম্বর ঘরই নেই সেই জন্যই তো বারো আর চোদ্দো নম্বর ঘর এত বড়ো সাইজের অন্তত দিনের বেলা যে ও ঠিকঠাক দেখেছিল, সেটা বুঝে একটু নিশ্চিন্ত হয় অ্যান্ডারসন তারপর বলে, “আসলে গত দুরাতেই আমি আমার ঘরের পাশে একটা ঘর দেখেছিলাম” ক্রিশ্চেনসেন এর উত্তরে কিছু বলার জন্য মুখ খুলছেন দেখে অ্যান্ডারসন হুড়মুড়িয়ে বলে, “না চোদ্দো নম্বর নয় চোদ্দো আর বারো-র মাঝে আমি একটা ঘর দেখেছিলাম তাতে কেউ ছিলও।” উত্তরে অট্টহাসি, এবং ঘুমচোখো ব্রিটিশারের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে আরও কয়েকটা রসিকতা ছাড়া কিছু জানা গেল না তবে অ্যান্ডারসন হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিল না। ও এটা বুঝতে পেরেছিল যে ওর ঘরে একটা গণ্ডগোল হচ্ছে ওই মাঝরাত্তির নাগাদ, যেটার ব্যাপারে ক্রিশ্চেনসেন কিছু জানেন না তর্ক না করে ও বুদ্ধি খাটাল কথায়-কথায় অ্যান্ডারসন জেনেছিল, ক্রিশ্চেনসেন পুরোনো আর্ট প্লেটের অনুরাগী তাই ও নিরীহভাবে বলল, “আমার কাছে আর্কাইভ থেকে তোলা বেশ কিছু প্লেট আছে, যেগুলো কালকেই আবার ফেরত দিয়ে দিতে হবে যদি আপনি আজ রাতেই একবার আমার ঘরে আসেন তাহলে সেগুলো নিয়ে আপনার মতো সমঝদারের মূল্যবান মতামত পাওয়া যাবে।” ক্রিশ্চেনসেন সোৎসাহে রাজি হয়ে বললেন, “হোটেলের কাজকর্ম মিটিয়ে যেতে-যেতে প্রায় মাঝরাত হয়ে যাবে। তাতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না তো?” সজোরে মাথা নেড়ে অ্যান্ডারসন জানিয়ে দিল, না, এতে ওর কিছুমাত্র অসুবিধে নেই।

ভেতরে-ভেতরে দারুণ উত্তেজনা হলেও অ্যান্ডারসন নিজের কাজকর্ম কিছুটা এগিয়ে রাখবে বলে ঠিক করল। ঘরে যাওয়ার আগে আবার যাতে তেরোর গেরোয় পড়তে না হয়, সেজন্য ও এবার অন্য দিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠল, এবং এগারো নম্বর ঘর পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। তবে ঢোকার আগে একবার মুখ বাড়িয়ে পাশের ঘরটা দেখে নিতে ভোলেনি ও। তেরো নয়, চোদ্দো নম্বর ঘরের দরজাটাই দেখা যাচ্ছিল দূরে। সেই ঘরের বোর্ডার, জেনসেন নামের এক শান্তশিষ্ট জার্মান উকিল, যাঁর সঙ্গে খাওয়ার টেবিলে আলাপ হয়েছিল অ্যান্ডারসনের, ততক্ষণে দরজার বাইরে নিজের ভারী জুতোজোড়া ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছেন। নিজের মতো করে কাজ করছিল অ্যান্ডারসনআজ যাতে ওর ব্যাগটা খুঁজে পেতে সমস্যা না হয় সেজন্য ও ব্যাগটা দরজার পাশেই রেখেছিল। কাজের ফাঁকে হঠাৎ জানালার বাইরে ওর নজর পড়ল, যেখানে পাশের ঘরের বাসিন্দার ছায়াটা পড়েছে ওপাশের বাড়ির দেওয়ালে। মিস্টার জেনসেনের কি মাথায় গোলমাল হয়েছে? তা না হলে তিনি হঠাৎ অমন অদ্ভুতভাবে ঘরের মধ্যে নাচবেন কেন? অ্যান্ডারসন চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে গেল। হ্যাঁ, লালচে কমলা আলোয় প্রতিবেশীর অদ্ভুত, যন্ত্রণার খিঁচুনি আর আনন্দের উচ্ছ্বাস মেশানো হাত-পা ছোড়া বড়োই স্পষ্ট। চিন্তিত হয়ে অ্যান্ডারসন ভাবছিল, ভদ্রলোকের শরীর ঠিক আছে কিনা সে ব্যাপারে খোঁজ নেবে। তবে ঠিক এই সময়েই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। ঘরে ঢুকেই ক্রিশ্চেনসেন চমকে উঠলেন। চমকটা এতটাই জোরালো ছিল, আর সেটা যে ঘরের আয়তনের নাটকীয় পরিবর্তন নিয়েই হয়েছে, দুয়ের কোনোটাই তাঁর পেশাদারি হাবভাব দিয়ে লুকোনো গেল না। কিন্তু অ্যান্ডারসন সেই নিয়ে তাঁকে কিছু না বলে বরং প্লেটগুলো সযত্নে বের করল। প্লেটগুলোর বিষয়বস্তু, গুণমান, ক্রিশ্চেনসেনের অজস্র স্মৃতি, রসিকতা, এসবের মধ্য কীভাবে তেরো নম্বরের কথাটা তুলবে, অ্যান্ডারসন সেটাই ভাবছিল। ঘটনাক্রমে তখনই একটা ঘটনা ঘটল। পাশের ঘর থেকে একটা গান ভেসে এল।
গান... তবে তাতে সুরটা বড়ো অদ্ভুত। নীচু থেকে শুরু হয়ে সেটা উঁচুতে উঠে অদ্ভুতভাবে কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ধুলোভরা কুলুঙ্গিতে রাখা একটা বাঁশি, বা বুজে আসা শাঁখ দিয়ে বের করা হচ্ছে একটা তীব্র, তীক্ষ্ণ আওয়াজ। আওয়াজটা এতটাই উঁচুতে পৌঁছল যে অ্যান্ডারসনের মনে হচ্ছিল, ওর কান ফুটো হয়ে যাচ্ছে, দাঁতও শিরশির করছে। ক্রিশ্চেনসেনের মুখচোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তাঁরও একই অবস্থা। ওই উচ্চগ্রাম থেকে আওয়াজটা এবার নেমে এল। কিন্তু সেই নামারও কোনো তাল বা লয় ছিল না, বরং একটা চিমনির মধ্য দিয়ে হাওয়া যেভাবে গোত্তা খেয়ে নামে, তেমনভাবেই শব্দটা নীচু পর্দায় এসে হঠাৎ থেমে গেল। ক্রিশ্চেনসেন মুখ হাঁ করে বসে রইলেন।
অ্যান্ডারসনই মুখ খুলল, “আওয়াজটা পাশের ঘর থেকে এল না?”
“হ্যাঁ,” কপালটা মুছে বললেন ক্রিশ্চেনসেন, “উকিলদের নিয়ে অনেক কথা শুনেছি বটে। তবে রাতবিরেতে এইরকম কাজকারবার...!”
“কিন্তু ভদ্রলোককে দেখে তো বেশ শান্তই মনে হল,” অ্যান্ডারসন বলতে বাধ্য হল, “অবশ্য একটু আগে...”
জানালা দিয়ে দেখা নৃত্যরত ছায়াটার কথা বলতে যাচ্ছিল অ্যান্ডারসনতবে তার আগেই দরজায় সজোরে কেউ নক্‌ করল।
দরজা খুলেই অ্যান্ডারসন তার প্রতিবেশীর মুখোমুখি হল। জেনসেন যে ঘুম থেকে উঠে, কোনোক্রমে ড্রেসিং গাউন চড়িয়েই বেরিয়েছেন সেটা তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল।
“মাফ করবেন!” ভদ্রলোক যে বেশ কষ্ট করে রাগ চাপার চেষ্টা করছেন সেটা তাঁর কাঁপতে থাকা গলাই বুঝিয়ে দিল, “কিন্তু মাঝরাত্তিরে এইরকম চিৎকার করে আর পাঁচজনকে উত্যক্ত করার মানেটা কী, জানতে পারি?” ক্রিশ্চেনসেন তাঁর হোটেলের বোর্ডারকে কীভাবে সামলান তা দেখার মতো ধৈর্য অ্যান্ডারসনের ছিল না। ও সোজা প্রশ্ন করল, “আওয়াজটা আপনি করেননি?”
“আমি?!” ক্রুদ্ধ মানুষটি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তারপর এই ঘরের দু’জন, সামনে ছড়ানো আর্ট প্লেট, এসব দেখে ঘুম আর বিরক্তির চাদর সরিয়ে ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ঢোকে।
“তাহলে আপনারাও আওয়াজটা করেননি?” চোয়াল ঝুলে যায় ভদ্রলোকের, “কিন্তু আমার পাশের ঘর থেকেই তো আওয়াজটা এল!”
“আমরাও আওয়াজটা পাশের ঘর থেকেই পেয়েছি,” ক্রিশ্চেনসেনও এবারে কেটে-কেটে বলেন। “কিন্তু...” জেনসেন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তাতে ব্যাঘাত ঘটল। পাশের ঘর থেকে ভেসে এল একটা অদ্ভুত হাসি। শুধু হাসি নয়। হাসি, কান্না, হিংসে, রাগ, উল্লাস, হাহাকার... সব মিশে থাকা সেই আওয়াজ শুনে অ্যান্ডারসনের ঘাড়ের কাছের ছোটো-ছোটো চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল। ঘরে থাকা অন্য দু’জনের অবস্থাও যে একই রকম তা তাদের ফ্যাকাসে হয়ে আসা মুখ দেখে বোঝা গেল।
“আওয়াজটা তো আপনার ঘর থেকেই আসছে মিস্টার জেনসেন!” ক্রিশ্চেনসেনের ক্রুদ্ধ গলা শুনে অ্যান্ডারসন বোঝে, হোটেল মালিক নিজের স্বাভাবিক পালিশটা হারিয়েছেন এই অবস্থায়। নইলে একজন বোর্ডারের উদ্দেশে এভাবে চেঁচাতেন না তিনি।
“এই ঘর আর আপনার ঘরের মধ্যে তো আর কোনও ঘর নেই, তাই না?” দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়া অবস্থা সামলে প্রশ্ন করে অ্যান্ডারসন
“না, নেই,” নির্জীব গলায় বলেন চোদ্দো নম্বর ঘরের বোর্ডার। তারপর ইতস্তত করে যোগ করেন, “অন্তত আজ দিনের বেলায় ছিল না।”
“দিনের বেলায় ছিল না?” কথাটা পুনরাবৃত্ত করে অ্যান্ডারসন, “তার মানে এখন আছে?”
“এসব কী বলছেন!” গলায় জোর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন ক্রিশ্চেনসেন, হয়তো আলোচনাটা ব্যক্তির বদলে হোটেলের দিকে ঘুরছে দেখেই, “একটা নতুন ঘর রাতারাতি গজাবে কীভাবে?”
“নিজেই দেখে নিন না,” রেগে ওঠেন জেনসেন, “এত কথায় কাজ কী?”
অ্যান্ডারসন-ই নেতৃত্ব দিল। পিছু-পিছু, কিঞ্চিৎ কম্পমান অবস্থায়, বেরোলেন ভোগেল এবং ক্রিশ্চেনসেন পাশের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন সবাই

হ্যাঁ, সামনের দরজাটা দেখলে আর কোনও সংশয় থাকে না। তার ওপর জ্বলজ্বল করছে ‘তেরো’ নম্বর বসানো পেতলের তক্তিটা।
ঘরের ভেতর নিথর নীরবতা। তবে দরজার তলা দিয়ে সেই কম্পমান লালচে-হলুদ আলোটা দেখতে পাচ্ছিল অ্যান্ডারসন
অ্যান্ডারসনের খুব শীত করছিল। ভোগেলের অবস্থা যে আরও খারাপ, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁরই হোটেলে তাঁর অবর্তমানে একটা ঘর এইভাবে আবির্ভূত হয়েছে দেখেই হয়তো ক্রিশ্চেনসেন ভীষণ রেগে গেলেন। দরজার হাতলটা সজোরে ঘুরিয়ে, এমনকি সজোরে কয়েকবার ধাক্কা দিয়েও অবশ্য দরজাটা খুলতে পারলেন না তিনি।
“মিস্টার ক্রিশ্চেনসেন,” গম্ভীর গলায় বলল অ্যান্ডারসন, “আপনি আরও তাকতদার কাউকে জোগাড় করতে পারবেন? দরজাটা খোলা নিতান্তই জরুরি হয়ে উঠেছে।”
“হ্যাঁ,” সজোরে মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন জেনসেন, “এর শেষ দেখে ছাড়ব আমরা।”
ক্রিশ্চেনসেন দ্রুত নীচে নেমে গেলেন।
অ্যান্ডারসন আর জেনসেন চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকায় নৈঃশব্দ্যটা বিস্ফোরক হয়ে উঠল করিডরে।
অ্যান্ডারসনই কথা শুরু করল, “তাহলে তেরো নম্বর ঘর আছে?”
“সে তো দেখাই যাচ্ছে,” গাল চুলকে বলেন জেনসেন, “কিন্তু দিনের বেলা এটা থাকে না।”
“আচ্ছা...” অ্যান্ডারসনের হঠাৎ খেয়াল হয় ব্যাপারটা, “দিনের বেলা আপনার ঘরটাও কি...?”
“হ্যাঁ,” চোয়াল শক্ত করে বলেন জেনসেন, “ঘরটা অনেক বড়ো থাকে। তাতে জানলাও থাকে তিনটে।”
“আমারও!” প্রায় লাফিয়ে ওঠে অ্যান্ডারসনসিগারেটের টুকরোটা ধারের জানলা থেকে সরে মাঝের জানলায় চলে আসার রহস্যটা এবার পরিষ্কার হয় ওর কাছে। ওর ব্যাগটাও কোথায় ছিল সেই রাতে, সেটা ও বুঝতে পারে।

অ্যান্ডারসন গত রাতের অভিজ্ঞতা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করছিল। জেনসেন তেরো নম্বর ঘরের দরজাটা পেছনে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে সাগ্রহে সেগুলো শুনছিলেন। হঠাৎ অ্যান্ডারসন দেখতে পেল, দরজাটা খুলে যাচ্ছে। জেনসেন ওর বড়ো হয়ে ওঠা চোখজোড়া দেখে হয়তো কিছু আন্দাজ করে একটু সরে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেজন্যই দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা হাতটা অল্পের জন্য ওঁর নাগাল পেল না। হাত না বলে অবশ্য সেই সরু, কালচে, লোমশ, বড়ো-বড়ো নখসর্বস্ব জিনিসটাকে একটা থাবা বললেই ঠিক হবে! লোমের আড়ালে পার্চমেন্টের মতো সাদাটে খসখসে চামড়া দেখা যাচ্ছিল জায়গায়-জায়গায়। তার ওপর ছিল একটা শতছিন্ন পোশাকের হাতা। এক হ্যাঁচকা টানে জেনসেনকে সরিয়ে আনে অ্যান্ডারসন দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে যায়। চাপা গর্জনের সঙ্গে হালকা হাসি মেশানো একটা আওয়াজ ভেসে আসে ঘরের মধ্য থেকে। সেটা শুনে অ্যান্ডারসন আর জেনসেন, দু’জনেরই গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এক চুলের জন্য কার, বা কীসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন সেটা জেনে জেনসেন করিডরে, বিশেষত ওই দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইতস্তত করছিলেন। অ্যান্ডারসনের অবস্থাও বিশেষ সুবিধের ছিল না। এমন সময় ক্রিশ্চেনসেন লোহার গজালধারী দুই মুশকো চেহারার কর্মচারীকে নিয়ে হাজির হলেন। এবার অ্যান্ডারসন নয়, জেনসেনই সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন, একটু আগে কী হয়েছিল, এবং কী হতে যাচ্ছিল। শুনে দু’জন বলবানই ঝটপট হাতের যন্ত্রপাতি নামিয়ে রেখে পশ্চাদপসরণ করতে চাইল। ক্রিশ্চেনসেনও “এই রাতে এসব না করে কাল করলে হয় না?” ইত্যাদি আউড়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলেনতখন জেনসেন মোক্ষম অস্ত্র কাজে লাগালেন।
“এখানে আসার আগে কত কথা শুনেছিলাম ড্যানিশ সাহস নিয়ে,” অ্যান্ডারসনের উদ্দেশে, কিন্তু গোটা করিডরকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বললেন জেনসেন, “কিন্তু এখন দেখছি সেসব...!”
এক জার্মান ও এক ব্রিটিশের সামনে এমন কথা হজম করা নিতান্তই অসম্ভব। দরজার সামনে থেকে অ্যান্ডারসন ও জেনসেনকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দিয়ে পজিশন নিল ড্যানিশ সাহসের তিন প্রতিনিধি। একজন লোহার শিকটা তুলে, হাওয়ায় দুলিয়ে তার অবস্থানটা ঠিক করে নিয়ে ঠিক দরজার হাতল বরাবর নামিয়ে আনল সজোরে।
তখনই বাইরের উঠোনে ডেকে উঠল একটা মোরগ আর্তনাদ করে শিকটা হাত থেকে ফেলে দিল লোকটি।
করিডরে উপস্থিত সবাই সবিস্ময়ে দেখলেন, দরজাটা আর নেইতার বদলে ফিরে এসেছে সাদামাটা দেওয়াল, যাতে লোহার শিকের মারে একটা গভীর দাগ তৈরি হয়েছে।
করিডরের এক প্রান্তে থাকা জানালাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল অ্যান্ডারসন অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। শুরু হয়ে গেছে একটা দিন।
মিলিয়ে গেছে তেরো নম্বর ঘর।

এরপর অ্যান্ডারসন বা জেনসেনের পক্ষে যথাক্রমে বারো ও চোদ্দো নম্বর ঘরে একা-একা থাকাটা নিতান্তই অসম্ভব ছিল। ক্রিশ্চেনসেন কোনোভাবে একটা ডবল-বেডেড ঘর জোগাড় করে দেন দু’জনের জন্য। দিনের আলো ভালোভাবে ফোটার পরেই অবশ্য তাঁদের সবাইকে আবার ফিরে আসতে হয় অকুস্থলে। দুই ঘরের মাঝের দেওয়ালটাতে। বেশি লোক-জানাজানি যাতে না হয় সেজন্য ওই দুই কর্মচারীকে দিয়েই ঘরের দেওয়াল, আর তার লাগোয়া পাটাতনগুলো সরালেন ক্রিশ্চেনসেনঅ্যান্ডারসন আর জেনসেনও যথাসাধ্য সাহায্য করায় জিনিসটা বেরিয়ে এল। না, কোনো কঙ্কাল পাওয়া যায়নি ওখানে। একটা তামার বাক্স পাওয়া গেল, যার মধ্যে ছিল চামড়ার ওপর গভীর আঁচড় কেটে লেখা কিছু কথা। ক্রিশ্চেনসেনের চাপে অ্যান্ডারসনকেই নিজের জ্ঞানগম্যি কাজে লাগিয়ে লেখাটার পাঠোদ্ধার করতে হয়। লেখাটা একটা চুক্তিপত্র বলা চলে। কিছু পাওয়ার বিনিময়ে চিরকালীন ভিত্তিতে কিছু একটা অবস্থায় আটকে থাকার ব্যবস্থা। তাতে এক পক্ষের নাম বলা নেই, অন্য জন হল নিকোলাস ফ্র্যাংকেন।
চামড়ার গায়ের সব আঁচড় বা দাগের অর্থ বোঝেনি অ্যান্ডারসন। তবে সেগুলো যে কিছু একটা তারিখ বা তিথি বোঝাচ্ছে, সেটা ওর চোখে ধরা পড়েছিল। গত দু’দিন ধরে শহরে যে বিশেষ উৎসব চলছিল, সেটা অনেকদিন পর হল তিথি-নক্ষত্র মেনেই। সেজন্যই কি...?

ভিবর্গ শহরটা অ্যান্ডারসন আর জেনসেনের কাছে এরপর খুব একটা আকর্ষণীয় বলে মনে হয়নি। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী ক্রিশ্চেনসেনও ওই ঘরগুলো আর লোককে ভাড়া দেন না। ওগুলো গুদাম হিসেবেই কাজে লাগে এখন।
____________________
মূল কাহিনিঃ নাম্বার থার্টিন, লেখকঃ এম আর জেমস
প্রথম প্রকাশঃ গোস্ট স্টোরিজ অফ অ্যান অ্যান্টিকোয়ারি (১৯০৪)
_____

3 comments:

  1. অনুবাদের সম্ভার তো অসাধারণ। খুব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, এই আর কি।

      Delete
  2. darun likhechen..darun

    prosenjit

    ReplyDelete