উপন্যাস:: ময়ূখ ভিলা রহস্য - সত্যজিৎ দাশগুপ্ত


ময়ূখ ভিলা রহস্য
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত

।। ।।

আচ্ছা বল তো, তোর বাড়ির ঠিকানাটা যদি মেঘমালা অ্যাপার্টমেন্ট, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কালীঘাট, কলকাতা-২৬ না হয়ে অন্য কিছু হত, তাহলে কেমন হত?
সদ্য কিনে আনা কলকাতার ওপর বইটা দ্বিতীয়বার পড়তে পড়তে মাঝে একবার থেমে অনিদা প্রশ্নটা করল আমাকে।
অন্যরকম মানে?
আমি এই কয়েকদিন আগে ঘুরে আসা হিমাচলের ছবি দেখছিলাম কম্পিউটারে। অনিদার প্রশ্ন শুনে থামতে হল। ও তখন বইয়ের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, এই ধর, কলকাতা-২৬ না হয়ে যদিলিনগর-২৬ হত?
লিনগর-২৬!
এবার ছবি দেখা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল আমার। ও এবারও বইয়ের ওপর মুখ রেখেই বলল,  ১৭৫৬ সালে সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা অধিকার করে তার নাম পালটে দিয়েছিলেন।
কী সাংঘাতিক! কলকাতার বদলে আলিনগ! চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম আমি।
তাতে মুচকি হেসে অনিদা বলল, আসলে তার পরের বছরই সিরাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হেরে যান। আর...”
কলকাতা থেকে যায় কলকাতাতেই। অনিদার কথা শেষ করলাম আমি।
ঠিক তাই। বলে হেসে মাথাটা একবার সামনের দিকে ঝোঁকাল অনিদা।
আসলে একটা কেস সেরে সিমলা থেকে আসার পরপরই কলকাতা শহর নিয়ে পড়েছে অনিদা। বলছে, নিজের শহরকে ভালো করে জানতেই পারলাম না এখনও। এর থেকে আর লজ্জার কী হতে পারে?
অনিদার নতুন জিনিস নিয়ে পড়াশুনা করা মানেই আমারও অনেক কিছু জানা হয়ে যাওয়াএবারেও তাই হল। কিছু তথ্য আমার জানা থাকলেও অনেক কিছুই ছিল অজানা। যেমন, ১৭৭৫-এ নন্দকুমারের ফাঁসি, ১৮১৭-তে হিন্দু বা প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৯-এ প্রথম বাংলা দৈনিক সংবাদ প্রভাকরের আত্মপ্রকাশ বা ১৮৫৪ সালে প্রথম রেল চলাচল, যাতে করে কিনা কলকাতা থেকে হুগলী পর্যন্ত যাওয়া যেতঅথবা ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হওয়া - এর সবগুলোই ছিল আমার জানা। কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে যে প্রথম ছাত্র ছিল মাত্র কুড়িটা বা এই শহরে প্রথম মোটর গাড়ি দেখা গেছিল ১৮৯৬-তে অথবা ১৮৯৯ সালে তৈরি হয়েছিল প্রথম ইলেকট্রিসিটি কিংবা এসপ্ল্যানেড থেকে প্রথম ইলেকট্রিক ট্রাম চলেছিল ১৯০২-তে - এই জিনিসগুলো নতুন করে জানলাম।
দুপুরে খাবার পর থেকেই বসে রয়েছি অনিদার পড়ার ঘরে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলও চলে যেতে বসেছে। অলসভাবে কেটে চলেছে সময়। এ অবশ্য আমাদের কাছে নতুন নয়। কতদিন যে আমরা এইভাবে এই ঘরটাতে কাটিয়ে দিয়েছি তার হিসেব নেই।
কলকাতার ওপর বইটা আর দুপাতা পড়ার পর শরীরটা সোফার মধ্যে আর একটু গুঁজে আলস্যটাকে আরামে বদলে নিল অনিদা। আর ঠিক এই সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। সেটা শুনে অনিদা বই থেকে একবার মুখ তুলে দরজার দিকে দেখে নিয়ে বলল, বয়স্ক কোনও লোক হবেননিজেদের বাড়ির বেলটা মনে হচ্ছে একটানা বাজে
কী করে বুঝলে? অনিদার কথা শুনে অবাক হলাম।
বেল বাজানোর ধরন দেখে। অতিথির মধ্যে একটা স্থিরতা আছে। আর আমাদের টিংটং আওয়াজের বেলটার মধ্যে টিং আওয়াজটা হওয়ার বেশ কিছুক্ষ পরে টং আওয়াজটা হল। কারণ, ভদ্রলোক বেলটা টিপে সাথে সাথেই ছেড়ে দেননি। তার মানে হল, ওঁর অভ্যেস কলিং বেল টেপার পর বেশ কিছুটা সময় নিয়ে তারপর ছাড়ার। তাই বলছি, ওঁর বাড়ির বেলটা একটানা বাজে।
এত অল্প সময়ের মধ্যে ও এতকিছু বুঝল কী করে কে জানে! ততক্ষণে বিজুদা দরজা খুলে দিয়েছে। সদর দরজা বন্ধ করার পর জুতো ছাড়ার আওয়াজ পেলাম। এবার ঠকঠক করে একটা শব্দ কানে আসতে অনিদা বলল, লোকটার হাইট পাঁচ দশের কম নয়, আর সে লাঠি ব্যবহার করে।
আগন্তুক যে লাঠি ব্যবহার করে, ঠকঠক শব্দ শুনে সেটা আমিও বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু হাইটটা কী করে বুঝল সেটা জিজ্ঞাসা করার আগেই আবিষ্কার করলাম, আমাদের বসার ঘরের দরজার আড়াল থেকে ডানহাতে ধরা একটা লাঠি এসে আমাদের ঘরের মেঝেতে ঠক করে পড়ল। আর তার ঠিক পেছন পেছন এসে উপস্থিত হলেন হাতের মালিক। যেহেতু অনিদা আগে থেকেই লোকটা কতটা লম্বা সে সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিল, তাই আমার প্রথমেই নজর গেল ভদ্রলোকের উচ্চতার ওপর। চোখের ফিতেয় মেপে দেখলাম, উনি লম্বায় প্রায় অনিদার কাছাকাছিই হবেন। অর্থাৎ পাঁচ দশ কি এগারোউচ্চতাটা ঠিকঠাক মিলিয়ে নেবার পর এবার চোখ গেল ডানহাতে ধরা কারুকার্য করা লাঠিটার ওপর। এমন বাহারি লাঠি আজকাল কেউ ব্যবহার করে এমন খুব একটা দেখা যায় না। কাঠের লাঠির মাথাটা ঘোড়ার মাথার আকারের।
যে ভদ্রলোক ঘরে এসে ঢুকেছেন তাঁর বয়স হবে আনুমানিক পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর। গায়ের রং ফর্সা। লম্বাটে মুখের গড়ন। দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কাটা। মাথাভর্তি পাকা চুলগুলো পাট করে ব্যাক-ব্রাশ করা। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। পাতলা ঠোঁট জোড়াতে একটা হালকা হাসি লেগে রয়েছেচোখমুখ ওঁর চরিত্রের দৃঢ়তার পরিচয় দিচ্ছিল। শক্ত চওড়া কাঁধের অধিকারী এই অতিথির পরনে ছিল দামি কারুকার্য করা ঘিয়ে রঙয়ের পাঞ্জাবী আর তার সাথে মানানসই ধুতি। লক্ষ করলাম, চেহারা থেকে পোশাক, ওঁর প্রতিটা জিনিসেই একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া রয়েছে
ঘরে ঢুকেই উনি আমাকে আর অনিদাকে পালা করে তীক্ষ্ণদৃষ্টি দিয়ে মেপে নিয়ে অনিদার দিকে চেয়ে মোটা রাশভারী গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনিই কি অনিরুদ্ধ সেন?
হ্যাঁ। ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে বলল অনিদা।
হ্‌, নাইস টু মিট ইউ। বেশ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে বললেন ভদ্রলোক।
অনিদা এবার ওঁকে ডানদিকের সোফাটার দিকে ইশারা করে বলল, বসুন।
ধন্যবাদ। বলে সোফায় বসে হাতে ধরা লাঠিটা তার গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। অনিদা ততক্ষণে আমাকে চোখের ইশারায় হুকুম করে দিয়েছে ওঁর জন্য চা আনানোর। সেইমতো আমিও এতটুকু সময় নষ্ট না করে ওর হুকুম চালান করে দিয়েছি বিজুদার কাছে।
ভদ্রলোককে বসতে দিয়েই সরাসরি প্রসঙ্গে গেল অনিদা। বলল, বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?
তার আগে আমি আমার পুরো পরিচয়টা দিয়ে নিই। বলে ভদ্রলোক জানালেন, ওঁর নাম রূপেন রায়। থাকেন ডানলপে।
এমনিতে তো নিজের গাড়িতে এসেছেন। কিন্তু আসার সময় শ্যামবাজার অঞ্চলে একবার নামতে হয়েছিল মনে হচ্ছে?
অনিদার প্রশ্নে অবাক হলেন রূপেন রায়। হা হা করে হালকা একটা একটা হাসি দিয়ে বললেন,এগুলো জানলেন কী করে?
তাতে অনিদা বলল, এইমাত্র একটা গাড়িকে আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াতে শুনলাম। আর তার ঠিক কিছুক্ষ পরেই এলেন আপনি। তাই আন্দাজ করে নিলাম আপনি গাড়ি করে এসেছেন। আর আপনার পোশাকের বেশ কিছু অংশ, বিশেষ করে কাঁধের কাছটা বেশ ভিজে। তাছাড়া আপনার ডান পায়েও কাদা লেগে রয়েছে। বলে ওঁর ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে ইশারা করে অনিদা বলল, আসলে এক বন্ধু শ্যামবাজারে থাকে। একটু আগেই ও হোয়াটস অ্যাপে জানিয়েছে যে ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে।
অনিদার কথা শুনে রূপেন রায়ের মুচকি হাসিটা গাল পর্যন্ত ছড়াতে বুঝতে পারলাম অনিদা এর মধ্যেই ওঁর মন জিতে নিয়েছে। বললেন, আপনার দৃষ্টির তারিফ না করে পারছি না।
অনিদা এই প্রশংসাটা ওঁকে বুঝতে না দিয়ে হজম করল। অবশ্য আমার কাছে ওর এই না দেওয়া অভিব্যক্তিটা পরিচিত। তাই বেশ বুঝতে পারলাম যে মনে মনে ও বেজায় খুশি হয়েছে। এবার কলকাতার বইটাতে একটা বুক মার্কার গুঁজে সামনের সেন্টার টেবিলটাতে রেখে আরেকটু আয়েশ করে সোফায় বসে ওঁকে বলল, বলুন, আপনার এখানে আসার কারণটা কী?
বিজুদা এর মধ্যে চা আর পনিরের পকোড়া দিয়ে গেছেঅনিদা এবার ইশারায় অনুরোধ করাতে ভদ্রলোক প্লেট থেকে একটা পকোড়া মুখে পুরে চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক মেরে তাঁর সমস্যার কথা বলতে শুরু করলেন।
রূপেন রায় পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ধর্মতলায় কিউরিও শপের দোকান আছে। শুরু হয়েছিল ঠাকুরদার আমলে। উনি অকৃতদার। পিছুটান বলে কিছু নেই। ব্যাবসা করতে করতে আর দেশবিদেশ ভ্রমণ করতে করতে সংসার করার আর সময়ই পাননি ওঁর বয়স এখন সাতষট্টি। রোগ-ব্যাধি শরীরে তেমন বাসা বাঁধতে পারেনি বললেই চলে। তবে হাঁটুটা মাঝে মধ্যে একটু বেইমানি করে। তাই এই লাঠির ব্যবস্থা।
ভদ্রলোকের সারাটা দিনই কাটে ব্যাবসার পেছনে। নতুন নতুন কিউরিও ঘাঁটতে ঘাটঁতেই ওঁর প্রায় পুরোটা জীবন কেটে গেছে। ব্যাবসার পাশাপাশি পুরনো জিনিস নিয়ে পড়াশুনা আর সেগুলো সংগ্রহ করতে উনি বিশেষ পছন্দ করেন। অনিদারও পুরনো জিনিসের ওপর বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। তাই প্রসঙ্গটা উঠতে লক্ষ করলাম, ওর চোখের পাতা পতে গিয়েও আটকে গেল এবার যখন জানতে পারল যে সুলতানি আমল থেকে শুরু করে মোগল বা পাল রাজাদের অথবা ব্রিটিশদের ব্যবহার করা জিনিসও আছে রূপেন রায়ের সংগ্রহে, তখন বাহ্‌, তাই নাকি!’ বলে চোখ কপালে তুলল। ওর প্রশংসাটা খুশি হয়ে গ্রহণ করে আবার বলতে থাকলেন রূপেন রায়।
গত মাসে ছুটি কাটাতে কাশ্মীর গেছিলেন ভদ্রলোকআর সেখানে ঘটনাচক্রে ওঁর হাতে চলে আসে একটা মহা মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। সারদা লিপি।
সারদা লিপি! চোখ বড়ো বড়ো করে অনিদা বলল, অষ্টম শতাব্দীতে যে লিপি ব্যবহার হত সংস্কৃত আর কাশ্মীরি লিখতে?
ঠিক তাই। বললেন রূপেন রায়।
বহুবছর পুরনো সেই লিপির এখন দাম নাকি আকাশছোঁয়া। জিনিসটা আসল কি না জিজ্ঞাসা করতে ভদ্রলোক বললেন যে তেমন না হলে উনি সেটা ওঁর সংগ্রহশালায় রাখতেনই না।
হুম। ছোট্ট কথায় উত্তর সেরে নিদা আবার ওঁকে বলতে দিল।
আমার মন বলছিল যে এই পাণ্ডুলিপি পাওয়াটাই ওঁর সমস্যার তৈরি করেছে।
আসলে কী জানেন, বলে একটা গলাখাঁকারি দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ওই পান্ডুলিপিটা পাওয়ার পর থেকেই সবকিছু ওলটপালট হতে শুরু করেছে
ওলটপালট! সেটা কেমন? ভুরু কুঁচকে গেল অনিদার।
উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমে একটু সময় নিলেন রূপেন রায়। তারপর যা বললেন, তা অনেকটা এই -
সেদিন ছিল শুক্রবার। বিকেলে দোকান থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছি। বাড়িতে ঢুকতেই আমার কাজের লোক সবুজ কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট দিয়ে আমায় জানাল যে বিকেলে কেউ সেটা দরজার সামনে রেখে গেছে। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দেখলাম যে তাতে আমার নাম লেখা রয়েছে। ভাবলাম, আমাকে এভাবে কে কী পাঠাতে পারে? আর আশ্চর্যের বিষয় হল এই যে, পোস্টাল বা ক্যুরিয়র যাই হোক না কেন, তার বাহক সেটা সই না করিয়ে জিনিসটা কার হাতে তুলে দেবে না। অথচ এটা কে দিয়ে গেল সেটাই জানা যায়নি
শুনেছি কারও সাথে শত্রুতা থাকলে আজকাল লোকজন এইভাবে বাক্স করে বোম-টোম পাঠায়। কিন্তু বাজারে আমার যথেষ্ট সুনাম। আর ব্যক্তিগত জীবনেও কোনও শত্রু নেইতাহলে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে বাক্সটা খুলতে তাজ্জব বনে গেলামঢাকনা খুলতে আবিষ্কার করলাম, তাতে রয়েছে প্লাস্টিকের একটা খেলনা পিস্তল!
পিস্তল!
গলার স্বর শুনেই বুঝলাম এমন অদ্ভু উপহারের কথা শুনে অনিদাও বেশ অবাক হয়েছে। ছোট্ট করে বলল, আশ্চর্য! এবার জিজ্ঞাসা করল, তারপর?
তারপর আর কিছুই না। পিস্তলপর্ব শেষ হয়ে গেল ওখানেই। সেটা নিয়ে আর কিছু বাড়াবাড়ি হয়নি। প্রথমটায় তাই ভেবেছিলাম, আমার সাথে কেউ হয়তো প্র্যাক্টিক্যাল জোক করছে। যদিও তার কারণ আন্দাজ করতে পারিনি। বাড়ির অন্যদের দেখিয়েছিলাম। সবাই হেসেই উড়িয়ে দিল। তাই ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ভুলে গেছিলাম। কিন্তু এর ঠিক সাতদিন পর এল আরেকটা প্যাকেট। আশ্চর্যের ব্যাপার, সেদিনও ছিল শুক্রবার! রাতে বাড়ি ফিরতে আমার কাজের লোক আবার সবুজ কাগজে মোড়া প্যাকেট আমার হাতে দিল। এবারে কিন্তু মোটেও সুবিধের মনে হল না ব্যাপারটা। প্যাকেটের সাইজ এবং সেটার ওপর সাঁটা মার্বেল পেপারের ধর দেখেই বুঝলাম, এটাও একই লোকের পাঠানো। একবার নেড়েচেড়ে দেখলাম বাক্সটা। ভেতরে যে কিছু একটা আছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। দোনামনা করতে করতে এবার খুলে ফেললাম সেটা। আর এবার সেটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল পাতলা রবারের তৈরি কালো রঙয়ের একটা মুখো চোখ, নাক আর মুখের কাছটা কাটা।
মুখো! ইন্টারেস্টিং! বলে চায়ের কাপে আবার চুমুক মারল অনিদা।
আমার তখন গলার কাছটা শুকোতে শুরু করেছে।
রূপেন রায় বলতে থাকলেন
অবশ্য এবারেও কিছু ঘটল না। তবে জিনিসটা আমাকে যে ভাবিয়েছিল তা অস্বীকার করব না। একবার ভাবলাম, পুলিশে খবর দিলে কেমন হয়? তারপর মনে হল, প্যাকেটগুলো আমার কাছে আসছে বটে, কিন্তু তাতে তো আমার কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। তাহলে আরেকটু দেখাই যাক না।
এই পর্যন্ত প্যাকেট পেয়েছিলাম মোট দুটো। এবার তিন নম্বর প্যাকেটটা পেলাম তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে। মানে পরের শুক্রবার। সেই একইরকম প্যাকেট, একইরকম সবুজ মার্বেল পেপারে মোড়ামনের ভেতর একটা দুরু দুরু ভাব অনুভব করলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম এটা আগেরগুলোর থেকে ভারী। এবার সেটা খুলতে সেটার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল প্লাস্টিকের তৈরি একটা মড়ার খুলি আর একজোড়া হাড়
বাক্সের ভেতরের জিনিসগুলোর কথা শুনে ঝট করে সোজা হয়ে বসল অনিদা। সচরাচর নিজের অনুভূতিটাকে বাইরে প্রকাশ হতে দেয় না ও। কিন্তু মড়ার খুলির কথা শুনে উত্তেজনাটাকে লুকোতে পারল না। আমার বুক এর মধ্যেই ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করেছে। এমন একটা সাংঘাতিক উপহারের কথা শুনে এমনিতেই গরম চা বেশি করে মুখে নিয়ে ফেলেছি। এবার নিজের ঠোঁটে নিজেই ফুঁ দিতে দিতে সোফায় আরেকটু জমিয়ে বসলাম। অনিদার দিকে তাকাতে দেখি, ও একদৃষ্টে মিঃ রায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে। কপালে চারটে ভাঁজ। চায়ের কাপটা শক্ত করে ডানহাতে ধরা। ওর এই চাউনি আমার অচেনা নয়। তাই আমি নিশ্চিত, কেস যাই হোক না কেন, এটা ও নেবেই।
মিঃ রায় আবার বলতে শুরু করলেন।
প্যাকেটে আসা জিনিসগুলোর একটারও মানে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে প্রথমদিকে তৈরি হওয়া ভয়টা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আমি ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতে শুরু করলাম। কিন্তু মনে ভয় ঢুকল গত সোমবারসেদিন রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে বরাবরের অভ্যেসমতো একটা বই নিয়ে বিছানায় গেছিরাত প্রায় বারোটা পর্যন্ত আমার বই পড়া অভ্যেস। তখন সাড়ে বারোটার কাছাকাছি হবে। পড়তে পড়তে কখন জানি না ঘুমে ঢলে পড়েছি হঠাৎ আচমকা একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল মনে হল, কেউ বাইরে থেকে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। ধড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। পা টিপে টিপে এবার দরজার কাছে এগিয়ে আচমকা দরজা খুলতেই আগন্তুক ঘাবড়ে গেল। ভয় পেয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না প্রথমটায়। আমি এবার কে বলে চেঁচিয়ে উঠতে সে আমাকে একটা ধাক্কা মেরে ফেলে পালিয়ে গেল। লাইট বন্ধ থাকাতে লোকটাকে সেদিন চিনতে পারিনি। তবে একথা বলতে পারি যে, সে-লোক পুরুষমানুষ এবং বেশ লম্বা।
হুম। সেকেন্ড দুয়েক কী যেন চিন্তা করল অনিদা। এবার বলল, তার মানে আপনি চান যে সেই রাতের অতিথিকে আমি ধরে দিই?
শুধু রাতের অতিথি না, সেই তিনটে প্যাকেটের রহস্যও উদ্ধার করতে হবে আপনাকে বেশ অনুনয় করে বললেন মিঃ রায়। তারপর বললেন, আর সেই পান্ডুলিপির মানেও উদ্ধার করতে হবে। কারণ, আমার মন বলছে যে ওটার মধ্যে আছে ভীষণ মূল্যবান কিছু তথ্য
সত্যি কথা বলতে কী, রাতের সেই হামলাটার থেকেও আমার মন কেড়েছিল সেই তিনটে প্যাকেট। অনিদা কী ভাবছিল তা জানি না, তবে কেসটা যে ও হাতে নিয়ে নিয়েছে তা বুঝতে পারলাম ওর প্রশ্নগুলো শুনেই।
প্যাকেটগুলো ঠিক কখন এসেছিল?
এগজ্যাক্ট টাইমিং তো বলতে পারব না, তবে কাজের লোকের কথা অনুযায়ী ও প্রত্যেকবারই ওগুলো পেয়েছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ।
ঠিক সেই সময় কে কে এসেছিল আপনার বাড়িতে? এবার প্রশ্নপর্বটাকে আস্তে আস্তে লম্বা করতে শুরু করল অনিদা।
কেউ না। মাথা নেড়ে মিঃ রায় বললেন, তিনদিনের কোনদিনই সেই সময় আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনি। একমাত্র বাগানের মালিটা ছাড়া।
মালি? ভুরু কুঁচকে গেল অনিদার।
হ্যাঁ, আমার বাড়ির কাছে আলি বলে একটা লোক থাকে। ওকে আমি মালির কাজে লাগিয়েছি। প্রতি শুক্রবার ওই সময় ও আসে।
প্রতি শুক্রবার? প্রশ্নটা করে সন্দেহ আর কৌতূহল নিয়ে অনিদা আমার দিকে তাকাল।
এবার হালকা কিছু কথাবার্তায় আমরা রূপেন রায়ের বাড়ির লোকজনের সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানতে পারলাম।
পীযূষ রায়, মানস মিত্র আর কৌশিক সেনগুপ্ত জোয়ান পুরুষমানুষ বলতে রূপেন রায়ের বাড়িতে এই তিনজন। পীযূষ রায় সম্পর্কে রূপেন রায়ের বোনপো। ছেলেবেলায় বাবা-মা মারা যাবার পর উনিই ওকে বড়ো করেন। ভেবেছিলেন বোনপোকে উচ্চশিক্ষিত করবেন। কিন্তু কলেজে উঠে কুসঙ্গে পড়ে বখে যেতে থাকে সে। শেষপর্যন্ত অবশ্য পথে ফেরে পীযূষ রায়। এখন সে কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির উচ্চপদস্থ অফিসার। রূপেন রায় নিজের সোর্স ব্যবহার করে ওকে কাজে ঢুকিয়েছিলেন।
মানস মিত্র রূপেন রায়ের ব্যাবসার প্রধান স্তম্ভ। প্রথমটায় সামান্য কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে প্রখর বুদ্ধির অধিকারী এবং কর্মঠ হওয়ার দরু কয়েক বছরের মধ্যেই উনি হয়ে ওঠেন ব্যাবসার সেকেন্ড ম্যান। ওঁর বাড়ি পুরুলিয়ায়। সেখান থেকে রোজ যাতায়াত করা সম্ভব নয়তাই প্রথমে কলেজ স্ট্রিটের একটা মেসে থাকতেনপরে মিঃ রায়ের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার জন্য উনি ওঁকে নিজের বাড়িতে এনে তোলেন।
কৌশিক সেনগুপ্ত হ মিঃ রায়ের খুব দূর সম্পর্কের এক মামাতো ভাইয়ের ছেলে। বছর পাঁচেক আগে পরিবার হারা হওয়ার পর থেকে ও এই রায়বাড়িতেই রয়ে গেছে। একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করলেও সে মূলত একজন থিয়েটার আর্টিস্ট। গত কয়েক বছর বেশ কিছু নামকরা প্রোডাকশনে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেবেচারার নিজের বলতে কেউ নেই।
এই তিনজন ছাড়া বাড়ির সদস্য বলতে রয়েছে রূপেন রায়ের কাজের লোক ভানু। আজ প্রায় তিরিশ বছর সে আছে এই বাড়িতে। বলতে গেলে রায়বাড়ি এর কাঁধে ভ করেই টিকে আছে।
আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম যে অনিদা এই কেসটা নিয়ে আগ্রহীএবার ঠিকানা চাইতে নড়েচড়ে বসলাম। রূপেন রায় তখন পকেট থেকে পার্স বের করে তার থেকে একটা কার্ড নিয়ে অনিদার দিকে এগিয়ে দিলেন। অনিদা সেটা নিয়ে সাথে সাথে পকেটে চালান করল। রূপেন রায় এবার পাশ থেকে লাঠিটা নিয়ে তাতে ভ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডানহাতটা এগিয়ে দিলেন অনিদার দিকে ঠিক হল, আগামীকালই আমরা ওঁর বাড়ি যাব
অনিদা এবার ওঁকে বলল, একটা প্রশ্ন।
এতে কপালটা একটু কোঁচকাল রূপেন রায়ের। যার মানে হল, কী?
সারদা লিপি নিয়ে কা সাথে আলোচনা করেছিলেন?
অনিদার প্রশ্ন শুনে মিঃ রায় চোখ কপালে তুলে বললেন, পাগল! তবে ওটায় লেখা জিনিসটার মানে আমায় জানতেই হবে।

।। ।।

আমি যে অনিদার অ্যাসিস্ট্যান্ট, এই প্রথম তাতে কেউ সন্দেহ প্রকাশ করল না। আসলে আমি যে অনিদার তদন্তগুলোতে ওর সাথেই থাকি সেকথা প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের মায়েরা ছেলেবেলাকার বান্ধবী। অবশ্য বাইরের লোকের কাছে আমরা নিজেদের মাসতুতো ভাই বলেই পরিচয় দিই।
চোর কি পান্ডুলিপিই চুরি করতে এসেছিল, অনিদা? বেশ অনেক্ষ ধরে অনিদাকে পায়চারি করতে দেখে কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম ওকে। কারণ, ও কী ভাবছিল সেটা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিল।
আমার প্রশ্ন শুনে অনিদা বলল, মিঃ রায়ের মুখ থেকে যা শোনা গেল তাতে এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়
ওর কথা শুনে বুঝলাম, ও একটামাত্র ধারণাতে আটকে নেই। ওর মনে অনেক কিছু ঘুরছে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কেসটা নিলে কেন? পান্ডুলিপির জন্য?
আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে ও একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি তখন আবার জিজ্ঞাসা করলাম, বাক্সগুলোতে যেগুলো ছিল তার প্রত্যেকটাই নিশ্চয় একেকটা সংকেত?
তাতে ও, আলবাত! বলে হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে সোফায় এসে বসল। তারপর বলল, ওগুলোর রহস্য উদ্ধার করতে পারলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
তারপর সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে বলল, একটা পিস্তল, একটা মুখো, একটা মড়ার খুলি আর একজোড়া হাড়। কিন্তু এগুলোর মানে কী? বলেই ঝট করে চোখ মেলে তাকাল ও। তারপর তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করা শুরু করল। এবার মুখ দিয়ে বার দুয়েক চুক চুক করে শব্দ করে মাথা নেড়ে বলল, নাহ্‌, বোঝা যাচ্ছে না।
এরপর কাটল আরও প্রায় মিনিট দশেক। আমরা দুজনেই চুপচাপ। এর মধ্যে অনিদা একবার সেকেন্ড দশেকের জন্য সোফায় বসেছে, বার চারেক ঘরের এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করেছে, কিছুক্ষ জানালার গ্রিলে মাথা রেখে কী যেন ভেবেছে আর শেষে ঘরের চলন্ত পাখার দিকে চেয়ে থেকে নিজে নিজে কী যেন একটা বলেছে।
এবার বলল, আচ্ছা জয়, এই তিনটে জিনিসের মধ্যে কোন জিনিসটা তোর সবথেকে বেশি ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে?
আমি বললাম, কঙ্কাল আর হাড়দুটো
হুম, আমারও তাই। বলল অনিদা। তারপর বলল, কঙ্কালের মাথা দেখলে তোর কী মনে হয়?
আমি তাতে বার দুয়েক ঢোঁক গিলে বললাম, মৃত্যু।
মৃত্যু?
উত্তরটা শুনে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল অনিদা। তারপর নিরাশ ভঙ্গীতে ঠোঁট উলটে বলল, নাহ্‌ তা হবে না। তা কী করে হয়?
শেষের কথাগুলো অনিদার নিজের নিজেকে বলাএবার গলা নামিয়ে বলল, প্রত্যেকটা প্যাকেটই শুক্রবার এসেছিল। আর বাইরের লোক বলতে সেদিন এই সময় বাড়িতে শুধু আলি ছিল।
তার মানে কি আলিই প্যাকেটগুলো পাঠাচ্ছে?
আমার প্রশ্নে ও মাথা নেড়ে বলল, সে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
আমি তখন বললাম, আজ তো বুধবার। তাহলে পরশু শুক্রবারও কিছু একটা আসা উচি?
আমার কথার সায় দিল না অনিদা। অবশ্য নাকচও করল না। তবে আগামী পরশু আর কিছু আসবে কি আসবে না তার থেকেও ও বেশি চিন্তা করছে বাক্স করে আসা তিনটে জিনিসের মানে বের করার। অবশ্য এখনও কিছু সে ব্যাপারে আন্দাজ করে উঠতে পারেনি
এর মধ্যে বিজুদা আরেক কাপ করে চা দিয়ে গেছে। অনিদা এবার চা নিয়ে ব্যালকনিতে গেল। আমি এদিকে প্যাকেটে আসা জিনিসগুলোর মানে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।
আজ আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে হট্টগোল অনেক কমঅন্যদিনের তুলনায় গাড়ির আনাগোনা আমাদের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে বিশেষ নেই বললেই চলে। সকালে যখন জগিংয়ে গেছিলাম, তখনই দেখেছি আমাদের ফ্ল্যাটের উলটোদিকে গজ তিরিশেক দূরে প্রায় দেড় মানুষ সমান একটা গর্ত খোঁড়া হয়েছেমিউনিসিপালিটি থেকে লোক এসেছে। কলের কাজ হচ্ছে। গাড়িঘোড়া খুব একটা যাচ্ছে না। তাই চারদিক কেমন যেন চুপচাপ। মাঝে মধ্যে অবশ্য দুয়েকটা সাইকেল বা মোটর সাইকেল গেলেও সেগুলো খুব একটা আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না।
আরও বেশ কিছুটা সময় কেটেছে এমন সময় চেঁচিয়ে আমাকে ডেকে উঠল অনিদা জয়, এখুনি এদিকে আয়!
ওর এই উত্তেজিত গলার স্বর আমার চেনা। নিশ্চই কিছু একটা পেয়েছেসাথে সাথে দৌড়ে গেলাম বারান্দায়। ও তখন ব্যালকনির রেলিংয়ে শরীরটাকে অর্ধেক ঝুলিয়ে ঝুঁকে পড়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।
কী হল, অনিদা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
তাতে সামনে রাস্তার দিকে ইশারা করে ও বলল, সামনে দেখ।
গলার স্বরই বলে দিচ্ছিল ও কতটা উত্তেজিত।
কী দেখব?
ওইদিকে
ওর ইশারাকে অনুসরণ করে নজর ঘোরাতে দেখলাম, ও আমাদের ফ্ল্যাটের রাস্তার উলটোদিকে খোঁড়া জায়গাটাকে দেখাচ্ছে।
ও তো রাস্তা খুঁড়েছে বললাম আমি।
“খোঁড়া জায়গাটার সামনে ওটা কী দেখ!
গলায় রহস্য পেয়ে ওর দিকে নজর ঘোরাতে দেখলাম ওর চোখের পলক পড়ছে না এবার রাস্তার দিকে চোখ ফেরাতে জিনিসটা চোখে পড়ল।
আরে, ওটা তো...” কথা আটকে গেল আমার। কারণ, ততক্ষণে আমার চোখ আটকে গেছে রাস্তার উলটোদিকে বসানো টিনের কালো বোর্ডটার ওপরযেটার ওপর সাদা রংয়ে আঁকা রয়েছে একটা কঙ্কালের মাথা এবং তার ঠিক নিচে আড়াআড়িভাবে মানুষের দুটো হাড়! আর তারও নিচে গোটা গোটা বাংলায় পরিষ্কার লেখা - সাবধান!
অনিদা এবার ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ডান গালে একটা একপেশে হাসি টেনে বলল, এবার বুঝতে পারছিস?
সাবধান! তার মানে কেউ রূপেন রায়কে সাবধান করতে চায়! ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম আমি
তাহলে কী দাঁড়াল? রহস্য করে বলল অনিদা।
বুঝতে পারছিলাম, আমাকে দিয়েই ও কথাটা বলাবেআমি তখন বললাম, বিপদ! তার মানে প্রেরক রূপেন রায়কে আগে থেকে সাবধান করে বোঝাতে চাইছে যে ওঁর বিপদ!
কা-রে-ক্ট!
অনিদার প্রত্যেকটা অক্ষরের টেনে টেনে উচ্চারণ আর আমার কাঁধে চাপড় মারা দেখেই আন্দাজ করলাম আমার বুদ্ধির ঠিকঠাক ব্যবহারে ও কতটা খুশি।
কিন্তু কীসের বিপদ? কার দিক থেকে বিপদ? আর কেই বা ওঁকে সাবধান করতে চাইছে? তাছাড়া ওই পিস্তল আর মুখোশের মানেটা কী?
দাঁড়া দাঁড়া, আমার প্রশ্নের ফুলঝুড়ি দেখে অনিদা হেসে বলল, এত তাড়াহুড়ো করলে হবে না। আস্তে আস্তে সময় নিয়ে ওগুলোর মানে বের করতে হবে।
ব্রেকফাস্ট সেরে অনিদা ঘণ্টা তিনেকের জন্য বেরিয়েছিল। কোথায় সেটা আমায় বলেনি। এগুলোই আমার ভালো লাগে না। সাগরেদই যদি হব, তাহলে এত লুকোচুরি কেন?
ও যে সারদা লিপির ব্যাপারে অনেক কিছু জেনে ফেলেছে তা বুঝতে পারলাম ওর বলা তথ্যগুলো শুনেপশ্চিম পাকিস্তানের হুণ্ড গ্রামে সারদা লিপির আবিষ্কার হয়। লিপিটা লেখা হয়েছিল আনুমানিক ৭৭৪ খ্রিস্টাব্দেএগারো শতকে দেবনাগরী লিপি চলে আসার পরেও এই লিপি তার জনপ্রিয়তা হারায়নি। ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে গুপ্ত লিপির প্রচলন ছিল। তার থেকেই উৎপত্তি সারদা লিপির। এর আগে যেমন প্রচলন ছিল ব্রাহ্মী লিপির।
অনিদা অবশ্য এর আগেও লিপি-টিপি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলতে পুরীর উদয়গিরি আর খণ্ডগিরিতে দেখা পাহাড়ের গায়ে লেখা পালি লিপি।
আমাদের খাওয়াদাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, অনিদা তখন আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করল, হিন্দুদের কোন দেবীর আরেক নাম সারদা?
এটা আমার জানা ছিল। তাই সাথে সাথে উত্তর দিলাম, সরস্বতী।

ডানলপ থেকে যে রাস্তাটা দক্ষিণেশ্বরের দিকে বেঁকে গেছে, সেদিকে ঢুকেই ডানদিকের একটা গলি নিতে হল আমাদের। রাস্তার নাম দেখে আরেকটু এগোনোর পর এবার নম্বর মিলিয়ে যে বাড়ির সামনে এসে থামলাম, সেটার আকার নেহাত খুব একটা ছোটো নয়। প্রায় আড়াই মানুষ উঁচু মূল ফটকের ওপর লেখা রয়েছে ময়ূখ ভিলাপুরনো আমলের গ্রিলের দরজার সামনের সরু আঁকাবাঁকা রাস্তাটা দুপাশের বাগানের মধ্য দিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দায় মিলেছে। বাড়িটার বয়স কম করে দেড়শো হবেই। উত্তর কলকাতার সাবেকি বাড়ি হিসেবে এই বাড়িটার উদাহরণ দেওয়াই যায়
দোতলার গোলাকার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন রূপেন রায়। আমাদের দেখে হাত নাড়তে অনিদাও তার উত্তরে হাত নাড়ল। এবার উনি আমাদের উদ্দেশ্যে গলা তুলে বললেন, ভানু নিচেই আছে। সোজা ওপরে চলে আসুন। ও-ই আপনাদের রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
রূপেন রায় ভানু নামটা বলার সাথে সাথে আমার একতলার দরজার দিকে নজর গেল। আবিষ্কার করলাম আন্দাজ বছর পঞ্চাশের সামান্য বেশি একজন রোগা মানুষকেপরনে ফতুয়া আর পায়জামা। ঝুলে পড়া কাঁধ-জোড়া বলে দিচ্ছিল যে সেগুলোর ওপর ভর করেই বেঁচে আছে রায় পরিবার। বুঝলাম, ইনিই হলেন ভানুএখন থেকে একে আমি অবশ্য ভানুদাই বলব
আমাদের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে এলেন ভানুদা। আমরা এবার ওঁর দিকে এগিয়ে যেতে উনি বললেন, আসুন বাবুরা, দাদাবাবু ওপরে আছেন।
বাড়ির দরজা পেড়িয়ে ছোট্ট একটা হলঘর। সেটার শেষপ্রান্ত থেকে একটা সিঁড়ি বাঁক খেয়ে গিয়ে দোতলায় উঠে গেছে। সিঁড়ি শেষে দোতলায় শুরু হয়েছে একটা সরু বারান্দা। সেটা পেরিয়ে আমরা এবার এসে ঢুকলাম একটা ঘরেআকার আর ধরন দেখে আন্দাজ করা যায় সেটা বসার ঘর। সবকটা দেওয়াল জুড়ে কাঠের ফ্রেমওয়ালা আলমারিসেগুলোতে রয়েছে বাংলা থেকে ইংরেজি, নানান ধরনে বই। মাথার ওপর পুরনো দিনের পাখাটা ঘরের সিলিং থেকে হঠাৎ করে অনেকখানি নেমে এসে ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছে। ঘরের মাঝখানে সোফা আর সেন্টার টেবিল পাতা। আমি আর অনিদা দুজনেই ঘাড় তুলে ঘরটা দেখছিলাম।
অনিদা অবশ্য এর মধ্যেই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠার মধ্যে যতটা সময় লাগে তার মধ্যেই ভানুদার থেকে বেশ কিছু জিনিস জেনে নিয়েছে। তিন কূলে কেউ নেই বলে মালিকের জন্য বেশ চিন্তিত ভানুদা।
আপনার দাদাবাবুর কাছে আসা সেই তিনটে মজার প্যাকেট তো আপনিই পেয়েছিলেন, তাই না?
ভানুদাকে প্রশ্ন করল অনিদা। তাতে চোখ কপালে তুলে ভানুদা বললেন, ওইসব কঙ্কাল-টঙ্কাল মজার জিনিস!”
অনিদার অবশ্য তাতে কোনও প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলাম না। ভানুদা জানালেন, বাড়ির দরজার সামনে সিঁড়ির পাশের চাতালটাতে প্যাকেটগুলো রাখা ছিল।
অনিদা তখন আমার উদ্দেশ্যে চাপা গলায় বলল, ওই গ্রিলের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে বাগান পেরিয়ে চাতালের ওপর বাক্স রেখে ফিরে গেল। একদিন নয়, তিন-তিনটে দিন অথচ একদিনও কারও চোখে পড়ল না! নাহ্‌, ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না রে জয়।
সেই সময় বাড়িতে কেউ ছিল না? আবার ভানুদাকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
না, আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। বললেন ভানুদা। শুধু আলি বাগানে কাজ করছিল।
লি যে এ-বাড়িতে মালির কাজ করে, তা রূপেন রায় আমাদের আগেই জানিয়েছিলেন। তাই হয়তো অনিদা আলিকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না।
অনিদার প্রশ্ন মনে হয় ভানুদার মনে কোনও একটা সন্দেহ তৈরি করেছিল। আমাদের হাত দুয়েক আগে হাঁটছিলেন উনিএবার হঠাৎ ঘুরে প্রশ্ন করলেন, এগুলো জিজ্ঞাসা করছেন কেন বলুন তো? আপনি কি পুলিশ?
তাতে, না না, এমনিই জিজ্ঞাসা করছি,” বলে অনিদা এবার হ্‌’ আওয়াজ করে সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পতে পতে নিজেকে সামলে নিল
কী হল? সামলে। এগিয়ে এলেন ভানুদা।
তখন, না, ঠিক আছে, বলেই এবার সোজা হয়ে হাঁটতে শুরু করল অনিদা।
আসলে পরিষ্কার মেঝেতে হোঁচট খেয়ে পড়ার অভিনয় করে অনিদা যে ভানুদাকে ম্যানেজ করল, সেটা আমি বুঝতে পারলাম।
আমরা দোতলার বসার ঘরে পৌঁছতে ভানুদা এবার নিচে চলে গেলেনআমাদের চোখ তখন ঘরের দরজার ওপর দেওয়ালে টাঙানো বিশাল একটা ছবির ওপর। ছবির দুটো মানুষের একজনকে চিনতে পারছি। রূপেন রায়। কিন্তু ওঁর সাথে দাঁড়ানো প্রায় সমবয়সী অন্যজন কে সেটা ভাবছি, এমন সময় রূপেন রায় ঘরে এসে ঢুকলেন।
ও আমার ভাই, উপেন।
আমরা এবার ঘুরে দাঁড়াতে উনি আমাদের সামনে একটা সোফাতে বসে আমাদেরও বসার অনুরোধ করতে আমরা ওঁর সামনের সোফাটায় বসলাম। এর মধ্যে ভানুদা চা আর জলখাবার রেখে গেছেনরূপেন রায় এবার নিজের চায়ের কাপটা তুলে আমাদের দিকে ইশারা করতে অনিদা প্লেট থেকে একটা কাটলেট তুলে তার এক-তৃতীয়াংশ মুখে চালান করল।
সেন্টার টেবিলের সমস্ত খাবার শেষ করতে আমাদের লাগল মাত্র বারো মিনিট। আর তার আশি শতাংশ ক্রেডিট দেওয়া উচি অনিদাকে।
মিঃ রায় এবার প্রশ্ন করলেন, বলুন মিঃ সেন, কোথা থেকে শুরু করতে চান?
প্রত্যাশিতভাবেই অনিদা উত্তর করল, সারদা লিপি।

।। ।।

একটা বহু পুরনো কাঠের বাক্সতার ওপরের এমন বাহারি কাজ আজকের দিনে দেখতে পাওয়া যায় না। অনিদার সাথে ঘুরে আর ওর সঙ্গে থেকে যা শিখেছি, তাতে একথা বলতে পারি যে এ-জিনিস মোগল আমলের তো নয়ই, এমনকি সুলতানি আমলেরও নয়। তারও আগের।
কত পুরনো হতে পারে বলুন তো? জিজ্ঞাসা করলেন রূপেন রায়
অনিদা বাক্সটা দেখতে দেখতে বলল, এভাবে ঠিক বলা যাবে না। তবে হাজার থেকে বারোশো বছর পুরনো বলেই মনে হয়কারণ, ওই সময়েই তো এই লিপি চলত।
অনিদা বাক্সটার ঢাকনাটা ধরে একটু চাগা দিতে সেটা খুলে গেল। এবার সেটা আস্তে আস্তে তুলতে চোখের সামনে যে জিনিসটা ভেসে উঠল, তেমন জিনিস আমি আগে কখনও দেখিনি! বাক্সটার ভেতরের জিনিসগুলো যে কাগজ নয়, গাছের ছাল, তা চট করে বোঝা যায় নাআর সেই ছালের ওপর যে দুর্বোধ্য লিপিটা চোখে পছে, সেটাই সারদা লিপি।
কাগজের ব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কাল অনিদা বলেছিল, তখন কাগজের ব্যবহার মানুষ জানত কারণ, কাগজ তো আবিষ্কার হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক একশো থেকে একশো পাঁচ সালে। যদিও সেটা চিনে। ভারতে সেটা আমদানি হয়েছিল আনুমানিক ৭৫১ সালেআর এই লিপি সম্ভবত ঠিক সেই সময়কারই। হতে পারে তখনও আমরা ভারতীয়রা কাগজের ব্যবহারে রপ্ত হয়ে উঠতে পারিনি। তাই লেখার জন্য গাছের ছালই ব্যবহার করা হয়েছিল।
সবগুলো পাতা নেই মনে হচ্ছে? দেখতে দেখতে বলল অনিদা।
কী করে বুঝলে? জিজ্ঞাসা করলাম ওকে। মিঃ রায়ের দিকে একবার চোখ পতে দেখি অনিদার কথা শুনে আমার মতো উনিও অবাক।
বুঝতে পারছিস না? ভালো করে দেখ। বাক্সর কিছুটা অংশ খালি। আর কিছু পাতা ধরত।
তাই তো! মানে কিছু পাতা মিস করেছি বলছেন? মিঃ রায়ের ভুরুজোড়া এবার কপালে উঠল।
অনিদা এবার পান্ডুলিপিগুলোর ওপর নাক নিয়ে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল। পাতাগুলোর ওপর আলতো করে হাত বোলালঅবশ্য বের করার কোনও চেষ্টা করল না। বেশ ঝুঝুরে অবস্থা সেগুলোর। শেষে খুব সাবধানে বাক্সটা বন্ধ করল
কিছু বুঝতে পারলেন? জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ রায়।
আপনি যদি আপত্তি না করেন তো এটা আমি একবার নিয়ে যেতে চাই। বলল অনিদা।
তাতে মিঃ রায় প্রথমটায় রাজী না হলেও শেষে ইতস্তত করে বললেন, ওকে, তবে সাবধানে। আসলে লেখাগুলোর মানে বের করে ফেলতে পারলে আর ভয় থাকত না।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, মিঃ রায়। রূপেন রায়কে আশ্বস্ত করে বলল অনিদা।
রূপেন রায়ের কালেকশন দেখে আমাদের চোখ তখন কপালে উঠে গেছে। বাদশাহী আমলের তলোয়ার, মোহর। ইংরেজ আমলের পোশাক। সুলতানিদের খাবার পাত্র। আর কত কী! তবে এগুলোর মধ্যে এই পান্ডুলিপিটাই সবথেকে পুরনো আর দামি।
মিউজিয়াম থেকে আবার আমরা রূপেন রায়ের বসার ঘরে এলামভদ্রলোক এতক্ষ স্বাভাবিক গলায় কথা বলছিলেন। এবার ঘরে ঢুকতে গলা নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার কি মনে হয় প্যাকেট রহস্য থেকে শুরু করে সেদিন রাতে বাড়িতে লোক আসা, সবকিছুর পেছনে এই পান্ডুলিপিটাই রয়েছে?
অনিদাও এই গোপনীয়তার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তাই ও চাপা গলাতেই উত্তর করল, এ জিনিসের জন্য যদি আপনার শত্রু বৃদ্ধি হয়, তাহলে তো বলতে হয় আপনার বেশ শিক্ষিত শত্রু রয়েছে!
কথাটা শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিঃ রায়ের। তাতে অনিদা বলল, এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আপনার শোবার ঘর কোনটা?
তাতে, হ্যাঁ আসুন,” বলে উনি এবার আমাদের ওঁর শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। পুরনো বাঁকা কাঠের কাজ করা ছত্রীওয়ালা বিশাল খাটটা দেখিয়ে বললেন, এতেই সেদিন শুয়ে ছিলাম।
অনিদা ঘরের চারদিকটা খুব মন দিয়ে দেখছিল। এবার জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি মারল। ঘরটা একটা বারান্দা লাগোয়া। এই বারান্দাটা বাড়ির পেছনদিকে। ওদিক দিয়ে নেমে সোজা নিচে যাওয়া যায়ওই বারান্দাটায় কোনও দরজা নেই। ও একবার বারান্দায় বেরিয়ে ডানে বাঁয়ে দেখল। মিঃ রায় জানালেন, সেদিন লোকটা এই বারান্দার দিক দিয়েই এসেছিল
অনিদা এবার জিজ্ঞাসা করল, আপনার পান্ডুলিপিটা তো মিউজিয়ামেই থাকে?
তাতে মাথা ঝুঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন মিঃ রায়।
এবার কী যেন একটা চিন্তা করল অনিদা। তারপর যখন জানতে পারল যে রূপেন রায়ের পাশের ঘরে থাকেন ওঁর বোনপো পীযূষ রায়, তখন কেন জানি না হঠাৎ করে ওর কপালে চারটে ভাঁজ পল। ও কী ভাবছিল সেটা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল। এবার ভানুদা একটা কাজে এ-ঘরে আসতে মিঃ রায় যখন ওঁর সাথে কী একটা কথায় ব্যস্ত হয়ে পলেন, তখন সেই ফাঁকে অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে ও পীযূষ রায়কে সন্দেহ করছে কি না। তাতে ও জানাল যে সেটা ওর মাথায় ঘুরছে বটে, তবে সব জেনে বা না বুঝে ও কাউকে এত তাড়াতাড়ি দোষ হিসেবে ভাবতে চায় না।
মিঃ রায় এবার ভানুদাকে জানিয়ে দিলেন যে কেউ যেন আমাদের এখন বিরক্ত না করে। তা শুনে অনিদা বলল, কেন? এখন তো বাড়িতে কেউ নেই। কে বিরক্ত করবে আমাদের?
না, তা নেই। কিন্তু কৌশিকের ফেরার সময় হয়ে গেল। এখান থেকে ও যাবে রিহার্সালে।
উনি এই সময় রোজ ফেরেন? বলে অনিদা ঘড়ি দেখল।
আমিও হাত উলটে দেখলাম, পৌনে ছটা।
না, আর আগেই আসে। পাঁচটা নাগাদ। তবে আজ সকালে বলছিল, আজ নাকি ছটা বেজে যেতে পারে। বললেন মিঃ রায়।
এরপর উনি সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর ফিরে এলেন সবুজ মার্বেল পেপারে মোড়া তিনটে বাক্স হাতে নিয়ে। ওগুলো খোলা অবস্থাতেই ছিল। অনিদা এবার মিঃ রায়ের পারমিশন নিয়ে ওর ভেতরের জিনিসগুলো বের করল। পিস্তল, কঙ্কালের মুখ আর মানুষের হাড়জোড়া সবই প্লাস্টিকেরতবে কালো মুখোটা রবারের।
বাক্সের জিনিসগুলো দেখার জন্য অনিদা অবশ্য বেশি সময় খরচা করল না। বরঞ্চ বাক্স আর তার মোকের ওপর ওর যেন বেশি উৎসাহ
খুব সাধারণ মানের প্যাকেট। বলে উপহারগুলো আবার হাতে নিয়ে বলল, এগুলোও খুব অরডিনারি। এবার একটা বাক্স নাকের কাছে নিয়ে বলল, প্যাক করতে খুব সাধারণ মানের আঠা ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু এগুলোর মানে কী? প্রশ্ন করলেন রূপেন রায়।
অনিদা তাতে যখন কঙ্কালের মাথাটা হাতে নিয়ে বলল, বিপদ, তখন লক্ষ করলাম যে মিঃ রায়ের গাম্ভীর্য কিছুটা হলেও ফিকে হলকপালে চিন্তার ভাঁজ টেনে বললেন, কার বিপদ, মিঃ সেন?
অনিদা তখন খেলনা পিস্তল আর মুখোটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বলল, সেটা জানতে সময় লাগবে।
তাতে একটা ঢোঁক গিলে মিঃ রায় বললেন, আপনি সময় নিন মিঃ সেন, কিন্তু সমস্যার সমাধান করুন। তারপর বললেন, পান্ডুলিপির মানেটা বের করার কথাও মাথায় রাখবেন যেন। আর ওগুলো সাবধানে রাখবেন।
আমরা ময়ূখ ভিলাতে আর বেশি সময় খরচ করলাম না। অনিদা অবশ্য বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মানস মিত্র, পীযূষ রায় আর কৌশিক সেনগুপ্ত - তিনজনের ঘরেই একবার করে ঢুঁ মারল। ওদের ঘর থেকে যে জিনিসগুলো পাওয়া গেল, অনিদার মতে এই তিনটে জিনিস সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অবশ্য জানি না। আর সেগুলো হলঃ
         ·        পীযূষ রায়ের ঘর থেকে পাওয়া মোটা সোলওয়ালা উডল্যান্ডের জুতো।
         ·        মানস মিত্রর ঘরে পাওয়া একটা ডায়েরিতাতে লেখা কলকাতার নামকরা অঞ্চলের বেশ কিছু ফ্ল্যাটের দাম।
         ·     কৌশিক সেনগুপ্তর ঘরে পাওয়া বেশ কয়েকটা ইতিহাস বই। তার প্রায় প্রতিটাই সেই প্রস্তরযুগ থেকে শুরু করে বর্তমান ভারতবর্ষের। আর বইগুলো বেশিরভাগই নতুন।

ময়ূখ ভিলা থেকে বেরোনোর সময় দেখা পেলাম কৌশিক সেনগুপ্তর। মাঝারি উচ্চতা। গোলপানা মুখ। ব্যাকব্রাশ করা চুলে মাথার মাঝে সিঁথি। দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। গায়ের রং পরিষ্কারঠিক দরজার সামনে দেখা হয়েছিল ওঁর সঙ্গে।
আমাদের এগিয়ে দিতে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছিলেন মিঃ রায়। কৌশিক সেনগুপ্তকে দেখে বললেন, আজ নাটকে গেলে না?
তাতে, হ্যাঁ যাব, দেরি হয়ে গেল,” বলে হনহনিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন কৌশিক সেনগুপ্ত।
গলাটা যেন কানে লেগে রইল। মনে মনে ভাবলাম, এ গলায় অভিনয় না করে অন্যকিছু করাটাই অন্যায়।

।। ।।

বারোশো শতকে পানিপথের যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান মহম্মদ ঘোরিকে পরাজিত করেছিলেন। সেই সময় ওঁর এক সভাসদের নাম ছিল গঙ্গাধর। তাঁর আদি বাসস্থান ছিল কাশ্মীর। পানিপথের যুদ্ধের পর গঙ্গাধর কাশ্মীর ফিরে যান। তারপর তিনি লেখেন পৃথ্বীরাজ চৌহানের পানিপথ জয়ের কাহিনিআর সেই কাহিনি লেখার জন্য গঙ্গাধর ব্যবহার করেছিলেন সারদা লিপি
অনিদা যে পান্ডুলিপিটা নিয়ে ভীষভাবে উৎসাহিত হয়ে উঠেছে তা ওর এই গল্প বলা দেখেই বুঝতে পারলাম। ওর কথা অনুসারে, সেদিন রাতে রায়বাড়িতে হামলার কারণটা একেবারেই স্পষ্ট নয়। সে যদি পান্ডুলিপিই চুরি করতে আসবে, তাহলে সে শোবার ঘরে ঢুকবে কেন? সে তো যাবে মিউজিয়ামে। কারণ, লিপি তো ছিল মিউজিয়ামে।
সে-লোক কি ঘরেরই কেউ? অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তাতে ও বলল, মিঃ রায় তো বললেন উনি বাইরের কাউকে পান্ডুলিপিটার কথা বলেননি। অবশ্য বাড়ির অন্যরা কে কী করেছেন তা জানি না।
আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, আর ওই পার্সেলগুলো? ওগুলো কেন পাঠানো হল? পান্ডুলিপির সাথে ওগুলোর কি কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে?
তাতে অনিদা বলল, সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা বোঝার আগে ওগুলোর মানে বুঝতে হবে।
কঙ্কালের মাথার মানে তো বিপদ!”
হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ল অনিদা। তারপর বলল, বিপদটা কার? কীসের বিপদ? কে কাকে সাবধান করতে চাইছে?
প্রশ্নগুলো পরপর করে কী যেন বিড়বিড় করতে শুরু করল। কান খাড়া করতে বুঝতে পারলাম, যে শব্দদুটো ও বারবার উচ্চারণ করছে সেগুলো হল, পিস্তল আর মুখো!
বেশ কিছুক্ষ এইভাবেই কাটল আমাদের। মানে আমি চুপ আর অনিদা বিড়বিড়িয়ে চলেছে হঠাৎ এবার চেঁচিয়ে উঠল অনিদা, এই তো, পেয়েছি, পেয়েছি!
হয়তো আর্কিমিডিসও তাঁর বিখ্যাত বস্তুর ভর আবিষ্কারের পর একই সুরে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন। আমি প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে চোখ গোল গোল করে বললাম, কী পেয়েছ, অনিদা?
মুখোশ জয়, মুখোশ! বলে আবার চেঁচিয়ে উঠল ও।
বুঝলাম, মুখোশের ধাঁধাটা ও সলভ করে ফেলেছে। তাই চনমনিয়ে উঠলাম। আমার চোখে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে দেখে অনিদা বলল, নাটকের গ্রুপগুলোর লোগো কেমন হয় জানিস তো?
নাটকের গ্রুপের লোগো!” অবাক হয়ে বললাম আমি।
মনে পছে?
হ্যাঁ, মানে...”
আমি আমতা আমতা করতে অনিদা বলল, এবার মনে করার চেষ্টা কর, রূপেন রায়ের বাড়িতে যে মুখোটা দেখেছিলি, সেটা কেমন দেখতে
এই ফাঁকে বলে রাখি, ছোটোবড়ো বিভিন্ন গ্রুপের নাটক দেখা আমাদের প্রায় নিত্যকার অভ্যেসের মধ্যে পড়েতাই নাটকের দলের লোগোগুলো কেমন দেখতে হয় তা মনে করতে বেশি কষ্ট করতে হল না টিকিটে লোগোগুলো ছাপা থাকে। আর সেগুলোর বেশিরভাগই হয় মুখোশের আকারের। যার নাক আর চোখের কাছটা কাটা
সর্বনাশ! তার মানে রূপেন রায়ের কাছে পাঠানো মুখোশের সাথে নাটকের গ্রুপের কোনও সম্পর্ক আছে! জিনিসটা আবিষ্কার করে চোখ কপালে উঠল আমার।
কারেক্ট! ডান হাতের তর্জনী শূন্যে ছুড়ে অনিদা বলল, আর নাটকের কথা বললে তোর এখন কার কথা মনে পছে?
কৌশিক সেনগুপ্ত! ফ্যাসফ্যাসিয়ে আমি বললাম, তার মানে কৌশিক সেনগুপ্ত এর সাথে জড়িয়ে?
মুখো তো তাই বলছে। মাথাটা সামনের দিকে একবার ঝুঁকিয়ে বলল অনিদা।
তাহলে কি রূপেন রায়ের বিপদের পেছনে কৌশিক সেনগুপ্তর হাত রয়েছে? আমি প্রশ্ন করলাম।
সেটাই তো বুঝতে পারছি না। বারবার মাথা নেড়ে অনিদা বলল, যদি কৌশিক সেনগুপ্তর দিক থেকে কোনও বিপদ থেকে থাকে, তাহলে বলতে হয়, এমন কোনও লোক আছে, যে কিনা এই ব্যাপারটা জানে! কিন্তু কে সেই লোক?
একটা রহস্য তৈরি করে কথাগুলো বলল অনিদা। আর সাথে সাথে চা আর জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল বিজুদাতাতে অনিদা একটা তুড়ি মেরে বলল, গ্রেট টাইমিং!
আসলে প্রায় বারো বছর এ-বাড়িতে কাজ করছে বলে অনিদার পছন্দ অপছন্দ সবই জানে বিজুদা।
এবার একটা লুচির টুকরো আলু সমেত মুখে পুরে অনিদা বলল, নে, শুরু কর।
সকালে যোগাসন সেরে স্নান করে উঠে বেশ খিদে পেয়েছিল বটে। কিন্তু সেটা পাশে সরিয়ে রেখে কৌতূহলের সলতেটাকে আর একটু উসকে নিয়ে বললাম, তাহলে পিস্তলটা?
অনিদার মুখে তখনও মুচকি হাসিটা লেগে আছে। বলল, পিস্তল কোথায় তৈরি হয় জানিস নিশ্চ?”
ফ্যাক্টরিতে। বললাম আমি।
চলতি কথায় পিস্তলকে আরেকটা নামেও লোকে ডাকে জনিস তো?
একটু ভেবে আমি বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ, বন্দুক।
টেকনিক্যালি সেটা কিন্তু ভুল। তো যাই হোক, বন্দুকের ইংরিজি কী?
গান।
গুড! এবার ভেবে বল তো, গান কথাটার সাথে রায়বাড়ির কার সম্পর্ক আছে?
এবার আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম, পীযূষ রায়! উনি গান অ্যান্ড সেল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন!
ভেরি গুড! আমাকে থামস আপ দেখিয়ে অনিদা বলল, ধাঁধার পরের ব্যক্তিটি হলেন রূপেন রায়ের বোনপো পীযূষ রায়।
তার মানে এঁদের মধ্যেই কেউ একজন অপরাধী! আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম।
কিন্তু আমাকে দমিয়ে দিয়ে অনিদা বলল, ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে, তা কিন্তু নয়।
কেন বলছ একথা? এর মধ্যে কি অন্য কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তাতে অনিদা বলল, এদের থেকে মিঃ রায়ের কী বিপদ থাকতে পারে? আর তাছাড়া...”
তাছাড়া?
কে এই সংকেতগুলো পাঠাচ্ছে? কী বলতে চাইছে প্রেরক? আর যা বলার তা সে সরাসরি বলছে না কেন?
কিন্তু কে পাঠাচ্ছে বলে মনে হয় তোমার?
যে-ই পাঠাক, তার চিন্তাধারা যে বেশ উচ্চমানের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
দেখতে দেখতে আমাদের সকালের খাবার শেষ। এর মধ্যে অনিদা তিনটে ফোন করেছে। এক আর তিন নম্বর কলটা যাঁদের করেছিল, তাঁদেরকে আমি চিনি। প্রথমজন ওর খুব কাছের বন্ধু লালবাজারের ওসি রাজাদা। আসলে বিশেষ কোনও সাহায্যের দরকার পলে ও রাজাদার সাহায্য নেয়। তিন নম্বর কলের মানুষটা হলেন তথাগত চৌধুরীযাদবপুর ইউনিভার্সিটির ম্যানুস্ক্রিপ্টোলজি অ্যান্ড প্যালিওগ্রাফি বিভাগের একজন সিনিয়র প্রফেসর। উচ্চারণে কষ্ট আছে বলে ঐ বিষয়ের নামটা আর নিচ্ছি না। তবে বলে রাখি যাঁরা পুরনো পুঁথিপত্র নিয়ে কাজ করেন তাঁরা ওই বিভাগে কাজ করেন। বুঝলাম, সারদা লিপিটা নিয়ে বেশ গবেষণা শুরু করেছে অনিদা।
মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল অনিদা। বুঝলাম, কোথাও বেরোবে। আমি যাব কি না জিজ্ঞাসা করব ভাবছি, ঠিক তখন ও আমাকে বলল, ফিরতে দেরি হবে। দরকার হলে ফোন করে নিস। আর আমি যদি ফোন কেটে দিই, তবে এস.এম.এস বা হোয়াটস অ্যাপ করিস।
অনিদা সারদা লিপি নিয়ে বেরিয়ে গেল। হাতে কিছু কাজ নেই। পড়াশুনার পাট সারব দুপুরবেলা। তাই এবার ঘরে ফিরে ফেলুদার বইটা নিয়ে বসে পলাম।

ফেরার কথা ছিল বিকেল চারটেকিন্তু অনিদার ফিরতে ফিরতে হয়ে গেল রাত আটটা। সারাটা দিন আমার প্রচণ্ড ছটফটানিতে কেটেছের প্রধান কারণ আজ শুক্রবার। গত তিন সপ্তাহ ধরে প্রতি শুক্রবার বিকেল পাঁচটা নাগাদ রূপেন রায়ের বাড়িতে একটা করে পার্সেল আসছে। আজ তাহলে কী হবে? এই ভেবে ভেবেই ছটট করছিলামবিশেষ করে বিকেল পাঁচটার সময় তো বারবার জল খাচ্ছি দেখে মা একবার জিজ্ঞাসাই করে ফেলল যে আমার শরীর ঠিক আছে কি না।
অনিদা যখন বাড়ি ফিরল, তখন ওর মুখ-চোখ জ্বলজ্বল করছে। প্রথমেই জানাল যে কোনও রহস্যজনক প্যাকেট আজ রায়বাড়িতে আসেনিপান্ডুলিপির বাক্সটা এখন আর ওর হাতে নেই। বলল, ওটা ও রূপেন রায়কে ফেরত দিয়ে এসেছে। বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা তথ্য ওর হাতে এসেছে। তাই উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সারদা লিপির ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে?
তাতে, হুম,” বলে ও বলল, মনে হচ্ছে একটা সাংঘাতিক জিনিস রূপেন রায়ের হাতে চলে এসেছে
সাংঘাতিক জিনিস! অনিদার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে আমি বললাম, “ওঁকে বলনি সেকথা?
না যদিও উনি বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন সে-ব্যাপারে। পুঁথিতে কী লেখা আছে সে-বিষয়ে ভদ্রলোকের উৎসাহের সীমা নেই। তবে এখনই কিছু ওঁকে বলব না।
পান্ডুলিপিতে কী লেখা আছে, অনিদা? আমি দুরু দুরু বুকে জিজ্ঞাসা করলাম।
তাতে ও একবার মুচকি হেসে আমার দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, সাংঘাতিক একটা জিনিস। যদিও প্রফেসর চৌধুরীর সেটা একটা আন্দাজ। উনি ব্যাপারটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছেন। সময় লাগবে।
কী জিনিস? আমি সোফায় একটু এগিয়ে সোজা হয়ে বসলাম।
অনিদা তখন আমার উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়ে বলল, সময়মতো জানতে পারবি। আগে প্রফেসর চৌধুরীর সন্দেহটা সত্যি বলে প্রমা হোক।
আমি বুঝতে পারলাম, এখন আর ওর কাছে আবদার করে লাভ নেই। তাই এবার বললাম, তাহলে তো ও-জিনিস ওঁর পক্ষে ঘরে রাখা বেশ বিপজ্জনক হবে!
উত্তর না করলেও আমার কথা যে অনিদা মেনে নিল তা ওর মুখ দেখেই বুঝলাম।
কাকে তোমার রূপেন রায়ের শত্রু বলে মনে হয়? জিজ্ঞাসা করলাম অনিদাকে।
তাতে ও বলল, ঘরের যে কেউ হতে পারে। তবে কৌশিক সেনগুপ্তর কথা প্রথমেই মাথায় আসতে পারে।
কেন?
লোকটার ঘরে কত ইতিহাস বই ছিল দেখেছিস? মানে পান্ডুলিপিটা যে কতটা মূল্যবান, তা সে জানে। তাই মনে লোভ জাগতেই পারে।
তার মানে সেই রাতে রূপেন রায়ের ঘরে কৌশিক সেনগুপ্তরও আসার একটা সম্ভাবনা রয়েছে?
অনিদা কোনও উত্তর না করাতে আমি আবার বললাম, কিন্তু জিনিসটা তো মিউজিয়ামে রাখা ছিল। চোর চুরি করতে এলে বেডরুমে ঢুকবে কেন?
সেটাই তো ভাবাচ্ছে রে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অনিদা।
আর মানস মিত্র?
একটাই সন্দেহজনক তথ্য।
কী?
লোকটা কত টাকা মাইনে পায় যে কলকাতার ওইসব অঞ্চলের ফ্ল্যাটের খোঁজখবর নিচ্ছে?
অন্য কারও জন্যও তো হতে পারে।
আমার কথা অনিদাকে খুশি করতে পারল না। এবার আমি পীযূষ রায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে ও বলল, লোকটার আগের জীবনের কথা ভুলে যাস না।
আমি এবার জিজ্ঞাসা করলাম ভানুদার কথা। তাতে ও বলল, সে যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তাহলে বলতে হয় তার পেছনে অন্য কোনও লোকের মাথা রয়েছে।

গতকাল আমরা একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম। আজ ভোরে উঠে যোগাসন সেরে ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছি। ঘড়িতে এখন সকাল সাড়ে আটটা। ময়ূখ ভিলা থেকেও কোনও খবর আসেনি। তার মানে সব ঠিকঠাকই রয়েছে। অনিদা খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে। আমি অবশ্য সাপ্লিমেন্টারি নিয়েই ব্যস্ত। আজকাল অনেকেই ইন্টারনেটে খবর পড়ে নেয়। অনিদা অবশ্য বলে যে সকালবেলা ঢাউস পাতা উলটে খবর পড়ার যে মজা, ওয়েব দুনিয়ায় তা কোথায়? তবে ও কিন্তু খুব টেক স্যাভি থেকে থেকে যেমন মোবাইল ফোন বদলায়, তেমনই কোন অ্যাপে কী আছে সব জানে। আর তাই নিজের মোবাইলে গুচ্ছের অ্যাপ ডাউনলোড করে রেখেছে।
এভাবে কাটল আর পনেরো মিনিট। এমন সময় অনিদার মোবাইলে একটা ফোন এল। ঝট করে ধরার জন্য সেটা যে কার ফোন তা বুঝতে পারলাম না। তবে ফোনটা ধরার পর থেকে ওর মুখের ভাব যেভাবে পালটে যেতে লাগল তাতে আমার বুকের ধুকপুকুনিটা বাড়তে লাগল। ওর কপালের অস্বাভাবিক জোরালো ভাঁজ দেখে বুঝতে পারলাম, খবর মোটেও সুখের নয়। এবার ফোনটা রাখতে আমি যেই ওকে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে গেছি, ও আমার না করা প্রশ্ন সেখানেই বন্ধ করে তখন বলল, জলদি রেডি হয়ে নে। ময়ূখ ভিলায় খুন
কিছু একটা হয়েছে, বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু এতটা আশা করিনি। একটা ঢোঁক গিলে জিজ্ঞাসা করলাম, কে?
তাতে আমার দাঁতে দাঁত লেগে যাবার জোগাড় করে দিয়ে অনিদা জানাল, কৌশিক সেনগুপ্ত

।। ।।


বিছানার সামনে মেঝের ওপর চিত হয়ে পড়ে ছিল কৌশিক সেনগুপ্তর দেহটা। মাথার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে জমাট বাঁধা রক্ত। অনেক্ষণ আগে ঘটনাটা ঘটার জন্য লাল রক্ত কালচে হয়ে গেছে।
মৃতদেহের মাথার কাছটাতে হাঁটু গেড়ে বসে সেটা পরীক্ষা করছিল অনিদা। পাশেই ছিলেন ডানলপ থানার ওসি, মিঃ ঘোষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ করেছি, প্রাইভেট গোয়েন্দাদের পুলিশ ঠিক মেনে নেয় না। কিন্তু অনিদাকে সেসব সহ্য করতে হয় না। বরঞ্চ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশই নিজে থেকে সব তথ্য জোগাড় করে দেয়। এবারেও তেমনটাই হল। খুন যে সময়টায় হয়েছে বলে আন্দাজ করা হচ্ছে, সেটা মিঃ ঘোষই জানালেন অনিদাকে। আমরা ময়ূখ ভিলাতে ঢোকার সময় একজন ডাক্তারকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। উনিই নাকি পরীক্ষা করে বলেছেন খুনটা রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে হয়েছেএবার ডেড বডি ময়না তদন্তের জন্য যাবে। বাংলাটা লেখা সোজা, তাই লিখে ফেললামআসলে অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর লাশ কাটাছেঁড়াকে ইংরেজিতে বলে পোস্ট মরটেম
কোনও ভারী অস্ত্রের আঘাতেই খুনটা হয়েছে। বললেন পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষ।
হুম। মৃতদেহ পরীক্ষা করতে করতে ছোট্ট কথায় উত্তর দিল অনিদা।
আমি তখন মৃতদেহ সমেত ঘরের সমস্ত জিনিসের ছবি একের পর এক পটাপট তুলে নিয়েছি আমার মোবাইল ফোনে। এটা আমরা সব কেসেই করে থাকি। আগে ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যবহার করতাম। এখন ফোনেই কাজ চলে যায়। তার সাথে দরকারমতো লোকের কথাবার্তাও রেকর্ড করে নিই। অবশ্য কিছু লুকিয়ে রেকর্ড করার থাকলেও আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করি। এতে তদন্তের সুবিধা হয়। হয়তো এখন কেউ একটা কথা বলল, আর আমরা সেগুলো রেকর্ড করে নিলাম। তো পরে সেই লোকই যদি অন্যরকম কথা বলে, তাহলে সে ধরা পড়ে যাবে।
এক আঘাতেই সাবাড় বলে মনে হচ্ছে। মিঃ ঘোষের কথায় বোঝাই যাচ্ছিল যে এসব জিনিস পুলিশের কাছে কতটা জলভাত।
মেরেছে মাথার একেবারে মাঝে। মানে ব্রহ্মতালুতে। মাথার দিকটা ঝুঁকে পড়ে দেখতে দেখতে বলল অনিদা। তারপর গলাটা গম্ভীর করে বলল, আর এই জিনিসটাই সবথেকে সন্দেহজনক।
সে আবার কী কথা মশাই? অনিদার কথা শুনে হেসে মিঃ ঘোষ বললেন, মাঝে আঘাত না করে পাশে করলে ব্যাপারটা তেমন গুরুতর হত না বলছেন?
মিঃ ঘোষ যাই বলুন না কেন, অনিদা যে কিছু একটা ভেবেই কথাটা বলেছে তা আমি বিলক্ষণ জানি। নিশ্চয় কিছু একটা আন্দাজ করেছে ও। অবশ্য সেকথা ও মিঃ ঘোষকে এখনই জানাবে নাও কী ভাবছে সেটা জানার জন্য আমার মন ছটট করছিল। তাই এবার ছবি তোলার আছিলায় ওর একেবারে কাছে গিয়ে গলাটা একেবারে খাদে নামিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু বুঝতে পেরেছ, অনিদা?
উত্তরে ও গলা নামিয়ে বলল, যা করছিস করে যা, পাকামো করে সব কেঁচিয়ে দিলে বাড়ি ফিরে বত্রিশটা গাঁট্টা।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তবে বুঝতে পারলাম, আমার সন্দেহ ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু কথাটা জানার জন্য বাড়ি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কুকর্মটা কে করল বলুন তো? হয়তো কিছু পাওয়ার আশায় ঘর জুড়ে পায়চারি করতে করতে বললেন মিঃ ঘোষ।
যে-ই হোক, বাইরের কেউ করেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল অনিদা।
ঘরে মিঃ রূপেন রায় ছাড়াও আর দুজন পুরুষমানুষ উপস্থিত ছিলেনএদের মধ্যে একজন মানস মিত্র আর অপরজন পীযূষ রায়। দুজনেরই মুখের ভাব অস্বাভাবিক। পাংশুটে। অনিদার কথাটা বলার পর লক্ষ করলাম, পীযূষ রায় একবার ঢোঁক গিললেনআর না চাইতেও মানস মিত্রর চোখের পাতা বার কয়েক পড়ল।
আপনার কি ধারণা এতে বাড়ির কারোরই হাত রয়েছে? অনিদার কথা শুনে এবার প্রশ্নটা করলেন মিঃ রূপেন রায়।
প্রথমটায় কিছু বলল না অনিদা। এবার রূপেন রায় তাঁর পরের প্রশ্ন করলেন, কী করে বুঝলেন?
তখন অনিদা বলল, লাশটা পড়ে আছে ঘরের মধ্যখানে। আর আঘাতটা করা হয়েছে মাথার একেবারে মাঝে। সামনে থেকে। তাহলে বলা যায় খুনি দরজা দিয়ে ঢুকে এসে ঘরের মাঝখানে ভিক্টিমের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর আচমকা তাঁর মাথায় আঘাত করে। সে ছিল কৌশিকের পূর্ব পরিচিত আর তাই তাকে কোনওভাবেই সন্দেহ করেননি কৌশিক। তা না হলে উনি তাকে ঘরে ঢুকতে বাধা দিতেনআচমকা এই আক্রমণ কৌশিকের মুখে বিস্ময়ও তৈরি হতে দেয়নি। ওর মুখের ভাবও তাই বলছে। শুধুমাত্র একটা ব্যথার ভাঁজ পড়েছে।
কথায় বলে একে রামে রক্ষে নেই, তার ওপর সুগ্রীব দোসর। কারণ, এবারে যেটা জানতে পারলাম তাতে এই প্রবাদ বাক্যটা ব্যবহার করাই যায়। এতক্ষণ শুধু একটা খুনের খবরই শুনেছিলাম। এবার কানে এল, রূপেন রায়ের ঘর থেকে সারদা লিপি উধাও!
মাই গড! কথাটা শুনে ধড়মড়িয়ে উঠল অনিদা
লিপির ব্যাপারটা মিঃ ঘোষের জানা ছিল না। এবার সেটা ওঁকে অল্প কথায় বলতে উনি প্রথমে চোখ কপালে তুললেন। তারপর বললেন, , আই সি! এবার ডানহাতে ধরা লাঠিটা বাঁহাতের তালুতে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, দেন দি মাস্ট বি দ্য অরিজিনাল রিজন!
কাল রাতে রূপেন রায় বাড়ি ফেরেন প্রায় দুটো নাগাদ। দোকান যদিও বন্ধ হয়ে যায় রাত নটায়। একটা পার্টির নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরতে ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছিল। ভানুদাই দরজা খুলে দেউনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রাত এগারোটার মধ্যে। কিন্তু মালিকের ডাকে উঠতে হয়। এদিকে বাড়ির অন্যরা কাল দশটার মধ্যেই ফিরে আসেন।
কৌশিক সেনগুপ্ত ফিরে আসেন পৌনে দশটার মধ্যে। কাল একাডেমিতে ওঁর একটা শো ছিল।
প্রায় একই সময়ে ফেরেন মানস মিত্র। মালিকের সাথে নটা পর্যন্ত অফিসেই ছিলেন। উনি ফেরেন বাড়ি, আর মালিক যান নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে
পীযূষ রায়ের অফিস ছুটি হয় বিকেল পাঁচটায়। সেখান থেকে উনি সোজা চলে যান কফি হাউস। আর তারপর বাড়ি ফেরেন রাত নটা নাগাদ।
এরপর বলার মতো আর কিছুই ঘটেনি। সবাই যে যার মতো খাওয়াদাওয়া সেরে ঘরের দরজা দেয়। আগেই বলেছি, কাল অনেক রাত করে ফেরেন রূপেন রায়। ফিরে এসে উনিও সাথে সাথে বিছানা নেন
রোজের মতো আজও ভোর পাঁচটা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠেন ভানুদা। তার ঠিক একঘণ্টা পরে রোজের অভ্যেসমতো বিছানা ছাড়েন রূপেন রায়। রোজ সকাল সাতটার মধ্যে ঘরের সবাই সকালের আলো দেখতে হবে সে যত রাতেই শোওয়া হোক না কেন, এমনটাই নিয়ম করে রেখেছেন রূপেন রায়। আজও এই নিয়মের কোনও হেরফের হয়নি। রূপেন রায়ের মর্নিং ওয়াক সেরে আসার মধ্যেই ময়ূখ ভিলার সবাই সকালের চায়ের জন্য তৈরি হয়ে পড়েছিল। শুধুমাত্র কৌশিক সেনগুপ্ত ছাড়া। ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁলেও আজ ঘুম থেকে ওঠেননি উনি। সবাই ভেবেছিলেন ওঁর হয়তো শরীর খারাপ। মিঃ রায় তখন ভানুদাকে বলেন ব্যাপারটা দেখতে। প্রথমটায় বাইরে থেকে ডেকে কোনও সাড়া পান না ভানুদাএবার ঘরের দরজায় আলতো ঠেলা মারতে দেখেন যে দরজা ভেতর থেকে আটকানো নেই প্রথমটায় সন্দেহ হয় ভানুদার। তারপর দোনামনা করে ঘরের ভেতরে ঢুকতে আবিষ্কার করেন এই মর্মান্তিক দৃশ্য
এতটুকুতে অনিদার কতটা লাভ হবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আর তাই হয়তো অনিদা সবার সাথে আলাদা আলাদা করে কথা বলতে চাইল। তাতে পীযূষ রায় ছাড়া আর কেউই তেমন একটা অনীহা প্রকাশ করল না।
জেরা করে আর কি সুবিধে করতে পারবেন, মিঃ সেন? তাঁর থেকে বরঞ্চ মাথার ব্যবহারটা ভালো করে করুন।
মুখ দেখে মনে হল না অনিদা পীযূষ রায়ের এই খোঁচাটাকে তেমন পাত্তা দিল। হয়তো উনি আর কিছু বলতেন, কিন্তু রূপেন রায়ের হালকা ধমকে চুপ করে গেলেন।
অনিদা প্রথমেই ভানুদাকে দিয়ে শুরু করল। আগেই বলেছি, ভানুদা কাল রাত এগারোটার মধ্যেই শুয়ে পড়েছিলেন
আপনার বাবু কী করে বাড়ির ভেতর ঢোকেন? মেইন গেট খোলা ছিল? প্রশ্ন করল অনিদা।
না, না। ফটকে তালা মারা ছিল। তবে বাবুর কাছেও একটা চাবি থাকে তো। তাই উনি নিজেই ঢুকেছিলেন। তারপর ভেতরে ঢুকতে আমাকে ডাকেন।
আপনি কোন ঘরে থাকেন?
ওই সিঁড়ির সামনের ঘরটাতে।
উত্তরটা শুনে অনিদা ভুরু কুঁচকে কী যেন একটা ভাবল। তারপর বলল, তার মানে আপনাকে দরজা খোলার জন্য কৌশিক সেনগুপ্তর ঘরের সামনে দিয়েই যেতে হয়েছিল?
উত্তরে মাথাটা দুবার সামনের দিকে ঝোঁকালেন ভানুদা।
অনিদা আবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, কৌশিকের ঘরের দরজা তখন খোলা ছিল?
না। মাথা নাড়লেন ভানুদা।
আপনার বাবু যেদিন দেরি করে ফেরেন, সেদিন আপনিই দরজা খোলেন?
হ্যাঁ, কিন্তু কোনও কোনও দিন কৌশিকদাদাবাবুও দরজা খুলে দিতেন। দরজার সামনেই ঘর তো। তাছাড়া কলিং বেলটাও তো ওঁর ঘরের সামনেই লাগানো। তাই ওটার আওয়াজ সবথেকে বেশি ওঁর কানেই ঢুকত
অনিদা এবার সারদা লিপির চুরির কথাটা জিজ্ঞাসা করতে ভানুদা বললেন যে ও-ব্যাপারে উনি বিশেষ কিছু জানেন না। তবে ওঁর বাবু দিন কয়েক আগে কাশ্মীর থেকে একটা জিনিস এনেছিলেন, আর সেটা নাকি আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এতটুকুই জানেন ভানুদা।
অন্য আর কোনও বিশেষ কারও যাতায়াত আছে এই বাড়িতে? আবার জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
না, বাইরের আর তেমন কেউ বাড়িতে আসে না” বললেন ভানুদা।
অনিদা এবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করল যে এই বিল্ডিংয়ে ঢোকার আর কোনও দরজা আছে কি না। তাতে ভানুদা জানালেন যে পেছনদিকে নাকি আরেকটা দরজা আছে।
বাড়ির পেছনদিকে গিয়ে দেখলাম, মাটি থেকে একটা লোহার পেঁচালো সিঁড়ি সোজা ওপরে উঠে বাড়ির পেছনদিকের বারান্দায় মিলেছে। বুঝতে পারলাম, এটাই সেই বারান্দা যেটা রূপেন রায়ের শোবার ঘরের পেছনদিকে আগেরদিন দেখেছিলাম।
অনিদা কেন জানি না সন্দেহের চোখে সিঁড়িটার একেবারে নিচে গিয়ে ওপর দিকে চেয়ে রইল। তারপর বার দুয়েক এধার ওধার দেখল। এবার তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। সিঁড়িটা দোতলায় যেখানে শেষ হয়েছে, সেইখানটাতেই পীযূষ রায়ের ঘর। অনিদা সেই ঘরের সামনে গিয়ে কী যেন চিন্তা করল। তারপর নিচে নেমে এল।
ওর চোখে সন্দেহ দেখে ওকে এবার চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু পেলে?
তাতে, নাহ্‌” বলে মাথাটা একবার নেড়েই ও স্থির হয়ে গেলদেখলাম, ওর দৃষ্টি মাটিতে ঘাসের ওপর আটকে আছে চোখজোড়া সরু। কপালে হালকা তিনটে ভাঁজ। এবার নিচু হয়ে ঘাসের মধ্য থেকে ও যেটা তুলে আনল, সেটা হল একটা ইনহেলার তারপর সেটা মধ্যমা আর তর্জনীর ফাঁকে সিগারেটের মতো করে ধরে আমার চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, চিনতে পারছিস?
ইনহেলার! আমার বুক ধুকপুক করতে শুরু করল। বললাম, এইরকম ইনহেলার মানস মিত্রর ঘরে দেখেছি।
তাতে ও, গুড!” বলে সেটা এবার প্যান্টের পকেটে চালান করল।
জিনিসটা এখানে পাওয়া যাওয়ার মানে কী, অনিদা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।
তাতে ও বলল, মনে হচ্ছে, কাল মানস মিত্র কোনও কারণে বাড়ির পেছনদিকে গেছিলেন। বলে একবার থামল অনিদা। তারপর বলল, কিন্তু একটা খটকা।
কী? আমিও ফিসফিসিয়েই প্রশ্ন করলাম।
তাতে ও একটা অদ্ভুত কথা বলল। জিনিসটা কাত বা উলটো হয়ে না পড়ে সোজা হয়ে পড়ল কীভাবে?
মানে? ওর কথার মানে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এতটা বলেই থামতে হল আমাকে। কারণ, আমরা চলে এসেছি বাড়ির সামনের দিকে।
অন্যান্য আইনগত কাজে ব্যস্ত থাকাতে পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষ এতক্ষণ আমাদের সাথে ছিলেন না। এবার আমাদের দেখতে পেয়ে হাঁক পেড়ে বললেন, কী, মিঃ সেন? তদন্ত কতদূর?
সবে তো শুরু। হেসে উত্তর দিল অনিদা। তারপর বলল, ডেড বডির কী ব্যবস্থা হল?
পোস্ট মর্টেমে চলে গেছে। বললেন মিঃ ঘোষ। এবার এগিয়ে এসে পকেট থেকে একটা ছোট্ট জিনিস বের করে অনিদাকে দিয়ে বললেন, এটা ভিক্টিমের ঘরে পাওয়া গেছে।
অনিদা জিনিসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, এটা তো একটা কাঠের টুকরো।
“কীসের টুকরো, অনিদা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কোনও কাঠের বাক্সের। বলল ও
কাঠের বাক্স! কথাটা শুনেই আমার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিতে শুরু করল। আর তার সাথে অনিদার সন্দেহেরও যে মিল আছে, তা বুঝতে পারলাম ওর পরের কথায়।
সম্ভবত সেই পান্ডুলিপিটার বাক্সের। বলল অনিদা।
পান্ডুলিপির বাক্স! তাহলে তো বাক্সটাও ওই ঘরেই পাওয়া উচি! উত্তেজিত হয়ে বললেন রূপেন রায়।
তার মানে কৌশিক সেনগুপ্তই পান্ডুলিপি চুরি করেছিলেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তাতে অনিদা বলল, তোর কথা যদি মেনেও নিই, তবে উনি নিজেই কেন খুন হয়ে গেলেন? আর তাই বলতে হয় চোর অন্য কেউ
অনিদার কথা শুনে ঘরে উপস্থিত লোকজন একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। ও তখন রূপেন রায়ের দিকে ফিরে বলল, আমি আপনার শোবার ঘরটা একবার দেখতে চাই।

প্রথমদিন মিঃ রায়ের ঘরে ঢুকে এমনটা অনুভব করিনি। কিন্তু আজ ঘরটাকে রহস্যময় লাগছিল। ঘরের কোণে কাঠের আলমারিটা আগেরদিন চোখে পড়লেও আজ আমাদের কাছে ওটার গুরুত্ব অনেক বেশি কারণ রূপেন রায় জানালেন, অনিদার থেকে পান্ডুলিপিটা ফেরত পেয়ে উনি সেটা তারপর থেকে শোবার ঘরে এই আলমারিতেই রেখেছিলেন। ভয় ছিল যে ওটা যদি চুরি হয়ে যায়! তাই আর ওটাকে মিউজিয়াম থেকে সরিয়ে এনেছিলেন। এমনকি উনি নাকি ভেবেছিলেন ওটাকে ব্যাঙ্কের লকারে রেখে আসবেন। ওঁর মাথায় নাকি প্ল্যান ঘুরছিল যে আস্তে আস্তে উনি সব দামি জিনিসই লকারে চালান করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তার আগেই এসব হয়ে গেল।
আলমারি বন্ধ থাকত না? জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
থাকত। চাবি তো থাকত আমার কাছে। শোবার সময় বালিশের নিচে রাখতাম। কিন্তু কী করে চোর সেটা হাতাল সেটা একটা রহস্য
কখন ব্যাপারটা নজরে এল?
সকালে হাঁটতে যাবার সময় বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন জানতে পারলাম যে কৌশিক খুন হয়ে গেছে, তখন কেন জানি না মনে একটা সন্দেহ হল। তাড়াতাড়ি ঘরে এলামকিন্তু ততক্ষণে আর কিছুই করার নেই। পান্ডুলিপি চুরি হয়ে গেছে আর চাবি ঝুলছে আলমারির গায়ে
ডাক্তার তো বলছেন খুন রাত একটা থেকে দেড়টার মধ্যে হয়েছে। মানে আপনার বাড়ি ফেরার আগে। তাহলে বাড়ি ফিরে আপনি কিছু বুঝতে পারেননি? কৌশিকের ঘরের সামনে দিয়েই তো আপনাকে আসতে হয়েছিল
না মিঃ সেন, বুঝতে পারিনি। হতাশ হয়ে বললেন মিঃ রায়
অনিদা এবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, কৌশিকের কি ওটার ওপর কোনও লোভ ছিল?
তাতে উনি আমাদের অবাক করে দিয়ে জানালেন যে বেশ কিছুদিন ধরেই কৌশিক সেনগুপ্ত নাকি ওঁর কাছে ওটার জন্য আবদার জানাচ্ছিলেন
সে কী! কথাটা শুনে চমকে উঠে অনিদা বলল, একথা আগে জানাননি কেন?
তাতে গম্ভীর হয়ে মিঃ রায় বললেন, প্রয়োজন মনে করিনি। তারপর বললেন, পান্ডুলিপির মানেটা যদি জানা যেত!
অনিদা এবার ঘরের পেছনের দিকের দরজা খুলে পেছনের বারান্দাটায় গেল। এটা দিয়েই পীযূষ রায়ের ঘর পর্যন্ত যাওয়া যায়। আর তার সামনেই সেই পেঁচালো লোহার সিঁড়িটা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল অনিদা। তারপর প্রশ্ন করল, আপনি রাতে শোবার সময় ঘরের দরজা বন্ধ করেন না?
করি। কিন্তু কাল সামনের দরজাটা বন্ধ করতে পারিনি। বললেন মিঃ রায়।
কেন? বলে ভুরু কোঁচকাল অনিদা।
আসলে কাল রাতে ঘরে ফিরে দেখি ছিটকিনি ভাঙা।
ভাঙা? গলা শুনেই বুঝলাম ওকে এই তথ্যটা ভাবিয়েছে। ও মিঃ রায়ের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, কখন ভাঙল?
জানি না। কাল রাতে ফিরেই তো দেখলাম। বললেন মিঃ রায়।
অনিদা ততক্ষণে দরজার দিকে এগিয়ে গেছে। আমার এবার নজর গেল ভাঙা ছিটকিনিটার দিকে। সেটা তখনও নিচের স্ক্রুটার ওপর ভর করে দরজার গায়ে ঝুলছে। অনিদা বেশ কিছুক্ষ দরজা আর ঝুলন্ত ছিটকিনিটা পরীক্ষা করল। তারপর চোখ ছোটো করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল মাটির দিকে।
মিঃ রায় তখন ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে হচ্ছে, মিঃ সেন?
অনিদা তখন বলল, ছিটকিনি তো ভাঙেনি মিঃ রায়, এর তো স্ক্রু খুলে নেওয়া হয়েছে।
সে কি! আঁতকে উঠে ঝুঁকে পড়ে ছিটকিনিটা দেখতে দেখতে মিঃ রায় বললেন, কিন্তু এ-ঘরে আমি না থাকলে তো কেউ ঢোকে না!
অনিদা রূপেন রায়ের সাথে ওর জেরা-পর্ব এখানেই শেষ করল।

গুণ মামার মতো না হলেও চেহারা আর মেজাজে সেটা বজায় রেখেছেন পীযূষ রায়। ভারিক্কি মেজাজের সাথে আরেকটা জিনিস হল ভারী গলার স্বর। বললেন, ওঁর নাকি মামার ব্যাবসায় যোগ দেবার খুবই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মামার ইচ্ছের জন্য তাঁকে শেষপর্যন্ত অন্যের গোলামি করতে হচ্ছে। রায়-পরিবারের সদস্য হয়েও তাঁকে চাকরি করতে হচ্ছে। আর এটা যে যথেষ্ট অপমানজনক তা উনি জানাতে ভুললেন না। আর তা নাকি একমাত্র বাইরের লোকের জন্য। মনে হল উনি মানস মিত্রর দিকে আঙুল তুললেন।
আপনার মামা একটা মহা মূল্যবান পান্ডুলিপি পেয়েছেন, জানেন তো?
হ্যাঁ, শুনেছি। বলে মাথা ওপর-নিচ করলেন পীযূষ রায়।
আপনাকে দেখাননি?
না, আমার ওতে কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
সেটা কিন্তু চুরি হয়ে গেছে।
তাও জানি। বেশ হেলায় উত্তর দিলেন উনি।
কে চোর বলে মনে হয় আপনার?
এতে সামান্য বিরক্তির সুরে উনি বললেন, কী করে বলব? অনেকদিন ধরেই বলে আসছি বাড়িতে সি.সি. টিভি লাগাতে। শুনবে না কেউ কারও কথা। এবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, কেন? কাঠের টুকরোটা তো কৌশিকের ঘর থেকেই পাওয়া গেছে।
ওঁরশারাটা কোনদিকে তা বেশ বুঝতে পারলাম। অনিদা বলল, তাহলে উনি নিজেই কেন খুন হয়ে গেলেন?
অনিদার এই প্রশ্নে গলা চড়িয়ে উনি বললেন, সেটা তো আপনার বের করার কথা! আমাকে কেন ফাঁসাতে চাইছেন?
ওঁর রাগটাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে অনিদা আবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি যা আয় করেন তাতে আপনার চলে যায়? মানে বেশি ইনকাম করার ইচ্ছে নেই? আপনি তো এই বাড়ির ছেলে। তাছাড়া ধার-টারও কি করতে হয়?
এই প্রশ্নের কোনও উত্তর করলেন না উনি। মনে হল এটা ওঁকে ব্যাক ফুটে ঠেলে দিল। আমতা আমতা করে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন।

চেহারা তো বটেই, স্বভাব-চরিত্র আর কথাবার্তাতেও মানস মিত্র বেশ ধীরস্থির। উচ্চতায় অনিদার থেকে খাটো। তবে বয়স ওর কাছাকাছি। মানে তিরিশ থেকে বত্রিশ। গোলাকার মুখের গড়ন। মাথাটা আকারে বেশ বড়ো। পরনে ওঁর বুটিকের কাজ করা সবুজ পাঞ্জাবী আর নীল জিনসের প্যান্ট।
ঘরের অন্য সদস্যদের সাথে কথা বলে যা যা জানতে পেরেছিলাম তার থেকে বেশি কিছু ওঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল নাআগেই বলেছি, অন্য সবার মতোই উনিও রাত এগারোটার মধ্যেই শুতে চলে গেছিলেনরূপেন রায়কে উনি নিজের বাবার মতো শ্রদ্ধা করেন। কাকাবাবু বলে ডাকেন। জিজ্ঞাসা করতে জানালেন, কাল রাতে একবার কৌশিকের সাথে দেখাও হয়েছিল ওঁরকিন্তু তারপর রাতে কী হয়েছিল ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। তাছাড়া পান্ডুলিপিটার ব্যাপারে উনি বিশেষ কিছু জানেন না। তবে শুনেছিলেন জিনিসটা খুব দামি মিঃ রায় সেটা ওকে কখনও দেখাননি।
শ্বাসকষ্ট কি আপনার বহুদিনের? এবার একটা অন্যরকমের প্রশ্ন করল অনিদা।
বুঝতে পারলাম, ও ওই ইনহেলারটার প্রসঙ্গে কথা বলছে। আমরা যে ওটা খুঁজে পেয়েছি তা হয়তো উনি আশা করেননি। তাই প্রশ্নটা শুনে উনি একটু চমকালেন। তারপর উত্তর করলেন। হ্যাঁ, একটু অ্যাজমা টাইপের আছে।
এবার পকেট থেকে অনিদা ইনহেলারটা বের করল।এটা কি আপনার?
ইতস্তত করে মানস মিত্র তখন বললেন, ইয়ে মানে হ্যাঁ, আমার।
অনিদা এবার ওটা ওঁর হাতে দিতে উনি বিনা কথা খরচে সেটা পকেটে ঢোকালেন।

একটা লম্বা জেরা-পর্ব শেষে আমরা বাড়ির বাগানে পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষের সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। ভদ্রলোক এখনও অথৈ জলে। কে এমনটা করল আন্দাজ করতে পারছিলেন নাডেড বডি পোস্ট মর্টেমে পাঠানো ছাড়া আর কোনও কাজের কাজ করে উঠতে পারেননি উনিশেষে কৌশিক সেনগুপ্তর ঘরে থেকে একটা ডায়েরি এনে অনিদার হাতে দিলেন। অনিদা ওটা নিয়ে কী করবে জানি না। কারণ, তাতে কয়েকটা ফোন নম্বর, বেশ কিছু দোকানের নাম আর নাটকের কিছু সংলাপ ছাড়া আর কিছুই নেই।

।। ।।

ময়ূখ ভিলা থেকে ফিরেই ডায়েরিটা নিয়ে পড়েছে অনিদা। প্রথমে কিছুক্ষ তাতে লেখা নাটকের সংলাপগুলো দেখলতারপর ডায়েরিতে লেখা ফোন নম্বরগুলোতে যোগাযোগ করতে জানা গেল, তাতে শুধু কলকাতা নয়, ভারতের অন্যান্য শহরেরও নম্বর রয়েছে। কিছু ব্যক্তিগত নম্বর ছাড়া বাকি নম্বরগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা দোকানের। কোনওটা দিল্লির তো কোনওটা মুম্বইয়ের। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ওই দোকানগুলোর সবকটাই অ্যান্টিক জিনিসের। এর মধ্যে দুয়েকটা দোকানে নাকি কৌশিক সেনগুপ্ত কোনও এক পুরনো পান্ডুলিপি বিক্রির কথা বলেছিলেন
জিনিসটা জেনে মুখ গম্ভীর হয়ে গেল অনিদারএইমাত্র ও বড়ো কাপে এক কাপ চা খেয়েছে। তাও আবার বিজুদাকে চায়ের জন্য বলল
তার মানে সারদা লিপিটা কৌশিক সেনগুপ্তই চুরি করেছিলেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
সেকথা জোর দিয়ে কী করে বলি? একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অনিদা বলল, যে চুরি করল সে-ই খুন হল? এটা কী করে হয়? আর জিনিসটা তো ওর ঘরে পাওয়াও যায়নি। কৌশিক যে দোষী তার প্রমাণ কোথায়? এবার ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, মনে হচ্ছে হাতের কাছেই কিছু একটা সূত্র রয়েছে, আমরা ধরতে পারছি না
আমি বললাম, তাহলে সেই বাক্সগুলো?
তাতে ও মাথা নেড়ে বলল, ওগুলোই তো সব গ করে দিচ্ছে রে। বিপদ, পীযূষ রায় আর কৌশিক সেনগুপ্ত - এই তিনটে জিনিস বোঝা গেছিল ওগুলো থেকে। কিন্তু বিপদটা আসলে কার? রূপেন রায়ের, নাকি বাকি দুজনের? কিন্তু তাহলে সেখানে মানস মিত্রর নামে কোনও ক্লু নেই কেন? ওই কি নিজে এসব করাচ্ছে? নাকি অন্যকিছু?
আমি প্রায় শ্বাস আটকে অনিদার কথা শুনছিলাম। ও এবার বলল, তার মানে এমন কেউ আছে যে এই সমস্ত ঘটনা জানে আর পুরো ব্যাপারটাকে কন্ট্রোল করছে।
সে কি বাইরের লোক? কথাটা বলতে গিয়ে মনে হল আমার গলার কাছটা শুকিয়ে গেছে।
তাতে অনিদা বলল, হতে পারে। কিন্তু কীভাবে?
বুঝলাম, কাজটা যে বাইরের লোকের সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না অনিদার।
আমি বললাম, বাইরের লোকের তো তেমন যাতায়াত নেই ওই বাড়িতে। একমাত্র মালি ছাড়া।
কয়েক মুহূর্ত মাটির দিকে চেয়ে রইল অনিদা। তারপর বলল, ঘরের সবাই খেয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেছিলেন রাত এগারোটার মধ্যে এবং রূপেন রায় বাড়ি ফেরেন রাত দুটোয়। আর খুনটা হয় রাত একটা থেকে দেড়টা নাগাদ। যেটা কিনা সবার ঘরে ঢুকে যাবার পর থেকে রূপেন রায়ের বাড়ি ফেরার আগের সময় পর্যন্ত। এই সময়টাতে কেউ কাউকে দেখেনি। তাই বলতেই হয় যে কারও কোনও অ্যালিবাই নেই। সুতরাং ভাবতে বাধ্য হচ্ছি যে খুনি ঘরেরই কেউ
সর্বনাশ! অনিদার কথাটা শুনে অস্ফুটে বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে। একটা ঢোঁক গিলে বললাম, আর কিছু ধরা পড়েছে তোমার চোখে?
তাতে অনিদা বলল, তিনটে খটকা
কী? ওর উত্তর শুনে আমার উৎসাহ বেড়ে গেল।
এক, রূপেন রায়ের ঘরে দরজার ছিটকিনি ভাঙা হল না অথচ আলমারিতে ঘষটানির দাগ।
মানে? এটা আমার কাছে একটা নতুন তথ্য!
অনিদা তখন মাথাটা একবার ডানদিকে কাত করে বলল, হ্যাঁ, আমি দেখেছি আলমারিতে একটা ঘষা দাগ। সেটা কেন হবে?
আমি তখন উত্তেজনায় গলা চড়িয়ে বললাম, কিন্তু মিঃ রায় যে বললেন আলমারির দরজা খোলা ছিল!
ছিল। সেটা চুরির সময় খোলা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে সেটা ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। মিঃ রায়ের চোখে সেটা ধরা পড়েনি।
ও। আর?
দোতলার বসার ঘরে রূপেন রায়ের সাথে ওঁর ভাইয়ের ছবিটা।
ওতে তুমি কী পেলে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম অনিদাকে।
তাতে ও বলল, “ওঁর ভাইয়ের ডানহাতের সেই আংটিটা।
আংটি? আমি প্রথমে অবাক হলাম এই ভেবে যে অত ছোটো জিনিস ওর নজরে এল কীভাবে? তারপর ভাবলাম, এখানে আংটির প্রসঙ্গ এল কেন? তাই জিজ্ঞাসা করলাম, আংটিটায় কী আছে?
খুব দামি। হেঁয়ালি করে বলল অনিদা। যেটা ধরার ক্ষমতা আমার নেই। তাই এবার ও কী বলে সেটা দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। ও এবার বলল, আরেকটা সন্দেহজনক জিনিস।
কী? আমি নড়েচড়ে বসলাম।
তাতে ও বলল, মানস মিত্রর ইনহেলারটা। ওটা ওখানে ওইভাবে পড়েছিল কেন?
কেন?
প্রশ্ন করেই বুঝলাম ভুল করে ফেলেছি। কারণ তাতে অনিদা আমাকে খিঁচিয়ে উঠে বলল, কেন সেটা জানলে কি প্রশ্নটার পেছনে সময় নষ্ট করতাম?
আর কথা বাড়ালে আবার বকুনি খেতাম। তাই চুপ করে গেলাম
এর মধ্যে পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষের ফোন এসেছিলউনি জানালেন, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসেছে। কিন্তু তাতে সুবিধেজনক কিছু পাওয়া যায়নিব্যাপারটা জেনে শুধুমাত্র একটা হালকা শ্বাস ফেলা দেখে মনে হল এমনটাই আশা করেছিল অনিদাঅথবা অন্যকথায় বলতে গেলে এর বেশি কিছু আশা করেনি।

বেশ কিছুক্ষ পর আর একটা ফোন এল অনিদার কাছে। এবারেরটা সেই যাদবপুর ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের কাছ থেকে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে সারদা লিপির আরেকটা দিক খুলে যেতে চলেছে।
ফোন আসার দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল অনিদা। আমারও যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা নাকচ হয়ে গেল। আমার ইচ্ছেটাকে স্ট্রেট ড্রাইভ করে করে সোজা মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ও বলল, তোর গিয়ে কাজ নেই। পরে তো সব জানতেই পারবি।
বাধ্য হয়ে রাগটা মনের মধ্যেই চেপে রাখতে হল।
অনিদা ফিরল প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর। লক্ষ করলাম, ওর চোখদুটো চিকচিক করছে। ওর এই হাবভাব আমার চেনা। নিশ্চই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে পেরেছে ওআমি খুব স্বাভাবিকভাবেই সেটা জানার জন্য ছটফট করছিলাম। ঘরে ঢুকেই ধপ করে সোফার ওপর বসে ঘন ঘন মাথা নাড়তে নাড়তে অনিদা বলল, হ্‌, ভাবা যায় না!
কেন, অনিদা? আমার তখন ধৈর্যের বাঁধ প্রায় ভেঙে যাবার মতো অবস্থা।
অনিদা তখন বলল, কী মহা মূল্যবান জিনিস যে রূপেন রায়ের হাতে চলে এসেছে, তা যদি উনি জানতেন!
ওর কথা শুনে আমার শিড়দাঁড়া নিজে নিজেই সোজা হয়ে গেছিল। বুঝতে পারছিলাম যে সাংঘাতিক জিনিসটার কথা ওরা সন্দেহ করছিল, সেটা সত্যি। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, খুব দামি কিছু বুঝি?
তাতে ও বলল, দামি বলে দামি? ওহ্‌, কী সাংঘাতিক! এমন একটা জিনিস আমার জীবনকালে আমি কোনোদিন দেখতে পাব, কল্পনাও করিনি। আর সেটা চুরি হয়ে গেল! তাও আমার তদন্তকালে? এটা মেনে নেওয়া যায় না।
আমার মন বলছিল যে পান্ডুলিপিটার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তাতে লেখা বিষয়টা। তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, পান্ডুলিপিটা কীসের ওপর লেখা, অনিদা?
ওটা একটা...”
অনিদা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ওর ফোন বেজে উঠেছে।
রূপেন রায় স্ক্রিনটা দেখে নিয়ে ফোনটা কানে দিল অনিদা। হ্যাঁ মিঃ রায়, বলুন।
রূপেন রায় ওপাশ থেকে কী বললেন তা জানি না। অনিদা শুধুমাত্র, হ্যাঁ বলুন... তাই!... কখন?... কোথায়?... সে কি!... ওকে, আমরা এখুনি আসছি, এই বলে ফোন কাটল।
আমি ফোনে বলা কথাগুলোর কোনটার কী মানে সেটা বোঝার চেষ্টা করতে করতে ওর দিকে চেয়েছিলাম। এবার ফোন রেখে ও বলল, সারদা লিপি উদ্ধার হয়েছে।
খবরটা শুনে আমি উত্তেজনায় একবার হেঁচকি তুললামএবার আনন্দে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সামনের সেন্টার টেবিলে একটা ঠোকা খেলাম। তারপর হাঁটুতে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞাস করলাম, কীভাবে, অনিদা? কোথায়?
অনিদা প্রথমে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আমার সাসপেন্সটা একটু বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল,মানস মিত্রর ঘরে।
সে কি! চমকে উঠলাম আমি।
আর প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু অনিদা আমাকে তাড়া দিয়ে উঠল“জলদি তৈরি হয়ে নে। ময়ূখ ভিলা যেতে হবে।

আমরা এখন মানস মিত্রর ঘরে। সারদা লিপি উদ্ধার হয়েছে আজ সকালে। শরীর খারাপ থাকার জন্য আজ আর বেরোননি রূপেন রায়। শুয়েই ছিলেন নিজের ঘরে। অফিসের একটা দরকারি ফাইল মানস মিত্রকে কাল রাতে দিয়েছিলেন উনি। সেটা একবার দেখার দরকার হয়ে পড়েছিল ওঁর মানস মিত্র ততক্ষণে বেরিয়ে গেছেন। যাবার আগে মিঃ রায়কে মানস মিত্র বলে গেছিলেন যে ফাইলটা ওঁর ঘরেই আছে। কিন্তু মিঃ রায় আর বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছিলেন না। তাই উনি এবার পীযূষ রায়কে ডেকে পাঠান মানস মিত্রর ঘর থেকে ফাইলটা এনে দেবার জন্য। আর পীযূষ রায় তখন মানস মিত্রর ঘরে ফাইল আনতে গিরে আবিষ্কার করেন পান্ডুলিপিটা।
কোথায় রাখা ছিল সেটা? জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
ওই টেবিলের কোটাতে। নিচে মাটিতে পড়ে ছিল। বলে ইশারা করে দেখালেন পীযূষ রায়
এইখানে? এভাবে? আশ্চর্য!
বুঝতে পারছিলাম এত সহজে সারদা লিপির উদ্ধার হওয়াটা অনিদা মেনে নিতে পারছিল না। এর মধ্যে পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষও এসে পড়েছেন।
অনিদা এবার টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। ঝুঁকে পড়ে কী যেন দেখল। তারপর ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবল। এবার প্রশ্ন করল, সকালে ঘর ঝাড়পোঁছ কে করে?
কাজের লোক আছে। সকালে এসে করে যায়। বললেন রূপেন রায়।
এর আগে আজ কেউ এ-ঘরে আসেননি? জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
আজ্ঞে, আমি এসেছিলাম বাবু। বললেন ভানুদা। তারপর জানালেন যে সকালে উনি মানস মিত্রকে চা দিতে এসেছিলেনকিন্তু তখন কোনও বাক্স ওঁর চোখে পড়েনি।
পান্ডুলিপির বাক্সটা জানালার সামনে টেবিলটার ওপর রাখা ছিল। অনিদা এবার সেটার দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন গেলাম আমি আর মিঃ ঘোষও। এবার বাক্সটা একটু ডানদিকে ঘোরাতে দেখলাম ওটার কোনার কাছটা সামান্য ভাঙা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেটা মাত্র দুয়েকদিনের মধ্যেই ভাঙা হয়েছে। হয়তো ওটা থেকে ভাঙা সেই টুকরোটাই আমরা পেয়েছিলাম কৌশিক সেনগুপ্তর ঘর থেকে। জিনিসটা দেখে অনিদা একবার ঘা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। যার মানে হল, ও আমাকে মনে করিয়ে দিতে চাইল কৌশিক সেনগুপ্তর ঘরে পাওয়া সেই টুকরোটার কথা। এবার বাক্সটার ঢাকনা খুললআর সাথে সাথে ওটার ওপর ঝুঁকে পলাম আমি আর মিঃ ঘোষ।
যে ভয়টা ছিল, সেটা হয়নি। কারণ, পান্ডুলিপি অক্ষত। তাই অনিদা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,যাক! তারপর মিঃ ঘোষের উদ্দেশ্যে বলল, দেখুন মিঃ ঘোষ, যেহেতু খুনের ঘটনার সাথে এই মহা ল্যবা পান্ডুলিপিটার একটা সম্পর্ক রয়েছে, তাই আপাতত এটা পুলিশের জিম্মায় থাকুক
হ্যাঁ, সেই ভালো বললেন মিঃ ঘোষ।
পান্ডুলিপিটাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়াটা রূপেন রায় মনে হয় মেনে নিতে পারলেন নাকিন্তু...” বলে থেমে গেলেন ভদ্রলোক।
অনিদা তখন ওঁকে আশ্বাস দিয়ে বলল, চিন্তা করবেন না ওর থেকে আর নিরাপদ জায়গা এই মুহূর্তে আর আপনি পাবেন না।
কতটা বাধ্য হয়েই দমে গেলেন মিঃ রায়। কারণ, মুখ দেখে মনে হচ্ছিল না যে উনি চিন্তামুক্ত হয়েছেন।
এবার ঘরের লোকেদের থেকে একটু তফাতে আসতে মিঃ ঘোষ চাপা গলায় অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু মাথায় ঢুকছে, মিঃ সেন?
মনে হচ্ছে একটু একটু। একইভাবে গলা নামিয়ে উত্তর করল অনিদা।
তাতে, তাই? বলে একবার জোরে চেঁচিয়ে উঠে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে ফিসফিসিয়ে অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কাকে সন্দেহ করছ তুমি?
তাতে অনিদা বলল, সেটা বলার আগে মালিটার সাথে একবার দেখা করতে চাই।
লোকটাকে কি একবার ডাকাব? বললেন মিঃ ঘোষ।
না, ও এখানে আসবে না। আমরা ওর কাছে যাব বলল অনিদা।

মালি বেচারা কথা বলতে পারে না। তাই তার সাথে অনিদা কীভাবে কথা বলবে বুঝতে পারছিলাম না। তবে লোকটা কানে শুনতে পায় আর কথা বোঝে, এই যা রক্ষা আমরা ময়ূখ ভিলা থকে এসেছি শুনে প্রথমটায় খুব উত্তেজিত হয়ে হাসল। তারপর কোনও একটা কারণে ওর মুখের ভাব পালটে গেল। হাসি হাসি মুখটা দেখতে দেখতে চুন হয়ে গেল। বার তিনেক দেওয়ালের পেছনে চলে গেল। তারপর আবার সামনে এসে দাঁড়াল। কেন জানি না ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, সেটা ভয়ে। হাত নেড়ে যেন কিছু একটা বলতে চাইছিল।
তুমি জান যে কৌশিক সেনগুপ্ত খুন হয়েছেন? অনিদা প্রশ্ন করল আলিকে
তাতে আলি, “উ- করে মুখ দিয়ে বার দুয়েক আওয়াজ করে মাথাটা দুবার সামনের দিকে ঝোঁকাল। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছিল ওর। বেশ বুঝতে পারছিলাম যে ওই চোখের আড়ালেই কোনও একটা রহস্য লুকিয়ে আছে তবে আলি নিজেই যে একটা বড়ো রহস্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তুমি জানতে কে একাজ করবে?
অনিদার প্রশ্ন শুনে সাথে সাথে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল আলির। থরথর করে কাঁপতে লাগল বেচারা। তাতে আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না যে অনেক কিছু জানে আলি।
কে সেই লোক? মানস মিত্র, নাকি পীযূষ রায়? আবার আলিকে প্রশ্ন করল অনিদা।
সাথে সাথে ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেল আলির। গলা টেপার মতো করে দুটো হাত নিজের গলার ওপর রাখল। তারপর জোরে জোরে চারবার মাথা নাড়ল। শেষে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমরা এতক্ষণ আলির ঘরে বসে। ওর স্ত্রী আগেই আমাদের চা দিয়ে গেছে। অনিদা ওর কাপের শেষ চুমুকটা মারছিল। আলিকে ওভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে ওর স্ত্রী এবার ছুটে এলঅনিদা তখন ওকে আশ্বস্ত করে বলল যে আলির জন্য ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওর কিছু হবে না। শুধু এই কদিন ও যেন ময়ূখ ভিলাতে না যায়।
আমরা আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। অনিদা বেশ অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। ওকে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, লি সব জানে, তাই না?
নো ডাউট অ্যাবাউট ইট বলল অনিদা।
ও ভয় পাচ্ছিল কেন?
বিপদের ভয়কারণ, আমার মনে হয় এমন একটা কিছু ওর ভেতরে রয়েছে, যা কিনা বাইরে বেরিয়ে এলেই ওর বিপদ। আর ও সেটা ভালোতোই জানে।
আমরা আলির বাড়ি থেকে প্রায় কিলোমিটার খানেক চলে এসেছি। এবার সামনের মোটা ঘুরতে একটা দোকানের সামনে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল অনিদা।
হলটা কী? ভেবে ওর দিকে তাকাতে আবিষ্কার করলাম, ওর নজর রাস্তার বাঁদিকের দোকানটার ওপর। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও এবার গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেল দোকানটার ভেতর। আমি তখন হতভম্ভ হয়ে বসে রয়েছি গাড়ির ভেতরে। মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কারণ যে দোকানটায় অনিদা ঢুকেছে, সেটা একটা গিফট শপ
প্রায় মিনিট দশেক পরে অনিদা যখন দোকান থেকে বেরিয়ে এল, তখন ওর হাতে ধরা রয়েছে সদ্য কিনে আনা একটা মুখোশ! আমি এবার নিশ্চিত যে রহস্যের জট ও খুলে ফেলেছে।
আমার আন্দাজ এবার সত্যি বলে প্রমাণিত হল যখন ও পুলিশ অফিসার মিঃ ঘোষকে ফোন করে বলল, কাল বিকেলে তৈরি থাকুন, ময়ূখ ভিলার রহস্য উদ্ঘাটন হবে।তারপর মুখোটা ধীরে ধীরে আমার মুখের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলল, চিনতে পারছিস?
ঠিক এইরকমই একটা মুখোশ রূপেন রায়ের কাছে এসেছিল। কথাটা ওকে বলতে ও বলল, রাইট! এবার এর পেছনে কার মুখ লুকিয়ে আছে সেটা জানার সময় হয়ে এসেছে।

।। ৭ ।।

প্রায় মাস ছয়েক আগের কথা। কাশ্মীরের বাকশালী গ্রাম। পুরু নামে এক চাষির প্রায় সাতপুরুষ ধরে বাস এই গ্রামে। এক কঠিন অসুখে ওদের বাড়ির পোষা কুকুটা সেবার মারা গেল। ওর মন চাইছিল না  সেটাকে অন্য কোথাও ফেলার। তাই পুরু ঠিক করল, সেটাকে পুঁতে ফেলবে বাড়ির পেছনদিকের পাইন গাছটার তলায়। তাই সাথে সাথে সে কোপানো শুরু করল মাটি। বেশ খানিকটা কোপানোর পর কীসে যেন ঠক করে লাগল কোদালটা। ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলকিন্তু অন্ধকার থাকায় ঠিক করে দেখতে পেল নাএবার চার সেলের টর্চটা আরেকটু কাছে এগিয়ে আনতে আবিষ্কার করল একটা বাক্স।
“কীসের বাক্স ওটা? ও শুনেছে, মাটির নিচে এইভাবে গুপ্তধন লুকোনো থাকে। এটাও কি তাই? বুক ধুকপুক করতে শুরু করল পুরুরচারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে এবার বাক্সটা বের করে আনল। কিন্তু সেটার ঢাকনা খুলতেই মন ভেঙে গেল কোথায় আশা করেছিল পাবে বাক্সভর্তি মোহর, আর সেখানে কিনা বাক্সের মধ্যে রাখা আছে গাছের কতগুলো পুরনো ছাল! তাতে আবার এক অজানা ভাষায় কীসব যেন লেখাধুর! এগুলো নিয়ে ও কী করবে? তাই ও প্রথমে বাক্সটা ফেলেই দিতে যাচ্ছিলকিন্তু কী ভেবে আবার রেখে দিল।
এর প্রায় এক সপ্তাহ পরের কথা। কাশ্মীর বেড়াতে গেলেন রূপেন রায়। ঘটনাচক্রে বাকশালী গ্রামে এসে পুরুর সাথে পরিচয় হল ওঁরকথায় কথায় জানতে পারলেন সেই গাছের ছালভর্তি বাক্সটার কথা জিনিসটা দেখার লোভ সামলাতে পারলেন না উনি। এবার জিনিসটা দেখেই বুঝলেন এ কোনও সাধারণ জিনিস নয়। পুরনো কোনও পান্ডুলিপি। তাই তাল বুঝে উনি মাত্র দশ হাজার টাকার বিনিময়ে জিনিসটা পুরুর কাছ থেকে কিনে নিতে চাইলেন।
কতগুলো গাছের ছালের জন্য দশ হাজার টাকা! লোকটা পাগল নাকি? মনে মনে হেসে উঠল পুরু। গাছের ছাল আর ওর কী কাজে লাগবে? তাই আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে রূপেন রায়ের প্রস্তাবটা লুফে নিল ও।
জিনিসটা যে ভীষ মূল্যবা, তা বুঝতে পেরেছিলেন রূপেন রায়। তাই আনন্দে লাফাতে লাফাতে কলকাতায় ফিরলেন উনি। তারপর চেষ্টাচরিত্র করে জানতে পারলেন, যে লিপি লেখা আছে ওই গাছের ছালের ওপর তার নাম সারদা লিপি। যা কিনা অবলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় হাজার বছর আগে! তার সংগ্রহশালার মধ্যে যে এটা সবথেকে মূল্যবা হতে চলেছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না ওঁর কিন্তু এবার মন চাইছিল ওই পান্ডুলিপির দাম কত সেটা জানতে। কী লেখা আছে ওতে? কেনই বা ওটা ওভাবে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হয়েছিল? তাই ডাক পল অনিরুদ্ধ সেনের।
একটানা অনেক্ষ কথা বলে থামল অনিদা। ময়ূখ ভিলার দোতলার ঘরে জমায়েত হয়েছিলাম আমরা। অনিদা বসেছে ঘরের মাঝে একটা সোফায়। আর ওর পাশে, সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছি আমরা সবাই। ও বলেছে আজই ময়ূখ ভিলার রহস্য উদ্ঘাটন হবে। তাই সবার মুখ গম্ভীর। ঘরের এই দৃশ্য আমার কাছে নতুন নয়। আজ পর্যন্ত ওর সবকটা কেসেই ওর সাথে থেকেছিতাই জানি ওর এই আস্তে আস্তে ‘মিস্ট্রি আনফোল্ড ব্যাপারটার মধ্যে একটা মজা আছে।
মিঃ রায় থমথমে মুখে বসে ছিলেন। বুঝতে পারছিলাম যে পরিবারের কেউ এইভাবে খুন হয়ে যাওয়াটা বাড়ির মালিক হিসেবে তাঁর কাছে খুব একটা সুখের নয়। তাই হয়তো খুনির পরিচয় পাওয়াটা ওঁর কাছে খুবই জরুরি
মানস মিত্র আর পীযূষ রায়, দুজনের মুখও গম্ভীর।
ঘরের এককোণে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভানুদা।
এদিকে মিঃ ঘোষ আজ আবার দুজন হাবিলদারকে সাথে করে এনেছেন।
অনিদা আবার বলতে শুরু করল।পান্ডুলিপিটা কলকাতায় নিয়ে আসার পর থেকেই শুরু হল গণ্ডগোল। শয়তানের কুনজর পড়ল ওটার ওপর। না বুঝে রূপেন রায় জিনিসটার কথা বলে ফেললেন এমন একজনকে যাকে বিশ্বাস করা আর বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে জেনে শুনে পা রাখা, একই ব্যাপারকাশ্মীর থেকে পান্ডুলিপিটা এনে প্রথমে অপরাধীকেই দেখান রূপেন রায়উনি কোনওভাবে চেষ্টাচরিত্র করে জেনেছিলেন যে, ওতে যা লেখা রয়েছে, সেটা বের করতে পারলে কামানো যাবে অনেক টাকাআর সেকথা উনি অপরাধীকে বলে ফেলেছিলেন এবং এখানেই ভুলটা করেছিলেন উনিপান্ডুলিপিটা দেখে অপরাধীর জিভ লক লক করে উঠলতাই প্রথমদিন থেকেই সে ছক কষতে শুরু করল যে, জিনিসটা কী করে হাতানো যায়।
অপরাধীর লোলুপ দৃষ্টি কিন্তু শুধু পান্ডুলিপির ওপরই ছিল নাকারণ, তার লক্ষ্য ছিল ময়ূখ ভিলার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা। তার সম্পত্তির মালিক হওয়া। কিন্তু এই বিরাট কর্মযজ্ঞ অপরাধীর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিল না। তাতে তার প্রয়োজন ছিল যোগ্য সঙ্গীর। ভাগ্যক্রমে সেই সঙ্গী পেয়েও গেল সে। আর ঠিক এই সময় থেকে এই বাড়িতে আসতে শুরু করল একটা করে অদ্ভু সব প্যাকেট। তার কোনওটাতে ছিল খেলনা পিস্তল, কোনওটাতে ছিল মুখো তো কোনওটাতে মানুষের মাথার খুলি। সবাই সেগুলো দেখে তো হয়রান। কে পাঠাচ্ছে এগুলো? কেন পাঠাচ্ছে? ঠিক এই সময় মঞ্চে ঢুকলাম আমি।
অন্য সবার মতো আমিও এই বাক্স রহস্য বুঝতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছিলামপরে বুঝলাম, এমন কেউ একজন আছে যে কিনা মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে করতে এই প্যাকেটগুলো পাঠাচ্ছে এবং তার উদ্দেশ্য অসৎ নয়। কারণ, সে অপরাধীর মুখো টেনে খুলে দিতে চায়।
অনিদার কথা শুনে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তার মানে যে প্যাকেটগুলো পাঠাচ্ছিল, সে অপরাধী নয়?
অনিদা আমার কথায় মুচকি হাসল। আমি তখন বললাম, কিন্তু সেটা সে করছিল কেন?
তাতে অনিদা বলল, সে বিষয়ে পরে আসছি। তারপর বলল, প্যাকেটে পাঠানো জিনিসগুলোর মানে যখন বের করে ফেলেছি, শুধু তাই নয়, অপরাধী হিসেবে যখন কৌশিক সেনগুপ্তকে সন্দেহের তালিকায় সবার ওপরে রেখেছি, ঠিক তখন মর্মান্তিকভাবে খুন হয়ে গেলেন উনি নিজেই! কিন্তু তাতে একটা রাস্তা আমার চোখের সামনে খুলে গেল। আসলে অপরাধীর সঙ্গে মিলে ছিলেন কৌশিক নিজেওইতিহাসের ছাত্র হওয়াতে পান্ডুলিপির মূল্যটা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন উনিতার সঙ্গে এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাতে লেখা কথাগুলোর মানে যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে সেটার দাম কয়েক লাফে উঠে যাবে অনেক গু! আর সেই কারণেই আমরা ওঁর ঘরে পেয়েছিলাম বেশ কিছু ইতিহাসের বই। আসলে পড়াশুনার দরকার হয়ে পড়েছিল যে। তবে শুধু কৌশিক নয়, ওঁর সঙ্গে আরও লোকজনকে দলে টেনেছিল অপরাধী। প্রতিশ্রুতি ছিল সম্পত্তির অংশ আর পান্ডুলিপি বিক্রির টাকার ভাগ।
কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বেঁকে বসলেন কৌশিক। ওঁর দাবি ছিল, অন্যদের থেকে তাঁর টাকার ভাগ বেশি চাই। না হলে উনি পুলিশকে জানিয়ে দেবেনআর এখানেই বেচারা নিজের পায়ে কুড়ুলটা মারলেনপরাধীর রোষের মুখে পলেনআর তারপর সেই অপরাধী আর সাধারণ অপরাধী রইল না। হয়ে উঠল খুনি! রাতের অন্ধকারে সে গেল কৌশিক সেনগুপ্তর ঘরে। প্রথমটায় খুনির উদ্দেশ্য বুঝতে পারেননি কৌশিক। ভেবেছিলেন, ভয় পেয়ে অপরাধী আপো করতে এসেছেকিন্তু নিজের ভুল উনি বুঝতে পারলেন খুনির ওঁর ওপর অতর্কিতে আক্রমণের পর। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। নিজেকে আর বাঁচাতে পারলেন না কৌশিক।
ঘটনার কিছুক্ষ আগে রূপেন রায়ের ঘর থেকে পান্ডুলিপিটা নিয়ে এসেছিল খুনি। তারপর কৌশিককে খুন করে সেই বাক্সের একটা টুকরো ভেঙে কৌশিকের ঘরে ফেলে রেখে দরজা ভেজিয়ে লাইট বন্ধ করে চলে যায় চলে যায় সেখুন করে যাবার সময় সে ঘরের পেছনের দিকের দরজা ব্যবহার করেছিলতার প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।”
অনিদার শেষ কথাটা শুনে আমার মনে পল বাড়ির পেছন দিকে পাওয়া সেই ইনহেলারটার কথা। সেটা মানস মিত্রর ব্যবহার করা জিনিস
অনিদা আবার বলতে শুরু করল, “অনেক টানাপোড়েনের পর পান্ডুলিপি শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল মানস মিত্রর ঘর থেকে। আর আশ্চর্যজনকভাবে সেটা পেলেন মিঃ পীযূষ রায়! বলে অনিদা দুজনের দিকেই একবার করে তাকাল। তাতে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নামিয়ে নিলেন মানস মিত্র। পীযূষ রায় অবশ্য তখন কটমটিয়ে চেয়ে ছিলেন অনিদার দিকে।
মিঃ ঘোষ এবার প্রশ্ন করলেন, মানস মিত্রর ঘর থেকে পীযূষ রায়ের এই পান্ডুলিপিটা পাওয়াটাই কি প্রমা করে না যে মানস মিত্র অপরাধী?
তেমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিক। এটা থেকে সাধারণত দুটো জিনিসই সবার মাথায় আসে। হয় ওটা মানস মিত্র সত্যিই নিজে চুরি করে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। না হয় পীযূষ রায় ইচ্ছাকৃতভাবে জিনিসটা ওঁর ঘরে রেখে পরে দাবি করেছিলেন যে উনি সেটা ওখানে পেয়েছেন। বলল অনিদা।
আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো? অনিদার কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন পীযূষ রায়।
পা থেকে মানস মিত্র এবার বিরোধিতা করে বলে উঠলেন, আপনি কেন আমাকে এইভাবে অপরাধী সাজাচ্ছেন, মিঃ সেন?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অনিদা এবার বলল, আপনারা হয়তো কেউ ঠিক করে আমার কথা শোনেননি। কারণ, আমি বলেছিলাম যে, তেমনটা মনে হওয়া স্বাভাবিকআমি একবারও কিন্তু আপনাদের কাউকে অপরাধী বলে দাবি করিনি।
অনিদার কথায় আবার খেই হারালাম আমরা।
তাহলে কি এঁদের মধ্যে কেউ অপরাধী নন?
কথাটা মিঃ ঘোষ ওকে জিজ্ঞসা করতে ও মাথা নেড়ে বলল, না, মিঃ ঘোষ।
ওর এই একটা উত্তরেই যেন মানস মিত্র আর পীযূষ রায়ের বুক থেকে পাথর নেমে গেল। অনিদা অবশ্য ওদের পুরোপুরি রেহাই দিল না। বলল, তবে এঁদের মধ্যেও একজন কিন্তু অপরাধের সাথে সরাসরি যুক্ত।
সে কি! কে সে? মিঃ ঘোষের সাথে সাথে আমিও চমকে উঠলাম।
অনিদা এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধিরে এদিয়ে গেল পীযূষ রায়ের দিকে। এবার ঝুঁকে পড়ে বলল, সম্পত্তি তো পেতেনই, তবু কেন জড়িয়ে পড়লেন অপরাধের সাথে?
অনিদার কথায় এতটাই জোর আর আত্মবিশ্বাস ছিল যে পীযূষ রায়ের তেজ এমনিতেই উধাও হয়ে গেল। মাথা নিচু করে করে নিলেন উনি। তারপর বললেন, আমি লোভে পড়ে গেছিলাম, মিঃ সেন।
কিন্তু জিনিসটা তো মানস মিত্রর ঘর থেকে পাওয়া গেছিল। বললেন মিঃ ঘোষ।
হতে পারে। কিন্তু সেটা উনি নিয়ে যাননি। বলল অনিদা।
তাহলে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তাতে অনিদা বলল, আসলে খুনি ওঁকে ফাঁসানোর জন্য বাক্সটা ওখানে রেখে এসেছিল। কারণ, সে জানত যে কারও না কারও চোখে বাক্সটা পবেই। আর তখন ফেঁসে যাবেন মানস মিত্র।
কিন্তু তাতে তার লাভ কী? মানস মিত্র তো এর মধ্যে ছিলেনই না! বললে মিঃ ঘোষ।
তাতে মুচকি হেসে অনিদা বলল, দল যখন একটা আছে, তখন তার একটা বিরোধী দল তো থাকতেই হবে, মিঃ ঘোষ। মানষ মিত্র এই পুরো ষযন্ত্রটার কথা জানতেন। মনে মনে এর বিরোধীতা করলেও মুখে কিছু বলার সাহস করেননি। কারণ, তাতে তাঁর প্রাণের ভয় ছিল।
এতক্ষণ চুপ করে অনিদার কথা শুনছিলেন রূপেন রায়। এবার গলাখাঁকারি দিয়ে তাঁর অতি পরিচিত ঢংয়ে বললেন, তখন থেকে তো খালি খুনি খুনি করছেন। কিন্তু তাঁর আসল পরিচয়টা কী?
তাতে অনিদা এবার ওঁর দিকে কিছুক্ষ গম্ভীর হয়ে চেয়ে থেকে বলল, আমি বলব? নাকি আপনি নিজেই বলবেন, মিঃ রায়?
এবার সত্যিই অদ্ভু শোনাল অনিদার গলা।
মানে? কপাল কুঁচকে গেল মিঃ রায়ের। বললেন, আমি কী করে বলব?
আপনিই তো বলবেন, মিঃ রায়! আবার গিয়ে নিজের জায়গায় বসল অনিদা।
তাতে কপালটা আরেকটু কুঁচকে নিয়ে মিঃ রায় বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন বলুন তো?
অনিদার হেঁয়ালি আমিও বুঝতে পারছিলাম না। মিঃ ঘোষও একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিলেন।
অনিদা এবার মুচকি হেসে বলল, কাশ্মীর থেকে সারদা লিপি বাড়িতে আনার পর পীযূষ রায় আর কৌশিক সেনগুপ্তকে দলে টানা। সম্পত্তি হাতানোর ফন্দি আঁটা। কৌশিকের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়াআর তারপর উনি বেঁকে বসলে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা। এখানেই শেষ নয়খুন করে ফেরার পথে মানস মিত্রর ইনহেলারটা বাগানে ফেলে যাওয়া। আর শেষে পান্ডুলিপি মানস মিত্রর ঘরে রেখে তাঁকেও ফাঁসানোর চেষ্টা করা - এগুলো কি অস্বীকার করা যায়, মিঃ রায়?
হোয়াট! ভারী গলাটা সপ্তমে তুলে মিঃ রায় বললেন, আপনি বলতে চাইছেন যে নিজের সম্পত্তি নিজেই হাতানোর জন্য আমি নিজেই এসব করেছি? আপনি পাগল? নাকি আমি পাগল? আমিই একাজ করলাম আর আমিই গোয়েন্দা লাগালাম?
তাতে মিঃ ঘোষ মাথাটা বার দুয়েক ওপর-নিচ করে বললেন, “সত্যিই তো, রূপেন রায় কী করে একাজ করতে পারেন?
তাতে অনিদা আবার হেঁয়ালি করে বলল, আমি তো বলিনি যে রূপেন রায় একাজ করেছেন।
তাতে এবার ঘেঁটে গিয়ে মিঃ ঘোষ বললেন, হ্‌, কী করছেন বলুন তো? এই বলছেন উনি করেছেন আর এই বলছেন রূপেন রায় অপরাধী নন!
তাতে আবার হেসে অনিদা বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, মিঃ ঘোষ। রূপেন রায় অপরাধী নন।
তাহলে অপরাধী কে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
এবার রূপেন রায়ের দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে অনিদা বলল, অপরাধী হলেন উনি। মিঃ রায়।
মানে? আবার হেঁয়ালি! বললেন মিঃ ঘোষ।
হ্যাঁ, তাতে মাথাটা একবার ওপর-নিচ করে অনিদা বলল, এইসবের পেছনে একজনেরই হাত রয়েছে। আর সেটা হল ওঁরমিঃ উপেন রায়ের।”
সে আবার কে? অনিদার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পলেন মিঃ ঘোষ।
আমিও এবার একটু এগিয়ে বসলাম। এই নামটা আগে যেন কোথায় শুনেছি। মনে করার চেষ্টা করছি, অনিদা তখন আমাদের অবাক করে দিয়ে বলল, উপেন রায় হলেন রূপেন রায়ের নিজের ভাই।
ঘরের ভেতর যেন একটা বোমাল। আমার মুখ অজান্তেই হাঁ হয়ে গেল। মনে প, প্রথমদিন বসার ঘরে দেখা রূপেন রায়ের সাথে তাঁর ভাইয়ের ছবিটার কথা।
কিন্তু উনি তো রূপেন রায়!” বলে ঘরে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকালাম।
অনিদা তখন বলল, আমরা যাকে উপেন রায় বলে মনে করছিলাম আসলে তিনিই হলেন রূপেন  রায়। আর ওঁর ঠিক পাশের জন, তিনি হলেন উপেন রায়। মানে ইনি, যিনি এখন আমাদের সামনে বসে রয়েছেন।
কী সর্বনাশ! অজান্তেই বেরিয়ে এল আমার মুখ দিয়ে। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললাম, তার মানে কি...”
না না, আমার কথা কেটে অনিদা বলল, তুই যা ভাবছিস তা নয়। দাদাকে উনি খুন করেননি।
তাহলে?
উনি ওঁর দাদাকে আটকে রেখে নিজে রূপেন রায় সেজে বসে আছেন। বলে একবার আড়চোখে উপেন রায়ের দিকে তাকাল অনিদা।
ভদ্রলোক তখন কথা হারিয়েছেন। অনিদার কথার প্রতিবাদ করার শক্তি বা ক্ষমতা, কোনটাই আর ওঁর মধ্যে নেই। কারণ তেতো সত্যিটা অনিদা তখন ওঁর সামনে গড়ড়িয়ে বলে চলেছেবলতে গেলে অনিদার সাঁড়াশির চাপে বেচারা তখন দিশেহারা।
অনিদা আবার বলতে শুরু করল, কর্মঠ, সৎ এবং উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী রূপেন রায়ের এক শতাংশ গুও ছিল না উপেন রায়ের মধ্যে। অলস, কর্মবিমুখ উপেন রায় তাই কিছুই করে উঠতে পারেননি জীবনেবাবার সম্পত্তির একটা অংশ নিয়ে চলে যান দিল্লি। সেই কম বয়সে। এই বাড়িটা আর প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্যাবসা ছাড়া আর কিছুই জোটেনি রূপেন রায়ের ভাগ্যে। কিন্তু নিষ্ঠা আর সততার জোরে একটা মরা ব্যাবসাকে লাভের মুখ দেখাতে শুরু করেন রূপেন রায়।
ভাই দাদাকে ভুলে গেলেও, দাদা কিন্তু ভাইকে ভুলে যাননি। তাই রূপেন রায় নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন উপেন রায়ের সাথে। দাদার ব্যবসায়ে উন্নতি হওয়াতে মুখে খুশি খুশি ভাব দেখালেও মনে মনে উপেন রায় ফন্দি আঁটতে থাকেন যে কী করে দাদার সম্পত্তি হাতানো যায়। তাই আবার যাতায়াত শুরু করলেন কলকাতায়। এভাবে চলতে থাকল কয়েকদিনকিন্তু সেইভাবে কায়দা করে উঠতে পারলেন না উনি। তাছাড়া ভয়ে কিছু করার সাহসও পাচ্ছিলেন নাকিন্তু এবার হঠাৎ করে দাদার হাতে একটা মহা মূল্যবা পান্ডুলিপি চলে আসাতে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। আর তার জেরেই ঘটিয়ে ফেললেন এত বড়ো একটা ঘটনা প্রথমে হাত করলেন পীযূষ রায়কে, আর তারপর কৌশিক সেনগুপ্তকে। বলেন, আগে সম্পত্তি হাতাবেন আর তারপর পান্ডুলিপি। আর তার থেকে যথেষ্ট পরিমাভাগ দেবেন ওঁদেরকেব্যস, টোপটা খেয়ে গেলেন ওঁরাশুরু হয়ে গেল জয়েন্ট অপারেশন। এদিকে সবাইকে পারলেও কিন্তু মানস মিত্রকে ব করতে পারলেন না উনিএকইভাবে ওঁদেরকে সাহায্য করার জন্য বেঁকে বসলেন ভানুদাও। তবে তাতে ওদের কাজ চালাতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কারণ, ওঁরা মানস মিত্র আর ভানুদার মুখ বন্ধ করে রেখেছিলেন প্রাণের ভয় দেখিয়ে।
এবার প্ল্যানমতো সরিয়ে ফেললেন দাদাকে। উপেন রায় বাড়ি ছেড়ে তেমন একটা বেরোতেনও না। তাই ধরা পড়ে যাবারও ভয় ছিল না। দুয়েকজন যাঁরা বাড়িতে এর মধ্যে এসেছিলেন, তাদেরকে বাড়ির অন্যরা বলে দিয়েছিলেন যে রূপেন রায় বাইরে গেছেন মাস তিনেকের জন্য। দোকানেও একই কথা বলেছিলেন। তবে দোকানে বলা আর না বলার কী আছে। সেখানে মানস মিত্র ছাড়া আর আছে মাত্র একজন। সে একজন পিওন গোছের লোক। তবে সে আবার নতুন। কারণ, পুরনো লোককে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই এই উপেন আর রূপেন রায়ের গল্প সেই নতুন লোক জানতই না। মাঝে মধ্যে উনি দোকানে যেতেন বটেতবে সেটা খুব কমএবার হোম ওয়ার্ক চলতে লাগল সম্পত্তি হাতানোরকিন্তু পাণ্ডুলিপিটা? দাদা বলেছিল যে ওটায় হয়তো লেখা আছে এমন কিছু তথ্য যা কিনা আবিষ্কার হলে রাতারাতি অনেক টাকার মালিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কী আছে ওতে? কৌশিক ছাড়া কেউ ও-জিনিসের মূল্যও কেউ বুঝতে পারেননিঅবশ্য কৌশিকের পক্ষেও সে জিনিস সহজে বের করা সম্ভব নয়
এর মধ্যে ঘটতে শুরু করল আরেকটা ঘটনা। হঠাৎ করে কে যেন অদ্ভু কিছু বাক্স পাঠাতে শুরু করল রায়বাড়িতে। যেগুলোর মানে কেউ উদ্ধার করে উঠতে পারছিল না। একটার পর একটা বাক্স আসাতে এবার কেন জানি না ভয় পেয়ে গেলেন উপেন রায়। পুলিশও ডাকতে পারছেন না আবার নিজেও কিছু বের করতে পারছেন না। একে তো পান্ডুলিপি রহস্য আর তার ওপর আবার এই বাক্স রহস্য। তেমন কারও সাহায্য নিতেই হয় এবার। তাহলে? তাহলে একটাই উপায়। এমন একজনের ডাকতে হবে যে কিনা এ ব্যাপারে আলো দেখাতে পারবে। তাই উনি এবার যোগাযোগ করলেন আমার সাথেনিজের পরিচয় দিলেন রূপেন রায় বলেই
সবই চলছিল ঠিকঠাক। পান্ডুলিপির রহস্য উদ্ধার হয়ে গেলে তার সাথে বাক্স রহস্যও উদ্ধার হয়ে যাবে, এই আশা ছিল উপেন রায়ের মনে। কিন্তু এই সময় সবকিছু ওলটপালট করে দিলেন কৌশিক সেনগুপ্ত। হঠাৎ করে বেঁকে বসলেন উনি। তাঁর বেশি টাকার ভাগ চাই। না হলে সব ফাঁস করে দেবেন। ব্যস, ভয় পেলেন উপেন রায়। কৌশিক যদি এটা করে, তাহলে তাঁর সব প্ল্যান ফেল করে যাবে। তাই আর অপেক্ষা নয়। পথের কাঁটা সরাতে হবে যত তাড়াতাড়ি হয়ব্যস, সরিয়ে দিলেন কৌশিক সেনগুপ্তকে। আর কায়দা করে তার দায়টা চাপিয়ে দিলেন মানস মিত্রর ঘাড়েপ্রথমে ইনহেলারটা ফেলে এলেন পেছনের বাগানে আর তারপর পান্ডুলিপিটা নিজেই রেখে এলেন মানস মিত্রর ঘরে যাতে লোকজন মনে করে চুরি আর খুন দুটোর পেছনেই আছে মানস মিত্রর হাতউনি জানতেন, মানস মিত্র প্রমাণের অভাবে বেঁচে গেলেও তাঁর পক্ষে এ বাড়িতে আর টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আর তারপর বেঁচে থাকে আর মাত্র একটা কাঁটা। তাকেও হয়তো...”
শেষ কথাটা বলে অনিদা এবার পীযূষ রায়ের দিকে তাকাল
মিঃ ঘোষ তখন জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু এসবের প্রমা কোথায়, মিঃ সেন? উনি না হয় উপেন রায় তা মানলাম। কিন্তু খুন? সেটা যে উনি করেছেন তার প্রমা?
অনিদা তখন পকেট থেকে একটা ঝলমলে আংটি বের করে মিঃ রায়ের দিকে তুলে বলল, দেখুন তো মিঃ রায়, এটা চিনতে পারেন কি না
এবার আংটিটার দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলেন উপেন রায়। অনিদা তখন বলল, খুন করে রুমালে হাত মুছতে মুছতে ঘরে থেকে বেরিয়ে যখন ইনহেলারটা ঘাসের মধ্যে রেখে আসতে গেছিলেন, তখনই রুমালের চাপে অসতর্কতাবশত আংটিটা আপনার হাত থেকে খুলে পড়ে যায়ব্যাপারটা আপনি যখন পরের দিন সকালে বুঝতে পারেন যে আংটিটা আপনি কোথাও ফেলে এসেছেন, ততক্ষণে সেটা আমার হাতে চলে এসেছে। অবশ্য ওটা যে আমার কাছে ছিল সেটা আপনি বুঝতে পারেননি। তাহলে আমার ওপরেও অ্যাটাক করাতেন নিশ্চয়আর হ্যাঁ, সেই রুমালটাও আপনি বাড়ির বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। সেটাও এখন আমার জিম্মায়। ওটার গায়ে লাগা রক্তটাও আপনার বিরুদ্ধে কথা বলবে। কিন্তু অস্ত্রটা কোথায় সেটা জানি না।
কিন্তু উনি তো সেদিন বাড়ি ফেরেন রাত দুটোর পরে। নিমন্ত্র সেরে প্রশ্ন করলেন মিঃ ঘোষ।
হ্যাঁসেদিন উনি দোকানেও গেছিলেন। দোকান থেকে চলে যান অন্য জায়গায়। কিন্তু কোনও নিমন্ত্র সেদিন ওঁর ছিল না। মানস মিত্র একাই ফেরেন ট্যাক্সি ধরে। কিন্তু রাত একটা নাগাদ চুপিসাড়ে উনি বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর পেছন দরজা দিয়ে সোজা চলে যান দোতলায়। এবার একতলায় নেমে এসে খুন করেন কৌশিক সেনগুপ্তকে। এরপর আবার সেই পেছন দরজা দিয়েই বেরিয়ে যান বাড়ির বাইরে আর শেষে ফেরেন রাত দুটোর সময়।
বাবা! কী প্ল্যানিং রে ভাই! বলে চোখ কপালে তুললেন মিঃ ঘোষ।
আমার তখন মনে পল অনিদা হঠাৎ কেন সেদিন আংটির কথা বলছিল
আর উনি যে রূপেন রায় নন, সেটা বুঝলেন কবে? আবার জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ ঘোষ।
তখন শুধু আমাকে নয়, ঘরের সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনিদা বলল, একেবারে প্রথমদিন। যেদিন আমি প্রথম এই বাড়িতে এলাম।
সে কি! আমি থ হয়ে বললাম, কী করে?
অনিদা এবার ঘরে টাঙানো রূপেন রায় আর উপেন রায়ের ছবিটা দেখিয়ে বলল, এই ছবিটাই আমার চোখ খুলে দিয়েছিল। কারণ, আমার কাছে যিনি সশরীরে গেছিলেন, হাতের ওই লাঠিটা ছিল তাঁর কাছে। অথচ ছবিতে সেটা রয়েছে আরেকজনের হাতে। মানে আসল রূপেন রায়ের কাছে আর তাতে আমার সন্দেহ হয় যে কোথাও একটা গণ্ডগোল আছে। তাই প্রথম থেকেই সতর্ক ছিলামআর সেই কারণেই রূপেন রায়ের ছদ্মবেশে থাকা উপেন রায়কে কখনোই সন্দেহের তালিকা থেকে সরিয়ে রাখিনি। কিন্তু যে ভুলটা আমি করেছিলাম সেটা হল, গা ঝাড়া দিতে একটু বেশি দেরি করে ফেলে। আর সেই কারণেই একটা তাজা প্রাণ গেল
কখন তুমি শিওর হলে যে উপেন রায়ই আসল অপরাধী? অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বুঝতে পেরেছিলাম অনেক আগেই। কিন্তু অপেক্ষাটা একটু বেশি হয়ে গেল। বলে এবার উঠে দাঁড়াল অনিদা। তারপর পীযূষ রায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, অপরাধীকে সাহায্য করার জন্য আপনাকেও শাস্তি পেতে হবে।
আর সেই বাক্সগুলো? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তাতে হালকা একটা হাসির রেখা এনে অনিদা এবার ঘরে উপস্থিত একজন হাবিলদারকে কী যেন ইশারা করল। তাতে হাবিলদার ভদ্রলোক বাইরে বেরিয়ে গেলেন। আর কিছুক্ষণ পরে যখন ফিরে এলেন, তখন তাঁর পেছন পেছন গুটি গুটি পায়ে ঘরের ভেতর এসে হাজির হয়েছে আলি
আচমকা ওকে এখানে নিয়ে আসা মানে বুঝতে পারলাম নাতাই জিজ্ঞাসা করলাম, ও পাঠাচ্ছিল নাকি বাক্সগুলো?
ইয়েস। বলল অনিদা। তারপর আলির দিকে তাকাতে ও আগের দিনের মতোই মাথাটা জোরে জোরে দুবার ওপরনিচ করল।
কিন্তু...”
মাস্টার মাইন্ডটা যদিও ছিল অন্য কারও আমার কথা কেটে বলল অনিদা।
কার?
আবার চমকে দিয়ে অনিদা তখন বলল, আসলে বাক্সগুলো পাঠানোর প্ল্যান ছিল মানস মিত্রর। রূপেন রায়ের বিরুদ্ধে কোনদিনই যেতে পারেননি মিঃ মিত্র। বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছিলেন উনি তাই উপেন রায়কে মেনে নিতে পারছিলেন না বেচারা। উনি কৌশিক সেনগুপ্তর এবং পীযূষ রায়ের বিপদের কথা বুঝতে পেরেছিলেনতাই ওঁদের সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন।”
কথাটা শুনে পীযূষ রায় করুণ দৃষ্টিতে মানস মিত্রর দিকে একবার তাকালেন।
অনিদা বলল, মানস মিত্রর কথামতোলিই জিনিসগুলো কিনে এনে রেখে যেত। যেহেতু ও শুক্রবার করে আসত, তাই বাক্সগুলোও উপেন রায় পেতেন শুক্রবারেইযেহেতু এই বাক্স আসার ব্যাপারটা উপেন রায়ের প্ল্যানের বাইরে ছিল। তাই উনি এতে বেশ জোরে হড়কেছিলেন।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
এবার সেই মৌনব্রত ভাঙল অনিদা। মিঃ ঘোষের উদ্দেশ্যে বলল, আমার কাজ শেষএবার আপনি আপনার কাজ করুন, মিঃ ঘোষ।”
বলাই বাহুল্য, প্রায় বিনা বাক্যব্যয়ে আত্মসমর্পণ করলেন উপেন রায়। অনিদা এবার মিঃ ঘোষকে বলল, আপনার আরও একটা গুরুদায়িত্ব আছে যে।
কী? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ ঘোষ।
সারদা লিপিগুলো অক্ষত অবস্থায় তুলে দিতে হবে সরকারের হাতে।
তাতে হেঁ হেঁ করে হেসে উনি বললেন, সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
আমি তখন বললাম, কিন্তু লিপিটাতে কী আছে সেটাই তো বললে না!
বলব, যেতে যেতে। জিনিসটা গোপনীয়। হাওয়ায় ছড়ালে অসুবিধে আছে। তারপর বলল, আরও একটা কাজ বাকি
কী? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
অনিদা এবার ভানুদার দিকে এগিয়ে গেলএবার গলা নরম করে ওঁকে বলল, আমি জানি, আপনাকে ভয় দেখানো হয়েছিল। আপনি এবার একবার ওপরের চিলেকোঠার ঘর থেকে ঘুরে আসুন। আপনার বাবুকে আমরা এখন আর বিরক্ত করতে চাইছি না।

ফেরার সময় অনিদাকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এবার তোর কোথায় কোথায় অসুবিধে আছে তা বলে ফেল।
বুঝলাম, ওর মেজাজ এখন তোফা। আমি তাই আর সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞাসা করলাম, সেদিন উপেন রায়ের ঘরে তাহলে কে এসেছিল?
কেউ না। ওটা ওঁর বানানো গল্প। কারণ, উনি আমাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন যে ওঁর ঘাড়ের কাছে বিপদ নিঃশ্বাস ফেলছে।
“ওঁর ঘরের ছিটকিনি কে খুলল? আর আলমারিতেই বা কে আঘাত করল?
ওগুলোও ওঁর নিজের কীর্তি। যাতে লোকে বিশ্বাস করে যে পান্ডুলিপিটা কেউ একজন চুরি করতে এসেছিল।
এবার বলো, পান্ডুলিপির বিষয়টা কী
তাতে ও যা শোনাল, তাতে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। আর সেটা হল এই –
আমাদের ভারতবর্ষে বিজ্ঞান নিয়ে যে গবেষণা শুরু হয়েছিল বহুদিন আগে, তা আমরা সবাই জানি। তেমনই এক কাশ্মীরি পণ্ডিত একবার গবেষণা করতে করতে হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন একটা অদ্ভু তথ্য। সেই সময়, মানে প্রায় বারোশো বছর আগে উনি দাবি করেছিলেন যে, ওঁর হাতে এমন একটা সূত্র এসেছে যার সমাধান করলে নাকি মানুষ দেখতে পাবে তার ফেলে আসা সময়কে! জিনিসটা কতটা সত্যি তা সেই সময় জানা যায়নি। তবে উনি এমনটাই দাবি করেছিলেন। অবশ্য তিনি তাঁর জীবনকালে সেকথা প্রমা করতে পারেননি। কিন্তু মনে আশা ছিল, তাঁর তথ্য অনুযায়ী যদি কেউ এগিয়ে চলে তবে সে সেই কাজে সাফল্য পাবেই। আর তাই উনি তাঁর সমস্ত গবেষণার কাজ লিখে গেছিলেন ওই পান্ডুলিপিটাতে স্কুলে ফিজিক্স ক্লাসে লাইট চ্যাপটারে আছে যে, আলোর আগে যদি কেউ যেতে পারে, তাহলে এটা সম্ভব। তবে খাতায় কলমে সেটা সম্ভব হলেও বাস্তবে তা অসম্ভব। কিন্তু সেই পণ্ডিত দাবি করেছিলেন যে, এ-জিনিস সম্ভব। তিনি নাকি গবেষণা করে সেটা জানতে পেরেছিলেন আশা ছিল, অদূর ভবিষ্যতে কেউ হয়তো তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবে। তাই অতদিন আগে উনি লিখে গেছিলেন এই পাণ্ডুলিপি।
জিনিসটা শুনে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি সত্যি, অনিদা?
তাতে ও বলল, বিজ্ঞান তো এখনও সেকথা বলে না। তবে সেই পণ্ডিতের লেখা তথ্য যদি সত্যি বলে প্রমা হয়, তাহলে ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে তাই ওঁর গবেষণা ঠিক না ভুল, সেটার বিচার করবেন বিজ্ঞানীরা। আর তা জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া লিপিটার বিষয়টাই শুধু জানা গেছে। সেটার খুঁটিনাটি বিষয়ে জানতে গেলে সময় লাগবে অনেক। কারণ, সে লিপি আজ আর কেউ জানেন না। তার জন্য বিশেষজ্ঞদের অনেক কাঠখ পোড়াতে হবে।
অনিদার কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবলাম, ফেলে আসা ছেলেবেলাটাকে খুব মিস করিএকবার যদি দেখতে পেতাম!
অনিদা তখন বলল, এবার বুঝতে পারছিস, কী জিনিস হাতে চলে এসেছিল মিঃ রায়ের? উপেন রায় যদি আগে এ-জিনিসের মূল্য বুঝতে পারতেন বা এতে লেখা জিনিসটার ব্যাপারে জানতে পারতেন, তবে উনি কি বসে থাকতেন? বিদেশে বিক্রি করে কোটি টাকা কামাতেন আর দেশের সর্বনাশ করতেন।
আমি ওর কথা শুনে মাথাটা দুবার ডানে বাঁয়ে নাড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ভাগ্যিস!

এর প্রায় সপ্তাহ খানেক পরের কথা।
বিকেলবেলা অনিদার বসার ঘরে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারছি। এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলবিজুদা গিয়ে দরজা খুলতে যে ব্যক্তি লাঠি হাতে ঘরে এসে ঢুকলেন, তাঁকে আমরা রূপেন রায়ের বাড়িতে দেখেছি। ছবিতে। এঁকেই উপেন রায় তাঁর ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে অনিদাকে নমস্কার করে বললেন, আমি রূপেন রায়।
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ

1 comment:

  1. হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কালীঘাট, কলকাতা-২৬...BAH..
    bhalo galpo

    ReplyDelete