বায়োস্কোপ:: সিনেমা: জুটোপিয়া -মহাশ্বেতা রায়


জুটোপিয়া
আলোচনাঃ মহাশ্বেতা রায়

‘জুটোপিয়া’ - সে এক জবরদস্ত বিশাল শহর। শহর না বলে মহানগর বলাই ভালো। কী নেই সেখানে! আকাশছোঁয়া বাড়িঘর, বড়ো বড়ো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, জাদুঘর, স্কুল, কলেজ, সরকারি অফিস, শপিং মল, দারুণ উন্নত সব পরিবহন ব্যবস্থা... বলে শেষ করা যাবে না। তা এই দারুণ গোছানো আধুনিক শহরে কিন্তু একজনও মানুষ থাকে না। তাহলে কারা থাকে? থাকে এই দুনিয়ার সবরকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী - বিশাল বপু হাতি থেকে শুরু করে তোমার বুড়ো আঙুলের থেকেও ছোটো ইঁদুর, সবাই শান্তিপূর্ণভাবে জুটোপিয়াতে বসবাস করে। এইখানে বলে রাখা ভালো, জুটোপিয়ার সমস্ত বাসিন্দা চালচলনে পুরোপুরি অ্যানথ্রোপোমর্ফিক (Anthropomorphic), অর্থাৎ তারা মানুষের মতো (পেছনের) দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করে। আবার তারা আমাদের মতো জামাকাপড়ও পরে! বুঝতেই পারছ, বেজায় সভ্য পশুদের বসবাস এখানে। আরও ভালো কথা হল, এই শহরে মাংসাশী এবং তৃণভোজী প্রাণীরা একফোঁটাও ঝগড়া-বিবাদ না করে কিংবা একে অপরকে ভয় না পেয়ে একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে, মানে আক্ষরিক অর্থে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়।
তা এহেন এক বিরাট শহরে আসার স্বপ্ন কার না থাকে? তেমনি স্বপ্ন দেখেছিল অনেক দূরের ছোট্ট গ্রাম বানিবারোও-এর খুকি খরগোশ জুডি হপস। ছোটোবেলা থেকেই সে মনে মনে চেয়েছিল বড়ো হয়ে জুটোপিয়াতে এসে পুলিশ অফিসারের চাকরি করবে। করবে দুষ্টের দমন, আর শিষ্টের পালন। আর এইভাবে সে তার নিজের চারপাশের জগতটাকে আরও সুন্দর করে তুলবে সবার জন্য।
তরুণী জুডি তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করে, পুলিশ অ্যাকাডেমিতে খুব ভালো ফলাফল করে, বাবা-মাকে টাটা বাই বাই বলে ট্রেনে চেপে এসে হাজির হল জুটোপিয়াতে। তার চাকরি হয়েছে জুটোপিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টেকিন্তু জুডি যেহেতু এক ছোটোখাটো নিরীহ চেহারার খরগোশ, তাই চীফ বোগো, যিনি কিনা এক বিশালাকায় আফ্রিকান মহিষ, তাকে পার্কিং লটের নজরদারিতে বহাল করলেন। ব্যাপারটাতে জুডি খুবই রেগে গেল, কিন্তু তার কিছুই করার ছিল না। বরং প্রথমদিনেই তাকে বোকা বানালো নিক ওয়াইল্ড আর ফিনিক নামের দুটি ধুরন্ধর শেয়াল। জি-পি-ডিতে জুডির প্রথমদিন খুব একটা ভালো কাটল না।
কিন্তু পরের দিনই ঘটনাচক্রে জুডির সামনে এসে পড়ল এক গভীর সমস্যা। চৌদ্দজন মাংসাশী নাগরিক বেশ কিছুদিন ধরে একে একে রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন বয়স্ক, সম্ভ্রান্ত অটার মিস্টার এমিট অটারটন। তাঁর স্ত্রী, মিসেস অটারটন এসে চীফ বোগোর কাছে ভয়ানক কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। জুডি চীফ বোগোকে জানাল, সে এই রহস্যের সমাধান করতে চায়। তার এই সিদ্ধান্তে অ্যাসিস্ট্যান্ট মেয়র ডন বেলওয়েদার, এক মধ্যবয়সিনী ভেড়া তার খুব প্রশংসা করলেন। কিন্তু চীফ বোগো বেশ বিরক্তই হলেন। তিনি জুডিকে জানালেন, সে যদি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে না পারে তাহলে তাকে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
জুডি জানতে পারে, মিস্টার অটারটন যে সময়ে যেখান থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন সেই সময়ে সেই জায়গার আশেপাশে নিক নামের সেই শেয়ালও ছিল। জুডি নিকের সঙ্গে গিয়ে আলাপ জমায় এবং নিজের গোপন পেন-রেকর্ডারের মধ্যে তার সঙ্গে হওয়া সমস্ত কথা রেকর্ড করে নেয়। এদিকে নিক তো নিজেকে বেশি বুদ্ধিমান প্রমাণ করতে গিয়ে জুডির কাছে বলে ফেলেছে সে কীভাবে সরকারি কর ফাঁকি দিয়ে তার ব্যাবসা চালায়! জুডি সেই রেকর্ড করা জবানবন্দী নিককে শুনিয়ে তাকে বলে, যদি নিক তাকে সাহায্য না করে তাহলে সে সেই রেকর্ডিং অফিসে জমা করে দেবে। বলা বাহুল্য, নিক জুডিকে সাহায্য করতে রাজি হয়।
নিকের সাহায্যে নানারকমের রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে দিয়ে জুডি শেষপর্যন্ত মিস্টার অটারটনকে খুঁজে পায় শহর থেকে অনেক দূরে ক্লিফসাইড অ্যাসাইলাম নামের এক পাগলাগারদে। তাঁর সঙ্গে সে খুঁজে পায় বাকি তেরোজন হারিয়ে যাওয়া মাংসাশী নাগরিককেও। জানা যায়, এই চৌদ্দজন বিভিন্ন সময়ে হঠাৎ করে সব শিক্ষা-সহবত ভুলে সহনাগরিকদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিলেন। এও জানা যায় যে মেয়র লিওডোর লায়নহার্ট সিংহমশাই তাদেরকে সেখানে লুকিয়ে রেখেছেন; কেন তাঁরা হঠাৎ করে শিকারির মতো ব্যবহার করছেন সেটা জানার জন্য তিনি একজন বৈজ্ঞানিককে দায়িত্ব দিয়েছেন। সব খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় মেয়র ইস্তফা দিতে বাধ্য হন ডন বেলওয়েদার হন নতুন মেয়র জুডি রহস্যভেদ করে ফেলেছে বলে সবাই ধন্য ধন্য করে।
কিন্তু গল্প কি এখানে শেষ? একেবারেই না। এখান থেকে বরং গল্পের শুরু হল বলা যায়। ছবির বাকিটা অংশ জুড়ে থাকে জুডি আর নিকের বন্ধুত্বের ভাঙাগড়া এবং জুটোপিয়ার শান্তি-বিঘ্নকারী আসল শত্রুকে খুঁজে বের করার গল্প। কিন্তু সে গল্পটা এখনই বলে দিলে দেখার মজাটাই তো চলে যাবে। তাই বাকি গল্পটা কোনদিকে এগোলো, জুডি আর নিক আরও কোন কোন রহস্যের সমাধান করল সেটা জানার জন্য ছবিটাকে দেখে ফেলতে হবে। ডিভিডি জোগাড় করে তো দেখতেই পার, তবে জুটোপিয়া মাঝেমধ্যে বিভিন্ন মুভি চ্যানেলেও দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ইউটিউবে ডিজনির নিজস্ব চ্যানেলেও স্বল্পমূল্যে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু এটুকু জানিয়ে রাখি, গল্পের শেষে নিক জুডির সহকর্মী হিসাবে, আর জুটোপিয়ার প্রথম শেয়াল পুলিশ হিসাবে জি-পি-ডিতে যোগ দেয়। আর তাদের বন্ধুত্ব আরও জোরদার হয়ে ওঠেতারা একসঙ্গে জুটোপিয়ার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব নেয়।
ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিও দ্বারা নির্মিত, ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, ১০৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই অ্যানিমেটেড অ্যাডভেঞ্চার-কমেডি ছবিটি সে বছরের বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবিগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে। এছাড়াও ছবিটি পেয়েছে একাধিক পুরস্কার এবং দুনিয়াজুড়ে সমালোচকদের তারিফ।
তারিফ পাওয়ারই কথা, কারণ এই ছবিতে বিভিন্ন পশুদের চরিত্রগুলির মধ্যে দিয়ে ছবির দুইজন চিত্রনাট্যকার, জ্যারেড বুশ আর ফিল জনস্টন এবং দু’জন পরিচালক, বায়রন হাওয়ার্ড আর রিচ মুর যেন আসলে মানুষের দুনিয়ার কথাই বলতে চেয়েছেন। ঠিক এই মূহুর্তে আমরা এমন একটা জগতে বসবাস করছি যেখানে আমরা অন্য মানুষদের বিচার করি তার খাওয়াদাওয়া, ধর্মাচরণ, তার চেহারা, গায়ের রং - এইসব বাইরের দিকগুলোকে দেখে। এই যেমন ভারতবর্ষেই দেখো - কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে মাংস খায়, কে নিরামিষ খায় - এইসবের ভিত্তিতে মানুষ মানুষকে বিচার করছে। তারপরে ধরো, কেউ যদি মোটা হয় তাহলে তাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে, কারও গায়ের রং কালো হলে তাকে বলা হয় ফরসা না হলে সে সফল হবে না, কেউ যদি আগে কোনও খারাপ কাজ করে থাকে তাহলে ধরে নেওয়া হবে সে সবসময়েই খারাপ কাজ করবে, সে কোনওদিন ভালো কাজ করতেই পারে না। ঠিক সেরকমভাবেই জুডি খরগোশ বলে প্রথমে ধরে নেওয়া হল যে সে জঘন্য অপরাধীদের ধরতে পারবে না, যেন তার চেহারা ছোটোখাটো মানেই তার শক্তি কম। কিন্তু তার যে উপস্থিত বুদ্ধি অনেক বেশি হতে পারে সেটা চীফ বোগোও ভেবে দেখলেন না। কিংবা নিক কখনওই সৎ হতে পারে না, কারণ সে তো শেয়াল আর কে না জানে, যে শেয়ালেরা সবসময়ে ধূর্ত হয়! তাই একইভাবে জুটোপিয়াতে যখন হঠাৎ এক সমস্যার সৃষ্টি হয়, যেখানে কিছু কিছু মাংসাশী নাগরিক হঠাৎ করে অন্যদের আক্রমণ করছেন তখন এক লহমায় পুরো সমাজ মাংসাশী/শিকারি আর তৃণভোজী/শিকার - এই দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। টিউব রেলে যেতে যেতে মা-খরগোশ তাঁর সহযাত্রী বাঘকে দেখে বাচ্চাকে নিজের কাছে টেনে নেন। ওদিকে জুডির অফিসে ঢুকলে প্রথমেই যার মুখোমুখি হতে হয় - মোটাসোটা হাসিখুশি চিতা বেঞ্জামিন ক্লহাউসার, যে কিনা ডিসপ্যাচার হিসাবে তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে খেতে আর মোবাইলে গান শুনতে সবথেকে বেশি ভালোবাসে - সেই বেঞ্জামিনকে দফতর বদল করে বেসমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কারণ? কারণ, পুলিশের সদর দফতরে ঢুকে প্রথমে এক মাংসাশী চিতাকে দেখলে নাকি বেশিরভাগ নাগরিকেরা খুব ভয় পাবে! আধা সত্যি তথ্যের ভিত্তিতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে একে অপরের প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ বোনা হয়। যাদের দেখে নিরীহ মনে হয়, দেখা যায় তাদেরই মাথায় যত রাজ্যের খারাপ বুদ্ধি ঘুরছে। জুটোপিয়া দেখতে দেখতে মনে হয়, এ আর কল্পনা করে বানানো গল্প কোথায় - এইসব ঘটনা তো আমাদের চারপাশে, আমাদের এই উন্নত মানুষের সমাজে রোজ ঘটছে!
অবশ্য ছবির শেষে এহেন পরিস্থিতিকে বদলে দিতে সক্ষম হয় জুডি আর নিক। কারণ, জুডির সেই আত্মবিশ্বাস চিরকালই ছিল – ‘নো ম্যাটার হোয়াট কাইন্ড অফ অ্যানিমাল ইউ আর, চেঞ্জ স্টার্টস উইথ ইয়ু’ - তুমি যেমনই পশু হও না কেন, তোমাকে দিয়েই শুরু হবে পরিবর্তন। তাই জুডি খরগোশ হয়েও গল্পকথায় তার চিরশত্রু শেয়াল নিককে বিশ্বাস করেছিল, ঘোর বিপদেও তার বন্ধুর হাত ছেড়ে দেয়নি। আর গল্পের শেষে তাই জুটোপিয়ার সব পশুরা আবার একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে শুরু করে।
এই ছবিতে বিভিন্ন পশুকে যেসব চরিত্রগুলি দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার সবথেকে মজার লেগেছে কিংবা বলা যেতে পারে খুব ভালো লেগেছে তিনটি চরিত্রায়ণঃ
১) সরকারি অফিসের কর্মী হিসাবে কিছু ‘স্লথ’ - যারা তাদের অতি ধীর নড়াচড়ার মাধ্যমে প্রতিটা কাউন্টারের সামনে নাগরিকদের লম্বা লাইন বানিয়ে রাখতে বাধ্য করে
২) শহরের মাফিয়া নেতা মিস্টার বিগ হিসাবে একটি ছোট্ট ইঁদুর (আর্কটিক শ্রিউ), যে আবার বিখ্যাত ছায়াছবি সিরিজ ‘গডফাদার’-এর মূল অভিনেতা মার্লোন ব্র্যান্ডোর অনুকরণে কথা বলে, আর সেই খুদে চেহারার মিস্টার বিগের রক্ষী হল ইয়াব্বড় সব মেরু ভাল্লুক।
৩)  সুন্দরী, জনপ্রিয় পপ গায়িকা ‘গ্যাজেল’ - তার গলায় দুর্দান্ত গান ‘ট্রাই এভরিথিং’ গেয়েছেন শাকিরা। জুডি আর নিকের জন্য ডাব করেছেন যথাক্রমে জিনিফার গুডউইন আর জেসন বেইটম্যান।
জুডি আর নিকের সঙ্গে ‘নাইট হাউলার্স’-এর রহস্য ভেদ করতে করতে ঘন্টা দেড়েক সময় একেবারে হুশ করে কেটে যায়। তবে ‘জুটোপিয়া’ বার দুয়েক দেখার পরে আমার মাথায় একখানা প্রশ্ন ঢুকেছিল - জুটোপিয়ার তৃণভোজী নাগরিকেরা তো না হয় ঘাসপাতা, ফলমূল খেয়ে থাকে। কিন্তু যারা মাংসাশী/শিকারি নাগরিক, তারা কী খেয়ে থাকে? পুরো ছবি জুড়ে খুব একটা খাওয়াদাওয়া দেখানো হয়নি, তাই সহজে উত্তর মেলা ভারআমি অবশ্য নিজে নিজে সেই রহস্য ভেদ করে ফেলেছি। তুমি একটু এই ছোট্ট রহস্যটার উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? একটা ক্লু দিলাম - নিকের দিকে নজর রেখো

ইউটিউব লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=jWM0ct-OLsM

_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

2 comments:

  1. দুর্দান্ত রিভিউ! এক্ষুনি জুটোপিয়া থেকে ঘুরে আসতে ইচ্ছে করছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ধূপছায়া :) সুযোগ পেলে দেখো ছবিটা, ভালো লাগবে।

      Delete