গল্পের ম্যাজিক:: রহস্যভেদী ভিক্টর - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


রহস্যভেদী ভিক্টর
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

গোয়েন্দা গল্প লেখা খুব কঠিন বলেই আমি মনে করি। একজন গোয়েন্দা চাই, আর চাই একটা রহস্য। যেমন তেমন রহস্য নয়, খুব জটিল রহস্য। আমাদের গোয়েন্দা তো রেডি, কিন্তু মাথা খাটাবার মতো রহস্য কই?
গোয়েন্দার সাথে আগে পরিচয় করিয়ে দিই। গোয়েন্দা হল বিট্টু, যার ভালো নাম ভিক্টর। বড়ো হয়ে একদম ফেলুদার মতো হতে চায়। কোমরে কোল্ট রিভলভার গোঁজা থাকবে। চারমিনারটা অবশ্য খাবে না। রহস্য সমাধানে আটকে গেলে বরং পানপরাগ বা চুইং গাম বা ডেয়ারি মিল্ক খেয়ে নেবে। চারমিনার কখনওই নয়। সাঙ্ঘাতিক সাঙ্ঘাতিক বদমাইশ-খুনেদের সে একেবারে চুপ করিয়ে দেবে। তখন তার নাম হবে রহস্যভেদী ভিক্টরতার এমন কোনও কাজিন নেই যে এই ব্যাপারে কিছুটা হেল্প করবে। একে তো সবকটা বড়ো বড়ো, একটা কিছু বলতে গেলেই হাঁ হাঁ করে উঠবে আমি বিজি, একদম সময় নেই। সারাক্ষণ স্মার্টফোন ঘাঁটলে আর সময় থাকবে কী করে? তোপসে ছাড়াই ওকে এগোতে হবে।
এবার বিট্টুর পরিচয় দেওয়া যাক। মানে, ভিক্টরের। সে ক্লাস ফাইভে নবনালন্দায়। চোখে চশমা। খুব নিরীহ গোছের একটি ছেলে। এইরকম চেহারার লোকের ডিটেকটিভ হবার সুবিধে অনেক। সন্দেহ করতে পারবে না দুষ্টু লোকজন। ওর অনেকদিনের ইচ্ছে, বাড়িতে একটা চুরি-ডাকাতি কিছু হোক। তারপর ও সেটার সমাধানে জান লড়িয়ে দেবে। কিন্তু ভগবান এমন নিষ্ঠুর, ভিক্টরের কথায় মোটেও কান দেন না। কার কথাই তো উনি শোনেন না। প্রতিদিন ভিক্টর প্রাথর্না করে, আর প্রতিদিন তিনি ভিক্টরের মায়ের হাতের ভালো ভালো খাবার খেয়ে দোলনায় হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকেন।

ভিক্টর একটা রহস্য পেল, যদিও খুব সাধারণ। বিস্কুট রহস্য বলা যেতে পারে। রান্নাঘরের কৌটো থেকে বিস্কুট কমে যাওয়াটা রহস্য বৈকি এর সমাধান করা উচিতপ্রথমে তুচ্ছ জিনিস দিয়ে শুরু করতে হবে। প্রথমেই কি বড়ো বড়ো কেস আসে নাকি?
ওদের বাড়িতে পাঁচজন। বাবা, মা, দাদু, ঠাকুমা এবং ভিক্টর নিজে। বিস্কুট চুরি করছে এদের মধ্যে কেউ। মানে, গোয়েন্দা বাদে বাকি চারজন। ও একটা খাতায় লিখল -
১। যে চুরি করছে সে এতদিন চুরি করেনি কেন? সুযোগ পায়নি অথবা স্বভাবের পরিবর্তন?
২। বাইরে থেকে যারা আসে তাদের বিস্কুটের কৌটোয় হাত দেবার সুযোগ খুব কম। একমাত্র বাকি থাকে রুবিদি। কাজ করতে আসে। ওর জন্ম থেকেই আছে।
৩। দাদুর মিষ্টি ভালো লাগে, তবে বিস্কুটের ব্যাপারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ঠাকুমাও তাই। একটু চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে ওদের।
৪। মায়ের সুযোগ সবচেয়ে বেশি এবং বিস্কুট চুরি যাওয়া নিয়ে কোন হেলদোল নেই। প্যাকেট কিনে রাখছে বেশি করে। ফুরিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি কৌটোয় ভরে ফেলছে যাতে চুরি ধরা না পড়ে। আজকাল প্রায়ই মাকে কৌটোয় বিস্কুট ভরতে দেখা যাচ্ছে। তাহলে কি মা-ই? কিন্তু মোটিভ?
এইসব ভাবতে ভাবতে ভিক্টর স্কুলে যায়। কোচিংয়ে যাচ্ছে। আবৃত্তি ক্লাস, আঁকার স্কুল সবই করে চলেছে।
এক রবিবার বেশ সকাল সকাল ভিক্টরের ঘুম ভেঙে গেল। সেইদিনই আসল অপরাধী কে খুঁজে পেয়ে গেল। সকালে ঘুম থেকে ও ছাদে গেলঅপরাধী সেইখানেই ছিল। হাতে করে বিস্কুট এনেছেন। ভেঙে ভেঙে ছাদের মেঝেতে, পাঁচিলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। একঝাঁক ছাতারে, বুলবুলি, ঘুঘু, চড়াই, শালিক সব এসে জড়ো হয়েছে। বিস্কুট খাচ্ছে। আর খুব কথা বলছে কিচিরমিচির করে। ছাদের পাঁচিলের ওপর ছ’খানা কাঠবেড়ালিও এসে পড়েছে। বিস্কুটের লোভে লোভে। ভিক্টরের বাবা পেট ভরে সবাইকে বিস্কুট খাইয়ে পকেটে কয়েকটা বিস্কুট ভরে নিলেন। ও জিজ্ঞাসা করল, এগুলো আবার পকেটে ভরলে কেন?
গুড মর্নিং! আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তায় একটা নেড়ি বসে থাকে, ওর জন্য নিলাম হেসে জবাব দিলেন বাবা।
তুমি কি রোজই ওদের খেতে দাও?
এই কদিন শুরু করেছি। রোজ দেবার চেষ্টা করি। তোর মা জানে
যে লোক সকালে উঠে পাখিদের খাবার খাওয়ায় সে অপরাধী হতেই পারে না। বাবাকে দেখলে ওর সবচেয়ে সুন্দর মনের মানুষ বলে মনে হয়। উফ্‌, প্রথম কেসে ডাহা ফেল! তবু একজন ভালো গোয়েন্দা কখনওই আশা ছাড়ে না। এই কথাটি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়াল এক্সামের পর ডিসেম্বর মাসে সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হল রাজস্থান। প্রতিবছর এই সময় ওরা বেড়াতে বেরোয়। বড়ো একটা ট্যুর করে। ওরা বেরিয়েছে একটা ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে এইবার দাদু-ঠাকুরমা এলেন না। রাজস্থান বেড়ানো নিয়ে ভিক্টর মনে মনে খুব উত্তেজিত। ফেলুদাও তো এই রাজ্যে এসে নিজের ভেলকি দেখিয়ে গেছেন। বলা যায় না, তারও কোন কেস জুটে যেতে পারে।
রাজস্থানের জয়পুর থেকে ট্যুর শুরু। জয়পুরে নেমেই শহরটাকে ভালো লেগে গেল ভিক্টরের। শুরুতে ছিল অম্বর ফোর্ট প্যালেস। কলকাতা থেকে অনেকেই আছেন। বাবার অফিস-কলিগ মিস্টার রায় এবং মিস্টার বসাক ওঁদের ফ্যামিলি নিয়ে এসেছেন। ভিক্টরের বয়সি দুটি ছেলে আছে এঁদের ফ্যামিলিতে। তবে তারা সবসময়ই মোবাইলে ডুবে রয়েছে। কথাবার্তা খুব কমই বলে। মায়ের সঙ্গে বেশ ভাব হয়েছে মিসেস দস্তিদার এবং ওঁর বোন মিসেস পালের সঙ্গেদু’জনারই বয়স পঞ্চাশের ওপরে, ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে। দুজনেরই হাজব্যান্ড খুব কর্মব্যস্ত, তাই দুই বোন নিজেরাই বেড়াতে বেরোপঞ্চাশের বেশি বয়স হলেও খুব সেজেগুজে থাকেন যাতে তিরিশ মনে হয়। আর আছে কলেজে পড়া দিদি শুভ্রা এবং তার বাবা-মা, মিস্টার এবং মিসেস ভট্টাচার্য। মিস্টার রক্ষিত এবং রক্ষিত গিন্নী, এরাই সবচেয়ে কম বয়সি গ্রুপের মধ্যে। আর আছেন মিস্টার এবং মিসেস ব্যানার্জি। এদের একটি খুদে মেয়ে, রুমি। আমাদের ভিক্টরকে পাগল করে তুলেছে বকবক করে। চার বছর বয়স হলে কী হবে, কথার যেন ফুলঝুরি বাবা! নিজের ইস্কুলের গল্প, বন্ধুদের গল্প সব বলা চাই। ওর মায়ের সঙ্গে ভিক্টরের মায়ের বেশ ভাব হয়ে গেছে। দশজন মধ্যবয়স্ক গিন্নির আরেকটি গ্রুপ। এরা সব এক পাড়ায় থাকেন। প্রত্যেকেই ঝাড়া হাত-পা। একসঙ্গে বেড়াতে বেরোন এবং নিজেদের গ্রুপের বাইরে খুব বেশি মেলামেশা করেন না। আর ট্রাভেল এজেন্সির কিছু ছেলে আছে। ট্যুর ম্যানেজার আছেন।
অম্বর ফোর্ট প্যালেস থেকে ওদের বেড়ানো শুরু হয়েছিল। তারপর হাওয়ামহল, জলমহল, যন্তর মন্তর, বিড়লা মন্দির সব দেখতে দেখতে প্রায় সন্ধে। অনেকে কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছেসবাই মিলে একটা বড়ো গাছের নিচে বসেছেন। চা দেওয়া হচ্ছে। চা খেয়ে বাসে চড়বেন সবাই। কেউ হোটেলে নামবেন; কেউ ইচ্ছে করলে মার্কেটে যাবেফেরাটা তাদের নিজেদের দায়িত্বে। শুভ্রাদির মা মিসেস ভট্টাচার্য জয়পুরের একধরনের কাচ বসানো ছোটো ছোটো হাতি কিনেছেন অনেকগুলো। শো-কেসে রাখবেন কিছু, কিছু গিফট করবেন আত্মীয়স্বনদের। শুভ্রাদির বাবা বলছেন, বেকার বেকার কিনলে সব! দাম বেশি নিয়েছে তোমার থেকে। এইসব কাচের কাজ তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে অনেকেই হাতে নিয়ে দেখছেন। হাতিগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে গিয়ে মিসেস ভট্টাচার্য টের পেলেন কুড়িটার জায়গায় সতেরটি হাতি রয়েছে। বাকি তিনটি গায়েব। যারা হাতে নিয়ে দেখছিল তারা সবাই ফেরত দিয়ে দিয়েছে এখন কাউকে বললে বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। দোকানে ছুটলেন আবার। কিন্তু দোকানে ফেলে আসেননিতাছাড়া ওঁর স্পষ্ট মনে আছে, কর্মচারী ছেলেটি গুনে গুনে কুড়িটা হাতিই একটা ছোটো কাপড়ের থলিতে করে ওঁকে দিয়েছিল। ভুল করে কি কেউ নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল? যে রেখেছে সে নিশ্চয় নিজের ভুল বুঝতে পারলে হাতিগুলো আবার ফিরিয়ে দেবে। মিসেস ভট্টাচার্য ব্যাপারটা কাউকে বলতে পারলেন না। একমাত্র বিট্টুর মা সুচরিতার সামনে ব্যাপারটা ঘটেছিল। তাই তিনি ছাড়া আর কেউই টের পেলেন না।
পরের দিন জয়পুর আরেকটু ঘুরে নিয়ে দুপুরে লাঞ্চের পর আজমীঢ় শরিফ। আজমীঢ়ে অবশ্য থাকা হবে না। রাত্রিবাস পুস্করে। দুটো পাশাপাশি শহর। একমাত্র পুস্করেই ব্রহ্মার মন্দির আছে। এই কারণে হিন্দুদের কাছে পরম পবিত্র আর আজমীঢ় মুসলিম এবং হিন্দু উভয়ের কাছেই পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। বিখ্যাত সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগা। হাতি হারানোর পর থেকে মিসেস ভট্টাচার্যের মুখে আনন্দ নেই। এখনও ফেরত পাননি।
পরের দিন ভোরে উঠে পুস্কর মন্দির। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভিক্টররা তৈরি হয়ে নিল। বাস চলেছে ব্রহ্মার মন্দিরের উদ্দেশ্যেরুমি আজকেও গল্প জুড়ে দিয়েছে ভিক্টরের সাথে। ভিক্টর ফটো তুলতে ব্যস্ত।
পুস্করে ব্রহ্মার পুজো দিলেন গ্রুপের প্রত্যেকেই। এখানে বড়ো একটা লেক আছে। পুস্কর লেক। জলেই পুজো দেওয়া হয়। এখানে অনেকে নানারকম পারলৌকিক কাজও করেন। পুজো দেওয়ার পর গ্রুপের প্রত্যেকেই মার্কেটিংয়ে বিজি হয়ে গেল। এখানে মেলার মতো প্রচুর জিনিসের দোকান। এমনকি মেমসাহেবরাও ঘুরে ঘুরে রাজস্থানী ঘাগরা, চোলি, দোপাট্টা, গয়না দেখছে এবং কিনছে। ওরা অনুভব করছে রঙিন এক বর্ণময় জীবন। রুমির ভীষণ পছন্দ হল একজোড়া কাঠপুতলিরাজা আর রানি লাল রঙের বাঁধনির ড্রেস পরা। এইধরনের পুতুল অনেকেই ড্রয়িং রুমে দেওয়ালে সাজিয়ে রাখে। জানালার ধারে ঝুলিয়ে রাখলেও দেখতে ভালো লাগে। রুমির মায়েরও খুব পছন্দ হল। অনেকগুলো কিনে ফেললেন। সুচরিতাও বাদ গেলেন না। গ্রুপের মহিলারা প্রত্যেকেই কিনে ফেললেন ঘর সাজাবার জন্য বা কাউকে গিফট করার জন্য।
তারপর সবাই বাসে ফিরে গেলেন। হোটেলে ফিরে সবাই রেস্ট নিতে গেলেন। দুপুরেই আবার উদয়পুরের দিকে যাত্রা। হারিকেন ট্যুর পুরো। রুমিরা ভিক্টরদের পাশের রুমেই আছে। রুমির কান্নার স্বর শোনা গেল হঠাৎ। সুচরিতা কারণ জানতে গেলেন ভিক্টরও সঙ্গে গেল। মিসেস ব্যানার্জি বললেন, আর বলো না, দিদি। রুমির কাঠপুতলি পাওয়া যাচ্ছে না। সেই লাল রঙের ড্রেস ছিল। ও খুব কাঁদছে
সে কী! দোকানে ফেলে আসোনি তো?
না না, জেম্মা। আমি হাতে ধরেছিলাম শক্ত করে রুমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে।
তুমিই নিশ্চয় কোথাও ফেলে দিয়েছ আমার হাতে দিলে থাকতনিজেই জেদ করে নিলে। এখন দেখো, জেদ করার ফল
সুচরিতা রুমির মাকে বারণ করলেন মেয়েকে বকাবকি করতে। বললেন, হয়তো বাসে আছে
জয়পুর থেকেই ট্রাভেল এজেন্সি বাস রিজার্ভ করেছিল। সেটাতেই পুরো ট্যুর চলবে। দুপুরে লাঞ্চের পর একটু রেস্ট নিয়ে আবার বাসে ওঠা। আবার মালপত্র নিয়ে উঠতে হল। এবার উদয়পুর।
বাসে উঠেই একটা ব্যাপার ঘটল। রুমি উঠেই সারা বাসটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। সিটের নিচগুলো। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। পেছনের দিকে সিটের তলা থেকে কুড়িয়ে পেল প্লাস্টিকের ব্যাগ, তার মধ্যেই সেই হারিয়ে যাওয়া কাঠপুতলি। ঠিক সেই মুহূর্তেই মিসেস দস্তিদার ওর হাত থেকে পলিব্যাগটা ছিনিয়ে নিলেন। উনি আগেই উঠে বসে ছিলেন। বললেন, এটা আমাদের গো। আমি এখানে রেখেছি
রুমি কিছু বলল না। তবে ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। রুমির মা লম্বা একটা জিভ কেটে সরি বললেন। মিসেস পাল বললেন, না না, ছেলেমানুষ। রুমি ইচ্ছে করলে পুতুলদুটো নিতে পারে
মিসেস দস্তিদার এবং মিসেস পাল রুমিদের পেছনের সিটে বসেছেন। ভিক্টর আর সুচরিতা রুমিদের ঠিক পাশের রো-তে আছে। বাবা এখনও বাসে ওঠেননি। জল কিনছেন দোকান থেকে। রুমির বাবাও নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন। বাসে এখনও অনেকেই ওঠেননি। কেউ জল, কেউ পান কিনছেন। কেউ ধূমপান, তো কেউ পায়চারি।
ভিক্টর আর চুপ থাকতে পারল না। বলে ফেলল, আপনাকে তো পুস্করে আমি কোন পুতুল কিনতে দেখিনি
সুচরিতা অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছেলেকে চুপ করাতেও ভুলে গেছেন। মিসেস ব্যানার্জিও হাঁ করে তাকিয়ে আছেন ভিক্টরের মুখের দিকে। রুমির কোন হেলদোল নেই। ও বাইরে তাকিয়ে আপনমনে একটা ছড়ার গান গাইছে। মিসেস দস্তিদার কেমন জবুথবু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
মিসেস পাল বললেন, তুমি কি সবসময়ই আমার ওপর নজর রাখছিলে? বলার সময় তার সুন্দর ভুরু ভীষণভাবে কুঁচকে গেল।
ভিক্টর হেসে ফেলল। বলল, মানছি আপনি পুস্করে পুতুলদুটো কিনেছিলেন। কিন্তু এমন কী হল যে এখনও প্যাকিং করার সময় পেলেন না? হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন! আমরা যারা পুস্কর থেকে শপিং করেছিলাম সকালে, প্রত্যেকেই হোটেলে ফিরে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে রেস্ট নিয়ে আবার বেরিয়েছি এবং প্যাকিং করারও সময় পেয়েছি। আপনার মতো কেউই হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে নেই। প্রত্যেকেই জিনিসগুলো প্যাকিং করেছেন
কী বলতে চাইছ তুমি? আমরা সময় পাইনি প্যাকিং করার কর্কশ গলা মিসেস পালের। তবে ওঁর গলার সুরে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল।
বলতে চাইছি যে কাঠপুতলিদুটো রুমির। ও ভুল করে বাসে ফেলে এসেছিল, এখন আপনারা যেটা নিজের বলে দাবি করছেন সময় কি একেবারেই পাননি? তাহলে পুস্করের মার্কেট থেকে দরদাম করে যে উট আর ঘোড়াগুলো কিনলেন সেগুলো  প্যাকিং করলেন কীভাবে? আর পুতুলগুলো পড়ে রইল!
সামান্য পুতুলের জন্য আমরা এমন কেন করব?
আমি কী জানি! এর আগের দিন মিসেস দস্তিদার শুভ্রাদির মায়ের হাতি দেখতে নিয়ে আর ফেরত দেনি। কেউ খেয়াল করছে কি না দেখে নিয়ে নিজের ব্যাগে পুরে দেন সেটাও আমি দেখেছিলামঘটনাটা মোবাইলে ভিডিও করে রাখি
বাস এবার ছাড়বে ছাড়বে করছে। যারা বাইরে ছিল প্রত্যেকে উঠে পড়ছে দেখে দুই বোন থামলেন। ওদের বলার মতো কিছু আর ছিল না। রুমি তার পুতুল ফিরে পেল। হাতিও ফিরে পেলেন মিসেস ভট্টাচার্য। দস্তিদার আর পাল জানালেন, ভুল করে তারা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলেছিলেন।
সুচরিতা ভিক্টরকে চেপে ধরলেন। কী করে বুঝলি?
বুঝলাম ওঁদের চোখমুখের অবস্থা দেখে। মিথ্যে কথা বলছিলেনএকটু চেপে ধরতেই স্বীকার করে ফেললেন। হাতি চুরির ব্যাপারটা নিয়ে আমি কনফার্ম ছিলাম না অবশ্য। তবে পুস্করে ওঁরা পুতুল কেনেননি। কিনেছিলেন উট আর ঘোড়া। রুমি ওর পুতুলের ব্যাগ সিটের নিচে রেখে ভুলে গিয়েছিল। হয়তো সিটেই রেখেছিল, পরে তলায় পড়ে যায়। কিন্তু দস্তিদার পুতুলের ব্যাগটা নিজের বলে দাবি করাতে সন্দেহ নয়, নিশ্চি হলাম। এটা ক্লেপ্টোম্যানিয়া কি না জানি না। এরকম আগেও করেছেন নিশ্চয়ই, তবে আমার মতো কাউকে পানি কখনও। তাই চুরিটা ধরা পড়েনি। ওঁরও সাহস বেড়ে গিয়েছিল। একটা আনন্দ পেতেন এইধরনের কাজ করার পর
কিন্তু তুই কীভাবে এটা ধরলি?
মা, আমরা যখন বেড়াতে গিয়ে মার্কেটিং করি তখন সেই জিনিসগুলোকে লাগেজের মধ্যে সুন্দর করে গুছিয়ে নিই। কখনও কি হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আবার বেড়াতে বেরোই? তুমিও তো যা কিনেছ সব প্যাকিং করে ফেলেছ
সুচরিতা মাথা নাড়লেন।
রুমির মা মিসেস ব্যানার্জি ভিক্টরকে একটা খুব সুন্দর কাঠের ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। ভিক্টর তার নাম চৈতক রেখেছে।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

2 comments: