ম্যাজিক ল্যাম্প:: অক্টোবর ২০১৮

চতুর্থ বর্ষ।। প্রথম সংখ্যা।। অক্টোবর ২০১৮
শারদীয় সংখ্যা


প্রচ্ছদঃ অরিজিত ঘোষ
_____

সম্পাদকীয়:: শারদীয় ২০১৮


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

এই তো পুজো, পুজোর আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে দিগ্বিদিক
কোথাও একটু বৃষ্টি হল, কোথাও একটু রোদ ঝিলিক।

কেমন আছ সবাই? পুজোতে খুব মজা করবে বলে রেডি তো? কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখবে, কোন জামাটা কবে পরবে সে সবই প্ল্যান করছ, তাই তো? আর মাঝে মাঝেই ভাবছ যে যদি পুজোর দিন বৃষ্টি হয় তাহলে সব সাজগোজ মাটি আর যাদের পুজোর দিনেও কাজের তাড়া তাদেরকেও বলছি, একদম মন খারাপ করবে না
এসে গেছে ম্যাজিক ল্যাম্প শারদ সংখ্যা যা পড়ার জন্য তোমাকে কোত্থাও যেতে হবে না পুজো প্যান্ডেলে, বাড়িতে, অফিসে শুধুমাত্র একটা ক্লিকেই খুলে যাবে ম্যাজিক দুনিয়া
থাকছে দশ দশটা উপন্যাস, ছাব্বিশ খানা বিভিন্ন স্বাদের মন মাতানো গল্প, সুন্দর সুন্দর ছড়া প্রবন্ধ। লিখেছেন বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা দীপ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, সুজন দাশগুপ্ত, সৈকত মুখোপাধ্যায়, অনন্যা দাশ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, চুমকি চট্টোপাধ্যায়, ঋজু গাঙ্গুলী, সমুদ্র বসু কে নেই সেই তালিকায়!
এছাড়া কমিকস, বিজ্ঞানের প্রবন্ধ, মগজাস্ত্র... তোমাদের প্রিয় বিভাগগুলো তো রয়েছেই মুখোমুখি বিভাগে এবারে রয়েছে সেরা দাবাড়ু গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্য শেখর গাঙ্গুলীর ইন্টারভিউ তাহলে আর অপেক্ষা না করে চটপট পড়তে শুরু করে দাও ম্যাজিক ল্যাম্প

এই সংখ্যাটি এডিট করতে, প্রুফ দেখতে সাহায্য করেছেন সহেলী চট্টোপাধ্যায়, সহেলী রায়, রুমেলা দাস, রাজীব কুমার সাহা, তাপস মৌলিক সুন্দর সুন্দর অলংকরণ করেছেন সুমিত রায়, পার্থ মুখার্জী, স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়, রুমেলা দাস, মৈনাক দাশ, অরিজিত ঘোষ, দীপিকা মজুমদার, সুজাতা চ্যাটার্জী, নচিকেতা মাহাত, পুষ্পেন মণ্ডল, সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী প্রমুখ শিল্পীরা ম্যাজিক ল্যাম্প শারদ সংখ্যার নির্মল ঝকঝকে প্রচ্ছদটি এঁকেছেন অরিজিত ঘোষ
ম্যাজিক ল্যাম্পের বিজ্ঞান বিভাগ সম্পাদনা করেছেন শ্রী অমিতাভ প্রামাণিক আর সম্পূর্ণ ম্যাজিক ল্যাম্প সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন শ্রী তাপস মৌলিক
খুব ভালো থেকো বন্ধুরা খুব আনন্দে পুজো কাটুক তোমাদের পুজোর দিনে পারলে যাদের নতুন জামা, ভালো খাবার জোটে না তাদের সাহায্য করার চেষ্টা কোরো সবাই মিলে আনন্দই তো সত্যিকারের আনন্দ
ইতি,
জিনি
_____
ছবিঃ নচিকেতা মাহাত

উপন্যাস:: ভিনু - প্রকল্প ভট্টাচার্য


ভিনু
প্রকল্প ভট্টাচার্য

।। ।।

দূরে কোথাও একটা ঘন্টা বাজছিল। থেমে থেমে, অনিয়মিত। অনেকটা তাদের পাড়ার মল্লিকবাড়িতে আরতির সময় যেমন বাজে।
কী পুজো আজ?
মা বোধহয় রান্নাঘরে ব্যস্ত। দেখতে না পেলেও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এখনো তো বাইরে অন্ধকার, সকাল না রাত্রি? লেপটা আর একটু ভালো করে মুড়ে নেওয়া যাক।
ছোটুর মনে হল কেউ তাকে ডাকছে, ‘উঠে পড়, সময় হয়ে গেল!’ কিসের সময়?
চোখ না খুলেই ছোটু মাকে ডাকল। ‘মা! আমি আর একটু ঘুমোই?’
কয়েকজনের হাসির আওয়াজ। একজন বলল, ‘না বাবা, রাইজিং বেল পড়ে গেল, এখনই উঠতে হবে। ব্রাশ করে হট ড্রিংকস খেতে চলো।’
এরা কারা! কী ভাষায় কথা বলছে! ছোটু অবাক হয়ে চোখ খুলে তাকাল।
আর তখনই তার মনে পড়ল যে সে তার বাড়িতে নেই। গতকাল বিকেলে সে এই হোস্টেলটায় এসেছে, আরও তিনজনের সঙ্গে এই আঠারো নম্বর ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা।
বুক ঠেলে কান্না আর অভিমান বেরিয়ে এল। ইন্দ্রনীলদা, অর্ণব আর শুভায়ু তখনও হাসছে। ছোটু উঠে মশারি তুলে বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
খুব স্নিগ্ধ একটা সকাল। জানুয়ারির শিশিরমাখা ঘাস, আর কত গাছপালা! আবছা আলোয় এত সবুজ দেখে তার চোখ জুড়িয়ে গেল। গতকাল বিকেলের মরা আলোয় সে ভালো করে দেখতে পায়নি। এখন প্রাণভরে দেখতে থাকল।
ছোটুর জন্ম এবং থাকা সমস্তই শহরে হলেও, গ্রামের প্রতি কেমন যেন তার একটা টান আছে। ছুটিছাটায় দেশের বাড়ি গিয়ে দিম্মার কাছে থাকতে সে ভীষণ ভালোবাসে। গাছপালা, পশুপাখী তার প্রাণ। তাই চারধারের সমস্ত কিছু তার খুব চেনা, খুব আপন মনে হল।
ঠিকই বলেছিল মা, ‘দেখবি, ওই পরিবেশটা তোর ভীষণ ভালো লাগবে।’
মাঠে একজন ধুতি পরে ফুল তুলছে। কত রকম ফুল ফুটেছে বাগানটায়! আকাশটা আস্তে আস্তে ফরসা হচ্ছে। চোখের আড়ালে ট্টি-ট্টি করে একটা পাখি ডাকছে, চিলচিলে একটা হাওয়া বইছে, তাতে ধূপের বা ধুনোর মিষ্টি, পবিত্র একটা গন্ধ... সব মিলিয়ে এত সুন্দর পরিবেশে কি বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকা যায়!
ছোটু আবার ঘরে ঢুকে গিয়ে বলল, এই অর্ণব, মশারি কীভাবে ভাঁজ করতে হয় দেখিয়ে দে না রে!
অর্ণব হাত লাগাল।
শুভায়ু গ্লাশ নিয়ে তৈরিহট ড্রিঙ্কসের বেল বাজল, চলো চলো!
কী দেবে রে হট ড্রিঙ্কসে?
দেবে কিছু একটা হট, তাই খাব না হয়। এই শীতে ভালোই লাগবে। চলো তো!
তুই যা, আমি ব্রাশ করেই আসছি।” ব্রাশ, পেস্ট সমস্ত মা গুছিয়েই রেখেছে ছোটুর আলমারির সামনের তাকে।
না না, আমি দাঁড়াচ্ছি, তুমি করে নাও, একসঙ্গে যাব।”
ইন্দ্রনীলদা সিক্সে পড়ে। কেন রে শুভায়ু, ডাইনিং হলটা কীভাবে যেতে হয় ভুলে গেছিস নাকি?
হ্যাঁ, মানে... গতকাল রাতে ঠিক কীভাবে...
আবার একপ্রস্থ হাসাহাসির পালা, এবং ছোটুও যোগ দিল।
হোস্টেলে ক্লা ফাইভের প্রথম ভোরটা ছোটুর মনখারাপ দিয়ে শুরু হলেও, তার মনে হল জায়গাটা বোধহয় খুব খারাপ নয়।

।। ।।

বুঝলি, এর মতো স্কুল হয় না! আরে আমার বসের বড়োছেলে তো এই স্কুলেরই ছাত্র ছিল! এখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে চাকরি করে। আর আমাদের পাড়ার রঞ্জন, সেও তো... ,” বাবা বলেই যাচ্ছিল।
বাবা আগেও তাকে দু-একবার বলেছিল স্কুলটা বদল করাবার কথা, কারণ এই স্কুলটা থেকেই টানা পাঁচ বছর মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে আসছিল। সে না হয় হল, কিন্তু ছোটু কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে তাকে হোস্টেলে পাঠাবার জন্য হঠা সকলে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল কেন!
গুরুজনদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই, আর তাছাড়া বাবাকে সে খুব ভালোবাসে। তাই ছোটু প্রশ্নটা পরে মাকে করেছিল।
“তোর পড়াশোনার দিকে নজর দেওয়া যাচ্ছে না, আর তাছাড়া...
“তা ছাড়া কী মা?”
“তাছাড়া এই পাড়াটাও খুব ভালো নয় -”
এই পাড়াটা ভালো নয় কেন? এই তো দিব্যি বাবুলাল, কালো, পিন্টাদের সঙ্গে সে এতদিন গল্প করছে, কই একটুকুও তো খারাপ মনে হয়নি তাদের!
ছোটু বুঝতে পারে না, আর প্রশ্ন করলেই মা আর বাবা বলে, তুমি তো এখনও ছোটো, তাই বুঝবে না।’
ছোটু এবার ক্লা ফাইভে উঠল। ফা-ই-ভ! এখন সে বড়ো হয়নি!! হতে পারে কখনও!
দেওয়ালে আয়নাটার পাশে দাঁড়িয়ে সে তার মাথা বরাবর দাগ দিয়ে রাখে। প্রতিমাসে মেপে দেখে সে কতটা লম্বা হল। যেদিন ঐ আয়নাটাকে ছাড়িয়ে যাবে, সেদিন নিশ্চয়ই সে বড়ো হবে!
ছোটু শুনেছে স্কুলটা নাকি আশ্রমে। সন্ন্যাসীরা একই সঙ্গে থাকেন, তাঁরা ক্লাও নেন। পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর, অনেকটা তাদের দেশের বাড়ির মতো বোধহয়।
দেশের বাড়িতে তো দিম্মা আছে। আশ্রমে কি কেউ তাকে অত আদর যত্ন করবে? মনে হয় না। ওরা নির্ঘাত নিয়মকানুন বিষয়ে খুব কড়া। তবু সেও না হয় হল, কিন্তু পাড়ার সমস্ত বন্ধুদের না দেখে, মা-কে ছেড়ে সে থাকবে কী করে?
রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে আবার সে জানতে চাইল।
“মা, আমাকে ছেড়ে থাকতে তোমার কষ্ট হবে না?”
“একটু তো হবেই, কিন্তু তোকে যে মানুষ হতে হবে সোনা!”
“মা, আমি যদি খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করি, তোমার সব কথা শুনি, রাস্তায় আর বন্ধুদের সঙ্গে কথা না বলি, তাহলেও কি তুমি আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে?”
মা আর কিছু বলল না। উত্তরের অপেক্ষা করতে করতে ছোটু যখন প্রায় ঘুমিয়ে পড়ছে, তখন তার মনে হল মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
কেঁদো না মা, আমি হোস্টেলেই যাব, মানুষ হব। ঠিক বলছি, দেখো!
মা ছোটুকে জড়িয়ে ধরেছিল “লক্ষ্মীসোনা আমার!

।। ।।

রুটিনে লেখা ‘ক্লিনলিনেস’।
সেটা কী ব্যাপার, ইন্দ্রনীলদা?
ঘর ঝাঁট দিতে হবে। কবে কে দেবে ঠিক করে নেব আমরাই।”
শুভায়ুর আপত্তি আছে। সে কী! ঝাঁটা হাতে ঝাড়ু লাগাতে হবে নাকি!
সবাইকেই সব কাজ করতে হবে। এ ছাড়াও প্রতি মাসে ডিউটি পড়বে ডাইনিং হল, প্রেয়ার হল, অথবা...
ছোটুর বেশ মজা লাগছিল। গতকাল দেখেছে ডাইনিং হল-এ ছাত্ররা পরিবেশন করছে। আর ঐ প্রিয়তোষদা, হিরণ্যাভদা, অশেষদা, ওদের VS না কী যেন বললে?
ওরে বাবা, ওরা হল মেম্বারস অফ দ্য বিদ্যার্থী সংসদ, মানে ভবন লীডারস বলতে পারো এই এক মাস ওদের সবথেকে বেশি ক্ষমতা।”
মানে প্রধানমন্ত্রীর মতো?
প্রায় তাই। আর প্রতি ব্লক-এ ব্লক লিডার আছে, মুখ্যমন্ত্রী! নাও হাত লাগাও, বিছানা পরিষ্কার করো! এই মাসে পিটি হবে না, পরের মাস থেকে এত সময় পাবে নাকি!
ছোটুর খুব আশ্চর্য লাগছে এই নিয়ম মেনে চলা। নির্দিষ্ট সময়ে ঘন্টা বাজছে, সেই দায়িত্বও দুজন ‘টাইম কীপার’-এর। সকালে তারাই এসে রাইজিং বেল বাজাচ্ছিল প্রতিটা ঘরে। খালি খাবারের সমস্ত ঘন্টা ডাইনিং হল-এ বাজে।
এই সব কথাবার্তার মধ্যেই প্রেয়ার বেল পড়ে গেল।
ইন্দ্রনীলদা, ধুতি পরতে হবে নাকি?
আজ নয়, শুধু রবিবার। প্রেয়ার বই আর প্রেয়ার চাদর নিয়ে নাও।”
ছোটুদের গত সন্ধ্যাতেই ‘আমাদের গান’ নামে একটা বই দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে একটা সাদা ধুতি আর চাদর। বই আর চাদর নিয়ে সকলের সঙ্গে প্রেয়ার হল-এ ঢুকল সে।
গত সন্ধ্যায় ভালো করে দেখতে পায়নি, খালি ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’ বলে একটা ধীরগতির লম্বা গান গেয়েছিল সকলে, আর আলো নিভিয়ে ধ্যান করতে বলেছিলেন প্রণব মহারাজ। আজ ভালো করে দেখতে পেল প্রেয়ার হল-এর ভিতরটা। দেওয়ালে অনেক ছবি, সামনে রামকৃষ্ণদেব, স্বামীজী আর সারদামণির ছবি সিংহাসনে রাখা, ফুল দিয়ে সাজানোধূপ জ্বলছে, কী শান্ত, পবিত্র পরিবেশ...
একজন জোরে বলে দিল কোন পৃষ্ঠার গানটা গাওয়া হবে, তারপর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শুরু হল। হারমোনিয়াম, তবলা, খঞ্জনি সবই ছাত্ররাই বাজাচ্ছে, এমনকি প্রেয়ার শুরু হওয়ার আগে অশেষদাকে শাঁখ বাজাতেও দেখেছে সে।
গান শুরু হল, ‘ভব সাগর তারণ কারণ হে...’
ছোটুর চোখদুটো অজান্তেই জলে ভরে এল। এই গানটা মায়ের ভীষণ প্রিয়। মা এখন কী করছে? অন্যদিন তাকে স্কুলে পাঠাবার তোড়জোড় করে, টিফিন বানায়, কিন্তু আজ?
ও মা গো, কেন আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলে!
ছোটু যখন প্রায় কেঁদে ফেলেছে, তখনই তার চোখে পড়ল ঠিক পাশে একটা চশমা পরা ছেলে গান গাইতে গাইতেই প্রেয়ার বই খুলে খুলে বুক ক্রিকেট খেলছে ছোটুর এত হাসি পেয়ে গেল, যে আর মায়ের কথা মনেই পড়ল না!

।। ।।

সত্যি বলতে কি, অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে আসবার আগে পর্যন্ত ছোটুর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা হচ্ছিল না এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার। এখানকার ছাত্ররা যতই মাধ্যমিকে ফার্স্ট হোক আর পাড়ার রঞ্জনদা পড়ে থাকুক, তার আগের স্কুল, নিজের পাড়ার বন্ধুরা কী দোষ করল যে সকলকে ছেড়ে তাকে এখানে থাকতে হবে! সে মায়ের সঙ্গে বড়ো মঠে গেছে, এবং জায়গাটা ভীষণ সুন্দর হলেও, গেরুয়াধারী মহারাজদের দেখে তার মোটেই খুব কাছের মানুষ মনে হয়নি। সবসময় গম্ভীর, যেন বকা দেওয়ার বাহানা খুঁজে যাচ্ছে সকলে! আর কত্তো নিয়মকানুন! ঘাসে বসবেন না, ওধারে দাঁড়াবেন না, এদিকে আসুন, ওদিকে যান, কথা বলবেন না... এভাবে বেশীক্ষণ থাকা যায়!
কিন্তু পরীক্ষা দিতে এসে স্কুলের পরিবেশটা তার ভীষণই ভালো লেগে গেল। কত বড়ো বড়ো মাঠ, কত গাছপালা, আর কত রকমের ফুল! ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকার তো ছড়াছড়ি, নাম না জানা আরও কত সিজন ফ্লাওয়ার! সবুজে সবুজ! আমবাগানে কাঠবিড়ালী ছুটে বেড়াচ্ছে, কী যেন একটা পাখি ডাকছিল, আর তারই মাঝখানে খাওয়ার স্টল, মাইকে ঘোষণা, ত্রিপল ঢাকা বসার ব্যবস্থা, যেন মেলা বসেছিল!
চারদিকে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেদের চেপে ধরে পড়াচ্ছিলেন। এইভাবে শেষ মুহূর্তে পড়ালে কার কিছু মনে থাকে! অনেকে তো আবার প্রাইভেট টিউটরকেও সঙ্গে এনেছিলেন! ছোটুর খুব হাসি পাচ্ছিল তাদের অবস্থা দেখে। একজন ছেলেটাকে হাঁ করিয়ে মুখের ভিতর খাবার ঠেসে দিচ্ছেন, আর একজন তার মাথায় সেভেন-এইটের অঙ্কের ফর্মুলা ঠুসে দিচ্ছেন। মাঝখান থেকে সেই বেচারার অবস্থা খারাপ!
এই ব্যাপারে ছোটু ভীষণ লাকি। তার মা নিয়মিত তাকে পড়িয়েছে, কিন্তু পরীক্ষার দিন কিচ্ছু মুখস্থ করাতে যায়নি। খালি বলল, দ্যাখ কী সুন্দর পরিবেশ! তোর ইচ্ছে করছে না, এমন একটা স্কুলে পড়তে? যদি ইচ্ছে করে, তাহলে কিন্তু আজকের পরীক্ষাটায় তোকে পাশ করতেই হবে! আমি জানি, তুই খুব পারবি। শুধু মন স্থির করে উত্তরগুলো লিখবি, কেমন? কী রে, লিখবি তো?
তা লিখেছিল ছোটু। আর রেজাল্ট দেখে বাবার আনন্দ দেখে কে! এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে এসে হাজির!
দিম্মাকে প্রণাম করতে গেছিল ছোটু। দিম্মা ভীষন খুশি! তার সময়ে দিম্মা ছিল গ্রামের প্রথম বি এ পাশ মহিলা, তাই কেউ পড়াশোনায় সফল হলে দিম্মা খুব আশীর্বাদ করে, বলে ‘পরিবারের নাম রাখবি তুই! অনেক বড়ো হবি!’ তারপর তার জন্যে রসবড়া আর মালপোয়া বানাতে বসল। ছোটোমামা তো আনন্দে তাকে কোলেই তুলে ফেলল, আর বড়োমামা একটা সুন্দর পেন গিফট দিল।
আত্মীয়রা সবাই খুশি, শুধু মা-ই কেমন যেন একটু মুষড়ে পড়েছিল।
মা, আমি পাশ করেছি, তুমি খুশি হওনি, তাই না?
ধুর পাগল! তুই পাশ করেছিস আর আমি খুশি হব না! কী যে বলিস!
তাহলে তুমি এমন করে আছ কেন? আমি চলে যাব বলে কষ্ট হচ্ছে?
মা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তুই অনেক বড়ো হবি রে ছোটু, অনেক অনেক বড়ো! দেখবি, তোর জন্য আমাদের সকলের একদিন কত্তো গর্ব হবে!
ছোটু সেদিন একটা কথা বলতে পারেনি। সকলের কথা সে জানে না, তবে তার মাকে খুশি করবার জন্য সে যে কোনও কাজ করতে রাজি, যে কোনও সময়!

।। ।।

প্রেয়ার হয়ে গেলে স্টাডি হল।
প্রণব মহারাজ এই ভবনের ওয়ার্ডেন, ওনার আরও একটা গালভরা নাম আছে, স্বামী ধর্মেশ্বরানন্দ। সন্ন্যাসীদের ঐ রকম দুটো করে নাম থাকে, ছোটু জানে। স্বামী বিবেকানন্দের যেমন নরেন্দ্রনাথ! কিন্তু এখানে এসে শুনছে মহারাজদেরও নাকি দাদা বলে ডাকা যায়! প্রণবদা! ধুর, কেমন বেমানান!
স্টাডিহল-এ প্রণব মহারাজ সকলকে ডেকে বসতে বললেন। ছোটু তখনই জানল যে এই অভেদানন্দ ভবনে ফাইভ এ সেকশন আর ডি সেকশন, তার সঙ্গে সিক্স বি সেকশনে ছেলেরা আছে। এ আর বি সেকশন হল ইংলিশ মিডিয়াম, আর সি ও ডি হল বাংলা। ছোটুর পাশে বসল কৃষ্ণমোহন খান নামে একটা ছেলে। সেও ছোটুর সঙ্গে এ সেকশনে পড়ে, তবে ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিন্দি
এখানে তোমাদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। স্টাডি হল, প্রেয়ার হল আর ডাইনিং হল-এ কোনকথা বলা চলবে না। সময়মতো স্নান খাওয়া করতে হবে, বাড়িতে যেমন ইচ্ছামতো কাজ করতে পার, এখানে তা হবে না। মানিকদা আর প্রসূদা, এই দুই শিক্ষক পাঁচ নম্বর ব্লকে থাকেন, এনারাও তোমাদের খেয়াল রাখবেন।”
পাশ থেকে কৃষ্ণমোহন ফিসফিস করে বলল, মানিকদা বাংলা পড়ান, প্রসূনদা সায়েন্স আর অংক।”
তাই বুঝি? আচ্ছা, তুই কী করে জানলি রে?
আমার বাবা তো এখানে হিন্দি পড়ান! আমি তো টিচার্স কোয়ার্টার্স-এ থাকি!
তোমরা মা-বাবাকে ছেড়ে এখানে থাকবে, কিন্তু মনে রেখো, এখানে তোমরা এমন কোনও কাজ কখনও করবে না, যা তোমরা বাড়িতে বাবা-মায়ের সামনে করতে পারবে না। কোন অসুবিধা হলে আমাকে, বা আমাদের কোনও একজনকে অবশ্যই জানাবে, বুঝেছ তো?
ছোটু বুঝেছে। ভদ্র ভাষায় এটা একটা জেলখানা। সবই করতে হবে নিয়ম মেনে, আর বাইরে বেরোনো যাবে না।
স্টাডিহলের মিটিং শেষ হলে রুমে ফিরতে ফিরতে ছোটু গুনগুন করে একটা গান গাইছিল। হিরণ্যাভদা হঠা ডেকে বলল, এই যে, শোনো! কী নাম তোমার?
অনিরুদ্ধ,” ছোটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল।
গান গাইছ যে? জানো, এখানে সিনেমার গান গাওয়া বারণ?
কিন্তু এটা তো...
আবার তর্ক করছ? তুমি তো ভারী পাকা ছেলে! ইন্দ্রনীলের ঘরে থাকো, তাই না?
হ-হ্যাঁ...
হুমমম। দাঁড়াও, তোমায় সিধে করবার ব্যবস্থা করছি।” হিরণ্যাভদা চলে গেল।
ছোটুর বুক ঠেলে কান্না এল। কীই বা এমন দোষ করেছে সে, যে মাত্র এক বছরের বড়ো এই দাদা তাকে এইভাবে ধমক দেবে! প্রণব মহারাজকে নালিশ করবে ওর নামে?
সে ঠিক করল নিজেই যাবে প্রণব মহারাজের কাছে।
তোমার নাম তো অনিরুদ্ধ, তাই না? ছোটু অবাক, প্রণব মহারাজ তার নাম মনে রেখেছেন!
তুমি ভুলে গেছ, ইন্টারভ্যু-এর সময় আমিও ছিলাম। তুমিই তো বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি হলে! এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
ননা মহারাজ! বিব্রত ছোটু বলতেই পারল না যে সে কেন এসেছিল মহারাজের ঘরে।
যাও, ব্রেকফাস্ট খেতে যাও, ঘন্টা পড়ে গেছে।”
ব্রেকফাস্টে ছিল পরোটা আর আলুর তরকারি, কিন্তু মন খারাপ থাকার কারণে ছোটু ভালো করে খেতেই পারছিল না।
মায়ের জন্য খুব মন কেমন করছিল আর তখনই খেয়াল করল, সেই প্রেয়ার বই দিয়ে বুক ক্রিকেট খেলা ছেলেটা তার পাশে বসে ধীরেসুস্থে একটা পরোটার মধ্যে আলুর তরকারি ভরে, সেটা রোল করে আরাম করে খাচ্ছে! ছোটু তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে আস্তে করে বলল, কাউকে বলিস না, আমাদের গ্রহে এইভাবেই পরোটা খেতে হয়!
ছোটু তো আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, -তোদের গ্রহ.. মানে!
আমি তো এই গ্রহে থাকি না! আমার গ্রহের নাম চিঙ্গুসিটিংগাদুমক্রসচারবুম!!
গলায় পরোটা আটকে ছোটু বিষম খেয়ে ফেলে আর কি! সব ছেলেরা উঠে যাচ্ছে দেখে তাড়াহুড়োয় শুধু বলতে পারল, তোর নাম কী?
ভিন গ্রহের প্রাণী সংক্ষেপে আমায় ভিনু বলে ডাকতে পারিস! এই বলে থালা ধোয়ার ভিড়ে মিশে গেল ছেলেটা

।। ।।

তার পাশ করবার খবর শুনে বাবা একপ্তা অফিস ছুটি নিয়েছিল! মাথায় হাত বুলিয়ে কত আদর করল! অ্যাডমিশনের দিন বাবাই তাকে সঙ্গে নিয়ে গেল।
অ্যাডমিশন টেস্টের দিন অনেক লোকজন ছিল, তাছাড়া দোকানপাট, টেবিল চেয়ারে আড়াল হয়ে গিয়েছিল আশ্রমের নিজস্ব সৌন্দর্যটা। আজ সে দেখতে পেল কত লম্বা একটা ক্রিসমাস ট্রি রয়েছে গেটের মুখে... স্বামী বিবেকানন্দের একটা সাদা মূর্তি... কী একটা গাছে অদ্ভুত ফুল ফুটে আছে...
ওটা কী গাছ বাবা?
ওটা নাগলিঙ্গম। এই দ্যাখ, ফুলের ভিতর কেমন যেন শিবলিঙ্গ, আর তার ওপর সাপের ফণা, দেখেছিস?
আর নাগকেশর বলেও একটা ফুল আছে, তাই না?
হ্যাঁ, নাগকেশর ঐ লম্বা গাছটা, সাদা লম্বাটে ফুল আর কী মিষ্টি গন্ধ!
বাবা ওটা কী গাছ? কী সুন্দর আকৃতিটা!
আকৃতি কথাটা নতুন শিখেছিস বুঝি? ওটা বকুল গাছ। বকুল ফুল শুকিয়ে গেলে গন্ধ বেরোয়, দেখবি, কেমন মাথা ঝিম ঝিম করা গন্ধ!
বাবা, তুমি কী করে এত গাছ, এত ফুল চেনো?
বাবা হাসল, বড়ো হলে তুইও চিনবি, জানবি অনেক কিছু! এবার একটু পা চালিয়ে চল, সময় হয়ে গেল!
স্কুলের অফিস রুমে এক এক করে ডাকা হচ্ছিল। বাবা বলেছিল, সম্ভবত হেডমাস্টারমশাই স্বামী গিরিজানন্দ, আর দুই-একজন শিক্ষক থাকবেন, ছোটু যেন তাঁদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। কিন্তু ঘরে ঢুকে ছোটু বেশ ঘাবড়ে গেল। কী বিশাল ঘর! একটা লম্বা টেবিলের ধারে অন্তত আটজন বসে আছেন, দু’জন মহারাজ। ওই ফরসা মহারাজই কী হেডমাস্টার গিরিজানন্দ?
কার পায়ে হাত দেবে! ছোটু হাত জোড় করে সকলকে একসঙ্গে প্রণাম জানাল। ওনাদের কয়েকজন তা দেখে হেসে ফেললেন।
তোমার নাম অনিরুদ্ধ?
হ্যাঁ।”
কোন স্কুলে পড়তে তুমি?
হিন্দু স্কুল।”
কিন্তু তুমি তো বাংলা মিডিয়ামে পড়তে, ইংরাজি সাবজেক্ট তো তোমার ছিলই না দেখছি! এখানে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে কী করে?
সর্বনাশ!! ছোটুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! তাহলে কী হবে! বাবা তো বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে, ডেকে আনবে?
মুশকিল আসান করলেন আর এক শিক্ষক। দেখেছেন ওর মার্কশীট! হিন্দু স্কুলে বাংলায় ৮৫% পেয়েছে! এ ঠিক পারবে।”
তাই বলছেন, দীননাথদা?
অবশ্যই। আমি বলছি, মিলিয়ে নেবেন!
তাহলে আর কিছু বলবার নেই। তুমি এখন পাশের ঘরে যাও।”
পাশের ঘরে জামা প্যান্টের মাপ নেওয়া হচ্ছিল, সেখানেই ছোটু জানল যে তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর ৪৭৬৩। ক্লা ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত এই নম্বরটাই তার পরিচিতি হবে।
পরে পাড়ার বন্ধু টিণ্ডা শুনে বলেছিল, বাঃ, এ তো সেই অমিতাভের বিল্লা নাম্বার সাতসো ছিয়াসি-র মতো রে!
বাবা অফিসরুমে সই সাবুদ করে, টাকা জমা দিয়ে এল। তারপর বলল, “চল, তোর জিনিসপত্র কিনতে হবে, তোকে সঙ্গে নিয়েই যাব।”
ওরা একটা লিস্ট দিয়েছিল, সেটা মিলিয়ে মিলিয়ে বাবার সঙ্গে গিয়ে বালিশ, তোক, সতরঞ্চি, সোয়েটার, গরম চাদর, লেপ, মশারি, স্যুটকেস সব কেনা হল। বালতি, মগ, স্টিলের থালা, গেলা...
এগুলোতে নাম লেখাতে হবে, বুঝলি, আর তোর রেজিস্ট্রেশন নাম্বার।”
সে সবও হল। জানুয়ারির আট তারিখে বিকেলবেলা তাকে হোস্টেলে যেতে হবে।
যত দিন এগিয়ে আসতে লাগল, ততই ছোটুর উত্তেজনা কমতে লাগল আর মন খারাপ বাড়তে লাগল। সত্যিই তাকে হোস্টেলে চলে যেতে হবে? ইচ্ছে হলেই কার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না?
মায়ের সঙ্গেও নয়?

।। ।।

স্কুল!!!
কী অদ্ভুত জামা প্যান্ট! শুভায়ু একটু মোটাসোটা, তাকে ওই ফতুয়ার মতো সাদা জামা আর ঢোলা ছাই রঙের প্যান্ট পরা দেখে ছোটু আর অর্ণবের হাসি আর থামেই না! পাশের ঘর থেকে সুদীপ ব্যানার্জীও ছুটে এল দেখতে। শুভায়ু তো লজ্জায় লাল! সেই হাসাহাসি গড়াল স্কুল যাওয়ার রাস্তা অবধি। প্রণবদাও শুনলেন, তারপর হাসি চেপে শুভায়ুকে বললেন, এই ছেলেটা, এর জন্য লজ্জা পাচ্ছিস? তুই তো একবারে গাধা প্লাস ক্যাবলা! তোর নাম হওয়া উচিত গ্যাবলা! সেটা শুনে সকলের আরও একপ্রস্থ হাসি, আর সেই থেকে শুভায়ুর নাম গ্যাবলাই হয়ে গেল।
অ্যাসেম্বলি হল আমবাগানে, ‘ওঁ’ লেখা একটা বাড়ির সামনে। জুনিয়ার সেকশনে ক্লা ফাইভ সিক্স পুরো, আর সেভেনের বেঙ্গলি মিডিয়াম শুধু। একজন সেভেনের দাদা, পরে নাম জেনেছে সুরথদা, সকলকে ‘সাবধান, বিশ্রাম’ করিয়ে ‘সহনাববতু, সহনৌভুনক্তু...’ মন্ত্র পাঠ করাল তারপর হেডস্যার স্বামী গিরিজানন্দ, ইন্দ্রনীলদা বলেছিল যে তাঁর নাম হরি মহারাজ বা হরিদা, ছোট্ট ভাষণ দিলেন।
“জানুয়ারি মাসের তেইশ থেকে ছাব্বিশ তারিখ আমাদের একজিবিশন হবে, তার প্রস্তুতির জন্য তোমাদের এখন কেবল ফার্স্ট আর ফিফথ পিরিয়ড হয়ে ছুটি হয়ে যাবে।”
বাঃ, বেশ মজা তো! ছোটু ভাবল। সে একজিবিশন দেখেছে, অনেক মজাদার প্রোজেক্ট হয়। তাকে যোগ দিতে দেবে?
স্কুল বিল্ডিংটা খুব সুন্দর, ছিমছাম। সামনে প্রচুর ফুলের বাগান! দোতলার কোণের দিকে ছোটুর ক্লা, ফাইভ ‘এ’ সেকশন।
মোট সাঁইত্রিশ জন ছেলে। কয়েকজনের সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছিল, ক্লাসে আরও কয়েকজনের নাম জানা গেল। প্রান্তিক বিশ্বাস, শান্তনু চৌধুরি, আর তাদের ক্লা মনিটার সৌভিক বসু এবং অয়ন মিত্র। তবে সব থেকে মজা লাগল সৌরভ ভট্টাচার্যের কথা শুনে। ক্লাসের মধ্যেও সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিল আর বলছিল, “আমার ধারণা ছিল আমার বাবা-মা যথেষ্ট বিচক্ষণ এবং বোধবুদ্ধিসম্পন্ন। কিন্তু তাঁরাও যে এমন অবিবেচকের মতো সিদ্ধান্ত নেবে, এ আমি কোনওদিন ভাবতেও পারিনি! আমাকে এইভাবে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিয়ে তাঁরা চরম মূর্খামির পরিচয় দিয়েছেন! এ কি একটা থাকার জায়গা হল! একে কি শৃঙখলা বলে! যখন খিদে পাবে, খাবার পাওয়া যাবে না, অথচ যখন একেবারেই খাওয়ার ইচ্ছে নেই, তখন বলবে ‘খ্যাও, খ্যাও, নইল্যা শ্যাস্তি...।” তার মুখ বেঁকিয়ে বড়োদের মতো ভঙ্গিতে বলা এই কথাগুলো শুনে সারা ক্লা তো হেসেই অস্থির!
রুটিন দেওয়া হল, তারপর রোলকল করে ছুটি। স্কুল থেকে ভবন হেঁটে পাঁচ মিনিটের রাস্তা, একই ক্যাম্পাসে আরও দুটো ভবন, অদ্বৈতানন্দ এবং নিরঞ্জনানন্দতাদের মাঝখানে পার্ক, সেখানে রয়েছে স্লিপ, দুটো দোলনা, আর বসবার জন্য সিমেন্টের বেঞ্চ। পার্কে বড়ো বড়ো গাছ, আর চারধার দিয়ে রাস্তা। বাইরে ব্যাটমিন্টন কোর্টও আছে। ছোটু দেখছিল, কত রকমের খেলা হচ্ছে। একটা চপ্পলের মধ্যে হাত গলিয়ে নিচু হয়ে একজন ‘ব্যাট’ করছে, বোলিং হচ্ছে টেনিস বল-এ, আণ্ডার আর্ম। এর নাম নাকি চটি ক্রিকেট! একটু আগে যেখানে অ্যাসেম্বলিতে সকলে ভালো ছেলের মতো হরি মহারাজের ভাষণ শুনছিল, এখন সেখানেই কোর্ট এঁকে ল্যাংচা খেলা হচ্ছে, সেখানে তুমুল উত্তেজনা! কেউ কেউ স্লিপটার চারদিকে ছোটাছুটি করে আর ঢালু দিকটা দিয়ে উঠে স্লিপ-চোর খেলছে, দু’জন তো সিমেন্টের বেঞ্চটার মাঝখানে দুটো ইঁট পেতে টেবল টেনিস খেলছে!
বেশ জায়গাটা। তারই মধ্যে মুচি বসেছে, যাদের জুতো পালিশ বা সেলাই করাতে হবে, নাম লিখিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। টাকা পয়সা হাতে একেবারেই রাখা বারণ, ব্যবহারের প্রয়োজনও নেই।
ছোটুর খেলাধুলোয় খুব আকর্ষণ নেই, বরং তার ঘুরে ঘুরে দেখতে বেশি ভালো লাগছিল। ভবনের পিছনদিকে একটা পুকুর, কী সুন্দর, স্থির জল! তবে লোহার জাল দিয়ে ঘেরা যাতে বেশি সামনে না যাওয়া যায়। এখান থেকে ঢিল ছুঁড়ে ব্যাং বাজি করবে নাকি? ছোটোমামা শিখিয়েছিল। একটা মনোমতো ঢিল খুঁজে নিয়ে পুকুরের দিকে এগোতেই একজন মোটামতো দাদা চেঁচিয়ে বলল, ও ভাই, পুকুরের দিকে যেও না! কোন ভবন তুমি?
উত্তর না দিয়ে ছোটু সরে এল।
একটা ঘন্টা বাজল। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘বাথ বেল!!’ স্নান করতে হবে! তেল মেখে, টাওয়েল পরে বাথরুমের দিকে এগিয়েই সে থমকে গেল। সর্বনাশ, গরম জল তো পাওয়া যাবে না! আর এই ঠান্ডায়...
তখনই তার চোখে পড়ল, ভিনু বেশ স্নান-টান সেরে বাবু হয়ে পাশের ব্লক থেকে আসছে ছোটু অবাক হয়ে বলল, এই ঠান্ডা জলে স্নান করলি কী করে রে!
কেন! খুব সহজ! শাওয়ারটা জোরে খুলে দিবি, তারপর একদৌড়ে তার তলায় ঢুকে যাবি! দেখবি একটুও ঠান্ডা লাগবে না!
বাঃ, ভালো কায়দা তো!
হ্যাঁ রে, আসলে আমরা অনেককিছুকে শুধু শুধুই ভয় পাই।”
ছোটুও সেই কায়দায় স্নান করতে গিয়ে দেখল ঠান্ডা তো লাগছেই না, বরং বেশ আরাম লাগছে ভিনু ছেলেটা খুব মজার তো!
হি-হি-হি! সব বলতে হবে মাকে, সব!

।। ।।

ছোটুর যেদিন হোস্টেলে জয়েন করবার কথা, বেডিং আর স্যুটকেশ গোছানো সমস্তই মা একা করল
এই নেভি ব্লু সোয়েটারটা স্কুলে পরে যাবি। সাদা মোজা, সাদা কেডস পিটি-র জন্য, নীল মোজা কালো শ্যু স্কুলে পরে যাবি। এই সোয়েটার, চাদর আর মাংকি ক্যাপ বিকেল হলেই পরে নিবি, কেমন? ঠাণ্ডা লাগিয়ে ফেলিস না যেন...
সত্যি তো! মা থাকবে না সঙ্গে! ছোটুর আবার একটুতেই ঠাণ্ডা লাগে, গলা ব্যথা হয়, মা তখন গরম জলে ওষুধ গুলে গার্গল করতে দেয়। জ্বরজারি হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তখন মায়ের পাশ ছেড়ে একেবারেই নড়তে ইচ্ছে করে না। এখন হোস্টেলে সুখ করলে কী হবে? শুনেছে একটা হাসপাতাল আছে, কিন্তু হাসপাতাল! ডাক্তাররা যতই ভালো হোক, মহারাজেরা যতই স্নেহময় হোন না কেন, মায়ের সঙ্গে কি কারও কোনও তুলনা চলতে পারে কখনও!!
দুপুরে সমস্ত তার প্রিয় খাবারগুলোই রান্না করেছিল মা। কিন্তু ছোটু খুব উচ্ছ্বাস দেখাতে পারল না। টেবিলে খেতে বসে তাদের দুজনেরই মুখ ভার...
বিকেল নামার আগেই বাবা গাড়ি নিয়ে বেরোলছুটির দিন নয়, জ্যাম হতে পারে রাস্তায়। তবে বাইপাস ধরে তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেছিল তারা।
এই প্রথম ছোটুর মনে হচ্ছিল, যে এত তাড়াতাড়ি গাড়িটা না চললেও তো পারত!
মেন গেটের কাছে এসে দেখল সার সার গাড়ি, সেই অ্যাডমিশন টেস্টের দিনের থেকেও বেশি। দারোয়ান বলে দিল কীভাবে তাদের জুনিয়ার সেকশান যেতে হবে, সেখানে লিস্ট দেখে জানা গেল যে ছোটু অভেদানন্দ ভবনে থাকবে। রুম লিস্টে দেখল তার নাম আঠারো নম্বর ঘরে।
সিঁড়ি... লম্বা বারান্দা... সারি সারি ঘর... কত নতুন মুখ... ছোটু কেমন হকচকিয়েই গেছিল। তার ঘরে ঢুকে আলাপ হল শুভায়ু ভট্টাচার্য, অর্ণব দত্ত, ক্লা সিক্সের ইন্দ্রনীল মজুমদারের সঙ্গে। মায়েরা গল্প জুড়ে দিলেন, ছেলেরা নিজেদের মধ্যে। বেশ একটা আড্ডার পরিবেশ। কে কীভাবে মশারি টাঙাবে, কোন আলমারিটা কার, এইসব ঠিক করে, মা ছোটুর বিছানা পেতে, সমস্ত জিনিসপত্র আলমারিতে গুছিয়ে রাখল। সবই করছিল, কিন্তু কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে... আর ছোটুরও ভালো লাগছিল না কিছু শুনতে...
একটা ঘন্টা বাজল, পুরোনো স্কুলের মতো পেটা ঘন্টা। ওটা নাকি ডাইনিং হল-এ যাওয়ার জন্য। ইন্দ্রনীলদা জানাল, হেভি টিফিন।
নতুন থালা আর গেলাস হাতে লাইন করে যাওয়া হল, দুদিকে বাবা-মায়েরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের ডাইনিং হল-এ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, তাই দরজা আর রাস্তা জুড়ে দেখছেন তাঁরা, যতটা, যতক্ষণ দেখা যায়। অ্যালুমিনিয়ামের পরত মোড়া সার সার টেবিল, এক-একটাতে পাঁচজন পাশাপাশি বসতে পারে। বসবার পর কিছু কাকু এসে তাদের একটা করে আপেল আর একগ্লাস দুধ দিল। বেরিয়ে এসে আর মা-কে খুঁজে পেল না ছোটু, রুমে চলে গেল। প্রেয়ার হল-এ যাওয়া, খণ্ডন ভব বন্ধন গাওয়া, ঘরে ফিরে কিছুক্ষণ কথাবার্তা, রাতে ডিনারে ভাত ডাল তরকারি ডিমের ঝাল, খাওয়া শুরু করবার আগে ‘ওঁ ব্রহ্মার্পণং...’ আর শেষে ‘জয় শ্রী গুরুমহারাজ...’ সবই কেমন আর যেন জমছিল না। তবু, মন খারাপের মধ্যেই ছোটু পোষাক বদলে, মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়েছিল, আর মায়ের মুখটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়েও পড়েছিল।
গুড নাইট, মা!!

।। ।।

ডাইনিং হল-এ আবার সেই মন্ত্র দেওয়া, জয় দেওয়া, এবং কথা না বলে খাওয়া। একটা মাছের কতগুলো ল্যাজ হয়? সকলের প্লেটেই তো প্রায় ল্যাজা দেওয়া হচ্ছিল! যাই হোক, তাড়াতাড়ি খেয়ে, থালা ধুয়ে আবার চেক করাতে হল পুরো ধোওয়া হয়েছে কি না, তারপর সেটা ঝুড়িতে রেখে বেরোনো গেল।
আবার স্কুল, এখন ছিল অঙ্ক ক্লা। তারপর ছুটি। একটু পরে লাইট টিফিনে শনপাপড়ি খেয়ে খেলার মাঠ। ছোটুর খেলাধুলোতে খুব আগ্রহ নেই, কিন্তু সকলকে নাকি মাঠে যেতেই হবে!
ক্রিকেট আর ভলিবল খেলা হচ্ছে। ক্লা অনুযায়ী মাঠ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে, মালিদা ব্যাট বল আর স্টাম্প দিয়েছেন। নিজেদের মধ্যে দল ভাগ করে নিয়ে খেলা শুরু হল। ছোটু পড়ল ব্যাটিং টিমে, তাই মাঠের পাশে বসে গল্প করতে লাগল রাজর্ষি দত্তের সঙ্গে।
দেশের বাড়িতে গেলে ছোটোমামা তাকে মাঠে বেড়াতে নিয়ে যায়। কচুপাতায় জলের ফোঁটা কেমন মুক্তোর দানার মতো দেখায়, আমরুলি পাতা খেতে কেমন টকটক, রাংচিত্তিরের পাতা ভেঙে বাঘের চোখ কীভাবে করতে হয়, এই সমস্তই ছোটোমামাই তো শিখিয়েছে!
রাজর্ষি বল দেখি, ঐটা কী গাছ, ওই যে কাঁটা কাঁটা আর হলুদ ফুল?
রাজর্ষি জানে না, শিয়ালকাঁটা। আর জানবার জন্য বিশেষ উসাহও দেখাল না। বাবা-মায়ের সঙ্গে সে যখন টরেন্টোর টাওয়ারে উঠেছিল, তখন মেঘগুলো কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল এটাই ছিল তার কাছে বেশি আশ্চর্যের।
ছোটু বুঝতে পারল যে ও নিশ্চয়ই কখন বটগাছের ঝুরি ধরে দুলতে দুলতে ঝপাং করে পুকুরে ঝাঁপ দেয়নি। হায় রে, বেচারা!
অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে শীত পড়ল। মাঠ থেকে ফেরার সময় একটা অদ্ভুত, মন কেমন করা গন্ধ... ভবনে ফিরে মুখ হাত ধুয়ে হেভি টিফিন, প্রেয়ার, সন্ধ্যেতে স্টাডি হল শুরু হয়নি বলে ঘরেই কাটিয়ে ডাইনিং হল, তারপর ঘুম।
প্রথম দিনটা কেটে যেতেই, কেমন যেন হুড়ুমুড়িয়ে দিনগুলো কাটতে লাগল। শেষে রবিবার এসেও গেল।
ব্রেকফাস্টে খিচুড়ি, পাঁপরভাজা! লাঞ্চে দই! তারপর দুপুরটা কোনওমতে কাটিয়েই, বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার!
ঘন্টা বাজতে না বাজতেই হুড়ুমুড় করে বাবা-মায়ের ঢুকতে আরম্ভ করলেন। ছোটু একেবারে সেই গেটটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, যার বাইরে যাওয়া নিষেধ। দূর থেকে দেখতে পেল মা আসছে। এই কয়েক দিনেই কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, এতটা জার্নি করে ক্লান্ত, কপালে ঘাম জমে রয়েছে... মা গো!
ছোটু দৌড়ে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরল। আর কি চোখের জল সামলানো যায়!
কত খাবার এনেছে মা, গল্পের বই, জামা কাপড়! কত প্রশ্ন মায়ের! ছোটুরও অনেক কথা জমে ছিল, সব ভালো করে বলতে না বলতেই আবার ঘন্টা। ভিজিটিং আওয়ার শেষ!
অন্ধকার নেমে আসছে। মা-র কাছ থেকে ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে ছোটু কিছুদূর এগিয়ে দিতে এল। আর যাওয়া যাবে না। মা হাত নেড়ে, অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ফেরার পথ ধরল। সেই সময়টাতে ছোটুর মনে হচ্ছিল যেন সব ফেলে ছুট্টে চলে যায় মায়ের সঙ্গে, কিন্তু... তাকে যে বড়ো হতে হবে, অনেক বড়ো! মাকে সে যে কথা দিয়েছে!
ছলোছলো চোখে কতক্ষণ যে সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তার নিজেরই খেয়াল নেই। হঠা টের পেল যে তার কাঁধে কেউ একজন হাত রাখল। চমকে তাকিয়ে দেখল, ভবনের কেয়ারটেকার গৌরদা।
মা বাড়ি ফিরে গেলেন? মন খারাপ লাগছে?
ছোটু জবাব দিল না।
প্রথম প্রথম একটু মন খারাপ হবে। তারপর দেখবে, এই হোস্টেল এত ভালো লেগে যাবে, যে বাড়িতে গিয়ে মন টিঁকবে না! এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছা করবে!
গৌরদার কথা পুরো বিশ্বাস না হলেও, মনখারাপটা ঝেড়ে ফেলে ছোটু ভবনে ফিরছিল
রাস্তায় আবার ভিনুর সঙ্গে দেখা, একাই দাঁড়িয়ে
কী রে, তোর বাবা-মা চলে গেছেন? ছোটু জানতে চাইল
আমার তো বাবা-মা নেই! কেউ আসে না আমায় দেখতে! এই প্রথমবার ভিনুর গলার স্বরটা কেমন ধরা ধরা শোনালো
ছোটুর খুব কষ্ট হল শুনে আহা রে, বাবা না হয় নেই, তা বলে মা-ও নেই! বেচারা ভিনু!
মন খারাপ করিস না রে, চল আমরা ভবনে ফিরে যাই! এই বলে ছোটু ভিনুর হাতটা ধরে আধো অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল

।। ১০ ।।

ভিনুর সঙ্গে ছোটুর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল ভিনু যেমন মজাদার কথা বলে, তেমনি অনেক কিছু জানে যে প্রশ্নগুলো ছোটু অন্যদের করতে পারে না, সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ভিনুর জানা!
ওই ঘরের সামনে দেওয়ালে যে লেখা রয়েছে ‘একং সদ্বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি’, তার মানে কী?
একম সৎ। বিপ্রাঃ বহুধা বদন্তি। এর মানে হল সত্য একটিই, বিপ্র মানে জানিস তো?
ব্রাহ্মণ?
ঠিক বলেছিসসত্য একটিই, তবু ব্রাহ্মণেরা তাকে বহুভাবে ব্যাখ্যা করেন। ঠাকুর যেমন বলেছেন, যত মত তত পথ!
আচ্ছা, আমরা পুজো করবার সময় সংস্কৃতে মন্ত্র বলি কেন? বাংলাতে সহজ করে বললে তো নিজেরাও বুঝতে পারি যে কী বলছি!
ঠিক, কিন্তু সংস্কৃত হল দেবভাষা। কেন জানিস? এই ভাষার ঝংকার আর তাৎপর্য অনেক গম্ভীর!
এইভাবে এসে গেল সেই একজিবিশনের দিনগুলো, আর কেটেও গেল। তারপর হল বিদ্যার্থী ব্রত। প্রদীপ মহারাজ সকলকে একসঙ্গে উচ্চারণ করালেন, ‘...ভবতু শুভায়, ভবতু শিবায়, ভবতু ক্ষেমায়...’ এই কথাগুলোর মানে পরে জেনে নেবে, ছোটু ভাবল।
ক্রমশঃ সে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল নিয়মমাফিক জীবনে। ‘এখানে পরিবেশ ব্রহ্মময়, জীবন ঘন্টাময় আর খাওয়াদাওয়া আলুময়!’ বলত সিনিয়ার দাদারা। ক্লাসে পড়াশোনাও শুরু হয়ে গেল। তারপর এল ফার্স্ট মান্থলি টেস্ট।
পাঁচটা বিষয়ে পরীক্ষা হল, ৪০ নম্বর করে। ছোটু অঙ্কে ভালো, কিন্তু একটা বেখেয়াল ভুল করে ফেলবার জন্য ফুল মার্কস পেল না। ইংরাজিতে এখন সে কাঁচা, আর সেই জন্য বিজ্ঞান, ইতিহাস সব বিষয় ইংরাজিতে পড়ে বুঝতে তার বেশ অসুবিধা হয়। তবু, খুব খারাপ করল না সে। তাদের ক্লাসের অংশুময়, সৌভিক, সোমশুভ্ররা অনেক বেশি নম্বর পেল, আর কী অদ্ভুতভাবে তারপর থেকে ছোটুকে একটু এড়িয়ে চলতে লাগল।
ছোটু বুঝতে পারছিল না। পরীক্ষায় পাঁচ দশ নম্বর বেশি পেলেই কি আর তার সঙ্গে কথা বলা যায় না! কষ্ট হতে লাগল তার খুবই, তবে ভিনু ছাড়া কাকে বলতে পারত না। তার ওপর ইংরাজিতে কাঁচা বলে একদিন ক্লাসে গোষ্ঠদা তার একটা উত্তর পড়ে হেসেছিলেন, সেই থেকে অনেকে তাকে বিদ্রুপ করতেই থাকত।
হ্যাঁ রে অনিরুদ্ধ, লোকেশান মানে লোকসংখ্যা, তাই না?
“তুই লিখলি কী করে বল তো, দ্য পিরামিডস অফ মিশর!!”
আর একবার বল, অর্জুন ওয়াজ ফেমাস ফর হিজ টিপ? হা-হা-হা!!
অথচ ছোটু বাংলায় খুবই ভালো নম্বর পেয়েছে, দীননাথদা আর সন্তোষদা ওকে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু সেটা তো একটামাত্র সাবজেক্টেই!
ছোটু অনেক কিছু পারলেও কোনও কিছুতেই সেরা নয়, এবং এটা সে বেশ বুঝতে পারছিল যে বিভিন্ন স্কুল থেকে সেরা ছাত্রদের বেছে এনে এই স্কুলে কেবল সেরাদেরই পাত্তা দেওয়া হয়। তাই এখানে নাম করতে গেলে তাকে যে কোনও উপায়ে সেরা হতেই হবে!
শর্ট টার্ম ভ্যাকেশানে চারদিনের জন্য বাড়ি গিয়েও সে একটু মনমরা হয়েই ছিল।
কী হয়েছে রে ছোটু? কেউ কিছু বলেছে?
মা, কেন আমি কোনও কিছুতেই সেরা হতে পারি না?
কেন পারবি না! তুই খুব ভালো কবিতা লিখতে পারিস। কেউ লিখুক তো দেখি তোর মতো কবিতা!
কিন্তু মা, এখানে কবিতা কোথায় লিখব?
খোঁজ নিয়ে দ্যাখ, নিশ্চয়ই কোনও ওয়াল ম্যাগাজিন বানানো হয়। তুই লেখা জমা দিবি কিন্তু! আর তুই ভালো অভিনয়ও করিস। কোনও নাটক হয় না তোদের?

।। ১১ ।।

হোস্টেলে ফিরে ছোটুর মাথায় ঢুকল কবিতা লিখতে হবে, নাটক করতে হবে। মানিকদা বললেন, হ্যাঁ, কিশলয় নামে পত্রিকাতে দিস একটা কবিতা, সামনের মাসে বার করব!
উত্তেজনায় ভর করে ছোটু দু’দিন ধরে একটা কবিতা লিখে জমা দিল। তারপর তার রাতে ভালো ঘুম হয় না, কেমন লাগবে তার লেখা সকলের? ম্যাগাজিন বার হওয়ার খবর পেয়ে সে সব ছেড়ে দেখতে গেল, কিন্তু এ কী! তার লেখা তো নেই!
তোর কবিতাটা ভালোই ছিল বুঝলি, তবে এই সংখ্যায় জায়গা পাওয়া গেল না। পরেরটায় নিশ্চয়ই বেরোবে,” মানিকদা বললেন।
ছোটু একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়ল। আর ভালো লাগে না, কিচ্ছু ভালো লাগে না! বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দিল।
তার এই মুষড়ে পড়া ভাব ভিনুর নজর এড়াল না।
কী রে অনিরুদ্ধ, কী ব্যাপার? শরীর খারাপ, নাকি মন ভালো নেই?
হ্যাঁ রে ভিনু, আমি কেমন ছেলে সেটা কি কেবলমাত্র আমার পরীক্ষার ফল দিয়েই বিচার হবে?
না, তা কেন! পরীক্ষা হল একটা মান নির্ধারক পদ্ধতি। তবে তা দিয়ে কি সঠিক বিচার হয়!
একই ছেলে তো একবার ফার্স্টও হতে পারে, একবার ফেলও করতে পারে। তার কারণ কী?
কিছুটা হতে পারে তার মনোযোগের অভাব বা প্রয়োগের ঘাটতি, আবার শারীরিক অসুস্থতা বা অস্বস্তিও হতে পারে এর কারণ।”
আচ্ছা, ভিনু, তুই তো সব কিছু জানিস, তাহলে তুই ফার্স্ট হলি না কেন?
এই প্রশ্নে ভিনু এতটুকু বিরক্ত হল না। হালকা হেসে বলল, সর্বজিত, স্বামীজী কী বলেছেন? Each soul is potentially divine. Education is the manifestation of the perfection already in man!’ এর মানেটা জানিস তো? তোর মধ্যে, সকলের মধ্যেই সেই একই শক্তি আছে। তার বহিঃপ্রকাশই শিক্ষা! তুই যা আছিস, তাই থাকবিকিন্তু পরীক্ষা শেখায় মনঃসংযোগ করতে, স্মৃতিধারণ করতে এবং প্রয়োজনমতো তা প্রয়োগ করতে। এগুলোও তো শিক্ষণীয়, নয় কি? তুই একবার মন দিয়ে পড়াশোনা করে দেখ তো তোর ফল ভালো হয় কি না!
ভিনুর উৎসাহেই হোক বা যে কোনও কারণেই হোক, ঠিক তার পরেই সেকেণ্ড মান্থলি টেস্ট হল, আর ছোটু ক্লাসে টেন্থ হল। মেরিট লিস্টে তার নাম উঠল স্কুলের নোটিশ বোর্ডে।
পরের রবিবার মা-কে না বলা পর্যন্ত তার তর সইছিল না। মা-ও খুব খুশি!
দেখেছিস তো, একটু চেষ্টা করলেই তুই পারবি! অনেক বড়ো হবি তুই, আমি জানি!
মহারাজও তাকে ডেকে একটা চকোলেট খেতে দিলেন। এটা তোমার পুরষ্কার!
আর তার দুই-একদিনের মধ্যেই রাজর্ষি দত্ত এসে তাকে বলল, শোন, আমরা অ্যানুয়াল ড্রামাতে চারমূর্তি নাটক করছি। ঘুটুঘুটানন্দের চ্যালা গজেশ্বর-এর পার্টটা করবি তুই?
এই সুযোগ ছোটু আর ছাড়ে! হোক না কেন ছোটো পার্ট, সে তাতেই ফাটিয়ে দেবে! পাড়ায়, স্কুলে কত নাটক করেছে সে, রজতদার অফিসে ‘মৃগয়া’ নাটকে তার লক্ষ্মণের অভিনয়ের সকলে কত্তো প্রশংসা করেছে!
হ্যাঁ, আমি করব। কোথায় রিহার্সাল? কবে কবে?
সেদিনই ভিনুকে জানাল খবরটাহ্যাঁ রে, তোর কথাই ঠিক হল! বড়ো হতে চাইলে আমাকে কেউ কোনওদিনই আটকাতে পারবে না, দেখিস!!”

।। ১২ ।।

নাটক হল, ভালোই হল। ছেলেরা তাকে কিছুদিন ‘গজেশ্বর’ বলে ডাকাডাকি করল, তারপর আবার ছোটু কেমন যেন একা হয়ে পড়ল।
স্কাউটিং শুরু হল লাইব্রেরিয়ান পঞ্চাননদার তত্ত্বাবধানে। ছোটুর কাছে স্কাউটিং নতুন নয়, হিন্দু স্কুলে শ্রীকান্তদা, সাগরদার কাছে তার হাতেখড়ি হয়েছিল। মহানন্দে সে নাম লেখাল, আর খুব শিগগিরিই পঞ্চাননদার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। ছোটু ভাবল, এই একটা ব্যাপারে অন্ততঃ সে অনেকের থেকে বড়ো হতে পারবে!
কিন্তু ফল হল উলটো। কণাদ মুখার্জী তো একদিন তাকে বলেই ফেলল, হ্যাঁ রে, তুই পড়াশোনা আর খেলাধুলো ছাড়া সমস্ত বিষয়ে এত ভালো কী করে হলি রে?
সত্যিই। শিশু কবি সম্মেলনে তার লেখা কবিতা শুনে প্রধান অতিথি শ্রী সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং প্রশংসা করলেন সেদিন, স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা ফাল্গুনীতেও তার লেখা কবিতা মনোনীত হয়েছে। এসব কি কার চোখেই পড়ে না? ছোটু গুমরে গুমরে বেড়ায়, রবিবারগুলো মায়ের সঙ্গেও ভালো করে কথাবার্তা হয় না। মা তার এই কষ্টটা কিছুতেই বুঝতে পারে না, বোধহয় ভিনু ছাড়া কেউই পারে না! কিন্তু কী আশ্চর্য, ছেলেদের ভিড়ের মধ্যে ভিনুকে সে দেখতেই পায় না, কেমন যেন মিশে থাকে কোথায় যখন কেউ থাকে না কাছাকাছি, তখনই সে এসে হাজির হয় হঠাৎ
না, দু’জন পারল। সৌরভ আর প্রান্তিক। থার্ড মান্থলি টেস্টের আগে সৌরভ ওকে বলল, তুই যে ভাবিস তুই অঙ্কে ভালো, কই, সেটা প্রমাণ করে দেখা! ফুলমার্কস পেয়ে দেখা এইবার! তেতে উঠে খুব মন দিয়ে পরীক্ষা দিল ছোটু, আর সত্যিই চল্লিশে চল্লিশ পেল! সৌরভ তখন বলল, দেখলি তো, একটু ইচ্ছে করলেই তুই পারিস। তাহলে তোর ইচ্ছেটারই অভাব, সে জন্যই তুই পড়াশোনায় ভালো হতে পারছিস না!
ছোটু এই কথাটা ভেবে দেখেনি। ঠিকই তো! এই হল প্রকৃত বন্ধু! প্রান্তিক খুব প্রশংসা করে তার বাংলা লেখার, তার কবিতার শান্তনু চৌধুরীও তার কবিতার খুব ভক্ত কিন্তু ছোটু যখন ওদের জিজ্ঞেস করে ভিনুর কথা, ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে.... ভিনুকে কি আর কেউ চেনেই না নাকি! অদ্ভুত লাগে ছোটুর 
গ্রীষ্মের ছুটি এল। আবার বাড়ি, মনের মতো খাওয়া দাওয়া, মায়ের কোল ঘেঁষে ঘুমোনো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কেমন যেন একঘেয়ে লাগতে আরম্ভ করল।
মা, চলো না আমরা দেশের বাড়ি যাই, দিম্মাকে কতদিন দেখিনি!
আবার সেই পুকুরঘাট, মেঠো রাস্তা, হারিকেনের আলোয় পিকনিক! কী অদ্ভুত, ছোটু এবার দিম্মার বাড়ির সঙ্গে আশ্রমের প্রচুর মিল খুঁজে পাচ্ছিল! সন্ধেবেলা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে তার মনে ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’-র সুর গুনগুনিয়ে উঠছিল।
ছুটি ফুরোলে এবার নতুন ঘরে নতুন রুমমেট হল প্রান্তিক, সাগ্নিক আর রজতদা। সকলেই দেরি করে ঘুম থেকে উঠত, তাই প্রণবদা তাদের রুমের নাম দিলেন ‘ঘুমঘর’।
তারপর এল হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা, এরা বলে রিভিশন টেস্ট। প্রান্তিক একদিন তাকে বলল, সর্বজিত, তুই বাংলায় এত স্ট্রং, কিন্তু হায়েস্ট পাস না কেন জানিস? হাতের লেখার জন্য। একটু ভালো করে লেখ, তুইই হায়েস্ট পাবি!
প্রাণপণ চেষ্টা করল ছোটু, ফলে আশিতে তেষট্টি, হায়েস্ট!
আস্তে আস্তে সৌভিক সোমশুভ্ররা তার ইংরাজি নিয়ে হাসাহাসি বন্ধ করল। গোষ্ঠবিহারীদা একদিন তার একটা বাক্যরচনায় খুশি হয়ে ক্লাসে পড়ে শোনালেন, ডেকে হ্যাণ্ডশেক করলেন। ইতিহাসের রবীনদার ক্লাসে ‘এক মিনিটে কে সবথেকে বেশি গ্রামাটিকালি কারেক্ট সেন্টেনস বলতে পারে’ প্রতিযোগিতাতেও সে ফার্স্ট হল।
ঠিক যখনই ছোটু ভাবছিল যে সে ইংরাজি ভাষাটা আয়ত্ত করতে পারছে, তখনই রিভিশন টেস্টের ইংরাজি খাতা বেরোল। সুশীলদার জায়গায় বিপ্রদাসদা খাতা দেখলেন, আর অনেকে ফেল করে গেল। ছোটু পেল বত্রিশ, টেনেটুনে পাশ!
কিন্তু অদ্ভুতভাবে, ভেঙে না পড়ে ছোটু এর ফলে আর তেতে উঠল। সেই রাতে বিছানায় শুয়ে সে দীননাথদাকে মনে মনে বলল, দীননাথদা, ভর্তি হওয়ার সময় আপনি আমার ওপর ভরসা করেছিলেন, বলেছিলেন যে বাংলাতে সড়োগড়ো হলে ইংরাজি ভাষা আয়ত্ত করা শক্ত নয়। আমি আপনার বিশ্বাস ভঙ্গ করব না, কিছুতেই না!

।। ১৩ ।।


গ্রীষ্মের ছুটির পর থেকেই দিনগুলো যেন খুব তাড়াতাড়ি কাটতে আরম্ভ করল।
নানারকম প্রতিযোগিতা হল। ক্যুইজ, সেই সঙ্গে আবৃত্তি, ডিবেট, গল্প বলা। ছোটু সবকটাতেই নাম দিল উসাহের সঙ্গে, প্রশংসাও পেল
স্কাউটিং-এর একটা ক্যাম্প হল গঙ্গানগরে। স্টেট স্কাউট কম্পিটিশনে ছোটুদের গ্রুপ ‘মেসেজ রিলে’-তে ফার্স্ট হল। এত্ত বড়ো শীল্ডটা নিয়ে বাসে করে হোস্টেলে ফেরা, সে আনন্দই আলাদা! পরদিন স্কুলের আগে অ্যাসেম্বলিতে নতুন হেডমাস্টার হয়ে আসা অশোক মহারাজ তাদের ছ’জনকে স্টেজে ডেকে প্রশংসা করলেন। প্রণব মহারাজও খুব খুশি হয়েছেন বোঝা গেল। নিজের স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পাওয়া, সে কি কম কথা!
একদিন বিকেলে পুকুরপাড়ের গাছ থেকে কামরাঙা পাড়তে গিয়ে ধরা পড়ল ছোটু আর আরও দু’জন। বেজায় বকা দিলেন সন্তোষ সাহা-দা। তোমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, তাই না? প্রচুর পয়সা? তোমাকে সাপে কামড়ালে বাঁচাতে পারবেন? বাবার প্রসঙ্গ টেনে এনে কথাবার্তা শোনা ছোটুর অভ্যাস নেই, তাও আবার গুরুজনদের মুখ থেকে। ভীষণ কান্না পাচ্ছিল তার।
ভবনে মানিকদার হাতেও সে একদিন বিনা দোষে চড় খেল। যত না ব্যথায়, তার থেকে বেশি অপমানে তার চোখে জল এসে গেল। তখন ভিনুই তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করল।
মাথা ঠান্ডা রাখিস অনিরুদ্ধ, সব সময়! না হলে তুই বড়ো হবি কী করে!
মন খারাপ হলেই ভিনু তার মন ভালো করবার কৌশল জানে!
আচ্ছা, বিনা দোষে বা অল্প দোষে শাস্তি দেওয়া কি অন্যায় নয়?
প্রশ্নটা ন্যায় অন্যায়ের নয়। আগে বল, শাস্তি কেন দেওয়া হয়?
যাতে আমরা একই দোষ বার বার না করি
আর গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা নিজেদের করা দোষটা বুঝতে পারি।”
হ্যাঁ, পুকুরপাড়ে কামরাঙা পাড়তে যাওয়াটা দোষ হয়েছে। বিপদ হতে পারত। কিন্ত সন্তোষদা তাই বলে ঐভাবে...
ঐভাবে উনি বকেছেন বলেই তুই আর কক্ষনো ওই কাজটা করবি না! কী, ঠিক তো?
হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু মানিকদা আমাকে বিনা দোষে মারলেন!
তুই নিশ্চয়ই দোষীদের কাছাকাছি ছিলি, সঙ্গদোষও তো দোষ! ভালো ছেলেদের সঙ্গেই থাকিস, বদসঙ্গে পড়িস না, তা হলেই হল!
তারপরে প্রান্তিকের সঙ্গে জুটি বেঁধে ছোটু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে নাম দিতে আরম্ভ করল। তাদের করা নাটক এবং অন্য অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয় হল। ওয়াল ম্যাগাজিন, নিউজবোর্ডেও ছোটু নিয়মিত ভাগ নিত।
ভবন জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রদর্শনীতে সে আর প্রান্তিক মিলে খুব অভিনব একটা প্রোজেক্ট বানাল।
শিক্ষকদের নাটক হল, রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’। চোখ বড়ো বড়ো করে ছোটু দেখল জীবন বিজ্ঞানের প্রশান্ত হাজরাদা আর জহরকালীদা কী অপূর্ব অভিনয় করে গেলেন!
এই সব কিছুর মধ্যেই এসে গেল পুজোর ছুটি। বাবা এসেছিল বাড়ি নিয়ে যেতে, কিছুদিন খুব আনন্দে কাটল। তার যে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে এটা কিন্তু সকলেই টের পাচ্ছিল। অনেক গোছানো, স্বাবলম্বী এবং দায়িত্ববান হয়ে উঠেছে সে! একেই কি বড়ো হওয়া বলে?
আবার স্কুল খুলল, বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। এল, আর হয়েও গেল।
গোটা একটা বছর কেটে গেল! এত তাড়াতাড়ি!

।। ১৪ ।।

ক্রমে এসে গেল ক্লা ফাইভের শেষ দিন। পরীক্ষা দিয়ে তারা বাড়ি চলে যাবে। ক্লা সিক্সের দাদারা তাদের বই খাতা সব তাদের ভায়েদের দিয়ে দিল, আগামী বছর কাজে লাগবে। সেভেন ইংলিশ মিডিয়ামে তারা সিনিয়ার সেকশানে চলে যাবে, মানে আগামী এক বছর আর তাদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা হবে না
সকালে বই খোলা রেখেও পড়ায় মন বসছিল না ছোটুরশেষে বাইরে বেরিয়ে এল।
ভিনুও একা একা ঘুরছিল ছোটুকে দেখে বলল, কী রে, মন খারাপ লাগছে? চল একটু বেড়িয়ে আসি।”
আচ্ছা ভিনু, এই যে ছুটি পড়ে যাচ্ছে, তুই কোথায় যাবি?
ভিনু হাসল অদ্ভুত সেই হাসি তারপর বলল, তোর খুব বাড়ির জন্য মন কেমন করে, তাই না রে?
না রেপ্রথম প্রথম খুব মন কেমন করত। মনে হত, এখানে বন্দি হয়ে আছি, সুযোগ হলেই পালিয়ে  যাব। কিন্তু এখন, কেমন যেন বাড়ি যেতেই ইচ্ছে করছে না!
আমি বোধহয় আমাদের গ্রহে ফিরে যাব এখানে আমার কাজ শেষ,” কেটে কেটে ভিনু এইটুকু বলে  চুপ করে গেল
ছোটুও চুপচাপ হাঁটতে লাগল এই রক্তচন্দন গাছ, ওঁ-বাড়ি, গার্ডেনিং ক্লাসের ছাউনি, বিদ্যালয় বিপণি...
এগুলো সব কি একই রকম থাকবে আগামী বছর! ঐ আমগাছের গায়ে বড়ো জালটার মাকড়সাটা, পাখির বাসাটাতে ছানাগুলো বড়ো হয়ে গেলে কি চিনতে পারবে তাকে আর!
সেই ট্টি-ট্টি পাখিটা আবার ডাকছে। প্রথম দিন সকালেও এই ডাকটা শুনেছিল ছোটু। বছর বছর ছেলেরা আসবে, চলে যাবে, কিন্তু এই গাছপালা, পশুপাখি, এই সুন্দর সকালগুলো এই একই রকম থেকে যাবে। যেন এদের ওপর সময়ের কোন প্রভাবই পড়ে না!
আচ্ছা, এই ভিনুর সঙ্গে ওর গ্রহে চলে গেলে হয় না! পাশে তাকিয়ে দেখল, ভিনু কখন উধাও হয়ে গেছে!
মাঠের একধারে মালীদা শুকনো পাতাগুলো জড়ো করে আগুন লাগিয়েছে। ‘ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ...’ ছোটু এই মন্ত্রের অর্থটা যেন চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পেল।
এই নিশ্চুপ, পাখি ডাকা সোনালী সকালে চারপাশে কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা! ছোটুর মনে হল যেন সমস্ত গাছপালা পশুপাখি একসঙ্গে গুনগুন করে গাইছে ‘নমো নমো প্রভু বাক্যমনাতীত মনবচনৈকাধার, জ্যোতির জ্যোতি উজল হৃদিকন্দর তুমি তমভঞ্জনহার!’
এই পরিবেশ, এই আশ্রম ছেড়ে সে কোথায় যাবে! আর গেলেও, বেশিদিন থাকবে কী করে!
ভবনে ঢোকার মুখেই স্বামীজীর বিশাল ফটো, ছোটুর মনে হল যেন তার দিকেই তাকিয়ে আছেন তিনি, কিছু যেন বলতে চাইছেন।
ফটোর নীচে লেখা ‘Arise, Awake, and stop not till the goal is reached!’ ছোটুর মনে পড়ল প্রণব মহারাজ তাঁকে একটা বই দিয়েছেন ‘আত্মবিকাশ’ নামে, তার মলাটেও এই বাণীটা লেখা আছে।
বইটা তাকে এই ছুটির মধ্যেই পড়ে ফেলতে হবে। কী করে বড়ো হতে হয়, তাকে জানতেই হবে!
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী