গল্পের ম্যাজিক:: বোর্ডিং স্কুলের বিপদ - অনন্যা দাশ


বোর্ডিং স্কুলের বিপদ
অনন্যা দাশ

।। এক।।

বাবা অফিস থেকে ফিরেই মাকে বললেন, “সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে ফর্ম ইত্যাদি যা ভরার ছিল আমি ভরে দিয়েছি, আর শংকর গিয়ে জমা দিয়ে এসেছে কথাও হয়ে গেছে, সামনের বুধবার সোহমকে নিয়ে যেতে হবে ভর্তি হওয়ার জন্যে
মা একটু ভয়ে ভয়ে বললেন, “সত্যিই কী তাহলে ওকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেবে?”
বাবাকে টলানো কঠিন বললেন, “হ্যাঁ, থাকুক কয়েকটা বছর আর নিউ হরাইজেন স্কুল তো আর যে সে বোর্ডিং স্কুল নয় সোহমদের মতন অনেক দুষ্টু আর বেয়াড়া ছেলেকে ওরা ঠিক করে তুলেছে ওইরকম ছেলেদের মানুষ করার জন্যেই ওই স্কুলটা খোলা হয়েছে পরিমলের ছেলেটা কী বদমাশই না ছিল পরিমলের বসের বাড়িতে গিয়ে সোফার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে সেটাকে ভেঙেই ফেলল! পরিমলের তো লজ্জার একশেষ সেদিন আর এখন তাকে দেখো, নিউ হরাইজেনে গিয়ে একেবারে শান্ত-বাধ্য ছেলে হয়ে গেছে! ব্যবহার দেখে বুঝতেই পারবে না যে একই ছেলে!”
মা তাও একবার বলতে চেষ্টা করলেন, “বাচ্চা ছেলে একটু চঞ্চল তো হবেই আমি না হয় বুঝিয়ে বলব আর করবে না দুষ্টুমি
কিন্তু বাবা আর একটাও কথা শুনতে রাজি হলেন না বললেন, “ওকে অনেক সুযোগ দেওয়া হয়েছে আর কিছু শুনতে চাই না আমি!”
পর্দার আড়াল থেকে সব শুনছিল সোহম ওর মনটা দুঃখে ভরে গেল তার মানে পরের সপ্তাহ থেকেই ওকে বোর্ডিং স্কুলে যেতে হবে সোহম অনেকদিন ধরেই এটা সেটা দুষ্টুমি করে এসেছে বকুনি খেয়েছে, মার খেয়েছে বেশিরভাগ সময় মার কাছেই বাবা মাঝে মাঝে বকেন, কিন্তু মারেন না এবারেও হয়তো সোহম দুষ্টুমিটা করে পার পেয়ে যেত, কিন্তু কেলেঙ্কারিটাতে বাবার বস জড়িয়ে পড়লেন বলে মুশকিলটা হয়ে গেল

গত রবিবার দুপুরবেলা মা-বাবা সোহমকে তারামাসির জিম্মায় বাড়িতে রেখে তাপসকাকুর বাড়িতে গিয়েছিলেন সোহমের বোন জিয়া খুব ছোটো। তাই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন তারামাসি টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল আর তখন সোহমকে পায় কে! মনের সুখে টেলিফোনটা নিয়ে উলটোপালটা নম্বর ডায়াল করে লোককে বিরক্ত করতে লাগল একটা সিনেমাতে দেখেছিল রিসিভারটাতে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বললে গলার আসল স্বর বুঝতে পারা যায় না তাই সেই পদ্ধতি ব্যবহার করল তারপর মনের মতন নম্বর ডায়াল করে লোককে ভয় দেখাতে লাগল কিন্তু কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয় কাকতালীয়ভাবে একটা নম্বর বাবার বসের বাড়ির হয়ে গেল! বাবার বস আর ওঁর স্ত্রী তখন বাড়িতে ছিলেন না শুধু বসের বৃদ্ধা মা বাড়িতে ছিলেন তাই তিনিই ফোনটা ধরলেন সোহম তো আর জানত না উনি বাবার বসের মা ওপাশ থেকে মহিলার গলার আওয়াজ শুনে সে গলাটাকে যতটা সম্ভব গম্ভীর করে বলেছিল, “হ্যালো, আমি লালবাজার থানা থেকে বলছি আমরা খবর পেয়েছি যে আপনাদের বাড়িতে কোটি কোটি টাকার চোরাইমাল লুকোনো আছে তাই আমরা এখুনি ওখানে আসছি
এখন সোহম সবাইকেই ফোন করে করে ওই কথাগুলোই বলছিল কিন্তু বেশিরভাগ লোকই ওটা কারও শয়তানি বুঝতে পেরে ফোন রেখে দিচ্ছিল বাবার বসের মা বয়স্ক মানুষ উনি ওর দুষ্টুমি ধরতে না পেরে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ওমা! সে কী গো! কী হবে গো!”
সোহম মনে মনে হাসল পুলিশ বলে কয়ে আসছে, সেটা আবার কেউ বিশ্বাস করেছে! সে এবার বলল, “কী আবার হবে? আপনাদের সবাইকে চোরাইমাল লুকিয়ে রাখার জন্যে জেলে পুরে দেওয়া হবে
ও রে বাবু রে! পুলিশ কী বলছে রে!” বলে মহিলা এবার কেঁদে ফেললেন
এমন কপাল, বাবু মানে বাবার বস ঠিক তখনই বাড়িতে এসে ঢুকেছেন তিনি নিজের মার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে, ‘হ্যালো! হ্যালো! কে বলছেন?’ বলতেই সোহম ফোনটা রেখে দিয়েছিল কিন্তু উনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে চেনা একজনকে ফোন করে ফোনটা কোথা থেকে এসেছে জেনে ফেললেন ব্যস, তারপর আর যায় কোথায়! উনি বাবাকে বললেন সবকিছু, আর সোহমের বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেল

।। দুই।।

নতুন স্কুলে গিয়ে প্রথম কয়েকদিন সোহম খুবই মনমরা হয়ে রইল বাবা, মা, জিয়া, বন্ধুবান্ধব সবাইকে ছেড়ে একা একা থাকতে কার আর ভালো লাগে? তারপর এই স্কুলের নিয়ম খুব কড়া ভোর ছ’টায় উঠে স্কুলের জন্যে তৈরি হয়ে খাবারঘরে যেতে হয় জলখাবারের পর স্কুল দুপুরবেলা খাবার পর আবার স্কুল ছুটির পর বাগানে কাজ করা, খেলার মাঠ পরিষ্কার করা ইত্যাদি বিকেলে একটু কিছুক্ষণ খেলা তারপর আবার পড়াশোনা রাতের খাবার আর ঘুম আবার সকালে উঠে সেই একরকম ছুটির দিনে কারও মা বা বাবা এসে তাদের বাড়ি নিয়ে যায়
প্রথম সপ্তাহতে সোহমের মা-বাবা কেউ এলেন না, ও সবে ঢুকেছে বলে এমনিতে স্কুলটা বেশ বড়োসড়ো স্কুলবাড়ি আলাদা আর ছাত্রদের থাকার জন্যে একটা আলাদা বাড়ি সেই বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বড়ো রান্নাঘর আর ডাইনিং হল যেখানে ছাত্রদের রান্না আর খাওয়াদাওয়া এছাড়া খেলার মাঠ, বাগান ইত্যাদি তো আছেই
দিন দুয়েক পর থেকেই ক্লাসে ওর পাশে যে ছেলেটা বসেছিল সেই সৌরদীপের সঙ্গে সোহমের বেশ ভাব হয়ে গেল দীপও ওর মতন দুষ্টুমি করার জন্যে নিউ হরাইজেন স্কুলে এসেছে বেশ চটপটে চালাকচতুর ছেলে সে ক্লাসের অন্য ছেলেগুলোর মতন গম্ভীর চুপচাপ নয় ওর সঙ্গে ভাব হওয়ার পর সোহমের বন্ধু না থাকার দুঃখটা কিছু কমল দীপের আরেক বন্ধু আকাশের সঙ্গেও ওর বন্ধুত্ব হল দীপ মাংস খেতে খুব ভালোবাসে বুধবার আর রবিবার রাতের খাবারে মাংস হয় সেই দিনগুলোর জন্যে হাঁ করে বসে থাকে সে
দুসপ্তাহ বাদে এক শনিবার মা-বাবার সঙ্গে বাড়ি গেল সোহম ভালোমন্দ খেয়ে জিয়ার সঙ্গে খেলা করে আবার সোমবার সকালে ওকে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে এলেন বাবা
বাড়ি থেকেই জলখাবার খেয়ে এসেছে বলে সোজা ক্লাসে গেল সোহম দীপের জন্যে চকোলেট এনেছে সে কিন্তু দীপ ক্লাসেই এল না সেদিন একে ওকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে দীপের নাকি শরীরটা খারাপ হয়েছে ছাত্রাবাস থেকে কিছুটা দূরে একটা হলুদ রঙের বাড়ি আছে। সেটাই নাকি হাসপাতাল কারও অসুখ করলে যাতে অন্যদের না ধরে যায় তাই তাদের আলাদা করে ওই বাড়িটায় রাখা হয় ওই হাসপাতালেই নাকি আছে দীপ মনটা খারাপ হয়ে গেল সোহমের বেচারা দীপ
কয়েকদিন পর অবশ্য দীপ ফিরে এল ওকে চকোলেট দিতে ও নিল বটে, কিন্তু খুব একটা উৎসাহিত দেখাল না ওকে সেটা দেখে সোহমের কেমন যেন লাগল দীপ তো এই চকোলেট খেতে খুব ভালোবাসে কিন্তু দীপ যেন বদলে গেছে যত দিন যাচ্ছে সোহমের মনে সেই ধারণাই যেন বদ্ধমূল হতে লাগল ওই শরীর খারাপটার পর থেকেই দীপ যেন কেমন একটা হয়ে গেছে ওর ওই প্রাণোচ্ছল দুষ্টু দুষ্টু ভাবটা আর নেই কেমন যেন একটা অন্যরকম চটপটে ভাব তবে সবচেয়ে বেশি বদল হয়েছে ওর খাবারে যে দীপ মাংস খাওয়ার জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে থাকত, সে এখন আর মাংস তেমন খেতেই চায় না! কোনওরকমে শুধু ভাত-ডাল খায়, স্যালাডটা খায়, আর মাছ-মাংস দেখলেই ওয়াক তোলে
ওর কী হয়েছে বল তো?” একদিন আকাশকে জিজ্ঞেস করল সোহম
আকাশও দীপের ভালো বন্ধু সেও বেশ চিন্তিত বলল, “কী জানি ওর ওই শরীর খারাপটা হওয়ার পর থেকেই এইরকমটা হয়েছে লক্ষ করছি এর আগেও তো অনেকের শরীর খারাপ হয়েছিল, আর হলুদ বাড়িতে গিয়ে থেকেছে কিন্তু কারও তো এইরকমটা হয়নি সবাই তো দিব্যি মাংস খায়!”
তারপর সেদিন রাতে একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল প্রতিটা ঘরে চারজন করে শোওয়ার ব্যবস্থা সোহম, দীপ, আকাশ আর রত্নাভ বলে একটা ছেলে এই চারজন একটা ঘরে শোয় সেদিন রাতে কীসের একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল সোহমের চোখ খুলে সে দেখল, দীপ তার খাট থেকে নেমে দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছে ঘরের দরজাটা খুলে দীপ বাইরে চলে গেল কোনও এক অজানা আশঙ্কায় সোহমের বুক কেঁপে উঠল উঠে পড়ল সে আকাশকে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলল আকাশ চোখ খুলে ‘আঁ আঁ’ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সোহম তার মুখে আঙুল চাপা দিয়ে ওকে থামাল রত্নাভ ঘুমোচ্ছে ওকে জাগিয়ে লাভ নেই সে ফিসফিস করে বলল, “উঠে পড়! দীপ কোথায় একটা গেল আমরা ওর পিছু নেব
এবার আকাশ উঠে পড়ল ওরা দু’জনে পা টিপে টিপে বাইরে গিয়ে যে দৃশ্যটা দেখল তাতে ওদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল দীপ বাগানে বসে পড়ে মুখ নিচু করে মাটিতে গজানো ঘাস তুলে খাচ্ছে! সেই দিনটা ছিল বুধবার রাতে খাবারে মাংস হয়েছিল দীপ তাই কিছুই খায়নি এখন সে বাগানে বসে ঘাস খাচ্ছে! সোহম আর আকাশ ঘরে ফিরে এসে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল একটু পরেই দীপ ফিরে এল এসে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল এদিকে সোহম আর আকাশের চোখে তো ঘুম নেই কী যে হচ্ছে! তবে সেইসব ভাবতে ভাবতেই কোনও এক সময় ওরা দু’জনেও ঘুমিয়ে পড়ল
পরদিন ক্লাসে সোহম আকাশকে বলল, “আমার স্থির বিশ্বাস ওই হাসপাতালেই দীপের মাংস না খাওয়ার রহস্যের চাবিকাঠি আছে তুই কখনও গেছিস ওই হাসপাতালে?”
না, আমার তো কখনও তেমন শরীর খারাপ করেনি আর এমনিতেও আমার বেশিদিন হয়নি এখানে তুই আসার কয়েক সপ্তাহ আগেই আমি এসেছি এখানে, আর আমরা আসার কয়েক মাস আগে দীপ
ঠিক আছে, আজকে স্কুলের পর বাগানের আগাছা পরিষ্কার করার কথা আছে আমরা দু’জনে আগাছা সাফ করতে করতে হলুদ বাড়িটার কাছে চলে যাব, আর সুযোগ বুঝে টুক করে ভিতরে ঢুকে দেখব কেমন?”
পারবি না! হাসপাতালের ওই হলুদ বাড়িটার দরজায় সবসময় তালা দেওয়া থাকে প্রিন্সিপাল স্যার বা ডাক্তার আর নার্সরা তালা খুলে ঢোকেন
ও, তাহলে তো মুশকিল! তাও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!”

।। তিন।।

সেদিন বিকেলে আগাছা সাফ করতে করতে দুই বন্ধু হাসপাতালের চারপাশে পাক মেরে দেখল হঠাৎ আকাশ বলল, “ওই যে, ওই যে!”
কী?”
একতলার একটা জানালা খোলা রয়েছে! আমি তোকে কাঁধে করে ওই পর্যন্ত তুলছি তুই যদি ঢুকতে পারিস তাহলে ঢুকে দেখে আয় হয়ে গেলে আবার লাফ মেরে ওই জানালা দিয়েই বেরিয়ে আসবি আমি বাইরে পাহারায় থাকছি দু’জনে ঢোকা যাবে না তাহলে বিপদ হতে পারে
ঠিক আছেবলে সোহম রাজি হয়ে গেল
আকাশের পালোয়ান চেহারা সে অনায়াসেই প্যাংলা সোহমকে ঘাড়ে তুলে জানালা পর্যন্ত পৌঁছে দিল টুক করে জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল সোহম
ওমা, ওটা একটা রান্নাঘর মতন! মনে হয় যাদের অসুখ তাদের জন্যে রান্না হয় এখানে ভাগ্য ভালো কেউ কোথাও নেই সোহম এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ল না সারি সারি ছোটো ছোটো ঘর তাতে প্রতিটাতে একটা করে বিছানা রাখা কয়েকটাতে ছেলেরা শুয়ে রয়েছে কিন্তু কেউ জেগে নেই, সবাই ঘুমোচ্ছে তা ঘুমোতেই পারে শরীর খারাপ হলে তো ঘুম পায় হঠাৎ কাদের কথা শুনতে পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে সোহম একটা আলমারির পিছনে লুকোল
প্রিন্সিপাল স্যার একজন সাদা লম্বা ডাক্তারদের কোট পরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছেন
সব অপারেশান সাকসেসফুল এরা শীঘ্রই ক্লাসে ফিরে যেতে পারবে
ঠিক আছে তবে শোনো ডাক্তার, যে পদ্ধতি প্রমাণ হয়ে গেছে সেটাকে বদলাবার চেষ্টা করতে যেও না
কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন না! নতুন পদ্ধতিতে বাধ্যতা অনেক বেশি আসবে!”
সেটা তুমি বলছ প্রমাণ তো নেই! উলটে খাওয়াদাওয়া নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে শুনছি ওসব বন্ধ কর!”
সোহম শুনে ভাবল, কী বলছে এরা? দীপের কি কোনওরকম অপারেশান হয়েছে নাকি? সেজন্যেই কি ও বেচারা আর মাংস খেতে পারছে না?
হঠাৎ ডাক্তার আর প্রিন্সিপাল স্যার ভোজবাজির মতন মিলিয়ে গেলেন! মানে এই ছিলেন, এই নেই! কথাও আর শোনা গেল না সোহম আস্তে আস্তে আলমারির পিছন থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখল না, কেউ কোথাও নেই তাহলে ওরা দু’জন গেল কোথায়? হঠাৎ ওর খেয়াল হল মাটিতে একটা চৌকো টাইল একটু আলগা মতন তার মানে ওনারা মনে হয় মাটির নিচের কোনও একটা ঘরে গেছেন আবার লুকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সোহম একটু পরেই চৌকো টাইলটা সরে গেল, আর ডাক্তার ও স্যার ওপরে উঠে এলেন
ওরা চলে যেতে সোহম ধীরে ধীরে নিচে যাওয়ার দরজাটা খুলল সামনেই নিচে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি তলা থেকে একটা আবছা আলো আসছে বেশ ভয় ভয় লাগছিল ওর কিন্তু কৌতূহলের জয় হল সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গিয়ে সোহম একটা ঘরে এসে পড়ল ঘরটাতে কেমন একটা যেন গন্ধ মানে, ভালো গন্ধ নয় নানারকম শব্দও হচ্ছে আবছা আলো চোখ সওয়া হয়ে যেতে আলোর সুইচটা দেখতে পেল সোহম ফট করে আলোটা জ্বালতেই যা দেখল তাতে ওর পিলে চমকে গেল ঘরটায় সারি সারি খাঁচা রাখা! কোনও খাঁচায় ইঁদুর, কোনও খাঁচায় খরগোশ, কোনওটায় গিনিপিগ ইত্যাদি সেজন্যেই ঘরটাতে গন্ধ
সোহম ভাবল, ‘ও, তাহলে এখানে গবেষণা হয়!’ কিন্তু কীসের গবেষণা বা কে করে কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠল কেউ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে! তাড়াতাড়ি আবার লুকিয়ে পড়ল সে আবার কে এল রে বাবা? তারা যতক্ষণ না যাবে সে তো আটকে গেল
এই দেখো, কে আবার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে চলে গেছে! ইলেকট্রিসিটির কত বিল দিতে হয় জানো আমাদের? এখানে তো একটা লো পাওয়ারের আলো জ্বলার কথা!”
সোহম লুকোনো জায়গা থেকে শুনে ভাবল, আরে, এটা তো ভাইস প্রিন্সিপালের গলা! আলোটা তো সোহম জ্বালিয়েছিল কিন্তু উনি ভেবেছেন অন্য কেউ জ্বালিয়ে রেখে গেছে! যাক, ভালো
কী আর করা যাবে, স্যার কেউ হয়তো ভুল করে জ্বালিয়ে রেখে গেছে আমি সবাইকে সাবধান করে দেব, এই ভুল যেন আর না হয়
হ্যাঁ, মনে থাকে যেন প্রিন্সিপাল শুনলে সবাইকে ওয়ার্নিং দেবেন!”
না না, স্যার ওই যে বললাম না, আর ভুল হবে না তবে কী, উনিই তো এখুনি বেরিয়ে গেলেন না?”
ঠিক আছে, ঠিক আছে তোমাকে আর স্যারের ভুল ধরতে হবে না নিজের চরকায় তেল দাও নাও, এবার নামগুলো লিখে নাও আর শোনো, আগের মতন ইঁদুরের ব্রেন সেল হলেই ভালো তোমাদের ওসব খরগোশ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে ছেলেটা আর আমিষ খেতে পারছে না! সেরকমটা হলে কিন্তু চলবে না সবার মনে সন্দেহের সৃষ্টি হবে প্রিন্সিপাল স্যার ডক্টর সাহার সঙ্গে কথা বলেছেন এই নিয়ে তুমি ওনার কাছে বিস্তারিত জেনে নিও
কিন্তু খরগোশ আপনাদের পছন্দ হচ্ছে না কেন, স্যার? ওরা তো আরও শান্ত প্রাণী বলেই আমরা চেষ্টা করেছিলাম, স্যার ইঁদুরের মধ্যে কিছু হিংস্র ভাব থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু খরগোশ তো একেবারেই নিরীহ, স্যার তবে ওই খাবারের ব্যাপারটা আমাদেরই ভুল তবে নিরামিষাশী হলে মন্দ নয় কিন্তু আর চাইলে আমরা কোষিকাগুলোকে...”
থাক, আর পাকামো করতে হবে না অনেক হয়েছে
লুকিয়ে থাকা জায়গা থেকে সব শুনে সোহমের তো রক্ত হিম হয়ে গেল এরা বলে কী? ছেলেদের শান্ত করার জন্যে ব্রেনে ইঁদুর, খরগোশের ব্রেন সেল ঢোকাচ্ছে! ইতিমধ্যে ভাইস প্রিন্সিপাল কয়েকটা নাম বলে চলেছেন আর সামনের জন মনে হয় লিখে নিচ্ছিল, “সৌরভ বসু, রুদ্রশক্তি রায়, আকাশনীল ঘোষ, অর্চিত দে আর সোহম মজুমদার
নামগুলো শুনে সোহম চমকে উঠল সোহম মজুমদার তো ওর ভালো নাম, আর আকাশনীল মানে তো আকাশ! এবার কী হবে? কী ভয়ংকর জায়গা রে বাপু! ওদের এখান থেকে পালাতেই হবে কোনওভাবে!
একটু বাদে ওরা আলো নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলেন সোহম তার লুকোনো জায়গা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল আবছা আলোতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল সে তারপর যেই না জানালাটা দিয়ে উঠতে যাবে অমনি পিছন থেকে কে একজন বলে উঠল, “এই তুমি ওখানে কী করছ? যাও, গিয়ে বেডে শুয়ে পড়!”
আর কিছু বলার আগেই সোহম এক লাফে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশ তখনও নিচেই ছিল ওকে দেখে বলল, “কী হল রে তোর? এত দেরি?”
ও আর কিছু বলার আগেই সোহম চিৎকার করে বলল, “আমাকে দেখে ফেলেছে পালা আকাশ, পালা আমাদের ভয়ংকর বিপদ!”
দুই বন্ধুতে প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল কিন্তু কোথায় যাবে? বাইরে যাওয়ার বিশাল গেট তো বন্ধ ওই গেট তো প্রিন্সিপালের অনুমতি ছাড়া খোলে না তাই ওদের বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই এদিকে নিজেদের ঘরেও যেতে পারবে না

তখন অন্ধকার হয়ে গেছে আকাশ বলল, “রান্নাঘরের পিছনে একটা আনাজ রাখার ঘর আছে না? চল, সেখানে গিয়ে বসে থাকি
চল, তাই চল!” বলে ওরা দু’জনে রান্নাঘরের পিছনের আনাজ রাখার ঘরটায় গিয়ে লুকিয়ে বসে রইল
আকাশকে সব বলল সোহম আকাশ বলল, “এবার কী হবে? আজ রাত হয়ে গেছে বলে কোনওরকমে বেঁচে গেছি কাল তো নির্ঘাত ধরা পড়ে যাব!”
ভাব দেখ যদি কিছু উপায় থাকে
আকাশ একটু ভেবে বলল, “একটা উপায় পেয়েছি মনে হয় কাল বাজারের দিন দেবুদা খুব ভোরে গাড়ি নিয়ে বাজারে যায় আমরা যদি সকাল হবার আগেই ওই গাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে পারি তাহলে ওই গাড়ি করে বেরিয়ে যেতে পারব কিন্তু গাড়ির যদি তল্লাশি হয় তাহলে কিছু করার নেই ওই ঝুঁকিটা নিতেই হবে
সারারাত ওরা দুই বন্ধু আনাজঘরে আলু-চাল ইত্যাদির সঙ্গে লুকিয়ে বসে রইল বাইরে যে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি চলছে সেটা ওরা ভালোই বুঝতে পারছিল কিন্তু আশ্চর্য! কেউ আনাজঘরে ওদের খুঁজতে এল না

।। চার।।

সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারল না দুই বন্ধু ভোরের আলো ফোটার আগেই ওরা বেরিয়ে দেবুদার ট্রাকে ঊঠে ত্রিপল গায়ে ঢাকা দিয়ে গুঁড়িসুঁড়ি মেরে বসে রইল
একটু পরেই আবছা সূর্যের আলো ফুটতেই দেবুদা হিন্দি গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে গাড়িতে এসে উঠল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, “আরে শ্যামসুন্দর, গেটটা খোল বাবা! আমি আজ হাটে না গেলে ছেলেপিলেগুলো যে না খেতে পেয়ে মরে যাবে!”
দারোয়ান শ্যামসুন্দর মনে হয় ঘুমোচ্ছিলএকটু পরেই গেটের কাছের ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল
এ কী, চোখ লাল কেন? ঘুমোচ্ছিলে নাকি, শ্যামসুন্দর?”
হ্যাঁ, দাদা আর বলবেন না কাল রাতে ওই দুটো ছেলেকে নিয়ে খুব হাঙ্গামা হল অনেক রাত অবধি খোঁজাখুঁজি চলছিল তাই ঘুমোতে পারিনি ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তোমার গাড়িটাও পুরো খুঁজে দেখতে বলেছে নাহলে ছাড়তে পারব না বড়োকর্তার হুকুম
আরে বাবা, সেটা কি আমি জানি না নাকি! ভালো করে খুঁজে তবে তো গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি সেজন্যেই তো আমারও একটু দেরি হয়ে গেল তোমাকে আর কিছুটি করতে হবে না
ঠিক বলছ তো? নাহলে আমার নোকরি যাবে!”
আরে বাবা, ঠিক নয়তো কি ভুল?”
সোহম আর আকাশ বিশ্বাস করতে পারছিল না ওরা ঠিক শুনছে কি না! দেবুদা মিথ্যে কথাটা বলল কেন?
গেট খোলা হতেই গাড়ি সাঁ সাঁ করে ছুটে একেবারে বাজারের কাছে গিয়ে থামল ওরা দু’জন ভাবল, একটু পরে দেবুদা বাজার করতে চলে গেলে তখন ত্রিপলের তলা থেকে বেরিয়ে আসবে কিন্তু তা আর হল না কারণ, উনি নিজেই সোজা এসে ত্রিপলটা তুলে দিয়ে বললেন, “আরে বাবা, আমি সাতবছর ধরে রোজ এই গাড়ি নিয়ে হাটে আসছি গাড়ির প্রতিটা আনাচকানাচ আমার চেনা আমি খুব ভালোরকম জানতাম তোরা ওই ত্রিপলের তলায় লুকিয়ে আছিস যেমন জানতাম কাল রাতে তোরা ওই আনাজঘরে ঘাপটি মেরে পড়েছিলি তবে কী জানিস, আমি পেটের দায়ে এই কাজটা করি বাড়িতে অনেক লোক, মা-বাবা অসুস্থ যাক, সে কথা থাক যা বলছিলাম আমার চোখ কান সবসময় খোলা ছেলেগুলো কীভাবে ম্যাদা মেরে যাচ্ছিল সেটা কি আমি দেখিনি ভাবছিস! তরতাজা ছেলেগুলো স্কুলে এসে কেমন যেন মিইয়ে পড়ত কী করছিল ওরা আমি জানি না, কিন্তু গন্ডগোলের ব্যাপার কিছু চলছিল ওখানে সেটা ভালোই বুঝতে পারছিলাম তোরা পালাতে পেরেছিস যখন পালা আর কখনও ফিরে যাস না বাপু ওখানে
তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না, দেবুদা! কিন্তু আমরা যা দেখেছি তা পুলিশকে বললে স্কুলে পুলিশ যাবে স্কুল হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে তাহলে তো তোমার চাকরি চলে যাবে!”
আরে দেবুকে অত কাঁচা পেয়েছিস তোরা? আমি গন্ডগোল আন্দাজ করেই তো অন্য চাকরি খুঁজছিলাম একটা পেয়েও গেছি পরশু থেকে শুরু করববলে দেবুদা ইয়াবড়ো একটা দেঁতো হাসি হাসল, “একটু পরেই এই গাড়ি স্কুলের গেটে নামিয়ে দিয়ে আমিও তো পগারপার হয়ে যাব!”

।। পাঁচ।।

নিউ হরাইজেন স্কুলটা বন্ধ হয়ে গেছে প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল, ডাক্তার আর অন্য যারা সব ওই চক্রে জড়িত ছিল তারা সবাই জেলে সেসব জেনেও কিন্তু সোহম এখন আর দুষ্টুমি করে না বলা তো যায় না, বাবা আবার কখন রাগ করে ওকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন আর সেই স্কুলেও যদি নিউ হরাইজেনের মতন ব্যাপার-স্যাপার চলে? না বাবা, ওসব ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই তার চেয়ে লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকা ঢের ভালো।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

3 comments: