গল্পের ম্যাজিক:: জলপাইগুড়ির মাসতুতো ভাই - রাজীবকুমার সাহা


জলপাইগুড়ির মাসতুতো ভাই
রাজীবকুমার সাহা

মুকুন্দপুর আর অরবিন্দনগর, পাশাপাশি দুটো মফস্বল শহর আর সব বিষয়আশয়ে দারুণ সদ্ভাব থাকলেও একমাত্র বছরে একবার হেমন্ত স্মৃতি ক্রিকেট ম্যাচ ঘনিয়ে এলেই একেকজন খুনে ডাকাত হয়ে উঠে দুই এলাকারই সবাই হেমন্ত বাড়ুজ্জে ছিলেন বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর সময়ে অবশ্য গোটা এলাকাটার একটাই নাম ছিল, বকুলতলি দিনে কালে লোক বেড়েছে প্রশাসনিক সুবিধার্থে গোটা বিশাল বকুলতলি দুভাগ করে নিয়ে দুটো আলাদা পৌরসভা গঠন করতে হয়েছে তখনই আলাদা আলাদা এলাকার আলাদা নাম পালটেছে হেমন্ত বাড়ুজ্জে এখনও দুই এলাকাতেই সমান শ্রদ্ধেয় তাই ফি-বছর তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই ক্রিকেট খেলাটা দুই এলাকাবাসীর যৌথ উদ্যোগেই হয়ে আসছে -বছর মুকুন্দপুরের মাঠে হলে ও-বছর অরবিন্দনগরের মাঠে

-বছর খেলা পড়েছে অরবিন্দনগরের মাঠে আর বেশি দেরি নেই, গোটা দিন চারেক মাত্র রয়েছে হাতে একদিন সকাল সকাল সাইকেল চেপে সৌম্য এসে হাজির আমার পড়ার ঘরে ঝড়ের বেগে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এবারে ট্রফি আমাদের, সুমিতদা তুমি দেখে নিও
কী একটা লিখছিলাম আমি তখন কলম মুড়ে রেখে পাশ ফিরে বললাম, “তাই নাকি? এত নিশ্চিত হচ্ছিস কী করে শুনি?”
সৌম্য ডগমগ করে উঠে বলল, “সে আছে একটা অস্ত্র নতুন প্লেয়ার নামাব এবার
মুচকি হেসে বললাম, “সে তোদের এগারোটাই নতুন প্লেয়ার নামালেও সেই ডেনিস দ্য কিলারের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না, গ্যারান্টি ছেলেটা যে কী ধাতুতে গড়া, সত্যিই! কী বোলিং, কী ব্যাটিং সবেতেই মারকুটে -দলে সে ঢোকার পর থেকে তো ট্রফি মুকুন্দপুরেই থেকে যাচ্ছে বছর বছর তোরা আর আনতে পারছিস কই?”
সৌম্য চোখ নাচিয়ে বলল, “আনব, আনব সবুর কর একটু
বললাম, “হ্যাঁ রে, জানুয়ারির তো শেষ পড়ে গেল আর কদিন আছে পরীক্ষার, হ্যাঁ? এইচএসের রেজাল্টটার ওপর কী কী নির্ভর করছে, বুঝিস?”
সৌম্য মুখ বেঁকিয়ে বলতে বলতে বেরিয়ে গেল, “ওই এক পরীক্ষা পরীক্ষা করেই তো কাটালে জীবনটা খেলার মাঠ কী জিনিস, বুঝেছ কখনও?”
মুখের ওপর সত্যিটা শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম জানালার শিক ধরে উঁকি মেরে দেখলাম, সৌম্য সাইকেলের স্ট্যান্ড গোটাচ্ছে দোতলা থেকে হেঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “তা তোর নতুন প্লেয়ার থাকে কই? নাম কী?”
সৌম্য সিটে বসে ডানদিকের উঁচিয়ে থাকা প্যাডেলটায় পা রেখে মুচকি হেসে বলল, “আমার মাসতুতো ভাই জলপাইগুড়ি থাকে আর নাম হচ্ছে শ্রীমান বিচ্ছু
মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সৌম্য বেরিয়ে গেল গেট পেরিয়ে

সত্যি, ওই ডেনিসটা যে কী ছেলে একটা! বাপ রে! যেমন তাগড়াই চেহারা, তেমনিই স্বভাব তিনবছর আগে মুকুন্দপুরে বদলি হয়ে এসেছে ওর বাবা সেই থেকে মুকুন্দপুর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে খেলে কী ক্রিকেট, কী ফুটবল, যেটাই খেলতে নামুক মাঠে, ধারে কাছে কেউ ঘেঁষে না ওর ফুটবল খেলতে নেমে ডেনিসের স্টিলের চেয়েও শক্ত কনুইয়ের গুঁতো আর রামলাথি খেয়ে উঠে আর মাঠের ধার ঘেঁষেনি এমন ছেলে অনেক আছে মুকুন্দপুরে ও খেলতে নামলেই মনে হয় বুনো মোষ একটা ছেড়ে দিয়েছে কে যেন মাঠে আর গত তিনবছর ধরে লক্ষ করছি, ক্রিকেট ম্যাচের মাঠে আমাদের অরবিন্দনগরের ছেলেপিলেদের ওপরই ওর আক্রোশটা যেন বেশি গতবছর আমাদের তিনটে বাড়ি পরের রাজেন তো ব্যাটিং করতে নেমে শেষে পাঁজাকোলায় চড়ে মাঠ ছেড়েছিল পাঁজরে বল লেগে ওর অপরাধ, হাফ সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় ছিল সে আর আমাদের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন মুকুন্দপুর স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন ডেনিসের হাতে বল তুলে দিতেই রাজেনের পাঁজরের হাড়ে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল সে তারপর সেকেন্ড ইনিংসে ব্যাট হাতে পেয়ে সে কী মার, সে কী মার! অরবিন্দনগর একাদশের বল পিটিয়ে ছাতু করে দিয়ে ট্রফিটা কাঁধে তুলে নিজেদের ক্লাবের রাস্তা ধরেছিল শেষে মুকুন্দপুরে ঢুকেই দু-চারটে অঘটন ঘটিয়ে ফেলতেই নাম পড়ে গিয়েছিল ডেনিস-দ্য কিলার
ডেনিসের আসল নাম অবশ্য ডেনিস নয়, দীনেশ দীনেশ অধিকারী তবে নিজেকে ডেনিস বলেই পরিচয় দেয় সবার কাছে বন্ধুরা ভুলেভালে কখনও দীনেশ নামে ডেকে ফেললে গুমগুম কিল বসিয়ে দিত পিঠে বিশেষত খেলার মাঠে মুখ ফসকে কেউ দীনেশ বলে ডাক দিলেই রক্তারক্তি কাণ্ড করে ছাড়ত ডেনিস লিলির চেলা কি না কে জানে তো এহেন একখানা পিস হাতে লেগে যেতেই মুকুন্দপুরের ছেলেরা যেন সাপের পাঁচ পা দেখে ফেলেছে যখন তখন অরবিন্দনগরের ছেলেদের কাঁচকলা দেখিয়ে বেড়ায় সুযোগ পেলেই
সেই থেকে সৌম্য, রাজেনরা বদলা নেওয়ার সুযোগ খুঁজছে কিন্তু খেলতে নেমে এক ডেনিসের সামনেই টিকতে পারছে না গোটা দল বদলা নেবে কী! তিনবছর ধরে হেরে চলেছে ম্যাচ সমানে
সকালে সৌম্য বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ভাবনায় পড়ে গেছি বেশ ছেলেটা আবার কাকে না কাকে হায়ার করে আনবে কে জানে সে যাকেই আনুক, ডেনিস থাকতে ও-ট্রফি মুকুন্দপুর ছেড়ে একচুলও নড়বে না সে বিলক্ষণ জানি আর দৈবাৎ যদি মুকুন্দপুর হেরেও যায় তাহলে ডেনিস তখন কী মূর্তি ধারণ করবে সে ভেবে কাঁটা হয়ে আছি শেষে একটা মাথা ফাটাফাটি না হয়ে যায়

দেখতে দেখতে খেলার দিনটা চলে এল মুকুন্দপুর-অরবিন্দনগর ক্রিকেট ম্যাচ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে কোনও অংশে কম নয় যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে মাঠে যখন পৌঁছলাম, তখন প্রায় ঘণ্টা দেড়েক খেলা গড়িয়ে গেছে সকাল নটায় খেলা শুরু হয়ে গেছে মুকুন্দপুর টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছে দুই উইকেট হারিয়ে স্কোর বোর্ডে বাষট্টি তখন দুই এলাকা ভেঙে পড়েছে মাঠের চারদিকে আমি মাঠে পৌঁছে পরিচিত কাউকে খুঁজতে যাব এমন সময় ওভারের শেষ বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে লং অনে ক্যাচ তুলে দিয়ে মাঠ ছাড়ল ওদের তিন নম্বর ব্যাটসম্যান মুকুন্দপুরের মুখে অন্ধকার আর অরবিন্দনগরের উদ্দাম নৃত্য ঢাকঢোল, হুইসেলে কেঁপে উঠল মাটি
চতুর্থ উইকেটে ডেনিস যখন ব্যাট হাতে নামল, আমাদের ক্যাপ্টেন রাজেন বোলিং অর্ডার চেঞ্জ করে ফেলল তখন ক্যাচ আকাশে উঠতেই ব্যাটসম্যানরা পজিশন ক্রস করে ফেলায় ডেনিস গিয়ে দাঁড়াল নন-স্ট্রাইকার এন্ডের দাগ ছুঁয়ে খুঁজে খুঁজে সৌম্যকে বার করলাম থার্ড ম্যানে দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বল করতে এল সুন্দর দেখতে ছিপছিপে একটা লম্বাগোছের ছেলে মাইকে বলছে, বোলারের নাম কৌশিক হালদার, রাইট আর্ম, পেস বোলার চিনতে পারলাম না আমাদের ক্লাবের সবকটা বিচ্ছুকে তো চিনি কিছু একটা ঘোঁট পাকিয়ে বাড়িতে হানাও দেয় মাঝেমাঝে কিন্তু এই ছেলেটিহঠাৎ কোঁচকানো ভুরু টানটান হয়ে গেল তবে কি এই সেই জলপাইগুড়ির মাসতুতো ভাই সৌম্যর? এছাড়া আর কে হবে? বাকি দশজন তো আমাদের এলাকারই
ওভারের প্রথম বলটা মাটিতে পড়তেই গর্জে উঠল অরবিন্দনগর আবার ওদের ব্যাটসম্যান দারুণ বিট হয়েছে কোনওমতে হাঁকরে-পাঁকরে স্ট্যাম্প তিনটে রক্ষা করেছে প্রথম বলটাই অপ্রত্যাশিতভাবে জাহির খানের ইয়র্কার এক্কেবারে দারুণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ওদের সেট ব্যাটসম্যান
দ্বিতীয় বলটা কোনওমতে এক্সট্রা কভারে ঠেলে দিয়ে এক রান নিল সে ডেনিস এবারে স্ট্রাইকে এখন শুরু হবে আসল মজা ওভার প্রতি দু-চারটে ছক্কা না মেরে ক্ষান্ত হয় না এ-ছেলে গোটা ইনিংসে দুয়েকবার মাঠের বাইরে বল না হারিয়ে শান্ত হয় না
কৌশিক তার রান-আপ শুরু করেছে ডেনিস ক্রিজে ব্যাট ঠুকতে ঠুকতে খুনে চোখে তাকিয়ে বলের অপেক্ষা করছে ডেনিস দ্য কিলার কখনও খুচরো রান দিয়ে নিজের ইনিংস শুরু করে না মুকুন্দপুরের হৈ-হল্লায় আর বাজনার তালে কানে তালা লেগে যাচ্ছে শ্বাস আটকে বসে আছে গোটা অরবিন্দনগর
ওমা, বল ডেলিভারি হয়ে যেতেই এলবিডব্লিউর জোরালো আবেদন উঠল সার্কেলের ভেতরে! মুকুন্দপুরের উত্তেজনা থিতিয়ে পড়েছে ক্রস ব্যাট চালাতে গিয়ে ডেনিসের থাইয়ে লেগেছে বল আম্পায়ার দুদিকে মাথা নেড়ে সরে দাঁড়ালেন মাঠে চাপা গুঞ্জন ডেনিসের চোখমুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে গ্লাভসের গ্রিপ বারবার খুলছে লাগাচ্ছে আর দাঁত কিড়মিড় করতে করতে কৌশিকের দিকে চেয়ে রয়েছে কৌশিক গুটি গুটি ফিরে যাচ্ছে তার রান-আপ পয়েন্টে
তারপর তো শুধু ভেলকি আর ভেলকি আহা, কী দেখলাম! কী করে যে বোঝাই! আচ্ছা, গ্লেন ম্যাকগ্রার লাইন-লেংথ, লাসিথ মালিঙ্গার অ্যাঙ্গেল আর শোয়েব আখতারের স্পীড যদি একটা বোলারের মধ্যে ঠুসে দেওয়া যায়, ব্যাপারটা ঠিক কী দাঁড়াবে বল তো? অসম্ভব বলছ? ঠিক তাই আরে আমিও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না প্রথমটায় ছানাবড়া হয়ে গেছিল পুরো চোখদুটো প্রত্যেকটা বল দেখার মতো ছিল কৌশিক ছেলেটার ইয়ার্কার একেকটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রক্তে আগুন ধরে যাচ্ছিল আর বাউন্সার? সে তো ডেনিসের হেলমেট ছুঁয়ে সাঁ সাঁ বেরিয়ে যাচ্ছিল একেকটা মাথা নুইয়েও সামলাতে পারছিল না ডেনিস দুবার তো রাম-আছাড় খেল দুটো কৌশিকের পাঁচটা বলে জায়গা থেকেও নড়তে পারেনি ও চোখমুখ কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে বেচারার সারা মাঠ থমথম করছে গোটা অরবিন্দনগর, এমনকি মাঠে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই কেমন যেন ভেবলে গেছে আনন্দ করবে কী!
পরের পরের ওভারেও একই অবস্থা মান বাঁচাতে মরিয়া হয়ে কোনওমতে এদিক ওদিক পুশ করে দু-চারটে খুচরো রান ব্যস স্কোর বোর্ড থেমে গেছে প্রায়
কৌশিক তার প্রথম স্পেলের শেষে মোট এগারো রান দিয়ে চারটা উইকেট চটকে লং অনে গিয়ে দাঁড়াল একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, কৌশিক যতটাই দুর্ধর্ষ বোলার ঠিক ততটাই বাজে ফিল্ডার সোজা হাতে বল না এলে ডাইভ মেরে বা এদিক ওদিক দৌড়ে গিয়ে বল ধরতে বিশেষ স্বচ্ছন্দ নয় সে খানিকটা বিরক্তি লাগল আজকাল কি আর সে ক্রিকেট আছে? এখন সবকটাকে অলরাউন্ডার হতে হয় ওর প্রচুর প্র্যাকটিস আর কোচিং দরকার
যাক গে, পুরো পঞ্চাশ ওভার খেলতে পারেনি এবারে মুকুন্দপুর ক্লাবের সেক্রেটারি কৃষ্ণেন্দু রায় মাথা হেঁট করে বসে আছেন চেয়ারে তেতাল্লিশ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে বিরানব্বই রান মাত্র তুলতে পেরেছে ওরা কৌশিক একাই ধস নামিয়ে দিয়েছে ওর ঝুলিতে এসেছে ছ-টা উইকেট সবাই মিলে ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে মাঠ ছাড়তে যাবে, নিজেই দৌড়ে বাউন্ডারি টপকে অরবিন্দনগরের শিবিরে গিয়ে ঢুকেছে কৌশিক লজ্জায় অধোবদন হয়ে বসে আছে সৌম্যর পাশে যেন কী একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে মাঠের অপর পাশে দাঁড়িয়ে সবই লক্ষ করছি আমি

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বিরতির পর সেকেন্ড ইনিংস শুরু হল প্যাড পরে ব্যাট হাতে নামল রাজেন আর সৌম্য মুকুন্দপুরের ক্যাপ্টেন ডেনিসের দিকে বলটা ছুঁড়ে দিতেই সে ওটা লুফে নিয়ে ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে কী যেন বলল ফিসফিস করে ক্যাপ্টেন হেসে বলটা আবার আরেকজনকে ছুঁড়ে দিল ডেনিসের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না সতেরোখানা বল খেলে মাত্র আট রান করে বোল্ড হয়ে গেছে কৌশিকেরই একটা খুনে ইয়র্কারে রাগে ফুঁসছে যেন গোঁয়ারটা বোলিং থেকে নিজেই সরে দাঁড়াতে আত্মায় জল এল আমার ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠছিলাম, ডেনিস বোলিং ওপেন করবেই আর রাজেন বা সৌম্য কেউ না কেউ হাসপাতালে যাবেই আজ রক্ষে পাবে না যাক, আপাতত নিশ্চিন্দি, পরেরটা পরে দেখা যাবেখন
খেলা শুরু হতেই দেখা গেল আমাদের ওপেনিং ব্যাটসম্যানদেরও দিন নয় আজ প্রথম থেকেই অসম্ভব বিট হচ্ছে চতুর্থ ওভার শেষে কোনও উইকেট না হারিয়ে মাত্র তেরো রান মুকুন্দপুরের দুজন বোলার আগুন ঝরিয়ে যাচ্ছে অনবরত পরের ওভারেই সৌম্য লাফিয়ে উঠেও বাউন্সারটা সামলাতে না পেরে মিড অনে ক্যাচ দিয়ে বসল তিন নম্বরে এল দেবু পা-ও জমাতে পারল না ক্রিজে তিন বলের মাথাতেই ফিরে গেল কট বিহাইন্ড হয়ে মুকুন্দপুরের শিবিরে তখন জোয়ার এসেছে যে যেমনভাবে পারে আনন্দ করছে
মাথা নিচু করে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ক্রিজে পৌঁছল কৌশিক এবারে ছেলেটার ফিল্ডিংয়ের নমুনা তো দেখেইছি ব্যাটিংয়ের হাত কেমন কে জানে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তো তেমন জুতের মনে হচ্ছে না নাহ্‌, এবারেও অধরাই রইল কাপটা দেখছি
ওমা, না তো! ছেলেটা টেকনিক্যালি দারুণ সাউন্ড! ওভারের তিনটে বল বাকি ছিল, দারুণ খেলল সবগুলো ডবলে কনভার্ট করে নিল ওভার শেষ হতেই আমার আশঙ্কাটাকে সত্যি করে দিয়ে বল করতে ডাক পড়ল ডেনিসের এবারে জমবে খেলা কে কেমন উস্তাদ দেখা যাবে এবার আবার মনে মনে ভয়ও হচ্ছিল খুব, ডেনিস নির্ঘাত কিছু নেগেটিভ বল করবেই করবে মাপ নেই পরের ছেলে, আমাদের হয়ে খেলতে নেমেছে, যদি উপরনিচ কিছু একটা হয়ে যায়! রাজেন এক রান নিতেই কৌশিক স্ট্রাইকে গেল
নাহ্‌, কৌশিক মুখ রেখেছে বটে অরবিন্দনগরের সেওয়াগের স্কোয়্যার কাট, সচিনের পুল, বিরাটের স্ট্রেট ড্রাইভ, যুবরাজের ছক্কা কিছুই বাদ দেয়নি ছেলেটা ডেনিসকে পিটিয়ে ছাতু করে দিচ্ছে একেবারে বেচারা এখন ঠিকই করতে পারছে না কোন স্পটে বল রাখবে এরই মধ্যে প্রাণঘাতী কয়েকটা বাউন্সারও করে দেখেছে সব কটাকে মাথার ওপরে ব্যাট পেতে উইকেট কীপারকে ডিঙিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছে কৌশিক ডেনিস মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে টাক ফেলে দিচ্ছে শুধু ডেনিস নয়, যে-ই বল হাতে দৌড়ে এসেছে তাকেই পিটিয়েছে কৌশিক রাজেনের শুধু কাজ ছিল ফ্যাল ফ্যাল করে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থাকা আর বলের পেছন পেছন দৃষ্টি ছুঁড়ে দেওয়া শেষে মাত্র একুশ ওভার চার বলে শেষ ছক্কা মেরে জয় ছিনিয়ে আনল অরবিন্দনগর ততক্ষণে মাঠের চারধারে পাগল হয়ে গেছে গোটা অরবিন্দনগর বাউন্ডারির দড়ির বেড়া ছিঁড়েখুঁড়ে একদল মাঠে নামতেই রাজেন আর কৌশিক দৌড়ে মাঠ ছাড়ল

দুদিন পর সৌম্যদের পাড়ায় গেছিলাম একটা কাজে গলির মুখেই সৌম্যর সঙ্গে দেখা হতে পিঠ চাপড়ে বললাম, “কথা রেখেছিস বটে সাবাশ!”
সৌম্য ঘাড় উঁচু করে বেঁকিয়ে বলল, “তবে?”
তা ডেনিসবাবুর কী খবর? জানিস কিছু?”
একটা বাঁকা হাসি হেসে সৌম্য জবাব দিল, “শুনেছি ঘর থেকেই বেরোচ্ছে না দুদিন
বলতেই হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়লাম দুজন সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হ্যাঁ রে, তোর মাসতুতো ভাই কি ফিরে গেছে?”
না থাকবে তো দু-চারদিন
খুশি হয়ে বললাম, “ঠিক আছে কাল-পরশু একবার ঘুরে যাব তোদের বাড়ি আলাপ করা যাবে
কথাটা কানে যেতেই সৌম্যর চোখমুখ যেন কেমন হয়ে এল নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “সে-সে তো কথা বলতে পারে না, সুমিতদা জন্ম থেকেই কারও সঙ্গে মিশতেও চায় না কত মানুষ এল, বন্ধুরা এল, সব্বাইকে ফিরিয়ে দিতে হল ও ঘর থেকেই বেরোয় না
মনটা বিষাদে ভরে উঠল আহা রে, অমন একটা ছেলে, এত সুন্দর খেলে

সেদিন কার মুখ দেখে উঠেছিলাম জানি না লোডশেডিংয়ের মধ্যে টিউশন সেরে বাড়ি ফিরছিলাম বাইকের হেডলাইটের কাঁচটা অসম্ভব ঘোলা হয়ে গেছে ইদানীং, ভাঙাচোরা রাস্তা দেখতে কষ্ট হচ্ছে আচমকা কী একটা গাছের শেকড়ই ছিল, না ইটের টুকরো ছিল মনে করতে পারছি না, সামনের চাকাটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেই পালটি খেয়ে গেল বাইকটা ছিটকে পড়ে পা-টা ফেললাম মুচকে হাতে কিছুক্ষণ শুশ্রূষা করে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলাম দাঁড়াতেই পারছি না আশেপাশে একটা লোকও নেই যে সাহায্য চাইব অসহায়ভাবে কিছুক্ষণ বসে থেকে ফোন লাগালাম সৌম্যকে, “পড়ছিলি বুঝি? একটু আসতে পারবি? ঠিক তোদের বাড়ির সামনেই গেট খুললেই দেখতে পাবি পড়ে গেছি বাইক থেকে
একটু পরেই সৌম্য বেরিয়ে এল হন্তদন্ত হয়ে গেট খুলে অবস্থা দেখে বলল, “চল, চল, আজ থেকে যাবে আমাদের এখানে বাড়িতে ফোন করে দিও একটা
বিবেচনা করে বললাম, “ঠিক আছে, চল তোর কাঁধটা নামা, ধরি
সৌম্য ব্যস্ত হয়ে বলল, “দাঁড়াও, বাইকটা ঢোকাতে হবে আগে এক মিনিটবলেই দৌড় দিল ঘরের দিকে
ফিরেও এল খানিক পরেই সঙ্গে কে একজন নিয়ে এসেছে ঠাহর করে দেখে চিনতে পারলাম, ওর মাসতুতো ভাই কৌশিক একটু হাসলাম মুখের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা পাত্তাই দিল না খানিকটা বিরক্তির সুরে সৌম্যকে বললাম, “আরে বাইকটা তো তুইই টেনে তুলতে পারতিস আবার ওকে কেন মিছিমিছি কষ্ট দেওয়া?”
ডান কবজিটাতে চোট পেয়েছি একটু সেদিন মাঠে ভারী জিনিস তুলতে পারি না এখনও
সৌম্যর মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদিকে দৃষ্টি পড়তেই ভিরমি খাবার যোগাড় হল আমার দেখি কী, কৌশিক ছেলেটা দুহাতে মাথার ওপরে বাইকটা তুলে নিয়ে গটগট করে রওনা হয়েছে ঘরের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলাম দেড়শো কেজির ওপর ওজনের বাইকটা অবলীলায় মাথায় তুলে নিল ছেলেটা! আর আরেকজন পালোয়ান একহাত পকেটে ঢুকিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে
হঠাৎ অবস্থা বেগতিক বুঝে সৌম্য তাড়াতাড়ি বলল, “ইয়ে সুমিতদা, প্লিজ বাবাকে বোলো না এসব কেমন?”
চোখ গোল্লা গোল্লা রেখেই জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার কোথায়? স্টাডি রুমে? না খাচ্ছেন?”
না, বাবা আজ বাড়ি নেই দিন দশেক হল কলকাতায় গেছে কীসব সেমিনার আছে কয়েকটা
রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক ভাবলাম অনেক সম্ভাবনা মাথায় এল, অনেক নাকচ হল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই কাকিমা অবশ্য খাওয়াদাওয়ার পর চুন-হলুদ গরম করে লেপ লাগিয়ে দিয়ে গেছেন সৌম্য একটা পেইন কিলার দিল খেয়ে বেশ আরাম হতেই চোখের পাতা বুজে এল
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না মনের অতলে কী একটা অস্বস্তি বুড়বুড়ি কেটেই চলেছিল দানবের মতো জেগে উঠেই দেহের সুপ্তিটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল আচমকা উত্তেজনায় ছটফট করতে করতে লক্ষ করলাম একের পর এক জোড়া লেগে যাচ্ছে সূত্রগুলো পরিষ্কার মনে পড়ে গেল, স্যার একান্ত ব্যক্তিগত একটা প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন গোপনে বছর দুয়েক আগে স্যার বিশ্বাস করে তাঁর প্রিয় ছাত্রকে মোটামুটি একটা ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিলেন আমি অবশ্য তাঁর বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি ব্যাপারটা এতই গোপন রেখেছিলাম যে নিজেই ভুলে গেলাম শেষপর্যন্ত! ছ্যাঃ, আরও আগে ব্যাপারটা মাথায় আসা উচিত ছিল আমার

চারদিন পর ফোন করে জেনে নিয়ে পৌঁছে গেলাম সৌম্যদের বাড়ি স্যার বাড়িতেই আছেন, সকালেই ফিরেছেন সৌম্যর বাবা, অসীমস্যারের কাছে ফিজিক্স পড়তাম কলেজে সটান স্টাডি রুমে হাজির হয়ে টগবগ করে বললাম, “স্যার, জিনিসটা কিন্তু দারুণ বানিয়েছেন দুর্দান্ত অ্যাকিউরেসি
স্যার অবাক হয়ে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, “কোন জিনিসটার কথা বলছিস?”
মুচকি হেসে জবাব দিলাম, “হিউম্যানয়েডটা আলাদা করে চেনাই যায় না
মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল স্যারের মুখটা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কোথায় দেখলি?”
এবার আমিও ভয় পেয়ে গেলাম খানিকটা এই রে, উচ্ছ্বাস সামলাতে না পেরে বলে বসলাম, এখন মার খেয়ে মরবে সৌম্যটা তবুও সাহস করে সত্যি কথাটাই বললাম সবিস্তারে মাঠের ঘটনা, আমার বাইক থেকে পড়ে যাওয়ার কথা স্যার চশমা খুলে গালে হাত ঠেকিয়ে শুনে গেলেন চুপচাপ তারপর সাঙ্ঘাতিক বিরক্ত হয়ে বললেন, “উফ্‌, ছেলেটাকে নিয়ে আর পারছি না আমি দুদিনের জন্যে ছিলাম না, আর এতসব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল! সামান্য ভুলের কী মাশুল গুনতে হত কোনও ধারণা আছে ছেলেটার? কী কুক্ষণেই যে ওকে দিয়ে আমি প্রোগ্রাম ইনসটলেশনগুলো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম!”
স্যার, প্লিজ একটু খুলে বলুন না ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে কথা দিচ্ছি, এ কথা আর কেউ জানবে না
আর জানার বাকি কী রাখল ওই বদমাশটা, অ্যাঁ? লোকভর্তি মাঠে নামিয়ে ছেড়েছে, আর তুই বলছিস...”
না না, স্যার, আমি নিশ্চিত ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কেউ আমিও না বোঝার কোনও উপায় রাখেননি যে!” ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলাম আমি
একটুক্ষণ ছটফট করে তারপর শান্ত হয়ে স্যার বলতে লাগলেন, “আরে, তুই তো জানিসই, প্রজেক্টটা নিয়ে কাজ করছিলাম বছর দুই আগে থেকেই তবে কিছু পার্টস মনোমতো যোগাড় করতে পারছিলাম না শেষে অনেক খোঁজখবর করে রাশিয়া থেকে আনাতে হল জলের মতো বেরিয়ে গেল গুচ্ছের টাকা তবুও শেষ পর্যন্ত স্ট্রাকচারটা ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে যেতেই সব গ্লানি মুছে গেল ওদিকে সৌম্যটা, তুই তো জানিস, কম্পিউটার নিয়ে পাগল দেখলাম, সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম ইনসটলেশনসংক্রান্ত নলেজটা ওর দারুণ মনে মনে ভাবলাম, ওই নলেজটা কাজে লাগিয়ে বাপ-ব্যাটা মিলেই ওটা বানাই না কেন? নয়তো আবার স্পেশালিস্ট আনাতে হবে গোপনে
তো যেমনি ভাবা, অমনিই কথাটা পাড়লাম সৌম্যর কাছে ব্যাটা তো লাফিয়ে উঠল আমার যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিলাম যতসব ইনসটলেশন ওই করেছে আমার সামনে সে যে শেষে অমন কাণ্ড ঘটাবে, জানা থাকলে কি আরইস্‌!”
একটু চুপ থেকে হেসে বললাম, “এইবারে পরিষ্কার হয়েছে সৌম্য কাপ জেতার জন্যে বেছে বেছে সেরা টেকনিকগুলো ইনসটল করেছে আপনি কলকাতা চলে যাওয়ার পর
সঙ্গে সঙ্গেই আবার বললাম, “কিন্তু স্যার, একটা কথা মাথায় আসছে না সৌম্য বা আপনি রোবটটা চালান কোন উপায়ে? সে কম্যান্ড পায় কীভাবে? ল্যাবরেটরিতে নির্দিষ্ট কোনও কাজ হয়তো প্রি-প্রোগ্রামিং করে রাখা যায় কিন্তু খেলার মাঠে নেমে খেলাটামাথায় ঢুকছে না স্যার
স্যার একটু মুচকি হেসে ড্রয়ার খুলে একটা মোবাইল ফেলে দিলেন আমার সামনে তবে আজকালকারমতো পুরোটা স্ক্রিনের নয়, নিচে কি-প্যাড আছে বললেন, “এটাতে অপারেটিং প্রোগ্রাম ইন্সটল করে নির্দিষ্ট চাবি চাপলে নির্দিষ্ট কাজ
বোকার মতো দাঁত বের করে বললাম, “কী বিচ্ছু ছেলে রে বাবা! মাঠেও এটা পকেটে রেখে সাবধানে কম্যান্ড দিয়ে গেছে অনবরত সবার অলক্ষ্যে! সেজন্যেই বাড়ি বয়ে গিয়ে বলে এল যে এবারে কাপ আমরাই আনছি হা হা হাসাহস আছে বটে ওর, যাই বলুন স্যার
স্যার কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে তারপর কেটে কেটে বললেন, “কিন্তু ওই কাপ যে আমাদের নয়, সুমিত এ কাপ দুনম্বরি পথে এনেছিস তোরা বিকেলেই গিয়ে ফেরত দিয়ে আসবি ওদের
আঁতকে উঠে বললাম, “সে কী! এ কি সম্ভব? ওরা কাপ ফেরত নেবেই বা কেন? প্রশ্ন করলে কী জবাব দেব? আমাদের জেতা কাপ…”
বলবি, গত তিনবছর যেহেতু ওরাই টানা জিতেছে, কাপ নিজেদের কাছে রেখেছে, তাই এবার থেকে আমরাও টানা তিনবার জিতেই তবে কাপ নিয়ে যাব আর এবার থেকে এই নিয়মই চলবে যে টিম টানা তিনবার জিতবে, কাপ তাদের
আমি কিছু একটা বলতে হাঁ করতেই স্যার কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন, “ওটাই শেষ কথা আর কোনও কথা নেই যা
আমি ধীরে ধীরে দরজার কাছে পৌঁছতেই স্যার পেছন থেকে বললেন, “আর হ্যাঁ, এ বছর যা করেছিস, করেছিস সামনের বছর থেকে সৎপথে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নিয়ে মাঠে নেমেই কাপ ছিনিয়ে আনতে হবে তোদের জানিয়ে দিস ওই বিচ্ছুটাকে
_____
অলঙ্করণঃ শ্রীময় দাশ

9 comments:

  1. ভালো চেষ্টা।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ, অভিজ্ঞানদা!

    ReplyDelete
  3. ভীষণ ভালো লাগল

    ReplyDelete
  4. গল্পটা ভালো, তবে মানুষের গল্প হিসেবেই পড়তে ভালো লাগছিল।

    ReplyDelete
  5. ভাল লাগল।

    মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য

    ReplyDelete

  6. দারুন গল্প।খেলা আর রোবট দারুন মিশেছে।

    ReplyDelete