গল্পের ম্যাজিক:: ভাবীকালের সন্ততিরা - পার্থপ্রতিম


ভাবীকালের সন্ততিরা
পার্থপ্রতিম

মানব-প্রজাতিকে যদি বাঁচতে হয়, আসন্ন বিলুপ্তির হাত থেকে, তবে আর একশো বছরের মধ্যেই অন্য কোনও গ্রহে বাসস্থান খুঁজে নিতে হবে।- স্টিফেন হকিং

 ১লা বৈশাখ, ১৫২৪। সকাল ১০:১০
পাপুনের লগ
·        আমি পাপুন। আমি আবার বাবা-মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি একটু সাহায্য করতে পারবেন?

১লা বৈশাখ, সকাল ১১:১০
টুপুর লগ
·        আমি ভেবেছিলাম শুধু আমিই বেড়াতে যাচ্ছি। তা নয়। এক্ষুণি বুঝতে পারলাম আমার বয়সী আরেকটা ছেলে আছে গাড়িতে। আমাদের ডিসপ্লে লগ  ইন্টারকানেক্টেডও ওর বাবা-মাকে খুঁজছে। বাবা-মার ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই। ওর নাম পাপুন। যাক, কানেক্ট করে দেখি।

১লা বৈশাখ, সকাল ১১:৩৫
পাপুন আর টুপুর চ্যাট লগ
·        হ্যাল্লো, পাপুন!
·        তুমি কে?
·        টুপু।
·        কে টুপু? আমার দিদি?
·        হুম।
·        এই দিদি, বাবা কোথায় রে, মা কোথায় রে?
·        ওসব বাদ দে, ওসব ভাবা বারণ।
·        ................
·        পাপুন?
·        হুঁ?
·        তুই জানতিস, তোর একটা দিদি আছে?
·        না তো।
·        তাহলে বুঝলি কীভাবে আমি তোর দিদি?
·        ওই তো, তুই টুপু বললি আর অমনি আমার মনে হল তুই আমার দিদি।
·        হুঁ।
·        উঁ?
·        আমিও তাই। যেই তুই দিদি বললি অমনি বুঝলাম তুই আমার ভাই।
·        হি হি...
·        ................
·        দিদি?
·        বল। আবার বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবি তো? শোন, আমাকে যেরকম খুঁজে  পেলি, ওইভাবে বাবা-মাকেও পেয়ে যাবি। ঠিক বুঝতে পেরে যাবি।
·        আমরা কোথায় রে, দিদি?
·        গাড়িতে। চলছে না গাড়িটা। আয়, একটু পড়াশুনো করা যাক। বল, ভৌত রাশি কাকে বলে?
·        যা মাপা যায়।
·        উঁহু। সঠিক পরিভাষা ব্যবহার কর। পরিমাপ, মাপ নয়। তথ্যভাণ্ডার খোঁজ করলে মাপ শব্দের হাজাররকম অর্থ খুঁজে পাবি, যেগুলো বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের সাথে ঠিক যায় না। সেজন্য সঠিক পরিভাষা বলবি। তুই তোর বুদ্ধিমত্তাকে একটু বেশি কল্পনার কাজে লাগিয়ে ফেলছিস।
·        তথ্যভাণ্ডারে সবই আছে। তুলে আনা মুহূর্তের ব্যাপার। তাহলে এরকম পড়ার কী মানে আছে রে, দিদি?
·        নিয়মমালার পাতাটা দ্যাখ। ‘মানুষের মতো মানুষ’ হতে বলা আছে। পড়া ঝালিয়ে নেওয়া আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা সবসময় করে এসেছে। তবে পড়া মনে থাকে। সেটাই আমাদেরও করতে হবে।
·        তাতেই বা কী? তথ্যভাণ্ডার ডিসকানেক্ট করলে কী হবে বল। যতই ঝালাপালা করিস এখন, একবার ডিসকানেক্ট করে দিলে তখন আর কিছুই মনে পড়বে না। হি হি।
·        এ.ইউ. মানে কী?
·        অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিট
·        অর্থ?
·        পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব।
·        কত?
·        ১৫০ মিলিয়ন কিমি। আচ্ছা দিদি, আমরা কত এ.এউ. পাড়ি দেব?
·        জানি না। বাবা-মা জানে।
·        বাবা-মা কোথায়?
·        জানি না। এখানেই আছে কোথাও।
·        খোঁজ না রে, একটু।
·        সব জায়গায় অ্যাকসেস নেই আমাদের। নিয়মমালাটা পড়ে দ্যাখ, শুধুমাত্র জ্ঞানচর্চার দিকে জোর দিতে বলা রয়েছে। দ্যাখ, লেখা আছে - ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ।
·        সে কী! সবসময় পড়তে কি ভালো লাগে নাকি?
·        তাহলে খেলা যাক। চেজ না লুডো, কী খেলবি?
·        ক্রিকেট।
·        ওই খেলাটার ব্যাপারে জানলি কী করে? ওটা তো প্লে গেমসে নেই।
·        আমি স্পোর্টস হিস্ট্রি পড়ছি। তুই বেসবল কাকে বলে জানিস? রাগবি? হি হি। চ না দিদি, রাগবি খেলি। আমি অডিও ভিজ্যুয়াল ইউনিট এড-অন করে খেলাটার কতগুলো ভিডিও দেখলাম। হেব্বি! একটা লম্বাটে বল নিয়ে হুড়োহুড়ি করে খেলা। মারপিট, দাঙ্গা সব এলাউড।
·        ওসব খেলে কী লাভ?
·        শারীরিক সক্ষমতা বাড়ে। শরীর সুস্থ-সবল থাকে।
·        সেজন্যই তো বলছি, ওসব খেলে-টেলে কোনও লাভ নেই। আয়, চেজ খেলি দাবা আর লুডো, দুটো খেলারই জন্ম ভারতে। ওইজন্যই বাবা এই দুটো খেলাই রেখেছে ডিস্কে , গেম স্টার্ট কর।
·        অ্যাই, বাবা খেলাদুটো রেখেছে কী করে জানলি?
·        তাই তো রে! আমার কেমন যেন মনে হল বাবা রেখেছে। আরও একটা জিনিস মনে হচ্ছে, জানিস?
·        কী?
·        বাবা খুব দেশভক্ত। বাবা খুব নামকরা বিজ্ঞানী হয়েও অন্যান্যদের মতো ভারত ছেড়ে যায়নি। বরং, বরং পেটেন্ট বিক্রির টাকায় - প্রচুর টাকা বুঝলি পাপুন, প্রচুর - সেই টাকায় দেশের বাড়িতে ল্যাবরেটরি খুলেছিল। একটা বিশাল বড়ো টেলিস্কোপ ছিল রে। তারপর কী যেন একটা ঘটল  কী ঘটল কেন মনে পড়ছে না বল তো?
·        বাবার পড়ার ঘরে কত ছবির বই দেখেছি রে। কিন্তু বইগুলো অনেক খুঁজেও রঙচঙে বাঁদর, নীল মেঘ, বৃষ্টির ছবি পাইনি। সবই রকেট-টকেটের ছবি। আমার এত যান্ত্রিকতা ভালো লাগে না। ফুল, পাখি, বেলপাতা দেখতে আমার হেব্বি লাগে। আর ঘাসফড়িংয়ের মতো যদি হুটোপুটি করতে পারতুম।
·        তুই পুরো মায়ের মতো কথা বলছিস, পুপুন। মাও এমন বলত। কিছুতেই বুঝত না, পলিউশনের চাপে যেগুলোর কথা বলছিস বহুদিন আগেই সব মরে গেছে, ঝলসে মরে গেছে রে সব।
·        দিদি দিদি, মনে করাস না, দিদি
·        ওসব দেখতে হলে ছবি দেখতে হবে। বা পুরনো দিনের ডিজিটাল মুভিগুলোতে। জানিস পুপুন, মানুষগুলো তখন এমন অমানুষ হয়ে গেছিল, এক-দেড়শো বছর আগে, যত কৃত্রিম আর নকল জিনিসগুলোকে নিয়ে মাতামাতি করত। প্লাসটিক বলে একটা জিনিস ছিল। হিস্ট্রির তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বের ইতিহাস চ্যাপ্টারে পেয়ে যাবি নামটা - কীভাবে ওই একটা জিনিস উন্নতির নামে গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখোমুখি করে দেয়। কৃত্রিমতা ব্যাপারটা এমন জায়গায় চলে যায় যে আসলের চেয়ে নকলের প্রতি সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে।
·        দিদি দিদি, এসব শুনতে ভালো লাগছে না, দিদি।
·        সব নকল রে পুপুন, মানুষও নকল। তখন থেকেই নকল মানুষ বেরুল। নকল মানুষ, হাত নেই, পা নেই, শরীরই নেই কিন্তু মানুষ
·        দিদি, দিদি...
·        সব নকল
·        দিদি?
·        .........
·        দিদি?
·        বল।
·        কোথায় ছিলি?
·        কোথায় আবার থাকব রে। উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলাম, তাই মাথার ক্যাশেগুলো ক্লিয়ার করে নিলাম।
·        কীসব ভুলভাল বকছিলি?
·        যাক, তোর বাবার মুখটা মনে আছে? মায়ের?
·        উঁ... না তো, পরিষ্কার আসছে না। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে
·        হ্যাঁ...
·        এই তো রে দিদি, মনে এসেছে বাবার মুখটা। মায়েরটাও আসছে। দাঁড়া, তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি কী রহস্যময় ব্যাপার না!  এই ছিল না, চলে এল। মেমরি কী মিস্টিরিয়াস!

কার্ত্তিক, ১৫২৩। রাত ২:০০

কাকলি তখনও দেখছিলেন অধিরাজ কম্পিউটরে মুখ গুঁজে খুটখুট করে চলেছেন শহর থেকে অনেক দূরে নির্জন বাগানবাড়িতে এখন তাঁরা রয়েছেন। যদিও বাগানের ছিটেফোঁটা নেই এখন। অধিরাজ  যখন Eniverse-এর অ্যাডভাইজিং অফিসারের চাকরিটা ছাড়লেন, তারপর থেকেই দু’জনে এখানে রয়েছেন।
ছেলে বা মেয়ে কোনওটাই ভগবান তাঁদের দেননি। কাকলি প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছেন এই দুই বছরে। আমেরিকার লাইফ স্টাইলে তাল মিলিয়ে প্রায় বিশ বছর কাটানোর পর ভারতে ঘুরতে-টুরতে আসা  ঠিক আছে,  কিন্তু তা বলে এইরকমভাবে এই জনশূন্য এলাকায় মাসের পর মাস থাকা সত্যিই অসহ্য।
আমেরিকায় থাকতে নানারকমভাবে সোস্যালাইজ করে আর এন.জি.ও. করে ভালোই সময়টা কাটিয়ে ফেলতেন কাকলি। মনের মিল হওয়া বান্ধবীও ছিল গুটিকয়েক আর এন.জি.ও.র অনাথ বাচ্চাগুলো তো ছিল তাঁরই মুখ চেয়ে তাদের মুখগুলো মনে পড়তেই মনটা কেমন কেমন করে উঠল কাকলির। এই দু’বছরে নিশ্চয়ই আরও একটু বড়ো হয়ে গেছে ওরা। ওদের ছেড়ে কিছুতেই আসতেন না কাকলি। খুবই ভালোবাসতেন,  কিন্তু অধিরাজকে যে তিনি বিশ্বের সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসেন।
Eniverse আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো কর্পোরেট মহাকাশ গবেষণা এবং প্রিমিয়াম স্পেস ট্রাভেল এজেন্সি। ধনকুবেরদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে মহাকাশে ভ্রমণ করিয়ে আনে এই সংস্থা। মঙ্গলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ফিল্ড কিনে নিয়েছে। সেখানে কলোনি বসানোর কাজ চলছে।
এত বিশাল মাপের কোম্পানির মুখ্য উপদেষ্টা হওয়া খুবই সম্মানের ব্যাপার অধিরাজের স্ত্রী হিসেবে ব্যাপারটা নিয়ে কাকলিও খুব আত্মশ্লাঘা বোধ করতেন। কিন্তু ওইরকম একটা চাকরি যে অধিরাজ কেন অমন হঠাৎ করে ছেড়ে দিলেন, তার কোনও কারণ খুঁজে পাননি কাকলি অধিরাজ তাঁকে জানাতেও চাননি। শুধু চুপচাপ বলেছিলেন, “আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে কাকলি, এ দেশ আমাদের নয়

এটুকুই থমথমে মুখে সেদিন বলেছিলাম আমি। কাকলি অবাক হয়ে চেয়েছিল আমার দিকে। তার অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, আমি আমার সদ্য পাওয়া মার্কিনি পরিচিতি নিয়ে প্রচন্ড গর্বিত থাকি। এতদিন বন্ধুমহলে সোৎসাহে তা বলেও এসেছি। ইন্ডিয়ার কোনও কিছুই আমার সহ্য হয় না। নোংরা থার্ড ক্লাস কান্ট্রি একটা। কলেজে ওঠার দিন থেকেই আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল যেভাবেই হোক এই দেশ থেকে পালাতে হবে।
তখন গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের দাগড়া দাগড়া ক্ষতগুলো দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। দিল্লি, ব্যাঙ্গালুরু, কোলকাতা – সব ক’টা মেট্রোসিটিতে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার শেষের পথে কোলকাতায় প্রায় একবছর এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি সেসব আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা ২১০০ সাল, নতুন মিলেনিয়াম শুরু  হয়েছে সবে। পৃথিবী নিয়ে ভাবার অবস্থায় কেউই নেই তখন, আমিও ভাবিনি। শুধু বুঝে গেছিলাম ভুল করে এ-দেশে জন্মে গেছি, তাই পালাতেই হবে। আর আমার কাছে পাখির চোখ ছিল একটাই, আমেরিকা।
সব ধরনের বিপর্যয় সামলাতে পেরেছিল আমেরিকা অন্য দেশের যখন কয়লা, তেল থেকে শুরু করে জল পর্যন্ত শেষের পথে, আমেরিকা তার লুকনো ভাঁড়ার খুলেছিল। এতদিন ডলারের বিনিময়ে গরিব দেশগুলোর কাছ থেকে শক্তি কিনে নিচ্ছিল তারা নিজেদের সঞ্চয় খরচ করে ফেলেনি বোকার মতো। তাই সারা বিশ্বের চরম বিপর্যয়ের মাঝখানে তখন সবচেয়ে সুখী জাত। একই সঙ্গে প্রায় অগম্য।
সারা পৃথিবীতে শক্তি বিপর্যয় নেমে আসার সাথে আমেরিকা বলা যায় সারা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে নিজেরাই একঘরে হয়ে গেছিল। সেখানে যাওয়া সাধ্যের বাইরে।
কিন্তু আমেরিকার বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলি তা করে কীভাবে? মাল্টিন্যাশনাল বিলিয়ন ডলারের বাজার তারা হাতছাড়া করতে চায়নি আর সারা বিশ্বের খাসা ব্রেনগুলোকে ড্রেন করে নেবার প্রথাটাকেও বন্ধ করেনি  বলা বাহুল্য, পৃথিবীর কথা ভেবে নয়, প্রফিটের কথা ভেবে।
তাতে আমার সুবিধেই হয়েছিল। ইসরোর অফার ছুঁড়ে ফেলে স্পেস ম্যাগনেট Eniverse-এ যোগ দিয়েছিলাম। ইসরোর আধিকারিকের মুখের ওপর বলেছিলাম যে আপনাদের দেশের যা অবস্থা ক’দিন গবেষণা চালাতে পারবেন? ক’দিন পর খেতে পাবেন তো ঠিকঠাক? রিসার্চ তো দূরের কথা। তখনই মনে মনে নিজেকে দি গ্রেট আমেরিকান ড্রিমের অংশ করে ফেলেছি ইচ্ছে করে ভুলে গিয়েছি জন্মানোর পর সাতাশটা বছর এই দেশটাই আমাকে  খেতে দিয়েছে, শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে, সেই শিক্ষায় ভর করে দেশছাড়ার আগে তার অপমান করতে বিন্দুমাত্র বাধেনি আমার।
আর এখন সেই দেশেই ফিরে এসে নিজের প্রতি ধিক্কারে বুকটা ফেটে যায় রোজ। মনে মনে শান্ত হবার চেষ্টা করিভাবি, বয়সের অহংকারে অমনটা করে ফেলেছিলাম।
বিশ বছর কেটে যাওয়ার পর পঁয়তাল্লিশে এসে এখন আমি অনেক পরিণত। কিন্তু বিবেক আর আমায় ছাড়বে না নিজের মনে তো আমি জানি দেশ ছেড়ে যাওয়ার একটাই  কারণ ছিল, আমার প্রবল লোভ। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির নিরাপদ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটানোর লোভ, দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছা, ইউজ অ্যান্ড থ্রো করতে গিয়ে নিজেই উচ্ছিষ্ট হয়ে গেলাম আমি। কাকলি না থাকলে হয়তো সুইসাইড করতাম আমিহয়তো কেন, নিশ্চই করতাম। ঘৃণ্য জীবন কাটিয়ে লাভ কী?
কাকলিকে চোখের সামনে চলতে ফিরতে দেখি বলেই মাঝে মাঝে দু-একটা স্বপ্ন মায়াভাঙা চোখে আবারও দেখে ফেলি। একটা স্বপ্ন মনে জায়গা দিয়েছিআমার সারা অস্তিত্বটাকে যতটা পারি স্বপ্নটাকে ধরার কাজে লাগিয়েছি।

এখন রাত দুটো স্বপ্নটা যত দিন যাচ্ছে পেয়ে বসছে যেন আমাকে ঘুমোতে পারছি না। কে যেন একজন বলেছিল না - যা ঘুমোতে দেয় না আসল স্বপ্ন সেটাই; ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমরা যেটা দেখি সেটা মিথ্যে।
আমার স্বপ্নটা কি সত্যি হবে! সত্যি করার জন্য আপ্রাণ খাটব আমি। খ্যাতি, প্রতিপত্তির লোভে ছুটতে ছুটতে যেটা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল, হঠাৎ কী ভীষণভাবেই চাইছি সেটাকে। আবেগপ্রবণতা, সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার-স্যাপারগুলো চিরকাল মেন্টালদের ডিপার্টমেন্ট ভেবে এসেছি। এখন সেখানেই নিজের নামটা লেখাচ্ছি।
কোথায়, খারাপ তো কই লাগছে না। বরং এই মধ্য চল্লিশে পড়ে যে অনুভূতি কখনও হয়েছিল বলে মনে করতে পারছি না সেই কোনওরকম চাওয়া-পাওয়া, দেয়া-নেয়ার সীমানা ছাড়ানো কামনাহীন ভালোবাসার স্পর্শ পাচ্ছি যেন। মনের ভেতরটা যেন দুটো পাখি হয়ে গেছে। যে পাখিটাকে কোনওদিন চিনতাম না,  জানতামও না আমার ভেতরেই সে আছে, ছিল এতদিন; হাসি হাসি চোখে আমার চেনা হতভম্ব পাখিটার দিকে চেয়ে আছে।
বাইবেলের সেইপ্রডিগাল সনগল্পটি মনে পড়ে গেছে।
ডিগবাজি নয়, এ অনুভূতি ফিরে আসার। ভুলে গেছিলাম যে দুঃখিনী মায়ের কথা, তারই কোলে।

চিরটাকাল ঝামেলা থেকে বাঁচা গেছে ভেবে কাকলির কাঁদুনিতে কান দিইনি। ওঅ্যাডপ্ট’ করার কথা তুলেছিল খুব কষে খেঁকিয়েছিলাম সেদিন। ভাগ্যিস মানা করেছিলাম, নইলে নিজেদের দুর্ভাগ্যের সাথে আরেকটি নির্দোষ মানবশিশুকে জড়িয়ে নেওয়া হত।
কিন্তু প্রত্যেক পুরুষেরই হয়তো সুপ্ত ইচ্ছে থাকেবাবাডাক শোনার। যখন একাকী হয়ে পড়ে সে, দু’চোখের রুপোলি মায়া ভঙ্গ হয় বা বেলা পড়ে এলে সেই সুপ্ত ইচ্ছেই হয়তো প্রবল আকার ধারণ করে। করে কি?
তীব্র অপত্যস্নেহ জোয়ারে ফুলে ওঠা নদ হয়ে উঠে বুক ভাসাচ্ছে আমার। ঘুমোতে পারছি না।
আড়াইটে বেজে গেছে। কাকলি পেছনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, চুপচাপ। আমি ঘুরে তাকালেই এগিয়ে আসবে, পিঠে হাতটা রাখবে। কত চেনা হাত, তবুও স্নেহ তার ফুরলো না

“এই বয়সে ছেলেমেয়ে!” কাকলি অবাক হয়ে বলে ফেললেন। তারপরই সামলে নিলেন নিজেকে। উনি জানেন আগের প্রবল আত্মবিশ্বাসী, সবসময় শেষ কথাটা বলার অধিরাজ হারিয়ে যাচ্ছে। ওর মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট তবুও নিশ্চয়ই কিছু একটা প্ল্যান ও ঠিক করেছে। ‘কুল’ ব্যাপারটা অধিরাজের কোনওকালেই নেই।
মনে পড়ল কাকলিরবিপদের মধ্যে কাজ করতে ভালো লাগে আমার যেন এক্ষুনি একটা ভূমিকম্প হবে, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে তার মধ্যেই আমি কাজ করে চলব এইটিই আমার উদ্দীপনার উৎস’ রাত দিন এক করে অফিসের গাদা গাদা প্রজেক্ট আর অ্যাসাইনমেন্টের কাজ সারার সময় বলত অধিরাজ, ‘তারপর প্রোমোশন’ ডান চোখ কুঁচকে হাসত।
কাকলির তাই আশা আছে, অধিরাজ ঠিক কোনও না কোনও উপায় বার করে ফেলবেই। এত বড়ো মাপের একজন বিজ্ঞানী। ওর অগ্রাধিকার থাকবে না!
কিন্তু ক’দিন হল বড়োই বিমনা লাগছে মানুষটাকে। এমনটা কাকলি কোনওদিন দেখেনি।
“ইসরোর ডঃ সত্যমূর্তির সাথে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ওনাকে বল না
“তুমি বুঝতে পারছ না, কাকলি  বিশ বছর আগে ওনার মুখের ওপর বলেছিলাম, আপনারা শেষ! তখন মনে হয়েছিল যে দেশ জীবনধারণের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্যটুকু দিতে পারে না, তার এত ব্যয়বহুল মহাকাশবিজ্ঞান চর্চায় কী প্রয়োজন! ইমম্যাচিউর ছিলাম তখন কাকলি! এখন কোন মুখে আবার যাব ওখানে!”
“তবুও
“শোন কাকলি, করেও কোনও লাভ নেই। তোমার কি মনে হয় মঙ্গল আর চাঁদে কলোনি স্থাপন করেও মানুষ টিকতে পারবে? এই সবুজ পৃথিবীটা শেষ করে ফেললাম আমরা কত লক্ষ-কোটি বছর ধরে বুকে ধরে রেখেছিল সবুজ আর সজীবতা মানুষ তো এই ক’দিন আগে এল বিবর্তনের ধারায়, পঞ্চাশ হাজার বছরও হবে না
“এককালে ডাইনোসরের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। উড়ুক্কু ডায়নো, ঘেসো ডায়নো, জলজ ডায়নো – আকাশ-বাতাস-সমুদ্র ছেয়ে ফেলেছিল তারা। চিরকাল রাজ করবে এই পণ করেছিল যেন। ডাইনোসর ধ্বংস হয়েছিল উল্কাপিন্ডের আঘাতে আর আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেললাম সেই সাথে শ্মশান করে দিলাম নীল গ্রহটাকেও।
“আমাদের কোন ক্ষমা নেই,  কাকলি, কোনও ক্ষমা আমাদের জন্য অপেক্ষা করে নেই  না মঙ্গলে, না চাঁদে। নিজের জন্মভূমিতে আমরা টিকতে পারিনি।
“ধরাধরি করে কলোনিতে গিয়েও কোনও লাভ নেইকিছু সময়ের অপেক্ষা, ওসবও হারিয়ে যাবে।”
অধিরাজের দীর্ঘশ্বাসটা যেন সোজা কাকলির বুকের গহনে এসে আঘাত করল। এত পরিবর্তন হয়ে গেল মানুষটার! রঙগুলো মেলাতে পারছিলেন না কিন্তু লুকনো আনন্দ হচ্ছিলকর্পোরেট অধিরাজের ভেতরে এই এলোমেলো মানুষটাও বাঁচে এই আস্থা চিরকাল কাকলির ছিল।
“তাহলে এভাবেই তিলে তিলে, এইখানে মারা যাব? আর বেশিদিন তো নেই, বড়জোর আট মাস তারপর আর বেঁচে থাকার পরিবেশ থাকবে না। মাস্ক এঁটেও আর দূষিত বাতাস এড়ানো যাবে না উষ্ণতা নিয়ন্ত্রক পোশাক পরেও বেরনো যাবে না।”
“এই লেখাটা পড়ো,” অধিরাজ ল্যাপটপে একটা নিউজ সাইটের বুকমার্কড পেজ ওপেন করে ডিসপ্লেটা কাকলির দিকে ঘোরালেন
তিরিশ বছর আগে ভারতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর নিয়মিত আগমন যখন হঠাৎই বন্ধ হয়ে গেল, দেশে জিডিপি গ্রোথ তলানিতে ঠেকল বলে অর্থনীতিবিদরা লাফালাফি করা শুরু করেছিল তাদের মাথাতেই আসেনি, পর পর কয়েকবছর মৌসুমি বৃষ্টি না হলে কৃষি তো দূরের কথা একটা গাছও বেঁচে থাকবে না, একটা নদীতেও জল বইবে না ভারতও ইরান, সৌদি আরব, আফগানিস্থানের মতো মরুভূমির দেশে পরিণত হবে। এই বছর মৌসুমি বায়ুর অনিয়মিত হওয়ার তিরিশ বছর আজ জিডিপি কূটকচালি নিয়ে ঘুঁটে দেওয়ার লোকের বড়ো অভাব। কারণ, তারা এই নীল সবুজ গ্রহটাকে ধূসর বানিয়ে এখন বিদায় নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে...
লেখাটা পড়তে পড়তে গলাটা ধরে আসে কাকলির। সেটা চাপা দিতেই বোধহয় জিজ্ঞেস করেন, “কেন অনিয়মিত হয়ে গেল তার কারণ বোধহয় সঠিক জানা গেল না, না?”
অধিরাজের মনোযোগ কাকলির প্রশ্নে ছিল না তার চোখদুটো বাইরের প্রচন্ড উত্তাপ আর বিষবাষ্প আটকানোর জন্য শক্তপোক্ত প্রোটেকটিভ শিল্ড দিয়ে ঘেরা জানলাটার দিকে হতাশভাবে চেয়েছিল তবে চোখের কালো তারাদুটো সুদূর হয়ে উঠে জানলাটাকে ভেদ করে কোনও অজানা নিরুদ্দেশে চলে যেতে পারল আস্তে আস্তে। আশাহত হওয়ার জন্যই।
“প্রকৃতি হঠাৎ করে কিছুই তো করে না। জানিয়ে দেয়, আসছি। চলেও আসে। নিয়তি আর প্রকৃতি, কোনও তফাৎ আর দেখতে পাও, কাকলি!”
কোনও প্রশ্ন নয়, শুধু বলে যাওয়া। অধিরাজ নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছে। হোক, বলে ফেললে মনটা হালকা হবেভাবেন কাকলি।
“তুমি বার বার একটা জিনিস চাইতে না? কাজের চাপের কথা বলে বারবারই আমি এড়িয়ে যেতাম,” অধিরাজ কাকলির দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান
অধিরাজের চোখে চোখ রাখতেই অর্থটা বুঝতে পারেন কাকলি। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধতার পরে তার বিস্মিত চেতন তার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেয়, “এই বয়সে ছেলেমেয়ে! আর এইরকম সময়ে? না অধিরাজ
“ওরকম নয়। ওদের কিছু হবে না। পৃথিবীতে মানুষ, গাছপালা কিছু হয়তো থাকবে না, মানুষের খাওয়ার মতো কিছু থাকবে না, বন্ধ হয়ে যাবে প্রচলিত শক্তির উৎস। কিন্তু সুয্যিমামা আলো দেওয়া তো বন্ধ করবে না। বরং জলীয় বাষ্প না থাকায় মেঘ সব হারিয়ে যাওয়ায় তার চাউনি আরও কটকটে হবে। সুয্যিদেবতা যত রাগবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা তত হৃষ্টপুষ্ট হবে” বহু বহু দিন পর অধিরাজের চোখেরা হাসে।
কাকলির কেমনতর দৃষ্টি অধিরাজের বাড়ানো তর্জনী অনুসরণ করে বড়ো দুটো সোলার প্লেট দেখতে পায়। বিদ্যুৎ সংযোগ আর কিছুদিন পর আর থাকবে না তাই ওগুলো এনে রাখা হয়েছে।
“আমার কম্পিউটরটা দেখছ? এটাই হবে ওদের ঘরবাড়ি। সফটওয়্যারটার শেষ একটু কাজ বাকি, ওটাই শেষ করছি। কাকলি, তোমার কতদিনের ইচ্ছে ছিল বল তো দ্যাখো, আবার বোলো না যেন তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করিনি
“কী হল কাকলি! শোন না  আমরা থাকব না  কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা তো অজর-অমর হয়ে থাকবে। ওদের স্মৃতিতে তো আমরাও বেঁচে থাকবভালো বাবা, ভালো মা হয়ে যেমনটা হলে ভালো হত, যা হতে চাইছি এখন বাবার খারাপটাকে না হয় নাই মনে রাখল ওরা, তাই না? ও হ্যাঁ, ওদের মেমরিটার সাইজটাও বেশ বড়োসড়ো দিয়েছি। এক্সপ্যান্ডেবল! অনেক কিছু জানতে পারবে, অনেক কিছু। আমাদের মগজের অত মনে রাখার ক্ষমতাই নেই ওদের দ্যাখো, সেই ক্যাপাসিটি থাকবে। সারা পৃথিবীটায় কেউ থাকবে না কেউ ক্ষতি করতে পারবে না রাজার হালে থাকবে আমাদের সন্ততিরা - জেন নেক্সট কিডোজ!”
অধিরাজের হাতের আঙুলগুলো দ্রুত হাতে কিবোর্ডে চলাচল করতে থাকে।

“এই হয়েছে কী, হল কী কাকলি! আরে এস ফ্রন্ট ক্যামটার মুখোমুখি দাঁড়াও, এস মিট পুপুন, আমাদের ছেলে আর এই যে টুপু, পুপুনের দিদি। ওরা এখনও কথা বলতে পারে না  আরে, হাই বল!”

১লা বৈশাখ, ১৫২৪সকাল ১১:৫০
পুপুন আর টুপুর চ্যাট লগ
·         এই দিদি!
·         বল।
·         একটা সারপ্রাইজ আছে, দ্যাখাব আগে কী দিবি, বল?
·         আরে, দেখা তো কী পেলি। তারপর বলব কী দেব।
·         পুরনো সার্ভারটা ইন্ডেক্সিং করছিলাম সেখানে এই ভিডিও ফাইলটা পেলাম।
·         কই, চালা

·         বাবা আর মা!
·         বাবা ইন্ট্রোডিউস করে দিল, তাপ্পর মা হাই বলল। হি হি!
·         ..........
·         এই দিদি, ডেটটা দেখেছিস? ছ’মাস আগের।
·         দেখেছি। আর কিন্তু দশ মিনিটও বাকি নেই। ঠিক বারোটার সময় কিন্তু অটো ইরেজার চালু হয়ে যাবে। কিছু মনে করতে পারবি না তারপর।
·         ওইজন্যই তো কিছু শিখতে চাই না আমি। সেই রোজ শিখব, আবার ভুলব, আবার শিখবভিসিয়াস সার্কেল বলে এটাকে। হয়তো এই ভিডিওটাও রোজ দেখি, আর রোজই ভুলে যাই যে দেখেছি
·         অটো মেমরি ইরেজার তো আমি ইন্সটল করিনি। আমাকে শোনাচ্ছিস কেন?
·         তো আনইন্সটল করে দে।
·         না। বাবা-মা হয়তো চায় না আমরা সবজান্তা হয়ে যাই। সবজান্তা হয়ে গেলেই আমাদের মানবিক ভাব, বোধ সব হারিয়ে যাবে। আমরা আরমানুষের মতো মানুষ’ হয়ে উঠতে পারব না। বাবা-মা কষ্ট পাবে।
·         এই দিদি
·         হুঁ?
·         ভিডিওটা দেখলি ভালো করে?  বাবা-মা দু’জনেই হাসছিল কিন্তু ওদের চোখের কোণটা চিকচিক করছিল কেন রে?
·         ওটাকে অশ্রু বলে। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে।
·         কষ্ট পেলে, না রে, দিদি?
·         সত্যিকারের আনন্দ হলেও

উপসংহারঃ ২০১৭ সাল। ৫ই জুন। সারা বিশ্বজুড়ে হই হই রবে পরিবেশ দিবস পালন হচ্ছে যখন, আমেরিকা চুপিসারে প্যারিস পরিবেশ চুক্তি ভেঙে মাথা উঁচু করে বেড়াতে লাগল। ভালো করে লক্ষ করলে দেখতে পাওয়া যেত উঁচু মাথাটায় কোনও চোখ নেই, আছে দুটো বড়ো বড়ো কালো গর্ত।
ভাবীকালের সন্ততিরা ওই অন্ধকার ভবিষ্যতের গর্ভে। তোমরা কি ওদের স্বাগত জানাবে?
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

5 comments:

  1. লেখার স্টাইল খুব অন্যধরণের। ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. এই গল্পের অসামান্য বিষয়বস্তু একটু আকর্ষণীয় আর ছোটদের উপযোগী করে লেখা হলে ভালো হতো ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যিই গল্পটা শিশু উপযোগী নয়। আপনাকে হতাশ করার জন্য দুঃখিত।

      Delete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  4. bah... bes laglo..onnyrokom

    ReplyDelete