কল্পবিজ্ঞানের প্রিয় গল্প:: চোবাটোকার গুপ্ত রহস্য - ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য


চোবাটোকার গুপ্ত রহস্য
ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য

আমাদের পাড়ার চট্টরাজমশাই যেমন ধনী তেমনই আমুদে। কোম্পানির আমল থেকে ওঁরা কলকাতার বাসিন্দা। তাঁদেরই কোনও এক পূর্বপুরুষ নাকি সে যুগে নুন আর সোরার ব্যবসা করে, এত টাকা উপার্জন করে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য রেখে গিয়েছিলেন যে এখনও ওঁদের কয়েক পুরুষ দিব্যি পায়ের ওপর পা রেখে রাজার হালে দিন কাটিয়ে যেতে পারেন।
তাই বলে চট্টরাজমশাই পায়ের ওপর পা রেখে আলস্যে দিন কাটাবার পক্ষপাতী নন কোনদিনই। কলকাতার নামী কলেজে লেখাপড়া শিখেছেন তিনি আর পাঁচটা তুখোড়বুদ্ধি ছেলেদের সঙ্গে; কাজ না করে ঘরের টাকা ভেঙে বাবুয়ানির কথা ভাবতেই পারেন না। তাই আইনের পরীক্ষা-টরক্ষায় পাশ করে নিয়ে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছেন।
অবশ্য কু-লোকে বলে প্র্যাকটিস না ছাই। হাইকোর্টে যাবার উদ্দেশ্য তাঁর স্রেফ আড্ডা দেওয়া। গত কয়েকবছরে কোনও জজের এজলাসে তাঁকে ক’বার হাজির হতে দেখা গেছে তা বোধহয় আঙুল গুনে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে তিনি কোর্ট কোনওদিনই কামাই করেন না। কোর্টে গেলেই দেখা যাবে চট্টরাজমশাই তাঁর নির্দিষ্ট টেবিলটিতে বসে বন্ধুদের সঙ্গে সমানে আড্ডা দিয়ে চলেছেন। তারই ফাঁকে ফাঁকে চা আসছে, সন্দেশ আসছে, আসছে আরও নানা মুখরোচক খাবার। চট্টরাজমশাই খেতে খুব ভালোবাসেন, ভালোবাসেন খাওয়াতেও।
আড্ডা ছাড়া আরেকটা নেশা আছে তাঁর। সেটা হল দেশভ্রমণের নেশা। ভারতবর্ষের হেন জায়গা নেই যেখানে কোনও না কোনও সময় গিয়ে বেড়িয়ে আসেননি। এই দেশভ্রমণের জন্য দেদার খরচ করতেও তিনি মুক্তহস্ত
কিন্তু দেশের বাইরে ইচ্ছা থাকলেও এ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। যতবার চেষ্টা করেছেন তাঁর স্ত্রীই বাগড়া দিয়েছেন তাতে। কারণ, চট্টরাজমশাইয়ের একটা দোষ, স্ত্রীকে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যাবেন না। প্রায়ই বলেন, গো, ইংরাজিতে কথা বলাটা এবার একটু ভালো করে সড়গড় করে নাও। বিদেশে তো তোমার বাংলা আর ভাঙা হিন্দি কোনও কাজে আসবে না। হিন্দি এদেশের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে, কিন্ত ওদেশে অচল।
কিন্ত সেবার হঠাৎ একটা সুযোগ জুটে গেল।
চট্টরাজমশাইয়ের বড়োজামাই ইঞ্জিনিয়ার। একটা মস্ত বড়ো কোম্পানিতে কাজ করে। হঠাৎ তাকে কোম্পানি থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হল জাপানে। কতগুলো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে আসার ট্রেনিং নেবার জন্য। বছর দুই থাকতে হবে ওখানে। জামাইয়ের সঙ্গে তাঁর মেয়েও চলে গেল জাপানে।
আদুরে মেয়ে, জাপানে দিনকয়েক কাটিয়েই মাকে চিঠি লিখল - মা, তোমাদের ছেড়ে এসে এখানে মন টিকছে না একদম। দেখছি অনেক কিছুই, জাপানি ভাষাও শেখার চেষ্টা করছি অল্পস্বল্প, কিন্তু মন খুলে কথা না বলতে পারলে ভালো লাগে কি? তোমার জামাই তো অষ্টপ্রহরই টইটই করে বেড়াচ্ছে। তাই বলি কি, বাবার তো দেশ বেড়াবার শখ চিরকালের, বাবাকে নিয়ে চলে এস না দিনকয়েকের জন্য।
চট্টরাজগিন্নি আদরের মেয়ের কথা ঠেলতে পারলেন না। স্বামীকে বললেন, তাহলে চল ঘুরেই আসি দিনকয়েক। খুকু এত করে লিখেছে...

যথাসময়ে চট্টরাজমশাই সস্ত্রীক টোকিওর এয়ারপোর্টে এসে নামলেন। বিজ্ঞানের দৌলতে পৃথিবীটা এখন অনেক ছোটো হয়ে গেছে। চট্টরাজমশাইয়ের মনে পড়ল, ছেলেবেলায় মামার বাড়ি পূর্ববঙ্গে যেতে কলকাতা থেকে সময় লাগত পাক্কা দুদিন অর্থাৎ আটচল্লিশ ঘণ্টা। প্রথমে ট্রেন, তারপরে স্টিমার, তারপর নৌকো। কিন্তু জায়গাটার দূরত্ব কলকাতার থেকে দেড়শো মাইলও হবে না। আর এখন?
কলকাতা থেকে সুদূর জাপানে পাড়ি দিতে বারো ঘণ্টাও লাগল না। তাজ্জব ব্যাপার।
এয়ারপোর্টে মেয়ে-জামাই দুজনেই এসেছিল, আর সঙ্গে এসেছিল তাঁর নাতি টুটু - বছর দশেকের টুকটুকে ছেলে। খুকু অর্থাৎ চট্টরাজমশাইয়ের মেয়ে সীতা বলল, টোকিও শহর এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর। শহরের এই হট্টগোলের মধ্যে থাকতে আমাদের ভালো লাগে না তাই আমরা কাছেই উকুবাসি নামক শহরতলিতে বাসা নিয়েছি। তিরিশ কিলোমিটারের মতো পথ। গাড়িতে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব
রাস্তা দিয়ে দ্রুতগামী গাড়িগুলো ছুটছে। কোনও কোনও জায়গায় দোতলা, এমনকি তেতলা রাস্তাও রয়েছে। সেগুলো পা হয়ে ওঁরা ক্রমে শহরের বাইরে এসে পড়লেন। কী সুন্দর ঝকমকে রাস্তা! কোথাও খানাখন্দ নেই, নেই কোনও আবর্জনা। দুপাশে এখানে ওখানে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবচেয়ে চোখে পড়ে চেরিফুলের গাছ। চট্টরাজমশাই অবাক চোখে দেখছেন, আর দেখছেন, আর দেখছেন।
শ্বশুর-শাশুড়ীর আগমনে জামাতা বাবাজী সুবীর এক সপ্তাহ ছুটি নিয়েছে। মোমো–নো-সোক্কু নাকি ওইরকম একটা উৎসব উপলক্ষ্যে টুটুরও ইস্কুল ছুটি। তাই ঠিক হল একদিন যতটা সম্ভব ঘুরে বেড়িয়েশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখে নেওয়া হবে।
হলও তাই। চট্টরাজমশাই যতই দেখেন ততই মুগ্ধ হন আর গিন্নিকে বলেন, দেখেছ? ঠিক তোমাদের ত্যাঁদড়গঞ্জের মতো, তাই না?
ত্যাঁদড়গঞ্জ চট্টরাজ-গিন্নির বাপের বাড়ি। নামটা মোটেও সুশ্রাব্য নয়, জায়গাটা আরও বিশ্রী। কিন্তু, তাহলেও বাপের বাড়ি তো বটে! চট্টরাজ-গিন্নি ফোঁস করে উঠলেন। ওই জন্যই তো বেছে বেছে গাঁয়ের সঙ্গে নাম মিলিয়ে ত্যাঁদড় জামাই করা হয়েছে।
সীতা মাকে ধমক দিয়ে বলল, আহ, মা! কী হচ্ছে! সামনে তোমাদের জামাই রয়েছে না?
দাদু-দিদার এই কৌতুক-কলহ দেখে টুটুর ভারি মজা লাগে। সে চেঁচিয়ে উঠে সুর করে বলে, নুকা সিকি, নুকা সিকি! ডাডু ডিডা পুটাবকি!
এখানে এসে এরই মধ্যে জাপানি ভাষা গড়গড় করে বলতে শিখেছে ও। অবশ্য একটু আধটু ভুল হয়। তা হলেই বা! এখানে তো আর মহাভারত নেই যে অশুদ্ধ হয়ে যাবে!
দিন তিনেক পরে সীতাই প্রস্তাব করল, চল, লেক চোবাটোকা দেখে আসি।
বাবাকে বলল, পাহাড়ের একেবারে মাথার ওপর চূড়ার কাছে মস্ত হ্রদ। কাকচক্ষুর মতো জল টলটল করছে। আর চারদিকে সে কী অপরূপ দৃশ্য! একবার দেখলে কোনদিন ভুলতে পারবে না।
সুবীর তার কথায় সায় দিল। টুটুও আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তারপরেই মাকে বলল, সেবারকার মতো স্যান্ডউইচ নিয়ে যেতে হবে কিন্তু। চিকেনের নয়, সুচাকির স্যান্ডউইচ।
সুচাকি এখানকার স্থানীয় একরকম পাখি, হাঁস-মুরগিরই স্বজাতীয় কিন্তু ওর মাংসটা আরও সুস্বাদু।
হ্যাঁ, নেব সীতা সংক্ষেপে বলল।
আর সেই সঙ্গে স্ট্রবেরি মাখানো ক্রিম।
সীতা সস্নেহে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা আচ্ছা, ফুরাসিকা, ফুরাসিকা। অর্থাৎ, তথাস্তু
সীতা যে একটু জাপানি ভাষা শিখেছে এটা বোধহয় তার নমুনা কিন্তু ভুল হয়ে গেল। টুটু হেসে গড়িয়ে পড়ল।
হল না, হল না। ফুরাসিকা নয়, ওটা হবে ফুরাসিকু।
পরের দিনই ওরা রওনা হয়ে গেল লেক চোবাটোকার উদ্দেশে।
সত্যি দেখবার মতোই বটে। মাটি থেকে একটা বিরাট পাহাড় খাড়া হাজার দেড়েক ফুট ওপরে উঠে গেছে। নিচের দিকটা গোলাকার। দেখতে অনেকটা ফানেলের মতো। তারই মাথার ওপর বিরাট এক হ্রদ। চারদিককার প্রাকৃতিক দৃশ্য এককথায় অপূর্ব।
পাহাড় বেয়ে হ্রদে পৌঁছতে হলে কষ্ট করে পা ভেঙে উঠতে হয় না। পাহাড়ের ওপর ঘুরে ঘুরে উঠবার জন্য মোটরগাড়ি যাবার রাস্তা। সারি সারি মিনিবাসের মতো গাড়ি রাস্তায়ই অপেক্ষা করছে। চড়ে বসলেই ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নামিয়ে দেবে। চট্টরাজমশাইয়ের মনে পড়ল, বিশাখাপত্তনমের কাছে সিমাচলম পাহাড়ে উঠতেও তাঁরা এইরকম মিনিবাসে চড়েই চূড়ায় উঠেছিলেন। কিন্তু এখানকার এগুলো আরও আরামদায়ক। গাড়ি একেবারে হ্রদের পাশে নামিয়ে দিল ওঁদেরকে। নেমেই দেখেন, যেরকম সব বেড়াবার জায়গাতেই দেখা যায় এখানেও তেমনি ট্যুরিস্ট হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফটোগ্রাফির ও আরও হরেকরকম শৌখিন জিনিসের দোকান। একটা দোকানে লাল টুকটুকে চেরিফল বিক্রি হচ্ছে। দেখলেই মুঠো মুঠো তুলে মুখে দিতে ইচ্ছে করে।
হ্রদের ধার ঘিরে রাস্তা। তাই ধরে বেড়াতে বেড়াতে এক জায়গায় দেখা গেল কতকগুলো সুদৃশ্য বোট বাঁধা আছে। এসব বোট ভাড়া পাওয়া যায়। অনেকেই রোয়িং করার উদ্দেশ্যে সেগুলো ভাড়া করে হ্রদের জলে ভেসে পড়ে। টুটুও আবদার ধরল, নৌকোয় চড়তে হবে। চট্টরাজ মশাই হেসে বললেন, বেশ, ফুরাসিকা! না, ভুল বললাম বোধহয়। ফুরাসিকু, তাই না?
দাদুর মুখে জাপানি ভাষা শুনে টুটু খিলখিল করে হেসে উঠল। কিন্তু দাদু একটু থেমে বললেন, সবাই সাঁতার জানো তো?
তারপর স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, তুমি তো বিয়ের আগে ত্যাঁদড়গঞ্জে মেয়েদের সুইমিং কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছিলে, তাই না?
চট্টরাজ-গিন্নি মুখটা বেঁকিয়ে হেসে বললেন, ঢং!
একটা বড়োসড়ো পাঁচ-জন বসতে পারে এমনিধারা বোট ভাড়া নেওয়া হল। না, মাঝি লাগবে না। নিজে না চালালে সেটা আবার রোয়িং হল নাকি?
সবাই মিলে নৌকায় গিয়ে উঠলেন। সুবীর আর সীতা দুদিকে দুটো বৈঠা নিয়ে বসল। টুটুও নিল একটা। চট্টরাজমশাই বললেন, আমি হালে বসছি।
তরতর করে স্বচ্ছ জলে ভেসে চলল নৌকো। ফুরফুরে বাতাস বইছে। একটু একটু শীত শীতও করছে যেন। নৌকোর নিচে ঠাণ্ডা টলটলে জল। হাতটা বাড়িয়ে জলে ডোবালে গাটা শিরশির করে ওঠে। কিন্তু তাইতেই নৌকোবিহার আরও লোভনীয় হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ টুটু বলল, দেখ দেখ, ওইখানটায় জলের মধ্যে কেমন বুড়বুড়ি উঠছে না!
সত্যিই তো! একটা জায়গায় জলের মধ্যে থেকে ক্রমাগত বুদবুদের মতো কী একটা উঠে আসছিল, ঠিক যেমনটা ফোয়ারার জলে প্রথমটা ওঠে। কিন্তু সাধারণ বুড়বুড়ি নয়, তা থেকে বেশ একটু বড়ো বড়ো এবং উঠে আসছিল সেগুলো জলের ভেতর থেকে।
কী ব্যাপার? সুবীর বৈঠা বাওয়া বন্ধ করে ভালো করে দেখতে লাগল। সীতা বলল, আরে, এদিকেও যে!
দেখা গেল একটা দুটো নয়, অনেকগুলো জায়গায় এক সঙ্গে জলের মধ্যে থেকে ওইরকম বুদবুদ ভেসে উঠছে এবং তা ক্রমেই আরও দ্রুতবেগে, আরও বড়ো বড়ো চেহারা নিয়ে দেখা যাচ্ছে।
একটু পরেই এদিকে ওদিকে ফোয়ারার মতো ফিনকি দিয়ে জলের ধারা ছিটকে বেরোতে শুরু করল। সমুদ্রে তিমি যখন জলের ওপর দিকে উঠে নিঃশ্বাস ছাড়ে তখন নাকি এইরকম ফোয়ারার মতো ফিনকি দিয়ে জল উঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু হ্রদেও কি তাহলে তিমি এসে জুটেছে নাকি? কিন্তু তা তো সম্ভব নয় তো লোনা জল নয়, মিষ্টি জলের হ্রদ।
দেখতে দেখতে ফোয়ারার সংখ্যাও ক্রমে বেড়েই চলেছে। সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে ক্রমাগত হুস হুস করে জল উঠছে আর ভেঙে পড়ছে সাদা ফেনায়। অন্যান্য যেসব ভ্রমণার্থী বোটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তাঁরাও এটা লক্ষ করেছিলেন এবং সকলেই দেখা গেল তীরের দিকে নৌকো ঘুরিয়ে দিয়েছেন। চট্টরাজমশাইও বেশ বিচলিত হয়ে উঠলেন বললেন, ব্যাপারটা যেন কেমন লাগছে! ডাঙার দিকে জোরে বৈঠা চালাও। নিজেও একটা বৈঠা তুলে নিলেন।
তাড়াতাড়িতে জোরে বৈঠা জলে ফেলতেই একঝলক হ্রদের জল ছিটকে এসে তাঁর গায়ে লাগল। চট্টরাজমশাই চমকে উঠে বললেন, কী, ও যে গরম জল! বেশ গরম! একটু আগেও তো এরকম ছিল না! বেশ ঠাণ্ডাই ছিল।
তাঁর কথা শুনে সুবীর, সীতা দুজনেই হ্রদের জলে হাত ঢুকিয়ে দিল এবং পরক্ষণেই দুজনেই প্রায় এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, কী, ভীষণ গরম! মনে হচ্ছে একটু পরেই ফুটতে শুরু করবে।
আতঙ্কে সকলেরই মুখ তখন সাদা হয়ে গেছে। যেভাবেই হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হ্রদের পাড়ে গিয়ে উঠতে হবে। চট্টরাজ-গিন্নি এবার তাঁর অপটু হাতে আরেকটা বৈঠা তুলে নিলেন।
পেছনে তখন কেমন একটা ক্ষীণ অথচ গুমগুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছেপ্রথমে সেটা ছিল অস্ফুট কিন্তু ক্রমেই তার তীক্ষ্ণতা বেড়ে চলেছ
সহসা টুটু চেঁচিয়ে উঠল, বাবা, দাদু, ওই দেখ!
সকলেই টুটুর কথা শুনে মুখ ফেরালেন। হ্রদের ওপর থেকে ঘন বাস্পের মতো কী যেন ওপরে উঠে আসছে, এদিক ওদিক সবদিকেই। প্রথমে সেটা ছিল সাদা কুয়াশার মতো কিন্তু ক্রমেই তার রঙ ঘন হয়ে এখন কালো ধোঁয়ার মতো হয়ে উঠেছে। ঠিক যেন কয়লা চালানো রেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া।
চট্টরাজ-গিন্নি অনভ্যস্ত হাতে বৈঠা টানতে টানতে বলে উঠলেন, একটা গন্ধও টের পাচ্ছি যেন! গন্ধক পোড়ালে যেমনটা হয় অনেকটা তেমনি দেখ শুঁকে!
ভয়ে তখন কারোর মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। এ কী বিপদ হল প্রমোদভবনে এসে! শেষপর্যন্ত ডাঙায় পৌঁছানো যাবে তো?
যাওয়া সত্যিই কঠিন! হ্রদের জলও এখন ছলাৎ ছলাৎ করে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। কে বলবে শান্ত হ্রদ? ও যে সমুদ্রের মতোই বড়ো বড়ো ঢেউ! নৌকো একবার ঢেউয়ের মাথায় গিয়ে উঠছে, পরক্ষণেই নেমে আসছে নিচে। চট্টরাজ-গিন্নি বৈঠা ফেলে দিয়ে দুর্গাস্ত্রোত্র শুরু করে দিলেন।
নমস্তে শরণ্যে শিবে সানুকম্পে
নমস্তে জগৎব্যাপীকে বিশ্বরূপে
নমস্তে জগৎবন্দ্য পাদারবিন্দে
নমস্তে জগত্তারিণী ত্রাহি দুর্গে...।
সীতা একালকার কলেজে পড়া মেয়ে ওসব মন্ত্র তার জানা নেই। কিন্ত বিপদকালে দুর্গানাম করার কথা সে ভোলেনি। প্রাণপণে বৈঠা টানছে আর মুখে বলে চলেছে, দুর্গা দুর্গা দুর্গা দুর্গা... দুর্গা দুর্গা দুর্গা দুর্গা...
শুধু টুটু চোখ বুজে রয়েছে মুখে কোন কথা নেই তার
যাই হোক, চট্টরাজ-গিন্নির আওড়ানো মন্ত্রের জোরেই হোক কিংবা কলেজে পড়া মেয়ের অস্বাভাবিক আন্তরিক ডাকেই হোক, মা দুর্গার মন হয়তো সামান্য একটু টলল। তিনি তো সর্বত্রই আছেন জাপানের এই হ্রদের ধারেই থাকবেন না কেন? হয়তো তাঁরই সেই আশীর্বাদে ওঁরা একসময় ডাঙায় গিয়ে উঠলেন—অক্ষত শরীরেই।
সারি সারি মিনিবাস দাঁড়িয়ে। একটা একটা করে নৌকো এসে তীরে ভিড়ছে আর বাসগুলো তাদের তুলে নিয়ে দ্রুতবেগে নিচে নেমে যাচ্ছে। ওঁরাও একটা মিনিবাস পেয়ে তাড়াতাড়ি তাতে উঠে পড়লেন। ঝড়ের মতো বেগে মিনিবাস ঘুরে ঘুরে পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে এল।
বাস থেকে ওঁরা একবার হ্রদের দিকে তাকালেন। সেখানে তখন ভীষণ অবস্থা জলের ওপরেই দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন ওপর দিকে ছিটকে ছিটকে উঠছে কাদার চাপটি, পাথরের টুকরো, আরও কীসব। ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠে গেছে মেঘের রাজ্যে। সেদিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়।
ততক্ষণে ওপরকার হোটেল, রেস্তোরাঁ আর অন্যান্য দোকানের লোকেরাও দলে দলে নিচে নেমে আসছে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে। যারা মিনিবাসে উঠতে পারেনি তারা দুরন্ত বেগে ছুটে ছুটেই নামছে। সেও এক ভয়াবহ দৃশ্য।
যাই হোক, চট্টরাজমশাই সবাইকে নিয়ে কোনরকমে ফিরে এলেন উকুবাসিতে সুবীরের কোয়ার্টারে।

এরপর বেশ কিছুদিন কাটলচোবাটোকার অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পর আর নতুন করে বাইরে বেরোবার ভরসা হচ্ছিল না যেন। কিন্তু জাপানে তো এখনও কত কী দেখবার আছে। দেখা হয়নি কুমাকুরার বিখ্যাত বৌদ্ধমূর্তি, দেখা হয়নি ফুজিয়ামা, দেখা হয়নি কিয়েটো, নাগাসাকি ইত্যাদি আরও কত জায়গা!
হ্যাঁ দেখবেন, সেদিনকার সেই রহস্য উদঘাটিত হলে তবেই। চট্টরাজমশাই না হয় গ্যাঁট হয়ে বসেই থাকবেন মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে। জলে পড়েননি তো আর। রহস্য কিন্তু কিছুদিন পরে সত্যিই উদঘাটিত হল। উদঘাটন করলেন জাপানি বিজ্ঞানীরা, বিশেষ করে ওখানকার জিওলজিক্যাল সার্ভে অর্থাৎ ভূতাত্ত্বিক সংস্থার বিজ্ঞানীরা।

চট্টরাজমশাই চলে আসবার পর চোবাটোকা হ্রদে আর কী ঘটেছিল তা তাঁরা চাক্ষুষ দেখতে না পেলেও কাগজে পড়েছিলেন, ছবিও দেখেছিলেন তার।
হ্রদের জল প্রথমে টগবগ করে ফুটতে থাকে; তারপরে একসময়ে ওই অত বড়ো হ্রদটার সমস্ত জল বাস্প হয়ে উবে যায় আকাশে। আকাশে উঠে ভাসতে থাকে মাইলের পর মাইল পুরু মেঘের স্তরের মতো। সেই নিবিড় মেঘে সমস্ত জায়গাটা অন্ধকার হয়ে যাবার কথা, কিন্তু তা যায়নি। কেননা, ওই হ্রদের সমস্ত জল চলে যাবার পরও সেখান থেকে বেরোতে থাকে ঝলকে ঝলকে আগুন।
প্রায় সাতদিন ধরে চলে এই কাণ্ড। তারপর সেই আগুন স্তিমিত হতে হতে একসময় আবার ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
তারপর বিজ্ঞানীরা শুরু করেন তাঁদের কাজ। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেন, চোবাটোকা সাধারণ পাহাড় নয়—আসলে ওটা একটা বিরাতা আগ্নেয়গিরি। কোন আদ্যিকালে ওটা সজীব ছিল কেউ জানে না কেননা, পৃথিবীতে হয়তো তখন প্রাণেরই আবির্ভাব হয়নি। ওই অঞ্চলটি তো এখনও আগ্নেয়গিরি বেল্ট বলে পরিচিত সে যুগে হয়তো ওরকম আরও ছিল। খোদ ফুজিয়ামাই তো একসময়ে ছিল আগ্নেয়গিরি।
যাই হোক, চোবাটোকার উদ্গীরণ ধীরে ধীরে কমতে থাকে তারপর সে আগুন চিরকালের জন্য নিভে যায়। চাঁদের পাহাড়গুলোর মতো এও হয়ে দাঁড়ায় একটা মৃত আগ্নেয়গিরি। সেও কতকাল আগের কথা কে জানে!
চোবাটোকা নিভে যায় আর তার ওপরকার ক্রেটার অর্থাৎ জ্বালামুখটা একটা যোজনজোড়া গহ্বরের মতো পড়ে থাকে। তারপর তার মধ্যে জমতে থাকে বৃষ্টির জল। সেও কত লক্ষ বছর ধরে কে জানে! একটু একটু করে জমতে জমতে একসময়ে গহ্বরটি কানায় কানায় করে ভর্তি করে ফেলে সেই জল ওটি হয়ে দাঁড়ায় এক বিশাল স্বাদু জলের হ্রদ। লোকে তার নাম রাখে চোবাটোকা।
কিন্তু চোবাটোকা হ্রদটি যে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়েছিল তা কি সত্যি নিভে গিয়েছিল? না, একেবারে নিভে যায়নি। ঘুমন্ত অবস্থায় পড়েছিল বলা চলে। এক-আধদিনের ঘুম নয়, লক্ষ লক্ষ বছরের ঘুম
কিন্তু পৃথিবীর ভেতরটা তো কোনদিনই শান্ত নেই। দিনরাত কত কাণ্ডকারখানা চলছে সেখানে; ভূমিকম্পে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে কত জায়গা! চোবাটোকা পাহাড়ের নিচেও যে এইরকম ভীষণ কাণ্ড চলছিল, তা কে জানত? আর কতদিন আগে থেকে তাও তো জানা সম্ভব ছিল না।
তারপর হঠাৎ যেন তার ঘুম ভাঙে তার ভেতরকার আগুন নতুন উদ্যমে একটু একটু করে আবার বেরিয়ে আসবার পথ খুঁজে নেয় তারপর সুযোগ বুঝে হঠাৎ একদিন শুরু হয়ে যায় তার অগ্নি-উদগীরণ। আর এমনি মজা, ঠিক যেদিন সে আগুন হ্রদের জল ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এল সেই দিনই কিনা চট্টরাজমশাইরা গেলেন হ্রদে নৌকো বিহারে!
অগ্নি-উদগীরণের ফলে কী ঘটল সে কথা তো আগেই বলা হয়েছে। প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে আশেপাশের সমস্ত অঞ্চল লণ্ডভণ্ড করে আবার তার আগুন নিভে গেছে। চোবাটোকা আবার ঘুমিয়ে পড়বে। কে জানে এটিই তার শেষ ঘুম কি না নাকি কুম্ভকর্ণের মতো আবার একদিন তার ঘুম ভাঙবে?
বিজ্ঞানীরা নানা হিসেবপত্র করে মনে করছেন, যদি কোনদিন সে আবার জাগেও তা হলেও দুলক্ষ বছরের আগে আর নয়। ততদিনে হয়তো বৃষ্টির জল জমে ওর জ্বালামুখের গহ্বরে তৈরি হবে আরেকটি হ্রদ। অবশ্য সেই দূর ভবিষ্যতে সেই হ্রদে নৌকো নিয়ে ভাসবার মতো কোনও মানুষ টিকে থাকবে কি না কে জানে
_____

(গল্পটি নেওয়া হয়েছে ছোটোদের পূজাবার্ষিকী ‘আনন্দ উৎসব’ নামক গল্প সংকলন থেকে। উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত। সম্পাদনায় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং রবিদাস সাহারায়। ১৪০১ বাংলা)

অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মন্ডল

2 comments:

  1. এ লেখাতে লেখকের নাম না থাকলেও বুঝতে পারতাম এটা ওনারই লেখা। ওনার লেখা যে কটা গল্প পড়েছি, তার সবকটাতেই বিজ্ঞানই প্রধান, কল্পনার জায়গা খুব কম। ভালো গল্প।

    ReplyDelete
  2. আপনাদের কাছে আনন্দ উতসব বইটির পিডিএফ আছে?

    ReplyDelete