প্রবন্ধ:: কোথায় গেল তারা? - কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

কোথায় গেল তারা?
কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

পৃথিবী। আমাদের বাসস্থানসসাগরা, সুজলা সুফলা, শস্যশ্যামলামহাকাশের নিরিখে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথের সূর্য নামক এক নক্ষত্রের জগতে একটি গ্রহমাত্র। অথচ আমাদের কাছে কী বিপুল আর বিচিত্র তার পরিচয়! একদিকে সে বুকে ধরে আছে আগুন ঝরানো মরুভূমি আর বরফ গলানো পর্বতশ্রেণী, অন্যদিকে আবার গভীর গহন অরণ্য আর অতল অপার সমুদ্র। সব মিলিয়ে যেন এক অজানা রহস্যের হাতছানি। কোটি কোটি বছর ধরে একটু একটু করে পৃথিবী সাজিয়ে তুলেছে নিজেকে, আর সেই সঙ্গে মানুষের সামনে মেলে ধরেছে অদ্ভুত অজানা সব রহস্যের ভান্ডার
সেইসব রহস্যের অনেক সমাধান আজকের বিজ্ঞানীরা করে ফেললেও এমন কিছু রহস্য আজও অজানা রয়ে গেছে, যার কোনও ব্যাখ্যা আজও কেউ দিতে পারেননিকোনও যুক্তি বা বিজ্ঞান দিয়ে যার কোনও সমাধান করা সম্ভব হয়নি আজওযেমন, বারমুডা ট্র্যায়াঙ্গলের রহস্য, কিংবা ঈস্টার দ্বীপ বা পিরামিড সৃষ্টির রহস্য, অথবা লকনেস হ্রদের দৈত্যের রহস্য, এরকম অদ্ভুত কিছু ব্যাপার মানুষের কাছে আজও রয়ে গেছে রহস্যাবৃত
আজ ঠিক তেমনই এক রহস্যের সন্ধানে আমাদের যাত্রা, পৃথিবীর অন্য অনেক রহস্যের মতোই যার কোনও কিনারা করা সম্ভব হয়নি আজওমানুষের সমস্ত বুদ্ধি, সমস্ত বিজ্ঞান হার মানতে বাধ্য হয়েছে এই রহস্যের কাছে

সময়টা ১৯৩০ সাল কানাডার কিভালিক অঞ্চলের আনজিকুনি হ্রদের ধারে একটি শান্ত নিরিবিলি গ্রাম আনজিকুনিএখানকার বাসিন্দারা সবাই ছিল এস্কিমোতুষারাবৃত এই অঞ্চলে তারা তাদের নিজেদের নিয়েই বাস করত নির্ঝঞ্ঝাটেকিন্তু নভেম্বরের এক সুন্দর ভোরে ফার সংগ্রহকারী জো লেবেল সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, গোটা গ্রামে কোনও মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে নাসারা গ্রামটা যেন মৃত্যুপুরীর মতো খাঁ খাঁ করছেপ্রায় ২০০০ থেকে ২৫০০ এস্কিমো বাস করত সেই গ্রামেকিন্তু আজ জনশূন্য সেই গ্রামে একটা মানুষেরও চিহ্ন নেই কোথাও। গ্রামশুদ্ধ লোক এক নিমেষে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে!
এ কী ব্যাপার! কোথায় গেল গোটা গ্রামের লোক? আর একসঙ্গে সবাই মিলে? এ কি ম্যাজিক নাকি? সঙ্গে সঙ্গে খবর গেল স্থানীয় প্রশাসনের কাছেতাঁরা তৎক্ষণাৎ লোকজন পাঠিয়ে অনুসন্ধানের ব্যবস্থা করলেনকিন্তু না, শুধু সেই গ্রামে কেন, আশেপাশে কোথাও একটি লোকেরও কোনও চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল নাঅথচ তাদের বাড়িঘর, ব্যবহার্য জিনিষ, তাদের বন্দুক, এমনকি পাত্রভরা খাবার ও পানীয় পর্যন্ত যেমন কে তেমন রয়েছে, শুধু মানুষগুলোই যেন কোন মন্ত্রবলে হাওয়ায় উবে গেছে
অনেকে প্রথমে ভেবেছিলেন যে হয়তো গ্রামের লোকেরা সবাই মিলে গণ-আত্মহত্যা করেছেতাই গ্রামের পাশে কবরখানাতেও খোঁড়াখুঁড়ি করার ব্যবস্থা হলকিন্তু কবরগুলো খোঁড়ার পর ব্যাপার দেখে কর্তৃপক্ষের চোখ আরও কপালে উঠে গেলকোনও কবরেই মৃতদেহ নেই। মাটির তলা থেকে কবরস্থ লাশগুলোও রাতারাতি হাওয়াতে মিলিয়ে গেছেঅর্থাৎ, আনজিকুনি গ্রামের সমস্ত জীবিত লোক এবং সমস্ত মৃতদেহগুলো কোনো এক অজ্ঞাত কারণে আকস্মিকভাবে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেছে!
আশেপাশের কিছু গ্রামের মানুষ দাবী করেছিল যে রাতের অন্ধকারে তারা নাকি কেমন একটা অদ্ভুত নীল আলো দেখতে পেয়েছে আকাশেকিন্তু তার কোনও ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর পুলিশের তদন্তে শেষপর্যন্ত এই রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে যে, জো লেবেল ওই জনশূন্য গ্রাম আবিষ্কার করার অন্তত দু’মাস আগে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাস থেকেই সম্ভবত গ্রামটি জনশূন্য ও পরিত্যক্ত হয়ে গেছেকিন্তু এর বেশি আর কিছুই জানা যায়নি এবং তারপর থেকে আজ এই এত বছর পর পর্যন্তও সেই হারানো মানুষগুলোর কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি


ঠিক এইরকমই আর একটা ঘটনা। সেটা আরও কিছুদিন আগেরএবার আর চোখের আড়ালে নয়, দিনের আলোয় জলজ্যান্ত কিছু লোকের চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটে। ১৮৮৫ সালে তদানীন্তন ফরাসি ইন্দো চায়না, বর্তমানে যার নাম ভিয়েতনাম, সেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল
অঞ্চলটা তখন ফরাসিদের অধীন ছিলএকদিন সাইগনের দিকে যাচ্ছিল প্রায় ছ’শো জন ফরাসি সৈন্যের একটা দল অঞ্চলের অধিবাসীরা অনেকেই লক্ষ করছিল তাদেরএগিয়ে যেতে যেতে যখন তারা তাদের ক্যাম্প থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে, তখন ফাঁকা মাঠের মধ্যে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর চোখের সামনে সেই ছ’শো সৈন্যের বাহিনী হঠাৎ শূন্যে মিলিয়ে গেল!
বিস্ময়ে আর আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন সেই প্রত্যক্ষদর্শীরাবারবার চোখ রগড়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করেন তাঁরা। তারপর ছুটে যান সেই মাঠে। না, কেউ কোথাও নেইবিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই সেই ছ’শো সৈন্যেরযেন কোনও এক জাদুকরের হাতের ইশারায় এক পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ছ’শো মানুষ
এ কেমন করে সম্ভব? কোথাও তো কোনও যুদ্ধের আভাস নেই! রাস্তায় মাইনস্‌ পোঁতা নেই কোথাও, অথবা কামান-বন্দুক নিয়ে কেউ আক্রমণও করেনি। তাহলে কোথায় কীভাবে পলকে উধাও হল এতগুলো মানুষ?
এই ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল চিনের নানকিং প্রদেশে, ১৯৩৯ সালে। এবার সংখ্যা আরও বেশিএকসঙ্গে প্রায় তিন হাজার চিনা সৈন্য হঠাৎ মিলিয়ে যায় হাওয়াতে
তারিখটা ছিল ১০ই ডিসেম্বরবিকেল তিনটের সময় সেই তিন হাজার চিনা সৈন্যের বাহিনীকে শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া যায়। তারপর থেকেই তারা উধাওতাদের সঙ্গে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরেরদিন ভোরে তাদের খোঁজে যখন কর্নেল লি ফু সিয়েন সেখানে আসেন, তখন আবিষ্কার করেন যে, সেই তিন হাজার সৈন্যের গোটা বাহিনীটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছেআর কোনও হদিশই পাওয়া যায় না তাদেরআর আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, তারা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলেও তাদের সঙ্গের অস্ত্রগুলোকে কিন্তু পাওয়া যায় অবিকৃত অবস্থায়শুধু সেই তিন হাজার মানুষের কোনও চিহ্ন কোথাও নেই
সেই সময় চিন-জাপানে যুদ্ধ বেধেছিল এবং জাপান সেই সময়েই নানকিং শহর আক্রমণও করেছিল। তাই চিন সরকার প্রথমে ভেবেছিলেন যে জাপান হয়তো হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের বন্দী করে নিয়ে গেছে কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, ঐ তিন হাজার চিনা সৈন্যের ব্যাপারে জাপান কিছুই জানে না, তাদের কাউকেই তারা বন্দী করেনি
তাহলে? কোথায় গেল তারা? কীভাবে এমন অকস্মাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে একসঙ্গে এতগুলো মানুষ? কী রহস্য আছে এর পেছনে?
এবার অন্যকিছু ঘটনা দেখা যাকশুধু দলবদ্ধ লোকই নয়, অনেক সময় দেখা গেছে, একজন মানুষ একা একাই হঠাৎ হারিয়ে গেছেন কোথায়, সারাজীবনে আর তাঁদের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নিতাঁরা আর কখনোই ফিরে আসেননি তাঁদের প্রিয়জনদের কাছেএরকম ঘটনা সংবাদপত্রে বা টিভিতে অনেক দেখা গেছেতাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো এই পৃথিবীতেই অন্য কোথাও চলে গেছেন, তবুও তার মধ্যে কিছু মানুষ কিন্তু অকস্মাৎ হারিয়ে গেছেন অন্য কোথাও, হয়তো অন্য কোনও জগতে, যে জগতের খোঁজ আজও পায়নি বুদ্ধিমান মানুষ জাতি
যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড লন নামে এক অবস্থাপন্ন কৃষক১৮০৮ সালের এক সন্ধ্যায় ফার্ম হাউসে বসে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে গল্প করতে করতে তিনি উঠে গেলেন তাঁর বাড়িতে কিছু আনার জন্যেবাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আর তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল নারাস্তা থেকেই উধাও হয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোকতারপর থেকে কোনওদিনই আর তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি
কিংবা ১৯৭৫-এর সেই অ্যালেন জনস্টনের ঘটনাতাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে প্রমোদ ভ্রমণে গেলেন উত্তর মেরুতেএকদিন তাঁরা যখন একটি উপত্যকায় মনের সুখে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ছবি তুলবেন বলে অ্যালেন এগিয়ে গেলেন সামনে। সেদিকে রাশিয়ার সীমান্তপেছনে খানিকটা দূরে স্ত্রী ক্রিশ্চিন দাঁড়িয়েছিলেনকিন্তু একটু পরেই দেখা গেল, অ্যালেনকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে নাভয়ে ক্রিশ্চিনের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেলতিনি চারপাশে খোঁজাখুঁজি করলেন, চিৎকার করলেন স্বামীর নাম ধরে, কিন্তু অ্যালেন আর ফিরে এলেন নাতিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন চিরদিনের মতো
এ কী ভৌতিক কান্ড! না কি অলৌকিক? অশুভ কোনও শক্তি কি এর পেছনে কাজ করছে? নাকি অজানা অচেনা মহাকাশের বুক থেকে কোনও গ্রহান্তরের জীবেরা এসে এক লহমায় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে জীবিত বা মৃত মানুষদের?
যাই হোক না কেন, মোট কথা, এইসব প্রশ্নের কোনও সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নিঅনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, অনেক গবেষণা হয়েছেকিন্তু আজও পৃথিবীর নানা প্রান্তের প্রশাসন, বিজ্ঞানীর দল বা গোয়েন্দাবাহিনী খুঁজে চলেছেন সেই অবাক করা রহস্যের জবাব – কীভাবে আর কেন এইসব মানুষেরা চিরতরে অদৃশ্য হয়ে গেল? কোথায় গেল তারা?
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

2 comments:

  1. চমকপ্রদ সব ঘটনা! ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  2. বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্যের ব্যাপারে জানা, পড়া। কিন্তু এই ঘটনাগুলি নতুন জানলাম। চমকপ্রদ। তার সাথে ভয়াবহও বটে। মাচুপিচুতে ইনকাদের সাথেও মনে হয় এরকমই কিছু ঘটেছিল। যদিও সঠিক জানিনা।

    ReplyDelete