গল্পের ম্যাজিক:: অদ্ভুতুড়ে - ঈশানী রায়চৌধুরী


অদ্ভুতুড়ে
ঈশানী রায়চৌধুরী

আজ খাসা আছি নিঝুম একা বাড়ি ফাঁকা কেউ নেই এমনটা অনেকদিন পর মাঝে মাঝে নেহাত মন্দ লাগে না খেলাম ইচ্ছে হলে; না খেলেও চলে কিংবা বিছানা অমনি রইল ঘুম পেলে কোনক্রমে একটু সরিয়ে শুয়ে পড়লেই হয় মাঝ রাত্তিরে ভাবছি বড় এক মগ চা বানিয়ে সুরুত সুরুত করে চুমুক মারব কাল অনেক বেলা পর্যন্ত খবরের কাগজ লাট খাবে দরজার বাইরে
কোথায় গেল? নাকি মরে টরেই গেল? কাগজ আসার আগেই যে কিনা পারলে কাগজ তোলে দরজা খুলে ...সবাই ভাববে তার হল কী!
আজ রাত্তিরে ওরা এলে বেশ হয় ধাড়ি আর কাচ্চাবাচ্চা অনেক কাল বাদে এমন একা আছি দরজার দিকে তাকিয়েছি; দেখি পর্দা ধরে কাঁচুমাচু মুখে জুলজুল চোখে দেখছে
দিদি আসবো?
ও মা, আসবে বই কি ভাইটি আমার তা একা নাকি?
না না, বে'র নেমন্ত করতে এলুম ফুল ফেমিলি পাশের পাড়ার (পড়ুন বেলগাছের) দাদুও এয়েছেন।”
       “বেশ বেশ ভেতরে এস।”
       “আলোটা এট্টু কমায়ে দ্যান চোখে বড্ড নাগতিছে।”
       “কে বললে কথাটা? ও মা, তুমি কে গা ভালোমানুষের ঝি?
       “এই, দিদিকে পেন্নাম কর! দিদি, ও হল জলার পেত্নী আমাদের ছোট খোকাডারে খেলা দেয়।”
       “পেঁচোকে? তা বেশ করেছ ওর মায়ের কী সে ফুরসত আছে? সে বড়মানুষের বিটি তো লালপেড়ে শাড়ি পরে মাছের সেন্ট ঢেলে পটের বিবি সেজে আশশ্যাওড়া গাছে বসে ঠ্যাং দোলাবে আর মানুষজনের হাতের ইলিশমাছের দিকে নোলা দেবে বউ মানুষ, একটু হায়া পিত্তি নেই!
       পাশ থেকে এক ছোকরা ফুট কাটল, আবার উল্টো গোড়ালি জুড়ে আলতা পরার শখ
       আমি তো তাজ্জব!
       “এটা কে? আগে তো দেখিনি?
       “উটি আমাদের সেজকাকার ছেলে মামদো গো সেজকাকা সেই কলমা পড়ে নুরুন্নেসাকে বে' কল্ল, বামুন তো আর রইলনি ঠাকুদ্দা মরার, থুড়ি, জম্ম নেবার পর আবার আমাদের পরিবারে মিলমিশ হয়ে গ্যাচে গাচের মগডালের ফেলাটে থাকি আমরা ঘাড় উঁচু কল্লেই আকাশ আকাশের কি আর জাত হয় গো? মাটির সীমানা  ঠাওর করা যায় কিন্তু আকাশের?
       “তা পাশের বাড়ির দাদুকে ডাক আর বিয়েটাই বা কার?
       “শাঁকচুন্নির আমার মেজো বোনের তুমি তো সেই কোন না ছোটটি দেকেচ এখন কেমন ডাগরডোগর চ্যায়রা, ফালুকফুলুক চাউনি, চ্যাটাংচ্যাটাং কতা।”
       “বাঃ বাঃ, তা পাত্তরটি কে?”
       “এন আর আই সায়েবও বলতি পারো কী গোরাপানা! অন্দকারে ঝিলিক দ্যায় পুরো।”
       “ওই ফ্যাশনের রেজেস্টারি বিয়ে নাকি? তাহলে আমি বাপু যাব না।”
       “না গো না আমাদের একটা ফেমিলি পেস্টিজ আচে না! হিঁদু মতে হবে।”
       দাদু খড়ম পায়ে, খেটো ধুতি আর খালি গায়ে পরিপাটি করে সাজিমাটি দিয়ে মাজা পৈতে ঝুলিয়ে জাঁকিয়ে বসল খাটে ওই সব অসৈরণ আমি মরে থাকতে হবার নয়নিজে মন্তর পড়ে শাস্তর মতে বে' দেব।”
       জট পড়া এলো চুলে ঝাপট মেরে পেঁচোর মা বলল, ও দিদি, এট্টু চা কর না!
       “আমি আধ হাত লম্বা জিভ কেটে বললাম, ছি ছি এই করছি তা সবাই নরমাল চা তো?
       পেঁচোর বাপ বলল, আমার জন্যি বেস্ত হতি হবেনি কো চা ফা খেলি রেতেরবেলায় ঘুমের পব্লেম হয় নিজের বেবস্তা নিজের নিয়েই এসিচি,” এই বলে স্যাট করে স্রেফ শূন্য থেকে একটা লালসুতো বাঁধা বিড়ির বান্ডিল আর দেশলাই বের করল
       দাদু বলল, আমার ডাইবিটিস চিনিটা আর দিওনি।” মামদো আর পেঁচোর মা আর মাসি গুছিয়ে বসেছে (শিক্ষেদীক্ষে ভালো এদের ঘরে আহা পেঁচোর মাসি ছেলেকে খেলা দেয়, দেখেশুনে রাখে .. সে তো মায়ের মতোই হল, নাকি? পেঁচোকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে হবেই তো! মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি) ..ওরা তিনজন নরমাল চা
       পেঁচো বলল, আমি আইসকিরিম খাব” কী ভাগ্যি, ফ্রিজে ছিল! নইলে ঘরে অতিথি, আমি বেইজ্জত হয়ে যেতাম! ছেলেমানুষ, মুখ ফুটে খেতে চেয়েছে! পেঁচোটা যে কী মিষ্টি হয়েছে বড্ড আদরকাড়া আহা, চেনা অচেনা নেই মোটে! আমাকে কদ্দিন পরে দেখল! তবু কোলের কাছটি ঘেঁসে বসা চাই খুদে খুদে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সর্দি মুছতে গিয়ে সারা হাতে মাখছে, আবার ওই হাতেই আইসকিরিম তুলে খাচ্ছেওসব সাহেবী চামচ টামচের ফালতু কেতা নেই
       দিব্যি বিয়ের কার্ড হয়েছে বর কনের নেই-ছবি দিয়ে ব্যবস্থাপত্র ভালো ফরেন চলে যাবে.. কিচ্ছুটি নিচ্ছে না ছেলে শুধু মেয়ের ক'টা শখের শাড়ি আর সাজের জিনিস আমি তো কথা দিয়েই দিয়েছি, যাব আমাকে তো যেতেই হবে বরকে বরণ করা থেকে কনেবিদায় .. আমি ছাড়া ওদের গার্জেন বলতে আর আছেটাই বা কে? এরা সব্বাই কিন্তু খুব ভালো বড্ড ভালোবাসে আমাকে তবে সব সময় তো আসতে পারে না! আমার দু:খ কষ্ট বোঝে বলেই রেখেছে, কিচ্ছুটি ভেবোনি, তোমার জন্য ওই নারকোল গাছের ওপরের ফেলাটটা সাজ্যেগুজ্যে রাকা আচে তোমাকে আমরা মাতায় করি রাকব।”
       সে তো রাখবে জানি দারুণ ফ্ল্যাট! পেন্টহাউজ আমি থাকি না তো কী! ওরা ঝেড়েমুছে সাফ করে রাখে চাদ্দিক খোলা হু হু করে হাওয়া নেই -দেওয়াল ঝিরিঝিরি সবজে আর নেই-ছাদ নীল রঙের সিঁড়ি পাটকিলে কিন্তু এখন যাব কী করে! সংসার খানিক না গুছিয়ে হুট করে অমন যাওয়া যায়? আমি অবিশ্যি ফ্ল্যাটের কথা বাড়িতে বলিনি শুনলেই নারকোল গাছ কেটে ভুষ্টিনাশ করবে এমনিতেই তো হরবখত শুনি আমার নাকি মাথার ব্যামো আ মোলো যা! এই মাথার ব্যামো নিয়েই যেন সাতগুষ্টির কাজ উদ্ধার করছি না!
       এখন বিয়েবাড়ি যাব কী করে তাই ভাবছি এরা তো নেমন্তন্ন করে চলে গেল ইস, পেঁচোটার জন্যে মনটা বড্ড পুড়ছে! যাবার আগে আঁচল বেয়ে কোলে উঠে কেমন টুক করে হামি খেল গালে দূর ছাই, এত লুকোছাপা আর ভাল্লাগে না! এদের চোদ্দগুষ্টির আত্মীয়কুটুম এলে এস জন, বোসো জন করতে পারি, আর আমার আপনার লোক এলে লুকোছাপা? কেন? আমার এমনি জীবন যে এক মুহূর্ত ছুটি নেই সংসার থেকেপান থেকে চুনটি খসেছে কী সামাল সামাল রব এখন যাই কী করে তাই ভাবছিবিয়েটা যেন কবে? এই তো! দিন পনেরো সময় আছে ম্যানেজ করতে হবে ওই দিন সন্ধে থেকে পেট ব্যথার ছুতোয় শুয়ে থাকব দোর দিয়ে, ঘর অন্ধকার করে তারপর ওদের খবর পাঠালে ঠিক এসে আমাকে খানিকক্ষণের জন্যে নেই করে জানলা দিয়ে বের করে নিয়ে যাবে ঘন্টা দু চার.. কোন ব্যাপার না! এমন তো আগেও কতবার...
       চোখটা বুঝি লেগে এসেছিল একটু ইস! উঠতে কত বেলা হয়ে গেছে বাড়ির সবার ফেরার সময় হল এসেই তো হুকুম মারবে, “সারারাত বাসজার্নি করে এলামচা বসাও, টোস্ট বানাও।” এই রে! দরজার ঘন্টি বাজল না? উফ, এসে গেছে! আমার সংসারের জ্যান্ত ভূতগুলো!
_________
ছবি - নচিকেতা মাহাত

লেখক পরিচিতি - পড়াশোনা রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স নিয়ে। তবে প্রথম প্রেম সাহিত্য। তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত। ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক, বিশেষ করে ছোট গল্প, টুকরো গদ্য আর কবিতা

2 comments: