ভৌত সংবাদ:: অশরীরীর কান্না - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়


অশরীরীর কান্না
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

গভীর রাতে ওরা আসে। কখনও ঘুঙুরের টুং টাং আওয়াজ, কখনও কান্না আবার কখনও অট্টহাসি দিয়ে জানান দেয় ওরা এসেছে। আলো-আঁধারি রাতে ওদের ঠিকমতো দেখা যায় না। তবে বোঝা যায় ওরা এসেছে। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের গল্প অনেক শুনেছি, পড়েছিও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভূতুড়ে বাড়িগুলোতে ওরা থাকে। আমাদের দেশেও এরকম অনেক বাড়ি আছে। কলকাতা শহরেও একসময় অনেক ভূতুড়ে বাড়ি ছিল। তখন তাঁরা সেখানে মহানন্দেই থাকত। তবে বর্তমানে তাঁদের এই শহরে দেখা পাওয়া মুশকিল।
দু’তিন দশক আগেও কলকাতা শহরে দু’চারটে হানাবাড়ি বা পোড়োবাড়ির দেখা পাওয়া যেত। জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে সেসব বাড়ি ভাঙা পড়েছে। সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বহুতল বাড়ি। ঝাঁ চকচকে বাড়ি ভূতেরা তেমন পছন্দ করে না। তাই বলা যায়, কলকাতার ভূতেরা আজ গৃহহারা। যতই সূক্ষ্ম শরীর হোক না কেন, থাকার জন্য ন্যূনতম একটু জায়গা দরকার হয়ই। কলকাতা শহরে এখন মানুষেরই থাকার জায়গার অভাব, ভূতেদের ঠাঁই হবে কোথা থেকে! তা সত্ত্বেও এখনও যে দু’চারটে পুরনো বাড়ি এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেখানে গেলে ওদের সঙ্গে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে। যাবে নাকি ওদের সঙ্গে দেখা করতে?

এরকমই একটা বাড়ি আছে গার্স্টিন প্লেসে। এই বাড়িতে প্রথম দিকে আকাশবাণীর অফিস ছিল। শোনা যায়, পুরনো দিনের বহু শিল্পী নাকি রাজপোশাকে এক সুদর্শন ব্যক্তিকে এই বাড়িতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। প্রথম দিকে তাদের মনে হয়েছিল কোনও নাট্যগোষ্ঠীর শিল্পী শো শেষ করে ছুটে এসেছেন কোনও নাটকের অনুষ্ঠানের রেকর্ড করতে। তাড়াহুড়োয় হয়তো পোশাক পাল্টানোর সময় পাননি! কিন্তু দিনের পর দিন ওই একই ব্যক্তিকে ঘুরে বেড়াতে দেখে তাদের মনে সন্দেহ জাগেকোনও নাট্যশিল্পীই তো! না মহারাজ নন্দকুমারের অশরীরী?


নন্দকুমারে ইতিহাস সকলেরই জানা। তাই এখানে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। যাদের জানা নেই তাদের জন্য সংক্ষেপে বলা যেতে পারে। বর্ধমানের দেওয়ান ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। কাউন্সিল মেম্বার ফিলিপ ফ্রান্সিস হেস্টিংসকে পছন্দ করতেন না। তিনি হেস্টিংসের নানা দুর্নীতির খবর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পৌঁছে দিতেন। অন্যান্য কাউন্সিল মেম্বারদের মধ্যে বার্ক ও মেকলে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরাও হেস্টিংসের কাজকর্ম সমর্থন করতে পারছিলেন না। এনাদেরই সুপারিশে এবং কিছুটা চাপে কোম্পানি ১৭৬৪ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে দেওয়ানের পদ থেকে সরিয়ে মহারাজ নন্দকুমারকে ওই পদে বহাল করেন। নন্দকুমার ছিলেন অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি। কোনওরকম দুর্নীতি তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। ফ্রান্সিস-এর মদতে ইনি হেস্টিংসের বিরুদ্ধে নানা অপকীর্তির অভিযোগ দায়ের করেন। হেস্টিংসও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। ফ্রান্সিস তাঁর পয়লা নম্বর শত্রু ছিলেন। এবার মহারাজ নন্দকুমারও সেই তালিকায় যুক্ত হলেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এলিজা ইম্পে ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর পরামর্শে এবং মদতে হেস্টিংস নন্দকুমারকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করতে লাগলেন। সেইমতো হেস্টিংস নন্দকুমারে বিরুদ্ধে জালিয়াতির মিথ্যে অভিযোগ আনলেন। বিচারক ইম্পে। অতএব বিচারের নামে যে প্রহসন হবে সকলেই বুঝতে পারলেন। হলও তাই। নন্দকুমারের হিতৈষীদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। ইম্পে ফাঁসির হুকুম দিলেন। ১৭৭৫ সালে মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি হয়। পরবর্তীকালে বার্ক ও মেকলেসহ কাউন্সিল মেম্বারদের একাংশ ইম্পে এবং হেস্টিংসের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। ফলস্বরূপ ইংল্যান্ডে হেস্টিংসের বিচার হয়েছিল। সেই ইতিহাসও আমাদের জানা।


মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি হয়েছিল কোথায়? এ নিয়ে মতভেদ আছে। কারও কারও মতে গার্স্টিন প্লেসের সেই বাড়িতে যেখানে আকাশবাণী কলকাতার পুরনো অফিস ছিল। আবার কারও কারও মতে বি.বা.দী. বাগের কাছে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট-এর বাঁ হাতে যে ছোটো রাস্তাটা বেরিয়েছে সেই ফ্যান্সি লেন-এ। একে অবশ্য রাস্তা না বলে গলি বলাই ভালো।

কলকাতা শহরের পত্তন করেছিল জব চার্ণক (যদিও এ নিয়ে মতভেদ আছে)। তিনশ বছর ধরে এই শহরের  সীমানা যেমন বেড়েছে তেমন বেড়েছে পথের সংখ্যা। ক্রমবর্ধমান শহরের বড়ো বড়ো রাস্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানে বেড়েছে গলির সংখ্যা। উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার সর্বত্রই গলি তথা লেনের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন রাস্তার যেমন নাম আছে এইসব গলিরও তেমন নাম আছে। পুরনো গলিগুলির মধ্যে ফ্যান্সি লেন অন্যতম। অফিস পাড়া অর্থাৎ বি.বা.দী বাগে যাদের যাতায়াত আছে তারা সকলেই এই গলিটির নামের সঙ্গে পরিচিত। বর্তমানে গলিটিকে দেখে বোঝাই যাবে না যে একসময় এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত একটি পশ্চিমগামী খাল যা গিয়ে মিশেছিল গঙ্গার সাথে। ‘ফ্যান্সি লেন’ নাম শুনলেই মনে হয় কলকাতা শহরে যত গলি আছে তাদের মধ্যে সবথেকে সুন্দর গলি এটি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। স্বজনহারা মানুষের অশ্রুজলে সিক্ত এই গলি বহন করে চলেছে বিভীষিকাময় স্মৃতি।
জব চার্ণকের আমলে কোনও অপরাধীর শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোররাস্তার ধারে কোনও বৃক্ষসংলগ্ন ফাঁসিমঞ্চে ফাঁসি দেওয়া হত এইসব অপরাধীদের। তারপর ঝুলিয়ে দেওয়া হত তাদের দেহ সেইসব গাছের ডালে। ফ্যান্সি লেনেও ছিল এইরকম একটি ফাঁসিমঞ্চ যেখানে বহু ভারতীয়কে ঝুলতে হয়েছিল ফাঁসির দড়ি গলায় পরে। আর্চ্চডিকন হাইডের মতে ফাঁসি শব্দ থেকেই ফ্যান্সি লেনের ‘ফ্যান্সি’ কথাটির উৎপত্তি।
আজ আর সে দিন নেই। নেই সেই ফাঁসীমঞ্চ। গলির দু’পাশে উঠেছে বড়ো বড়ো বাড়ি। পাল্টে গেছে সমাজ ব্যবস্থা। তবুও আজও অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ফ্যান্সি লেন তার নামের মধ্য দিয়ে। শোনা যায়, গার্স্টিন প্লেসের ওই বাড়িতে মহারাজা নন্দকুমারের অশরীরী যেমন বারবার ফিরে আসে তেমন শীতের রাতে চারিদিক নির্জন হয়ে এলে ফ্যান্সি লেনে কারা যেন জেগে ওঠে। শোনা যায় তাদের কান্না। সান্ত্বনা দিতে মহারাজা নন্দকুমারও নাকি সেখানে চলে আসেন। গম্ভীর গলায় বলেন, ‘দেখ তোমাদের মতো আমাকেও ওরা অন্যায়ভাবে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়েছিল।’ এরপরেই চারদিক নিঃশব্দ, নিঝুম হয়ে যায়।
তেঁনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে নাকি কোনও এক নির্জন শীতের রাতে ফ্যান্সি লেনে অথবা গার্স্টিন প্লেসের সেই পুরনো বাড়িতে?
________
ছবি – আন্তর্জাল

লেখক পরিচিতি - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। তাঁর লেখা বইগুলি পাঠক মহলে ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায় দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ এবং রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারের আজীবন সদস্য। বর্তমানে তিনি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সহ সভাপতি। জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য। এছাড়াও তিনি আরও অনেক পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে বিজ্ঞানের অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিত অংশ গ্রহণ করে থাকেন। দ্য সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল শ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২০০৫ সালে গোপাল ভট্টাচার্য স্মৃতিপুরষ্কার প্রদান করেন। লেখকের সম্পর্কে আরও জানতে হলে এই ব্লগে যেতে হবে Blogsite: kbbwriter.wordpress.com
_____

1 comment:

  1. বেশ ভালো লাগল। তবে কান্নার উৎস জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

    ReplyDelete