বিজ্ঞান:: এঁদো ডোবার লায়লা-মজনু - সৌম্যকান্তি জানা


এঁদো ডোবার লায়লা-মজনু
সৌম্যকান্তি জানা

নভেম্বর মাসের মিঠে রোদ গায়ে মেখে বসেছিলাম রাস্তার উপর। শীতের উত্তুরে হাওয়ার তখনও শরীরে কামড় দেওয়ার মতো শক্তি হয়নি। সকাল থেকেই কর্মযজ্ঞ চলছিল। মানে আমার হবু গৃহের প্রাচীর নির্মাণের কাজ চলছিল। আমার জায়গাটি মাটি দিয়ে ভরাট করা বাস্তুভিটে হলেও সীমানার পশ্চিম দিকে নিচু জলাজমি। তবে জলাজমি না বলে অগভীর ডোবা বলাই ভালো। কচুরিপানা আর হোগলা পাতায় ভরা সেই জলাজমি। জলনিকাশি ব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ায় বর্ষা বিদায় নেওয়ার দুমাস পরেও সেখানে মাটির উপর প্রায় একফুট জল।

জল থাকার জন্য পাঁচিলের কাজ শুরু করা যাচ্ছিল না। কারণ ভিত তৈরির জন্য গর্ত খুঁড়লেই হু-হু করে জল ধেয়ে এসে এক মিনিটের মধ্যেই জলে ভরে যাচ্ছিল। তাই সেদিন সকালে ওই জলাজমি থেকে জল সরানোর জন্য একটা পাম্পিং মেশিন এনে বসিয়েছি। সেদিন মানে ২০১৪ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখ। একদিকে জল সরানোর কাজ চলছে। অন্যদিকে রাজমিস্ত্রি ও জোগাড়েরা তাদের কাজ করছে। আর দুজন শ্রমিক মাটি কেটে ভিতের গর্ত তৈরি করছে। সব মিলিয়ে কর্মযজ্ঞই বলা যায়।

আশিস বলল, দাদা এখানে শোল-ল্যাটা থাকবেই। আশিস হল রাজমিস্ত্রি। গ্রামের ছেলে। সুতরাং মাছ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা কম নয়। তাছাড়া পানা ভরা ডোবা বা পুকুরে শোল, ল্যাটা, কই, মাগুর ইত্যাদি মাছ যে থাকতে পারে তা আমারও অজানা নয়। মনে মনে ভাবলাম, বেশ তো, যদি মাছ পাওয়াই যায় তো মন্দ কি? সেই ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে ধান কাটার আগে মাঠে মাছ ধরতাম। ধান জমির মাঝে যে সব জায়গা একটু নিচু থাকত জল শুকিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে মাঠের নানা মাছ এসে জড়ো হত। আমরা পেকে যাওয়া শীষসহ ধানগাছকে হাত দিয়ে দুদিকে সরিয়ে জমির আলপথ থেকে সেই নিচু জায়গা পর্যন্ত একটা রাস্তা বানিয়ে নিতাম যাতে যাওয়া-আসার সময় পাকা ধান শরীরের ধাক্কায় ঝরে না যায়। ধান জমির মাঝে ওই রাস্তা দেখলে মনে হত ঠিক যেন মাথার ঘন চুলের মাঝে কাটা সিঁথি। একটা ডিস আর হাঁড়ি নিয়ে চলে যেতাম সেই জল জমে থাকা নিচু জায়গায়। দেখতাম, আমার আগেই সেখানে মাছের খোঁজে হাজির হয়ে গেছে বক আর জলঢোঁড়া সাপ। তাদের হটিয়ে নিচু জায়গাটার সীমানা বরাবর কাদা দিয়ে একটা অস্থায়ী বাঁধ দিতাম। তারপর ডিস দিয়ে সেচে জল ফেলতাম ওই অস্থায়ী বাঁধের বাইরে। মাছেরা কল-কল করে ছোটাছুটি করত। শোল, ল্যাটা, কই, মাগুর, শিঙ্গি, পাঁকাল, বেলে, চ্যাং, ট্যাংরা, গুলে নানারকম মাছ পেতাম। কাদা মাখামাখি হয়ে মাছ নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম সে এক অদ্ভুত চেহারা হত। আমি বহুদিন গ্রামছাড়া। এই প্রৌঢ়ত্বে এসে একেবারে অবাঞ্ছিতভাবে শহরের মাঝে একফালি জলাজমিতে কি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে পাব আমার ছেলেবেলা?

ঘটঘট শব্দে মেশিন চলছে। জল গিয়ে পড়ছে রাস্তা পেরিয়ে ওপারে একটা পুকুরে। মাঠে জলের স্তর ক্রমশঃ নামছে। হোগলা গাছগুলো আর ভারসাম্য রাখতে না পেরে যে-যার গায়ে হেলে পড়ছে। তাগড়াই চেহারার কচুরিপানাগুলো ক্রমশঃ জল না পেয়ে থেবড়ে বসছে কাদামাটির উপর। পানার ভেতরে খাবারের খোঁজে থাকা তিন-চারটে ডাহুক পাখি নিরাপত্তার অভাব বোধ করে মনে হয় অন্যত্র খাবারের সন্ধানে উড়ে পালাল। মাঠের উঁচু জায়গাগুলো থেকে জল নেমে এসেছে। শুধু সামনে ডোবার মতো জায়গাটাতেই যা জল আছে। মেশিন-চালক বছর পনেরোর ছেলেটি মেশিন বন্ধ করে নেমে গিয়ে ওই ডোবা থেকে পানাগুলো টেনে সরিয়ে দিতে লাগল। পানা থাকলে মেশিনে জল উঠবে না। পানা সরতেই দেখলাম কালো কাদামাখা জল। কিন্তু মাছ কই? সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। শোল-ল্যাটা থাকলে লাফালাফি করবেই। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। তাহলে কি আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা একদিনের জন্যেও ফিরবে না? সকাল থেকে মানসচক্ষে যে কাদা মাখামাখি হয়ে শোল-ল্যাটা ধরার ধারাবাহিক পর্যায়ক্রম অবলোকন করেছি তার সামান্য অংশও বাস্তবায়িত না হওয়ার সম্ভাবনায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।

বকের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি ক্রমশঃ কমে আসতে থাকা জলের দিকে। হঠাৎ মনে হল ছোটো ছোটো কিছু মাছ ছরছর করে জল থাকে ডাঙ্গার দিকে উঠতে গিয়ে আবার জলের মধ্যে এসে পড়ল। দূর থেকে ঠিক ঠাহর করা যায় না। একটু বড়সড় সাইজের পুঁটি মাছ হতে পারে। কিন্তু পানাভরা এঁদো ডোবায় পুঁটি মাছ থাকার কথা নয়। ওরা স্বচ্ছ জলের বাসিন্দা। তাহলে? বাড়ি থেকে ছাঁকনি জাল এনেছিলাম। আশিসের সহকারী রবিকে সেই জালটা দিয়ে বললাম,ভাই, একবার নেমে গিয়ে ওখানে ছাবা কাটিয়ে দেখো তো। ওগুলো কী মাছ। আমাদের  গ্রাম্য মেদিনীপুরিয়া ভাষায় ছাবা কাটানো মানে জলে একবার জাল টেনে আনা।

পাম্পিং মেশিনে কাদাজল উঠতে শুরু করেছে। মেশিনচালক ছেলেটি মাঝে মাঝে মেশিনে জল তোলার গতি কমিয়ে দিচ্ছে, পাছে পাইপে হাওয়া ঢুকে যায়। রবি জলে নেমে জাল দিয়ে একটা ছাবা কাটাতেই দেখি তিনটে সেই মাছ। রবি মাছগুলো সমেত জালটা নিয়ে রাস্তার পাশে উঠে এল। আমি জাল থেকে চটপট মাছগুলো হাতে তুলে নিলাম। দেড় থেকে দুইঞ্চি লম্বা। একনজরে দেখে মনে হয়, কই মাছের বাচ্চা। কিন্তু এ তো কই নয়। ছোটবেলা এতো কই মাছ ছিপে, জালে বা হাতে ধরেছি যে কই মাছ চিনতে ভুল হবার কথা নয়। মাছগুলোর রঙ হালকা সবুজ। পিঠের আর পেটের পাখনা কই মাছের মতো, কিনারা নরম কাঁটাযুক্ত। দেহের  প্রতিপাশে আড়াআড়ি দশটি কালো ডোরা দাগ। সামনে থেকে পেছনের দিকে দাগগুলো ক্রমশঃ ছোট হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল কানকোর নিচে বক্ষ পাখনার সামনে থেকে দুপাশে দুটো সুতোর মতো শুঙ্গ ঠিক তোপসে মাছের মতো দেহের পেছনদিকে বিস্তৃত। আমি অনেক রকম মাছ দেখেছি ও খেয়েছি। কিন্তু এমন কোনও মাছ দেখেছি বা খেয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। সবাইকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই মাছটির নাম জানে কিনা। কেউই চিনতে পারল না। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী দুতিনজন পুরুষ ও মহিলা মাছধরা নামক আকর্ষণীয় ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের দেখালাম। একজন মহিলা দৃঢ়ভাবে বললেন,কই! বাকিরা চিনতে পারলেন না। আমিও নিশ্চিত কই নয়।

এঁদো ডোবায় কী মাছ থাকতে পারে যা আমার অজানা? ভেবে কুলকিনারা করতে পারছিলাম না। ইতিমধ্যে রবি আরও দুতিনবার ছাবা কাটিয়ে আরও পাঁচটা একই মাছ ধরেছে। মাছগুলো হাঁড়িতে রেখে তাতে একবোতল পরিষ্কার পানীয় জল ঢেলে দিলাম। জল পেয়ে মাছগুলো ছোটাছুটি শুরু করে দিল। তবে লক্ষ্য করলাম, মাছগুলোর গতি বেশ কম। লাফ দিয়ে হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ারও কোনও চেষ্টা নেইইতিমধ্যে জলসেচা শেষ। নাঃ শোল-ল্যাটা-কই তো দূর অস্ত, আর একটাও ওই অজানা মাছ নেই। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিবিধ আশা ও কর্মযজ্ঞের প্রাপ্তি আটটি অজানা মাছ। বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া!

আটটি মাছ নিয়ে ফিরে এলাম আমার বাসায়। আমার সহধর্মিণীকেও দেখালাম। লাভ হল না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয়। স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢুকেছি। মাথার মধ্যে চিন্তাটা ঘুরছিলই। আচ্ছা, আমাদের এই এলাকার কোনও বিলুপ্তপ্রায় মাছ নয় তো? হয় তো আমি চিনি না, কিন্তু একসময় ছিল। হয়তো সেই মাছ কোনও কোনও জায়গায় আমাদের অলক্ষ্যে আজও বেঁচে আছে। হয়তো ওই এঁদো ডোবাই সেই মাছের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। মাথায় এক মগ জল ঢেলেছি। হঠাৎই মনে হল, খলসে মাছ নয় তো? নাম শুনেছি বহুবার। পড়েওছি। পচা, নোংরা জলে থাকতে ভালোবাসে। মশার লার্ভা খেয়ে আমাদের দারুণ উপকার করে। কিন্তু চোখে কখনও দেখিনি। ঠাকুমার মুখে ছোটবেলায় শুনেছিলাম আমাদের এই সুন্দরবনের বসতি এলাকায় খাল-বিল, মাঠে-ডোবায় খলসে পাওয়া যেত। তবে বহুদিন আর তাদের দেখতে পাওয়া যায় না। আমার বাবা-জ্যাঠারাও দেখেননি। বহুদিন আগে কোনও এক পত্রিকায় দেখা খলসে মাছের অস্পষ্ট ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠল। সম্ভব। খলসে হতেই পারে। তড়িঘড়ি গা মুছে ঘরে ঢুকেই বসলাম কম্পিউটার-টেবিলে। সন্দেহ নিরসনের সহজলভ্য মাধ্যম ইন্টারনেট খুললাম। আঃ। আমার সন্দেহই সত্যি। খলসে!!!

জানলাম খলসের বিজ্ঞানসম্মত নাম Trichogaster fasciata. ইংরেজিতে এর নাম ব্যান্ডেড গৌরামি (Banded Gourami)দেহের দুপাশে কালো ডোরা দাগের জন্যই এমন নাম। পূর্বভারত ও মায়ানমার হল এই মাছেদের প্রধান এলাকা। অনেকরকমের খলসে দেখা যায়। সবই প্রায় একই দেখতে, পার্থক্য যেটুকু তা রঙে। মূলতঃ আগাছা পূর্ণ জলাশয় ওদের প্রধান পছন্দ। জলের ওপরের স্তরেই ওরা থাকতে পছন্দ করে। ওদের পৃষ্ঠ পাখনা আর পায়ু পাখনা অনেক প্রসারিত। পায়ু পাখনার প্রান্তে লালরঙা বর্ডার থাকে। তবে ওদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল দুটো লম্বা শুঙ্গযখন খলসে জলে ভাসে তখন শুঙ্গ দুটো নিচের দিকে ঝুলে থাকে। এরা নাকি খুব লাজুক, কিন্তু কষ্টসহিষ্ণু মাছ। জলাশয়ের তলদেশে নাকি স্ত্রী খলসে বাসা বানায়, আর সেখানে ডিম পাহারা দেয় পুরুষ খলসে। বাঃ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মাছেদের মধ্যেও! মা তেলাপিয়া-শোল-ল্যাটা মাছেরা বাচ্চাদের লালনপালন করে জানি। কিন্তু আসন্ন অপত্যদের জন্য পুরুষ মাছের এত ভালোবাসা ভাবাই যায় না। মনে মনে ভাবলাম, সত্যিই বিপুলা এ জীবজগতের কতটুকু জানি!

চাক্ষুষ খলসে দেখা এই প্রথম। প্রতিবেশীদের দেখালাম। কারোরই পরিচিত নয়। সুতরাং মাছটা যে আমাদের এলাকায় খুব বিরল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হাঁড়ির স্বচ্ছ জলে আটটা খলসে খেলছে। কী ভাবছে ওরা কে জানে! আমিও ভেবে পাচ্ছি না কী করব ওদের নিয়ে। ভাত খেতে খেতে একটা পরিকল্পনা করলাম। বাড়ির  তিনজন সদস্য তিনটে মাছ খেয়ে দেখব স্বাদ কেমন। তিনটে মাছ আবার তাদের পুরনো বাসস্থানে ছেড়ে দেব। ওদের বংশবৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। তবে আমার বিশ্বাস আমার হবু বাড়ির সংলগ্ন এঁদো ডোবা ছাড়াও আশপাশে আরও এমন যেসব এঁদো ডোবা আছে সেখানে আরও খলসে আছে। আর বাকি দুটো নিয়ে যাব আমার স্কুলে। স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বসার কক্ষে একটি অ্যাকোয়ারিয়াম আছেসেখানে রেখে দিয়ে ওদের আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করার খুব ইচ্ছে জাগল।

রাতে তিনটি খলসে আমাদের উদরস্থ হল। বলার মতো স্বাদ নয়, একেবারেই সাদামাটা। পরদিন সকালে একটা জারে তিনটে খলসে নিয়ে হাজির হলাম তাদের পুরনো বাসস্থানে। গিয়ে দেখি রাতের মধ্যে ঝরে আসা জলে সেই ডোবা প্রায় ভরে গেছে। সুবিধেই হল। তিনটে মাছ জারের জল সমেত ছুঁড়ে দিলাম। ঘোলা জলে ওরা মুহূর্তে হারিয়ে গেল। ঘরে ফিরে মনে হয় ওদের খুব আনন্দ হয়েছিল। কিন্তু ওরা ওদের পাঁচ বন্ধুকে চিরতরে হারিয়েছে আমার কারণেই। এজন্য ওরা আমাকে ক্ষমা নাও করতে পারে।

ইন্টারনেটে পড়ে জেনেছিলাম পুরুষ খলসেরা স্ত্রী খলসের তুলনায় একটু বড়ো হয়। সেই বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে একটা বড় ও দুটো ছোট খলসে ডোবায় ছেড়ে দিয়েছি, আর স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা বড় ও একটা ছোট খলসে রেখে দিয়েছি। একটু টেনশনে ছিলাম। স্কুল খুলতে কয়েকদিন বাকি। সেই সময় পর্যন্ত ওদের বাঁচিয়ে রাখতে পারব তো? যাইহোক, ঝুঁকি তো নিতেই হবে।

ওরা বেঁচে রইল। বুঝলাম যারা পচা-নোংরা জলে থাকে তারা সহজে মরার নয়। ঠিক আমাদের মতো। বস্তি এলাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যেমন দেখি ধুলো-কাদা মাখা বাচ্চাগুলো কেমন দিব্যি খেলে বেড়ায়, আর আমাদের বাড়ির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাচ্চাগুলো দুদিন ছাড়াই সর্দি-কাশি-জ্বরে ভোগে! স্কুল খুলতেই প্রথম দিন একটা জারে ওদের নিয়ে স্কুলে গেলাম। সহকর্মীদের দেখালাম। দুজন খলসে বলে চিনতে পারলেন যাঁরা আমাদের সুন্দরবন এলাকার বাসিন্দা নন। স্টাফরুমে খলসেদের নিয়ে বেশ একটা কৌতূহল শুরু হয়ে গেল। বেসিনের উপরে  অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ ধরার জন্য ছোট্ট জালে জারের জলসহ মাছ ঢেলে দিলাম। খলসে দুটো খুব একটা লাফাল না। মনে হয় কয়েকদিনের বন্দীদশায় অভুক্ত থাকায় ওদের শক্তি কমে গিয়েছিল। তবে রোগা হয়েছে কিনা তা আমার চর্মচক্ষে ধরা পড়ল না। যাই হোক, অ্যাকোয়ারিয়ামের ঢাকনা খুলে খলসে দুটোকে জলবন্দী অন্য মাছেদের মাঝে ফেলে দিলাম।

অ্যাকোয়ারিয়ামে ভিনদেশী মাছেদের ভিড়। তারা পুরনো বাসিন্দাও বটে। লাল, কালো, রুপোলি, সোনালি, ডোরাকাটা কত বাহারি রঙের রূপসী মাছ। তাদের কারও গমনভঙ্গী রৈখিক, কারও কৌণিক, আবার কারও বঙ্কিম। ওদের কেউ ঘোরে একা একা, উদ্দেশ্যহীনভাবে, হয়তো সঙ্গীর অভাবে, মনমরা হয়ে। আবার যে পেয়েছে সঙ্গী সে খুব চাঙ্গা। অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চেয়ে চেয়ে আমি ওদের বৈচিত্র্যময় আচার-আচরণ দেখতাম আর খুব মজা পেতাম। এবার ওই বিদেশীদের রাজত্বে অতিথি হল দুই স্বদেশীকী হবে এবার? বিদেশীরা কি ওদের মেনে নেবে? আক্রমণ করবে না তো? নাকি অবজ্ঞাভরে উপেক্ষা করবে? আর আমার স্বদেশীরা? নতুন পরিবেশে আদৌ মানিয়ে নিতে পারবে তো? অ্যাকোয়ারিয়ামে ওদের স্বাভাবিক খাবার পাবে কোথায়? ওরা তো শ্যাওলা আর জলজ পোকামাকড় খায়। কৃত্রিম খাবার ওদের মুখে রুচবে তো? বেশ রোমাঞ্চকর অবস্থা।

অ্যাকোয়ারিয়ামে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে ক্ষণিকের জন্য বিদেশীরা একটু থমকে গেল। থমকে গেল স্বদেশীরাও। বড় স্বদেশীটি মৃদু গতিতে সরে গেল বাঁদিকের কাচের দেওয়ালে লাগানো জলে বাতাস মেশানো যন্ত্রের কাছে। তারপর সে প্রায় স্থির হয়ে গেল। ছোট স্বদেশীটি একটু দূরেই ছিল। সে লেজের ধীর সঞ্চালনে মিনিট খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেল বড়টির কাছে। তারপর দুজনে কাছাকাছি, পাশাপাশি। ওদের মনের ভাষা পড়ার ক্ষমতা আমার নেই। হয়তো ওরা বলছিল, এ কোথায় এলাম রে বাবা!

ওদিকে বিদেশীরাও ঘাবড়ে গেল। মনে হয় ওরাও ভাবছে, এ কোথাকার নেটিভ রে? বিদেশীদের দুএকটা ছোকরা একটু বেশি উৎসাহী হয়ে স্বদেশীদের কাছে এগিয়ে গিয়ে মনে হয় বোঝার চেষ্টা করল, আগন্তুকের পরিচয়। জিজ্ঞাসা করল কিনা কে জানে? জিজ্ঞাসা করলেও কি আর উত্তর দিতে পারবে? মাছেদের রাজ্যে বিদেশীদের ভাষা আর স্বদেশীদের ভাষা আলাদা না এক, আমার জানা নেই! ওদের এগোতে দেখে দুই স্বদেশী আরও জড়সড় হয়ে কাচের গায়ে সেঁটে যেতে লাগল। পাঁচ-সাত মিনিট পর দেখি বিদেশীর দল একটু একটু করে তাদের স্বাভাবিক কাজে লেগে পড়েছে। তবে তারা কিন্তু স্বদেশীদের খুব কাছে ঘেঁছে না। দেখে মনে হল, অ্যাকোয়ারিয়ামে স্বদেশী দুজনের জন্য ওরা একটা ছোট এলাকা বরাদ্দ করেই দিয়েছে। আরও ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হল। স্বদেশী যুগলের তখনও ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা!

আমি সিদ্ধান্তে এলাম, অ্যাকোয়ারিয়াম নামক মাছেদের ছোট্ট সাম্রাজ্যে বিদেশীরা আর যাই হোক পরাধীন ভারতের অত্যাচারী ইংরেজদের মতো নয়। স্কুলের টিফিন আওয়ার অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছেদের জন্য লাঞ্চ-টাইম। এই সময় মাছেদের কৃত্রিম খাবার দেওয়া হয়। প্যাকেটে থাকে সেই দানাজাতীয় খাবার। জলে ফেলে দিলে তা জলে ভাসে। আর বিদেশীর দল মহানন্দে খপাৎ খপাৎ করে সেই খাবার ধরে আর গিলে নেয়। প্রতিদিনই রীতিমতো লম্ফ-ঝম্প করে খাবার খেতে দেখি ওদের। আমার কৌতূহল, দেশী-যুগল ওই খাবার খায় কিনা দেখার। জানি ওরা বেশ কয়েকদিন অভুক্ত আছে। তবুও খিদের জ্বালায় যা পাই তাই খাই - এমনটা বোধহয় মাছেরা করে না।

খাবার দেওয়া হতেই যথারীতি বিদেশী মাছেদের লম্ফ-ঝম্প শুরু হল। স্বদেশীরা কিন্তু নট নড়ন-চড়ন। মনে হয় কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলগাঁয়ের হাবু-গোপলাদের সোজা এনে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় খাবার টেবিলে বসিয়ে দিলে যা হয় তা-ই হয়েছে আমার খলসে দুটোর। মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা, আগে জানুক-বুঝুক ওরা। সাত দিন না খেয়ে থাকতে পারলে দশ দিনও পারবে। তারপরও যদি দেখি মানিয়ে নিতে পারেনি, তখন না হয় আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাব তাদের পুরনো জায়গায়। রুটিনমাফিক ছুটির সময়ও মাছেদের আর একবার খাবার দেওয়া হল। তখনও খলসে দুটো জড়সড় হয়ে একই জায়গায় প্রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। আমরা সবাই বাড়ি চলে গেলাম।

বাড়ি ফিরে মাছগুলোর জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। পরদিন স্কুলে পৌঁছে আগে গিয়ে দাঁড়ালাম অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে। আরেব্বাস! এ তো দেখি অবাক কাণ্ড! আমার খলসেরা বিদেশীদের মাঝে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে! বিদেশীরাও তাদের কিচ্ছু বলছে না! একরাতেই হাবু-গোপলাদের সাথে মাইকেল-পিটারদের এতো বন্ধুত্ব আশাই করা যায় না। কোথায় এঁদো ডোবা, আর কোথায় অ্যাকোয়ারিয়াম। কোথায় পচা জল, আর কোথায় অক্সিজেন মেশানো জল। কোথায় কেনা খাবার, আর কোথায় শ্যাওলা-পোকামাকড়! এত বৈপরীত্যের মধ্যেও যে একসাথে মিলেমিশে থাকা যায় তা আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মাছগুলো। ভেদাভেদ ভুলে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান মাছেরাও পারে, মানুষ পারে না।  

ওদের সহাবস্থান নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা ছিল না, দুশ্চিন্তা ছিল খাবার নিয়ে। দুপুর দেড়টায় আবার খাবার দেওয়া হল। বিদেশীদের যথারীতি লম্ফ-ঝম্প! কিন্তু এবারও আমার অবাক হওয়ার পালা! প্রথমে বড় খলসেটা ধীর গতিতে ভেসে উঠল জলের উপরে। তারপর ভেসে থাকা একটা খাবারের দানা মুখ দিয়ে ধরে জলের মাঝামাঝি এনে ছেড়ে দিল। যাঃ! তাহলে কী খাবার পছন্দ হল না? দানাটা ফের ভেসে উঠল। মাছটা আবার ভেসে উঠল। আবার একটা দানা মুখে ধরে নীচে নেমে এল। এবার কিন্তু দানাটাকে উদরে চালান করল। মনে হয় ভালোই লেগেছে। ফের সে ভেসে উঠে আর একটা দানা ধরে এনে গিলে নিল। এই ঘটনা দেখে ছোট খলসেটাও ভেসে উঠে একটা দানা মুখে নিয়ে নেমে এল কিন্তু তারও মুখ ফসকে দানাটা বেরিয়ে গেল। একটু অপেক্ষা। আবার সে চেষ্টা করল। আবার ব্যর্থ। এবার একটু বেশিক্ষণ সে এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল। ভাবলাম, হাল ছেড়ে দিল নাকি? নাকি খাবার ভালো লাগেনি? আমার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই আবার সে ভেসে উঠল একটা দানা ধরতে। ততক্ষণে বিদেশীদের রাক্ষুসেপনায় খাবারের পরিমাণ কমে এসেছে। কথায় বলে বারবার তিনবারএবার খাবারের দানাটা ধরে গিলে নিল। বড্ড মন্থর ওরা। অলস নাকি স্বভাব, কে জানে? ওদের ওই একটা-দুটো দানা খেতে খেতে বিদেশীরা সব দানাই সাবাড় করে দিল। তা দিক, বিদেশী খাদ্যে ও খাওয়ার কৌশলে গেঁয়োদের অভ্যস্ত হতে সময় লাগবেই। তবে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই ওদের আচরণে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম তাতে আমি দারুণ আশাবাদী হয়ে উঠলাম।

তৃতীয় দিনেই যে আমার স্বদেশী খলসেরা অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিবেশে এতটা অভ্যস্ত হয়ে উঠবে আমার কল্পনাতেও আসেনি। দেখি, বেশ চটপটে হয়ে উঠেছে। ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরো অ্যাকোয়ারিয়াম জুড়ে। খাবার দেওয়ার সাথে সাথে ওরাও বিদেশীদের মতো খাবার খেতে ভেসে উঠছে। খাবারের দানা মুখে ধরে নেমেও আসছে। তবে প্রতিবার ওরা দানাটাকে গিলতে পারছে না। মাঝে মাঝেই মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল ওদের মুখের গঠন ওইভাবে দানা ধরে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। আমি মনে মনে বললাম, হাল ছেড়ো না বন্ধু। তাছাড়া গতি মন্থরতার জন্যও বিদেশীদের সাথে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠছে না। সেজন্য অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা তরুণ সহকর্মী কৃষ্ণগোপালকে বললাম একটু বেশি করে খাবার বরাদ্দ করতে যাতে বিদেশীদের খাওয়া শেষ হলেও কিছু খাবার বাড়তি থাকে স্বদেশীদের জন্য। মনে মনে বললাম, তোদের গতি নাইবা হল বিদেশীদের মতো। আমাদের বেলায় আমরা যখন গোরুর গাড়িতে চড়ছি, তখন তো পশ্চিমি দেশের লোকেরা ট্রেনে চেপেছে। তাতে কী! ধৈর্য ধর। Slow but steady wins the race!

আর একটা ভারি মজার ঘটনা লক্ষ করলাম। খলসে দুটো কখনোই পরস্পর থেকে দূরে যাচ্ছে না। ডাইনে, বামে, ওপরে, নিচে- যেদিকেই যাচ্ছে তো দুজনেই যাচ্ছে। বিদেশ-বিভূঁইয়ে সঙ্গীছাড়া হলে বিপদ, ওরাও জানে! আমি বললাম, মানিকজোড়। রসিক সহকর্মী কালীপদবাবু শুনে বললেন, লায়লা-মজনু। সবাই হেসে উঠল। আমি বললাম, বাঃ, বেশ বলেছেন তো! আজ থেকে এটাই হোক ওদের নাম। আমার অনুমান ছিল, বড়োটি পুরুষ ও ছোটোটি স্ত্রী খলসে। সুতরাং এই নামকরণ মোটেই বেমানান হবে না!

দেখতে দেখতে কেটে গেল সাড়ে চার মাস। আমাদের লায়লা-মজনুও দিব্যি মানানসই হয়ে উঠেছে অ্যাকোয়ারিয়ামে। ভাগ্যিস, মাছেদের জগতে জাতিভেদ বর্ণভেদ প্রথা নেই! মার্চের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎই আমার কন্যা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওর চিকিৎসার জন্য ছুটি নিয়ে গেলাম চেন্নাই। কন্যার সুস্থতার চিন্তায় আমার লায়লা-মজনুর কথা মনেই ছিল না। মার্চের শেষে চেন্নাই থেকে ফিরে গেলাম স্কুলে। গিয়েই তাকালাম অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে। এ কী? অ্যাকোয়ারিয়াম জলশূন্য! জানলাম, কয়েকদিন আগে নাকি হঠাৎই সবকটা রঙিন মাছ একসাথে মারা যায়। কোনও বিষক্রিয়া? নাকি জলে অক্সিজেনের অভাব? কারণটা কেউ বুঝতে পারেনি। আমার পক্ষেও অনুমান করা মুশকিল। বেঁচে ছিল শুধু লায়লা-মজনু। পরদিন নাকি স্কুলে এসে আমার সহকর্মীরা দেখে একই সঙ্গে দেহত্যাগ করেছে লায়লা-মজনু। বন্ধু হারানোর শোক? কে জানে! তবে ওদের লায়লা-মজনু নামকরণ সার্থক। ওরা এসেছিল একসাথে, চলেও গেছে একসাথে। শুধু রেখে গেছে আমার হৃদয়ে তুচ্ছ কিছু স্মৃতি।
_________

5 comments:

  1. বাহ কি সুন্দর করে লেখা! খুব ভাল লাগলো -
    এইসব 'তুচ্ছ' স্মৃতিই তো জীবনকে মুল্যবান করে। যেমন ধানের ক্ষেতের সিঁথির মতো আল - ডিশ দিয়ে জল সেঁচে মাছ ধরা --
    আপনার লেখা খুব জীবন্ত তাই সামান্য ব্যাপারগুলোও খুব চট করে একাত্ম করে নেয়! অনেক ধন্যবাদ এই সুন্দর লেখাটার জন

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। আপনার মতো পাঠকদের থেকে মতামত জানতে পারলে নিজেকে আরও পরিশীলিত ও অনুপ্রাণিত করতে পারব। ভালো থাকবেন।

      Delete
  2. Replies
    1. ধন্যবাদ। অনুপ্রাণিত হলাম। ভালো থাকবেন।

      Delete